সীমান্তে-পাহারা, বহিঃগমন-আগমন, বাণিজ্য-পরিবহণ, জন-নিরাপত্তা, ইত্যাদি জন্যে পূর্বের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের বিজিবি (সাবেক বিডিআর) সংস্থার ধারা। বেসামরিক সংস্থা হওয়ায় ডেপুটেশনে আসা সেনাবাহিনীর ১ম গ্রেডের কর্মকারীদের দ্বারা পরিচালিত। আর ২য়, থেকে ৪র্থ গ্রেডের কর্মকারীরা সংস্থার নিজস্ব জনবল।

 

মুসলিম জীবণদর্শণ বিরোধী মার্ক্সবাদী, ভিন্নধর্মী ও সম-মনা বুদ্ধিজীবিদের অভিমত হলো, বৃহত্তর ভারতের সাথে ৯৪% সীমন্ত এবং বর্ণ-ধর্ম-অঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যে স্বকীয় মায়েনমারের সাথে ৬% সীমান্ত হওয়ায় বাংলাদেশে সেনাবাহিনী থাকার প্রয়োজন নেই। সাধারণ অস্ত্রভিত্তিক স্বল্প তথা কয়েক ডিভিশন বিজিবি/বিডিআরের মতো বাহিনী থাকলেই যথেষ্ঠ।

 

অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অপরিহার্যতা ক্ষেত্রে অনেকের ধারণা কম। চলমান বিশ্বে বহিঃপ্রতিরক্ষার চেয়ে অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্যে স্বনিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনীর ভূমিকা ও প্রয়োজনীয়তা বেশী। তাই আধা-গণতন্ত্রমুখী নিরুষ্কুশ অন্তর্মুখী হিন্দু অধ্যুষিত বৃটিশ-ভারতে হাজারজনে ১.৫ জনহারে সেনাবাহিনীর জনবল নীতি চালু রাখে।

 

অন্যদিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষার জন্যে গণতন্ত্রমুখী বৌদ্ধ-জাপানে হাজার জনগণে ২.০ জনহারে এবং গণতন্ত্রমুখী খৃষ্টান পঃজার্মানীতে হাজার জনে ২.৫ জনহারে সেনাবাহিনীর জনবলনীতি যক্তরাষ্ট্র-জাতিসংঘ অনুমোদন দিয়েছে। প্রাচীন-মধ্যযুগে রোমানরাজ্যে হাজারজনে কম-বেশী ৫ জনহারে সেনাবাহিনীর জনবল থাকার নীতি ছিল।

 

 

-২-

বিশ্ব-সমীক্ষামতে নিরুষ্কুশ মুসলমান ভিত্তিক বাংলাদেশে হাজার জনে ২.৫ হারে জনবল নিয়ে সেনাবাহিণী থাকার প্রয়োজন। তাই গভীর সমীক্ষা ছাড়া দু’/তিন ধাপে বাংলাদেশে হাজারজনে ২.০ জনহারে সেনাবাহিনী জনবল উন্নীত করার পরামর্শ রেখেছি(প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা, ১৯৮৫ ও বিভাগ-প্রতিরক্ষা কাঠামো, দৈনিক খবর, ১৯৮৯)।

 

উত্তরাধিকারসুত্রে সেনাবাহিনীতে প্রতি হাজার জনতায় ০.৫ জনহারে তথা ৩৬ হাজার জনবল ছিল। রক্ষীবাহিনী সমন্বয় করার পরে তা ৪৮ হাজারে উন্নীত হয়। নিবন্ধকারের পরামর্শ ও তাগিদের পরে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ ১৯৮৯ সালে ১ম ধাপে প্রতি হাজার জনগণে ১.০ জনহারে সেনাবাহিনীর জনবল নীতিসহ আঞ্চলিক ক্যান্টমেন্ট ৮টিতে উন্নীত করেন।

 

৮টি আঞ্চলিক ক্যান্টঃভিত্তিক এবং প্রতি হাজার জনগণে ১.০ জনহারে সেনাবাহিনীর জনবলে প্রতিরক্ষা-কাঠামো স্বনিয়ন্ত্রিত ও গণতন্ত্রমুখী হয় (১৯৯০)। দেশ ও জনগণের সেবায় ব্যক্তি-ইচ্ছায় সামরিক শাসনের অবসান হয়। এটা খালেদা জিয়া বা শেখ হাসিনা অবদান নয়, এরপরে খালেদা-হাসিনা ক্ষমতাসীন হতে ও থাকতে পারেন।

 

প্রতিরক্ষা-কাঠামো, জনবল ও গণতন্ত্র বিষয়ে লেখালেখি ও তাগিদের পরে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা হাজার জনগণে ১.৫ জনহারে সেনাবাহিণীর জনবল নীতিসহ আঞ্চলিক ক্যান্টমেন্ট ৯টিতে উন্নীত করেন (২০১৪)। আপাততঃ রামুকে অস্থায়ী ৯ম আঞ্চলিক ক্যান্টমেন্টে উন্নীতসহ বরিশালে স্থায়ী আঞ্চলিক ক্যান্টমেন্টের ভিত্তি দেন।

 

চলমান বিশ্বে মধ্যম রাষ্ট্র দখলেরও ভয় নেই। তবে বাংলাদেশে প্রতি হাজার জনগণে ২.৫ জনহারে সেনাবাহিনীর জনবল নীতি হলে, পুলিশ-আনসার-ভিডিপিসহ-বেসরকারী সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষার জনবলও পরিমিত হবে এবং মায়েনমারের রোহিঙ্গানীতি, স্বৈরচারী আক্রমণ, সাগরদখল ও উৎপাত থেকে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত থাকবে।

 

-৩-

সেনাবাহিনী থেকে প্রেষণে কমান্ডিং জনবল আসায় বিজিবি সংস্থার গুণগত মান উন্নত। অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা সঞ্চারের ব্যবস্থা হওয়ায় সেনাবাহিনীর গুণগত মানও বেড়েছে। তবে পদোন্নতিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর ২য় গ্রেডে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সাথে বিজিবির সামঞ্জস না থাকায় বিদ্রোহের কারণ সুপ্ত হয়।

 

শারিরিক-মানসিক গঠণের সুবিধার্থে মাধ্যমিক পাশোত্তর মেধাবী তরুণদের সেনাবাহিনীর কমিশন্ড তথা ১ম গ্রেডের কর্মকর্তা নিয়োগনীতি চালু রয়েছে। ১ম ও ২য় গ্রেডের কর্মকর্তাদের সুসমন্বয়ের জন্যে স্বাভাবতঃ সেনা-বিজিবি বাহিনীতে নন-কমিশন্ড তথা ২য় গ্রেডের কর্মকর্তার নিয়োগনীতিতে মাধ্যমিক পাশোত্তর ছাড়া আর বিকল্প সুযোগ নেই।

 

পুলিশবাহিনীতেও ২য় গ্রেডের কর্মকর্তার নিয়োগনীতিতে মাধ্যমিক পাশোত্তর নীতি আছে/ছিল যারা পদোন্নতির মাধ্যমে ১ম গ্রেডে সমন্বয় হন। অনেকে নন-ক্যাডার হিসেবে থাকলেও ১ম গ্রেডে সমন্বিতরা সুপার-পর্যায়েও উন্নীত হন। সেখানে সেনা-বিজিবিতে “অনারী” ছাড়া লেফ্টান্যান্ট পদেও পদোন্নতির সুযোগ কম। পদোন্নতিও দুধাপ নীচে থাকে।

 

সেনা-বিজিবি বাহিনীতে লেঃ কর্ণেল ও কর্ণেল পদ আছে। সে আদলে ৫ম বেতন গ্রেডভুক্ত মেজরপদের নীচে ৬ষ্ট বেতন গ্রেডভুক্ত লেঃ মেজর পর্যায়ের পদ সৃষ্টি করা যায়। তাহলে কোম্পানী কমান্ড বা সম-মানের দায়িত্ব পালনের লেঃ মেজর ও মেজর পদসোপান করা যাবে। লেফ্টান্যান্ট ও ক্যাপ্টেন পদধারীরা লেঃ/স্টাফ অফিসারের দায়িত্বে রবে।

 

তাহলে সেনা-বিজিবি বাহিনীতে নন-কমিশন্ড কর্মকর্তাদের কর্মরত লেফ্টান্যান্ট ও ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি দেয়ে যাবে এবং “অনারী” লেঃ মেজর পদোন্নতিও দেয়া যাবে। তাহলে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকবে না। নন-কমিশন্ড কর্মকর্তাদের পদে মেধা বাড়বে এবং সেনা-বিজিবি বাহিনীতে নন-কমিশন্ড ও কমিশন্ড কর্মকর্তাদের সমন্বয় সুষম হবে।

 

 

-৪-

চলমান রোহিঙ্গা পরিস্থিতিতে অবিশ্যিক হওয়ায় বিজিবি বাহিনীর জনবল বৃদ্ধিসহ সেনাবাহিনী জনবল প্রতি হাজারজনে ২.৫ জনহারে উন্নীত করা অপরিহার্য। সে কারণে সেনা-বিজিবি বাহিনীতে সমন্বয় বৃদ্ধিসহ আর অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের সুযোগ ও সম্ভাবনা সুপ্ত রাখা যাবে না।

 

বিগত সেনা-বিজিবি বিদ্রোহ থেকে নিশ্চয়ই অভিজ্ঞতা হয়েছে, নিরাপত্তা-প্রতিরক্ষা বাহিনীতে জনদায়িত্ববলী ছাড়া ব্যক্তিস্বার্থের দায়িত্ব দেয়া যাবে না। জাতীয় আয়-বন্টণ ও জনপ্রতি জাতীয় আয়ের সাথে সামঞ্জস রেখে জাতীয় বেতন স্কেলসহ বছরওয়ারী বেতন-ভাতা বৃদ্ধি হলে দেশের সামরিক-বেসামরিক পর্যায়ে ক্ষোভ পুঞ্জিভুত হবে না।

 

সেনাবাহিনীসমূহে ১ম গ্রেডের কর্মকর্তা পদে নিয়োগনীতিকে কমিশন্ড বলা দীর্ঘকালের রীতি। পরাধীনদেশেও ২য় গ্রেডের কর্মকর্তার নিয়োগনীতিকে নন-কমিশন্ড বলা মোটেও সমীচীন ছিল না। সুতরাং কর্মকর্তা নিয়োগনীতিতে ১ম গ্রেডের কমিশন্ড কর্মকর্তা এবং ২য় গ্রেডের কমিশন্ড কর্মকর্তা নামে সংশোধিত ও সংম্বোধিত হওয়া বাঞ্চনীয়।

 

বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতারা ৩য়-৪র্থ মেধাগ্রেডধারী। প্রজ্ঞাহীন, মিথ্যাচারী, চোর-প্রতারক, দূর্বৃত্ত-সন্ত্রাসী হওয়ায় বোধহীন। বিশ্বের ৯ম বৃহত্তর রাষ্ট্রকে কেউ দখল নিতে পারে, এবোধও নেই। লক্ষণ-সূর্য সেনদের পক্ষে বখতিয়ার-ইলিয়াস খানদের দেশকে দখল করা সম্ভব নয়। তাহলে লক্ষণ-সূর্য সেনদের অসমবঙ্গ হাতছাড়া হবে।

 

*মোহাম্মদ আহ্সানুল করিমঃ রাষ্ট্র-বিশেষজ্ঞ, মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক বিসিএস কর্মকর্তা। ১৯৮২ থেকে “উচ্চতর সমৃদ্ধিশীল গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ” গঠনের উদ্যোক্তা এবং প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা (১৯৮৫), প্রগতিশীল গণতন্ত্র(১৯৯১), ও সংবিধান সংশোধনের দিকগুলো (২০১০) নিবন্ধ/বইযের লেখক।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading