কবি গুরুঃ মানুষ, জমিদার ও ব্রাহ্ম

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ব সংসারের উচু মাপের কবি, লেখক, সাহিত্যিক, গল্পকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, সমাজ সংস্কারক, অবিকশিত অর্থ চিন্তাবিদ, রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও পর্যবেক্ষেক আরে কতো কি!!।

একই অঙে এত রূপ অথচ তিনিও তো মানুষ। স্বপক্ষের পণ্ডিত, দার্শনিক ও সমঝদারা তাকে মানবিক ত্রুটি-বিচ্যুতির উর্ধ্বে নিয়ে যাওয়ার জন্য এখনও সচেষ্ট।

এমনি একটি ঘটনার রিহার্সাল দেখার সুযোগ হয়েছিলো ১৯৮৮ সালে নিউইয়র্কের বালাদেশ সোসাইটির সম্মেলনে। আমি তখন আমেরিকা সফরে ছিলাম। আমাকে রাজনৈতিক পর্বে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো।

আগেই যেয়ে হাজির হলাম বন্ধুবর ও রিপাবলিকান পার্টির বাংলাদেশের উইং এর প্রধান গোলাম মেরাজের সাথে। অনেক নামী- দামী  লোকের সমাবেশ। সাক্ষাৎ হলো বিশ্ব বিদ্যালয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সলিমউল্লাহ খানের সাথেও। তিনি সেখানে পিএইচডি করছিলেন। এরশাদের সাবেক অর্থ মন্ত্রী জনাব এম এম মোহিতও উপস্থিত ছিলন।

লন্ডন থেকে এসেছেন  সে সময়ের বাংলাদেশের  বিখ্যাত সাপ্তাহিক “যায় যায় দিনের” শফিকুর রেহমান, ঢাকা  থেকে ইংরেজি সাপ্তাহিক দ্য নিউ নেশনের যুগ্ন সম্পদক ওয়াহিদুল হক ভাইসহ স্থানীয় অনেকে।

সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পর্বে আলেচনা করতে যেয়ে ওয়াদুল হক ভাই বললেন যার সার সংক্ষেপ হলোঃ

“কবি গুরু ছাড়া জীবনকে চিন্তাই করা যায় না। তাকে যদি আমরা জীবনের আলো হিসেবে নিতে পারি তবে একটি মানবিক, নৈতিক ও মুল্যবোধ  ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র  গড়তে পারি।

এ আলোকে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে  দিতে হবে। আরো আগ বাড়িয়ে বললেন, তার তুলনা তিনিই”।

আমি তাকে চিনতাম কারণে ছাএ জীবনে আমি দ্য নিউ নেশনের বিশেষ সংবাদদাতা ছিলাম।

অর্থাৎ কবি গুরুকে তিনি এমন এক মাএায় নিয়ে গেলেন যেখানে সাধারণ জনগন কবি গুরুকে আর নাগালে পাবেনা।

মোট ৯৫ টি ছোট গল্পের  মধ্যে পোস্ট মাস্টার ছোট গল্পটি পাঠকের মন টানে। গল্পে রতনকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস্তবতার মুখোমুখি করেছেন জীবনের স্বাভাবিকতাকে মেনে নেয়ার তাগিদের মধ্য দিয়ে।

ফটিক চরিএটা তার অনবদ্য সৃষ্টি, বহুমুখী জিজ্ঞেসায় জিজ্ঞেসিত উঠতি বালক চরিএের প্রতিভু  হিসেবে। অথচ এই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন গীতাঞ্জলি ও শেষের কবিতা রচনা করেন তখন মনে হয় তিনি অতি পরিপক্ক, জ্ঞানতাপস, অভিজ্ঞ দর্শনে এবং সৃষ্টি তত্ত্বে। কিন্তু সিদ্ধান্তে চাবুকসিদ্ধ নন।

তাই মানবিক দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধাতার সহজাত মানব সত্বার ধারক, বাহক হয়েও তাকে  বিশ্ব কবির অবস্থান থেকেও এক্সট্রা প্লাসের কোথায় যেন হোচট খেতে হচ্ছে!!

আমি সাহিত্যিক বা কবি নই,,তবে এ জগত থেকে বিচ্ছিন্নও নই। আমার জগত হলো জাতীয়, দ্বিপাক্ষিক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষায়াবলী।

আমি কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  সম্পর্কে যত জানার, বুঝার ও উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি আমার ততই মনে হয়েছে যে তিনি একজন অতি বড় মাপের মানব সত্বা, কালজয়ী, সমাজ সেবক আরো বহুলোভনীয় অসাধারণ গুনে আলোকিত, তবে তিনি মুলতঃ একজন মানুষ, একজন জমিদার (এটাকে তিনি আকড়ে ধরে রেখেছিলেন)ও একজন ব্রাহ্ম ( তিনি এ বিশ্বাস থেকে বিমুক্ত হতে পারন নি বা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অবস্থান ও উক্তি করে তিনি দোদুল্যমানতার পরিচয় দিয়েছেন )

কবি ইকবালের ভাষায়ঃ কোন কবিই বড় কবি নয় যদি না একই সময়ে তিনি একজন বড় মাপের দার্শনিক না হন।  কবি গুরু ছিলেন এর জীবন্ত উদাহরণ। কবি গুরুর সকল লেখা যদি একএিত করা হয় সেখানও সমতা বিধান করা সম্ভব হবে না। চিন্তার ও আবেগের, সুরের ঝংকার, তাল, লয় ও ছন্দ সমরেখায় চলবে না। বলাকা, সোনার তরী ও গীতাঞ্জলি সহ ৫২ টি কাব্যগ্রন্থকে এক পাল্লায় ওজন করা যাবে না। ৩২ খন্ডে প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলী, সংকলিত গল্পগুচ্ছ,গীতবিতান, ১৯ খন্ড প্রকাশিত পএ সাহিত্য, ৩৮ টি নাটক, ১০টি  উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ, ২০০০ মত গান এক মাএায় বিচরন করছে না।

এটা তার বেলায় যেমন সত্য তেমনি সত্য টলস্টয় , শেকসপিয়ার, হুইটম্যান, বায়রন, শেলী, কীটস, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, ইমারসন, মাইকেল মধুসুদন দত্ত, কবি ইকবাল, গালীব, শেখ সাদী, জালাল উদ্দীন রুমী, মিল্টন, সিসারে, হোমার, দান্তে, বাল্মিকী, বুধ, বৃহস্পতি প্রমুখের।

সবাই সময়ের সাথে যুক্ত এবং সময়ের চাহিদা ও প্রয়েজনীয়তার আলোকেই তাদের লেখা। সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, কৌটিল্য অথবা হরপা, মহেঞ্জাদড়ো, মায়া বা আরো প্রাচীন কোন সভ্যতা সবই সময় নির্ভর। সৃস্টি  ও ধ্বংসের এ লীলাখেলা চলছে এবং চলবে। কেউ নয় জরুরী এ মহাবিশ্বের জন্য, সবই ধ্বংসশীল ও ক্ষণস্থায়ী ।

মুসলিম বিশ্বের সাড়া জাগানো  খলিফা মুনসুর রশীদের ” হাউস অব উয়িসডমের কথা কে না জানে। এখান থেকে রচিত হয়েছিলো এক বিরাট সাহিত্য ভান্ডার, শত শত মাহাকাব্য। আলিফ লয়লা, আরব্য রজনী  আরো শত শত সৃষ্টি। সবই আজ স্মৃতিচারণ।

এক সময়ের ভারত সম্রাট আকবরের নবরত্ন আজ লুপ্তপ্রায়। মেসোপটিয়ান ও মুর সভতার  সৃষ্টি গুলো কোথায় জানি হারিয়ে গেলোা। মানব সভতার যাএায় লক্ষ লক্ষ সভ্যতার আগমন ঘটেছে, কতটুকুই বা সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। পবিএ কোরআনে আদি মানব- মানব-মানবী হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া থেকে রসুলের(সাঃ) সময় পর্যন্ত হাজারো কাহিনী ও ঘটনার কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, কতটুকুই বা আমরা ধারণ ও বহন করতে পারছি ?

তাইতো কবিগুরু নিজেই ” ১৪০০ সাল” কবিতায়

গভীর দর্শন থেকে উক্তি করলেন যে তার সৃষ্টি ও সময় নির্ভর। কোন ব্যক্তিই পূর্ণাঙ্গ নয়, সবাই আংশিক। আর আংশিক নিয়েে বাড়াবাড়ি এ ধরনের ভক্তদের কুমন্ডপতারই নামান্তর। একপেশে লেখাপড়া ও জানা আদিকাল থেকে চলছে এবং চলবে। কবি গুরু আমাদের এক অমুল্য সম্পদ, একমাএ নয়। তাকে আন্তর্জাতিকরন করা যায়, তবে একক নয়। এ বাজারটা অনেক বড়। ভাবুন তো বেদের সংকলক ও  মহাভরতের রচয়িতা ভিয়াসের কথা, তার মেধা ও ওজনের কথা?

জার্মান দার্শনিক হেগেলের বানীঃ

পূর্ণাঙ্গ, আংশিকের চেয়ে সত্য (Whole is truer than a part) অথবা ইনডাকটিভ লজিকের মুলসুএঃ

ল অব ইউনিফর্মিটি অব নেচার ও ল অব কজেশনের সার বত্তার বার্তাটা কি? তবুও নয় গুরুত্বহীন মানব জ্ঞানের ভান্ডার। মহাকালের মহা গহব্বরে সবই যাবে তলিয়ে সাময়িক প্রয়োজন মিটে গেলে। অতএব, মুলকথা একটাইঃ

চিনো নিজেকে, বুঝো নিজেকে এবং উপলব্ধি করো নিজেকে, তবেই জানবে কে তুমি ? কোথায় ছিলে ? কোথায় যাবে? কেন যাবে? কে তোমাকে সৃষ্টি করলো? কেন মারা যাবে? কোন জবাবদিহি আছে কি?

মনে রাখতে হবে দৃড়ভাবেঃ

“মহা বিশ্ব দাড়িয়ে আছি এক মহা নিয়ম ও নীতিমালার উপরে। নিছক নয় খেলা এটা। পালাবে কেথায়?”

ভারত বর্ষে রানী ভিক্টোরিয়ার  আগমনে কবি গুরু কেন জানি আবেগাপ্লুত হয়ে তার জয় ধ্বনিতে উল্লসিত হলেন, বিপরীতে জালিনওয়ালাবাগ হত্যাকন্ডের জন্য নাইটহুড ত্যাগ করার পক্ষে তিনি ব্রিটিশ কতৃপক্ষের  নিকট চিঠি লেখেন ( যদিও বিয়টি নিয়ে বাস্তবে তিনি আার আগাননি), ১৯০৫ সালে বঙ্গ একএীকরনে বিরোধিতা করে কবিতা লেখলেন আনন্দবাজার পএিকার সুরে, ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে দাড়ালেন পশ্চিম বাংলার পন্ডিত ও শিক্ষা ব্যবসায়ীদের স্বার্থে, এগুলো কি একবারেই  কাকতালীয় না গভীর কোন শিকড়ের কথা বলে ?

আমি কবি গুরুকে একজন  উচ্চ মার্গের পণ্ডিত ও মনীষী, মানবতাবাদী ও কৃষকবান্দব হিসেবেই দেখতে চাই, প্রজন্মেের পর প্রজন্মকে “রাবীনন্দ্রীক বলয়ে” আবদ্ধ  রাখরা পক্ষে নই। নতুন মেধা ও ধীশক্তির জয়গান গাইতে চাই। অতপর, মুল বিশ্বাসে যার গলদ, থাকো দুরে তার থেকে শত সহস্র মাইল দূরে যদিও হয় কথা ও চিন্তা অম্ল মধুসম

হে মানব- মানবী।

গ্রিক সভ্যতায় আমারা সফিইজম, স্টয়েসিজম এবং এপিকিউরিনিজমসহ কতো মতবাদ ও দর্শনের পাদুর্ভাব দেখলাম কিন্তু হায় স্থান-কাল- পাএ ভেদে গুরুত্ব  থাকলেও ধীর ধীরে তা হারয়ে গেলো। এটাই স্বাভাবিক সময় ও যুগের বাইরে এ মতবাদগুলো টিকতে পারেনি সীমাবদ্ধতার কারণে, আবেদন হারিয়ে ফেলার কারণে।

আমার  আমেরিকা প্রবাসী অনুজ  বিশিষ্ট লেখক ও ডাক্তার  সিনহা আবুল মুনসুরও কবি গুরুকে নিয়ে তার বিভিন্ন লেখায়ও কবি গুরুর গল্পের নায়ক-নায়িকাদের পরিণতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন নিজের বুঝা ও উপলব্ধি থেকে। কবি গুরুর চিন্তার সাথে, ঘটনার উপসংহারের সাথে ঐক্যমত্য পোষণ করাটা জরুরী নয়। জরুরী হলো তার চিন্তা জগতের ক্যানভাসের গভীরতা, ব্যাপ্তি ও প্রশস্ততাকে নিজের  দূরবীক্ষণ ও টর্চ  দিয়ে আরো জানা, বুঝা ও উপলব্ধি করার অনবরত চেষ্টা ।

 

সিনহা এন এ সাঈদ 

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading