ড. বুদ্ধদেব বন্দ্যোপাধ্যায় ‘প্রমীলা- নজরুল’ গ্রন্থে লিখেছেন- “আমরা যদি পৃথিবী ব্যাপী কবি সাহিত্যিকদের জীবনীপঞ্জি খুঁজে দেখি, সংগত ভাবেই দেখতে পাবো, পারস্পারিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মেলবন্ধনে সৃজনীশক্তির অসামান্য বিকাশ ঘটেছে দেশে, দেশান্তরে। যে প্রতিভাটি বিকশিত হল তার আড়ালে নিয়ামক শক্তি হিসাবে রয়ে গেল আরো একটি প্রতিভা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আড়ালের এই শক্তিটি লোকচক্ষুর অগোচরে থেকে যায়। মানুষ তার খোঁজ পায় না কখনো। বহুক্ষেত্রে খোঁজ রাখতেও চায় না। ফলে সংশ্লিষ্ট ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
বিদ্রোহী কবি জনমানসের কবি, ভারতীয় ভাবধারার অন্যতম প্রধান কবি-সারথী কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্য পর্যালোচনা করলে আমরা উপরোক্ত সত্য-বীক্ষণে স্থিত হতে পারি। তাঁর ঝঞ্ঝাবহুল ও তীব্র গতিময় জীবনে বড়ো একটি অংশে দক্ষ কাণ্ডারীর মত হাল ধরেছিলেন তাঁর সহধর্মিনী প্রমীলা নজরুল ইসলাম।” – ৩০শে জুন, প্রমীলা দেবীর প্রয়াণ দিবস উপলক্ষ্যে আরও একবার ফিরে দেখা সাহিত্যপ্রেমী প্রমীলা দেবীকে।
তৎকালীন ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমার তেওতা গ্রামে ১৩১৬ বঙ্গাব্দের ১৭ই বৈশাখ প্রমীলা দেবী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাল্য নাম ছিল আশালতা সেনগুপ্ত। ডাক নাম ‘দোলন’ বা ‘দোলনা’। গুরুজনেরা ভালোবেসে ‘দুলি’ নামে ডাকতেন। পিতার নাম বসন্তকুমার সেনগুপ্ত। মাতা গিরিবালা দেবী। চাকরি সূত্রে তাঁর পিতা স্ব-পরিবারে ত্রিপুরায় থাকতেন। প্রমীলা ছিলেন ভারী সুন্দরী। চাঁপার কলির মত ছিল গায়ের রং। মধুর স্বভাবের জন্য তিনি ছিলেন সকলের আদরের। প্রমীলাকে নিয়েই তাঁর বাবা-মার সংসার পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এই সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। হঠাৎ-ই অকালে প্রয়াত হলেন বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত। ছোট্ট দুলিকে নিয়ে গিরিবালা দেবীর জীবন সংগ্রাম শুরু হল। তিনি ছিলেন সংগ্রামী নারী। স্বামীর অকাল প্রয়াণে তিনি শোকাতুর হলেও কর্তব্যচ্যুত হননি। তাঁর দেবর ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত কুমিল্লার কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ইন্সপেক্টর ছিলেন। গোমতী নদীর তীরে কান্দির পাড়ে তাঁর বাড়ি ছিল। শিশুকন্যাকে নিয়ে এখানেই এলেন গিরিবালা দেবী। শুরু হল জীবনের নতুন অধ্যায়। এই পরিবারের সকলেই বিশ্বাস করতেন দেশকে পরাধীনতার হাত থেকে উদ্ধার করার কাজে সকলকে ব্রতী হতে হবে। এছাড়াও এই পরিবারে রবীন্দ্র সঙ্গীত এবং কাব্য সাহিত্যের ধারাবাহিক চর্চা ছিল। ইন্দ্রকুমারের স্ত্রী বিরজাসুন্দরী দেবী ছিলেন বিদুষী। তিনি কবিতা লিখতেন। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন। ১৩ই মাঘ, শনিবার, ১৩২৯ সালে ধূমকেতু পত্রিকায় বিরজাসুন্দরী দেবীর লেখা মায়ের আশীষ -২ (শ্রীমান কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি) নামাঙ্কিত কবিতাটি প্রকাশিত হয়।
ওরে লক্ষ্মীছাড়া ছেলে-
আমার এ বেদন ভরা বুকের মাঝে
জাগিয়ে দিলি নূতন ব্যথা
‘মা’ ‘মা’ ব’লে কাছে এসে
আবার কবে কইবি কথা? (অংশ বিশেষ)
কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘সর্বহারা’ কাব্যগ্রন্থটি বিরজাসুন্দরী দেবীকে উৎসর্গ করেছেন একটি কবিতার মাধ্যমে-
মা (বিরজাসুন্দরী দেবী)র
শ্রীচরণারবিন্দে
সর্বসহা সর্বহারা জননী আমার!
তুমি কোনোদিন কারো করনি বিচার,
কারেও দাওনি দোষ। ব্যথা-বারিধির
কূলে বসে কাঁদো মৌনা কন্যা ধরণীর
একাকিনী! যেন কোন্ পথ-ভুলে আশা
ভিন্ গাঁর ভীরু মেয়ে! কেবলি জিজ্ঞাসা
করিতেছ আপনারে, ‘এ আমি কোথায়?’- (অংশবিশেষ)
বর্তমান বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলামের ‘কুমিল্লা ও দৌলতপুরে নজরুল’ শীর্ষক রচনা থেকে জানা যায়, কাজী নজরুল ইসলাম বীরজাসুন্দরী দেবীকে ধূমকেতুর স্বত্ব লিখে দেন- “আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই ‘ধূমকেতু’-তেই ২৬শে সেপ্টেম্বর, ১৯২২ তারিখে প্রকাশিত হয় নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি। এই কবিতার কারণেই ৮ই নভেম্বর, ১৯২২ তারিখে পুলিশ ‘ধূমকেতু’ অফিসে হানা দেয় নজরুলকে গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে। নজরুলকে পুলিশ গ্রেফতার করার পূর্বেই তিনি বিহারে সমস্তিপুরে চলে যান, গিরিবালা দেবী তখন তার মেয়ে প্রমীলাকে নিয়ে বিহারের সমস্তিপুরে ভাইদের কাছে ছিলেন। নজরুল তাঁদের নিয়ে কুমিল্লা যান, সমস্তিপুর থেকে কুমিল্লা যাবার পথে নজরুল বেলুড়ে এক বন্ধুর বাড়িতে দুদিন ছিলেন। সেখানে তিনি আর্য পাবলিশিং হাউসের শ্রী শরচ্চন্দ্র গুহের কাছে কিছু টাকা পান এবং কুমিল্লা চলে যান। কুমিল্লায় তিনি এ সময় বিরজাসুন্দরী দেবীকে ‘ধূমকেতু’র স্বত্ব লিখে দেন। নজরুলকে কুমিল্লায় ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২০শে নভেম্বর তারিখে গ্রেফতার এবং কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। তাঁকে ফৌজদারী দণ্ডবিধি আইনের (ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের) ১২৪-ক ধারা অনুসারে রাজদ্রোহের অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
জেল আইনের ৪২ ধারা অনুসারে নজরুলের বিরুদ্ধে যে মামলা বহরমপুর মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে দায়ের করা হয়, তাতে নজরুল বাদী পক্ষের জবানবন্দীতেই নির্দোষ প্রতিপন্ন হয়ে বেকসুর খালাস পান বলে ১৩৩০ বঙ্গাব্দের ৩রা ফাল্গুনের সাপ্তাহিক ‘ছোলতান’ পত্রিকায় উক্ত সংবাদ দেওয়া হয়। নজরুলের মুক্তিলাভ সম্পর্কে সাপ্তাহিক ‘ছোলতান’ পত্রিকায় পরিবেশিত তথ্য:
কাজি নজরুল ইসলামের মুক্তি
গত ১৫ই ডিসেম্বর বহরমপুর জেল হইতে কাজি নজরুল ইসলাম মুক্তিলাভ করিয়াছেন; কিন্তু তাঁহার বিরুদ্ধে আর একটি নূতন মোকদ্দমা দায়ের আছে, আগামী ৯ই জানুয়ারি এই মোকদ্দমার শুনানীর দিন নির্দিষ্ট আছে।
নজরুল ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২০শে নভেম্বর তারিখে কুমিল্লায় গ্রেফতার হন আর বহরমপুরে মুক্তিলাভ করেন ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই ডিসেম্বর। নজরুল মোট এক বৎসর তিন সপ্তাহ কারাবাস করেন।”
মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ – এর ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’ থেকেও বিরজাসুন্দরী দেবীর সাহিত্যপ্রীতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়-
“নজরুলের দৌলৎপুর হতে ফিরে আসার পরে এবং আমার কুমিল্লা পৌঁছানোর (৬ই জুলাই, ১৯২১) আগে সে আরও অনেকগুলি কবিতা লিখেছিল। তার মধ্যে দুটি কবিতার কথা আমি এখানে বলব। এই কবিতা দু’টির সমস্ত কথা শ্রীযুক্তা বিরজাসুন্দরী দেবীর, নজরুল শুধু সেই কথাগুলি ছন্দে গেঁথেছে। তার একটি কবিতার নাম ‘অভিমানিনী’। শ্রীযুক্তা বিরজাসুন্দরীর একটি মেয়ে ছিল খুব অভিমানিনী। অসুখে সে মারা যায়। মরবার কিছুক্ষণ আগেও সে অভিমান করে কথা বন্ধ করেছিল। সেই অবস্থাতেই তার মৃত্যু ঘটে।
অভিমানিনী
ওরে অভিমানিনী!
এমন করে বিদায় নিবি ভুলেও জানিনি।
পথ ভুলে তুই আমার ঘরে দুদিন এসেছিলি,
সকল-সহা! সকল সয়ে কেবল হেসেছিলি!
হেলায় বিদায় দিনু যারে
ভেবেছিনু ভুলবো তারে হায়!
আহা ভোলা কি তা যায়?
ওরে হারা-মণি! এখন কাঁদি দিবস-যামিনী
(পূবের হাওয়া)
স্নেহাতুর
[নজরুলকে নিয়েই বিরজাসুন্দরী দেবীর কথাগুলি। সে যে তাঁকে মা ডেকেছিল সে কথা আগেই আমি বলেছি।]
এমন করে অঙ্গনে মোর ডাক দিলি কে স্নেহের কাঙালী
কেরে ও তুই কেরে, আহা ব্যথার সুরেরে, এমন
চেনা স্বরেরে,-
আমার ভাঙা ঘরের শূন্য তারি বুকের পরেরে,-
কোন পাগল স্নেহ-সুরধুনীর আগল ভাঙালি! !
(পূবের হাওয়া)
নজরুল দৌলৎপুর গ্রাম হতে কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে শ্রী ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় পৌঁছেছিল ৪ঠা আষাঢ় (১৩২৮ বঙ্গাব্দ) সকাল বেলা। খ্রীস্টীয় মাসের হিসাবে সেটা ছিল সম্ভবতঃ ১৮ই জুন (১৯২১), আমি কুমিল্লা পৌঁছেছিলাম ৬ই জুলাই (১৯২১) সকাল বেলা। সেদিন সে কোনো কবিতা লেখেনি। মধ্যখানে সতের দিন সময় মাত্র সে পেয়েছিল। এ সতের দিনে সে এত বেশী সংখ্যায় গান ও কবিতা লিখেছিল যে ভাবলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। আমি শুধু অল্প ক’টির কথাই এখানেই উল্লেখ করেছি। ‘পূবের হাওয়া’য় ও আরও কোনো কোনো পুস্তকে মুদ্রিত অনেক গান ও কবিতা নজরুল সে সময়ে কুমিল্লাতেই রচনা করেছিল। তা-ছাড়া সে মিটিং – এ ও মিছিলেও যোগ দিয়েছে।”
ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের কথাও এই প্রসঙ্গে উল্লেখের দাবী রাখে। তিনি ছিলেন গৃহকর্তা। তাঁর পরিবারে ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক সংকীর্ণতার কোনও ঠাঁই ছিল না। তাই পরবর্তীকালে নজরুলও এই পরিবারের সাথে একাত্ম হতে পেরেছিলেন। এইরকম একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল প্রমীলার উপর সদর্থক প্রভাব বিস্তার করেছিল। ফয়জুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে তাঁকে ভর্তি করেছিলেন গিরিবালা দেবী। ছোট মেয়ের কণ্ঠে রবীন্দ্র সংগীত শুনে সকলেই মুগ্ধ হতেন।
ড. সুশীল কুমার গুপ্ত তাঁর ‘নজরুল-চরিতমানস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- “১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে যখন ব্রিটেনের যুবরাজ ভারতে আসেন, তখন নজরুল একবার কুমিল্লায় যান। এই সময় যুবরাজের আগমন উপলক্ষ্যে কংগ্রেসের আহ্বানে সমগ্র দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়। নজরুল কুমিল্লায় প্রতিবাদ-মিছিলে যোগ দিয়ে হারমোনিয়াম কাঁধে ঝুলিয়ে ‘জাগরণী’ গানটি গেয়ে সারা শহর পরিভ্রমণ করেন।
১৯২২ সালের শেষের দিকে নজরুল আর একবার কুমিল্লায় গিয়ে বেশ কিছুকাল থেকে আসেন। এই সময় বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের ভগিনী প্রমীলার সঙ্গে নজরুলের গভীর প্রেম সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
অসহযোগ আন্দলোনের শুরুতেই প্রমীলা স্কুল ছেড়ে ছিলেন। প্রমীলার প্রাণময়তা,স্বাদেশিক মনোভাব,ব্যক্তিত্ব,সঙ্গীতপ্রীতি প্রভৃতি নজরুলকে বিশেষভাবে আকর্ষন করেছিল। ‘বিজয়িনী’ কবিতাটি এই সময় রচিত।”
শুধুমাত্র বাল্যজীবনেই নয়, বিবাহ পরবর্তীতে প্রমীলা দেবী তাঁর সাহিত্য চর্চা অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন। খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন এর ‘যুগস্রষ্টা নজরুল’ থেকে প্রমীলাদেবীর সাহিত্য চর্চা সম্পর্কে আমরা অবগত হই। তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন এইভাবে- “কবি যখন হুগলীতে, আমি তখন ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদীর’ সাথে সংশ্লিষ্ট। এই সময় আমি ত্রৈমাসিক ‘সাম্যবাদী’ পত্রিকাও সম্পাদনা করছি। আমার সনির্বন্ধ অনুরোধে কবি ‘সাম্যবাদী’র জন্য একটি কবিতা লিখে পাঠান। এই কবিতাটির নাম ‘সুবহ্ উম্মিদ’। এতে সমগ্র মুসলমান সমাজকে আশার বাণী শুনিয়েছিলেন তিনি। কবিতাটি প্রথমে পড়ে বন্ধু আবুল মনসুর আহমদের হাতে।
তিনি তখন সাপ্তাহিক মোহাম্মদীর সম্পাদকীয় বিভাগের ছিলেন। উৎসাহে, আবেগে চঞ্চল হয়ে আবুল মনসুর আহমদ বলেন, “এটা সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে ছেপেদি কি বল?”
কিন্তু কবি ওটা আমার অনুরোধে বিশেষভাবে ‘সাম্যবাদী’র জন্যই পাঠিয়েছিলেন। এ কথা আমি তাঁকে বললাম। আবুল মনসুর আহমদ বলেন, “তা হলে এটা তুমি সাম্যবাদীতেই প্রকাশ কর পরে না হয় ওটা সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে পুনর্মুদ্রণ করবো। ”
আমি হেসে বলেছিলাম “বেশ”।
এরপর একদিন আমি হুগলী গেলে কবি আমার হাতে একটি কবিতা দিলেন। গোটা গোটা অক্ষরে মেয়েলী হাতের লেখা কবিতা। বিস্মিত দৃষ্টি মেলে কবির মুখের দিকে তাকালাম। বললাম, “কার লেখা এটা?”
তিনি একটু হাসলেন। বললেন “তোর ভাবীও যে আজকাল কবিতা লিখতে শুরু করেছেন।”
তিনি নাকি? আনন্দে নেচে উঠলাম। বললাম, “এটা কিন্তু আমি সাম্যবাদীতে ছেপে দেব। ”
কবি বললেন, “হ্যাঁরে, এজন্যই তোকে দিলাম। ”
কবিতাটি প্রথমে আমি ‘সাম্যবাদী’তে প্রকাশ করি, এর অনেকদিন পর সওগাতের মহিলা সংখ্যায় পুনর্মুদ্রিত হয়। অমরেশ কাঞ্জিলাল সম্পাদিত একটি সাপ্তাহিকেও পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছিল। ”
শঙ্কিতা
কেন আজি প্রাণ মম বেদনায় বিহ্বল
কেন আজি অকারণ চোখে আসে জল।।
সন্ধ্যার সমীরণ হু হু করে বয়ে যায়
বয়ে যায় মোর মন করে কেন হায় হায়।
কেন বেদনায় মম বুক আজি কম্পিত
কে জানে গো হিয়া মাঝে কত ব্যথা সঞ্চিত।।
বেলা শেষে নীলিমায় চেয়ে আছে অনিমিখ্
কে ছড়ালে বিদায়ের সিন্দুর চারিদিক।
কিছুই বুঝিনা হায় কেন প্রাণ ভারাতুর
কে দিল হৃদয়ে বেঁধে মল্লার-রাগসুর।
মনে হয়, এ নিখিলে কেহ নাই, নাই মোর
তুমি বলো কি সন্ধ্যা, কেহ নাই, নাই তোর।।
তার লেখা আরও একটি কবিতা ১৩৩২ সালে আষাঢ় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
করুণা
সেই ভালো তুমি যাও ফিরে যাও
মোর সুখনিশি হয়েছে ভোর
সেধে সেধে কেঁদে থাকি পায়ে বেঁধে
ভেঙ্গেছে সে ভুল ছিঁড়িনি ডোর্।।
জনমের মতো ভুলে যাও মোরে
সহিব নীরবে যাও দূরে সরে
করুণা করিয়া দাঁড়ায়োনা দোরে
পাষাণ এ-হিয়া বাঁধিব গো।।
চিরদিন আমি থাকিব তোমার
কাঁদিবে বেহাগ কণ্ঠে আমার
আপনি একলা কত স্মৃতি হার
গাঁথিব ছিড়িব কাঁদিব গো।।
প্রাণ নাহি চায় দায়ে ঠেকে আসা
একটু আদর কিছু ভালোবাসা
চাইনা কো আমি ঘুমের কুয়াশা
থাকুক জড়ায়ে নয়নে মোর।।
দোষ করে থাকি ক্ষম মোরে ক্ষম
সুখী হও তুমি প্রার্থনা মম
চাহিনাকো সুখ, ভিখারীর সম
সেই ভালো তুমি হও কঠোর।।
রাঁচি থেকে কাজী অনিরুদ্ধ কে লেখা প্রমীলা দেবীর দুটি চিঠি বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে। ‘নিনি’ সম্বোধন করে লেখা এ চিঠি দুটি পড়লেই বোঝা যায় যে–সেই সময় প্রমীলা দেবী তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের উপর কতখানি নির্ভর করতেন। “এই চোখের জলের সঙ্গে নিয়ত প্রার্থনা করছি, তোমার সকল অশান্তি, সব বিঘ্ন দূর হোক। বাবা, হতাশ হয়ো না। কায় মনে ওঁকে স্মরণ কর, যার কৃপায় অলৌকিক ঘটনা ঘটে। আমাদের ব্যাধির জন্যে কষ্ট কোরো না। অনেকদিন গত হয়েছে। এতে প্রাণ ভয় নেই। তুমি ছাড়া শান্তি পাওয়ার আর কিছু নাই জীবনে। তোমাকে ভালো দেখতে না পেলে এই মৃত্যুহীন প্রাণ অসহায় হয়ে ওঠে। আমারই জন্য এবং যাঁর ছেলে তুমি তাঁর প্রতি কর্তব্যবোধে মন কে সবল রাখো। ওঁর অসুখের প্রথম অবস্থায় তোমারই জন্য কেবল ব্যাকুল হতেন এবং তোমার নাম করতেন। ওঁর প্রতি সকলেরই কর্তব্য আছে, কিন্তু যে তার অর্থ না বোঝে তাকে বলা বৃথা।” বিলেত থেকে প্রমিলা দেবী চিঠি লিখেছেন পুত্রবধূকেও। চিঠির প্রতিটি লাইনে ঝরে পড়েছে মাতৃস্নেহ।
শুধুমাত্র প্রমীলা দেবীই নন, প্রমীলা জননী গিরিবালা দেবীও কিছু কিছু সাহিত্য চর্চা করেছেন। তিনি মূলত গল্প লিখতেন, তাঁর লেখা ছোট গল্প অলকা, ভ্রান্তি এবং ঠিক – ভুল, নারায়ণ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তিনি খুব সুন্দর চিঠি লিখতেন। প্রমীলা দেবীর সাহিত্যচর্চায় তাঁর যে বিরাট ভূমিকা ছিল তা বলাই বাহুল্য।
তথ্য ঋণ: প্রমীলা-নজরুল, ড. বুদ্ধদেব বন্দ্যোপাধ্যায়
অন্তরঙ্গ অনিরুদ্ধ, কল্যাণী কাজী
কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা, মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ
নজরুল-চরিতমানস, ড. সুশীল কুমার গুপ্ত
বাংলাদেশে নজরুল, সম্পাদনা- রশীদ হায়দার
যুগস্রষ্টা নজরুল, খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন
তথ্য সংকলন: সোমঋতা মল্লিক, নজরুল সঙ্গীতশিল্পী ও সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading