অ্যাডভোকেট আনসার খান :উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দেশ সুদানে আবারও সেনাশাসন জারী হয়েছে গত২৫-অক্টোবরে।১৯৫৬-সালে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পরবর্তী সময়কালে সুদান বেশিরভাগ সময় সেনাশাসনে শাসিত হয়ে আসছে।২৫-অক্টোবরের সেনা অভ্যুথানের পূর্বে আরও পাঁচটা ক্যু সংঘটিত হয়েছিলো দেশটাতে।

বর্তমান সেনাশাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করেছেন দেশের গণতন্ত্রীপন্হী জনগণ।দূর্ভাগ্য যে-সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের সাথে থাকা মানুষের ওপর নির্বিচারে গোলাবর্ষণ করে মানুষ হত্যা করে চলেছে সামরিক জান্তা সরকার।আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকেও সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে নিন্দা জানানো হয়েছে।যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা কার্যক্রম স্থগিত করেছে।

ভূ-কৌশলগত কারণে আফ্রিকা মহাদেশ,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,রাশিয়া,চীনসহ বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো সুদান।সুদানের চারপাশের দেশ-অর্থ্যাৎ মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র,চাদ,মিসর,ইরিত্রিয়া,ইথিওপিয়া,লিবিয়া,

দক্ষিণ সুদান-এ-সাতটা দেশের সাথে সীমান্ত রয়েছে সুদান প্রজাতন্ত্রের এবং এ-কারণেও সুদানের আলাদা একটা গুরুত্ব রয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

১৯৫৬-সালের ১-জানুয়ারী ব্রিটেন ও মিসরের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলো সুদান।শাসন ব্যবস্হা হিসেবে গণতন্ত্রকে বেছে নিয়েছিলেন সুদানের জনগন।তবে সুদানের রাজনীতি ভীষণ জটিল,ওখানকার জনগণ বহু গোষ্ঠী ও নৃতাত্ত্বিক গোত্রে বিভক্ত।সুদানে কট্ররপন্হী ইসলামী উপাদান,অনানুষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক সশস্ত্র বাহিনী,রাজনৈতিক দল এবং গোষ্ঠী ও সশস্ত্র মিলিশিয়াদের আধিক্যে বিভক্ত রয়েছে এবং এদের প্রত্যেকেই সুদানের জনগনের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে বলে দাবি করে থাকে।বহুমুখী স্বার্থে বিভক্ত জনগোষ্ঠীর দেশকে গণতান্ত্রিক শাসনের ছায়াতলে একত্রিত করা দুঃসাধ্য হওয়া সত্বেও সুদানে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় ছিলেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব।সামরিক বাহিনীর কারণে সে চেষ্টা সফল হয়নি। সুদানী জনগণের জন্য দূর্ভাগ্য যে স্বাধীনতা অর্জনের পরে তারা গনতান্ত্রিক শাসনের স্বাদ দুই-আড়াই বছরের বেশি ভোগ করতে পারেনি সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত এবং দেশীয় সামরিক বাহিনীর উচ্চাভিলাষের কারণে।সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা জোর করে দখলে নিয়ে জারী করেছিলো জান্তা শাসন।

১৯৫৮-সালের ১৭-নভেম্বর সুদানের বৈধ গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে দেশের সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিয়ে সামরিক শাসন নামের জান্তা-শাসন চাপিয়ে দিয়েছিলো জনগণের ওপর।সামরিক বাহিনীর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সেই যে শুরু তারপর থেকে ১৯৫৯,১৯৬৯,১৯৮৫,১৯৮৯,২০১৯,২০২১ অর্থাৎ এ-পর্যন্ত ছয়-ছয়বার সামরিক ক্যু-দেতার মাধ্যমে বৈধ সরকারকে উৎখাত করেছে সামরিক বাহিনী।সামরিক বাহিনীর ক্ষমতার লোভ,অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে গোষ্ঠীগত ও নৃতাত্ত্বিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দ্বন্ধে সুদানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসেনি কখনো।স্বাধীনতার আন্দোলন ও সশস্ত্র যুদ্ধ করে সুদানের একটা অঞ্চল- “দক্ষিণ সুদান”- নামে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে সুদান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ৯-জুলাই ২০১১-সালে।

১৯৫৬-সালে দেশটা স্বাধীন হলেও একটা স্বাধীন রাষ্ট্র বিনির্মানের জন্য সুদানী জনগণ প্রকৃতঅর্থে কোনো সূযোগই পায়নি ক্ষমতালোভী সামরিক আমলাদের কারণে।স্থিতিশীল কার্যকর একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে মূল বাধা ছিলো ওই সামরিক বাহিনী।তাদের স্বার্থে আঘাত আসতে পারে এমন আশংকায় জান্তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিয়ে স্বাভাবিক রাজনৈতিক গতিপথ স্তব্ধ করে দিয়েছে বার-বার।একটা বেসামরিক রাজনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠতে দেয়নি জান্তারা।

সুদানের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের সামরিক শাসক ছিলেন জেনারেল ওমর আল বশির।১৯৮৯-সালে বশির ক্ষমতা দখল করেছিলেন এবং ২০১৯-সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ত্রিশ বছর স্বৈরাচারী শাসন বহাল রেখেছিলেন তিনি।তাঁর তিন দশকের নৃশংস শাসনের বিরুদ্ধে দূর্নীতি,সহিংসতা,সন্ত্রাসীগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ার এবং বিলিয়ন ডলার অর্থ চুরির অভিযোগ তোলে তাঁর স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে সুদানে এবং ওই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে বশির ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন-সামরিক বাহিনী বশিরকে ক্ষমতা থেকে সরাতে রাজী হয়েছিলো-কিন্তু সামরিক বাহিনী ক্ষমতা ছেড়ে যায়নি।বরং গণতন্ত্রীপন্হী আন্দোলনকারীদের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে রাজী হয়েছিলো সামরিক বাহিনী।

ফলে সামরিক ও বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ক্ষমতা ভাগাভাগির জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলো।চুক্তির একপক্ষে রাজনৈতিক নেতৃত্বের নেতা আবদাল্লাহ হামডোক এবং সামরিক বাহিনীর পক্ষে জেনারেল মোহাম্মদ হামাদান দাগালো ১৭.৭.২০১৯-তারিখে ক্ষমতা ভাগাভাগির ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন।এভাবেই বশির শাসনের অবসান ঘটে এবং সামরিক বাহিনী ক্ষমতার তত্ত্বাবধান নিয়ন্ত্রণ করে-“ট্রানজিশনাল মিলিটারি কাউন্সিল গঠন করে।চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কাউন্সিল পরবর্তী তিন বছর দেশ শাসন করবে এবং ২০২৩-সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট দেশ শাসনের দায়িত্ব হস্তান্তর করা হবে মর্মে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চুক্তির শর্ত মোতাবেক গঠিত কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল বুরহান এবং জেনারেল বুরহান তখন অঙ্গীকার করেছিলেন যে -দেশের নেতৃত্ব একটি বেসামরিক নির্বাচিত সরকারের হাতে হস্তান্তর না করা পর্যন্ত সশস্ত্রবাহিনী গণতান্ত্রিক উত্তরণের কাজ চালিয়ে যাবে।ওই কাউন্সিলের প্রধানমন্ত্রীর পদ অভিষিক্ত করেন আবদাল্লাহ হামডোক। পাঁচজন সামরিক ও পাঁচজন বেসামরিক রাজনৈতিক প্রতিনিধি নিয়ে কাউন্সিল গঠন করা হবে মর্মে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং আরও সিদ্ধান্ত হয় যে কাউন্সিলের পছন্দ অনুযায়ী অতিরিক্ত আরও এগারোজন সদস্য কাউন্সিলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

চুক্তি অনুযায়ী প্রথম একুশ মাস দেশ শাসনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে সামরিক বাহিনী এবং তাদের মেয়াদ শেষে শাসনের নেতৃত্ব যায় বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে।বেসামরিক নেতৃত্ব ক্ষমতা পাওয়ার পরেই বেসামরিক প্রধানমন্ত্রী আবদাল্লাহ হামডোকের সাথে সেনাপ্রধান তথা সামরিক জান্তার মধ্যে নীতিগত প্রশ্নে বিরোধ দেখা দেয়।সামরিক জান্তা তাদের মেয়াদকালে পূর্বের সকল প্রতিশ্রুতি এবং অঙ্গীকার উপেক্ষা করে  শাসনের ওপর সামরিক জান্তার একচেটিয়াত্ব কায়েমের প্রচেষ্টা চালিয়ে ২০১৯-সালের গণতান্ত্রিক পথের রূপান্তর ব্যর্থ করে দেবার জন্য কয়েক দফা চেষ্টা করে।কিন্তু বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরোধিতার কারণে সামরিক নেতৃত্বের অভিলাষ পূরণ হয়নি।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী হামডোক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ১৭-নভেম্বরের মধ্যে মূল ক্রান্তিকালীন চুক্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বেসামরিক শাসনে পরিপূর্ণ রূপান্তরের জন্য সামরিক নেতৃত্বের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।এর থেকে বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে দেখা দেয়।সামরিক নেতৃত্ব উপলব্ধি করে যে বেসামরিক নেতৃত্বের কারণে তাদের ক্ষমতার অভিলাষ ও আকাঙ্খা বাস্তবায়ন সম্ভব নয় এবং আকাঙ্খার বাস্তবায়ন অসম্ভব-ওই উপলব্ধির পরিণতি হলো বেসামরিক সরকারকে বন্দুকের জোরে ক্ষমতাচ্যুত করে ২৫-অক্টোবরে আবারও সেনা শাসন প্রবর্তন।ক্ষমতা দখল করে জেনারেল বুরহান সার্বভৌম কাউন্সিল ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভেঙে দিয়ে সামরিক শাসন জারী করেন।সামরিক শাসন জারীর পক্ষে সাফাই দিতে গিয়ে জেনারেল বুরহান বলেন-দেশটার ক্রান্তিকালীন সার্বভৌম কাউন্সিলের বেসামরিক সদস্যদের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি চুক্তি গত দু’বছরে-“একটা সংঘাতে পরিণত হয়েছে”-যা সুদানে শান্তি ও ঐক্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।

তবে নিরপেক্ষ বিশ্লেষকদের অভিমত-সুদানে সামরিক কর্তৃপক্ষের লোভ-লালসা বেসামরিক গণতান্ত্রিক শাসনের পথ রুদ্ধ করে রেখেছে দশকের পর দশকধরে।২০২১-সালেও লোভেরই জয় হয়েছে।পরিপূর্ণ বেসামরিক গণতান্ত্রিক শাসনে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ভোগবাদীতার সূযোগ- সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে এবং তাদের সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত অতীতের ব্যাপক দূর্নীতি-লুটপাট ও জনগণের ওপর  নিষ্ঠুর নির্যাতনের জন্য জবাবদিহি করাসহ বিচারের ও শাস্তির আওতায় আসার আশংকা  আছে মনে করে জেনারেলরা ভীষণ উদ্ধিগ্ন হয়ে পড়ে।উল্লেখ্য যে-‘সেন্ট্রি’ নামক ওয়াশিংটনভিত্তিক থিন্কট্যান্ক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে-সুদানের সামরিক বাহিনীর পরিচালিত বানিজ্যিক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে দূর্নীতিগ্রস্হ।এরজন্যও বেসামরিক শাসনে জেনারেলদের-বিশেষকরে-সুদান সশস্ত্র বাহিনীর(এসএএফ)প্রধান জেনারেল বুরহান এবং রেপিড সাপোর্ট ফোর্স(আরএসএফ)এর প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হামদান হেমেদতি দ্যাগোলের  জবাবদিহি করতে হবে সেটা নিশ্চিত।আর এ-সব অভিযোগ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্যই উভয় জেনারেলের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মূলত আবারও সেনাশাসন জারী করে বেসামরিক সরকার উৎখাত করেছে জেনারেলরা-এমনটাই মনে করেন বিশ্লেষকরা।

২০১৯-সালে ত্রিশ বছরের স্বৈরশাসক ওমর আল-বশিরকে তীব্র গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিদায় করে দিয়ে সুদানী জনগণ দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসন বিনির্মানের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন অক্টোবরের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বেসামরিক নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মানের স্বপ্ন আবারও হোটচ খেয়েছে-গণতন্ত্র বিনির্মানের পথ বন্ধ হয়ে গেছে।তবে গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মানের অগ্রসৈনিক সুদানের বীর জনগণ সশস্ত্র বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আবারও সেনাশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনে রাজপথে নেমে এসেছেন-এটাই গণতন্ত্রেরের জন্য ভরসার জায়গা।

লেখক:আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading