দেবাশীষ মুখোপাধ্যায় :ছুটতে ছুটতে ট্রেনটা ধরলো অভীক। দিনের শেষ ট্রেন।এটা ধরতে না পারলে ফিরতে পারতো না ও। সকালে বাবার শরীরটা খারাপ দেখে এসেছে। হার্টের রোগী বাবা। হঠাৎ কিছু হলে মায়ের পক্ষে একা সামলানো মুশকিল। অন্যদিন হলে এতোটা ঝুঁকি নিতো না। ছেলেবেলার বন্ধু তাপসের কোয়ার্টারেই থেকে যেত। তাপস বর্ধমান ষ্টেশনের রেল পুলিশের বড়বাবু।ও একাই থাকে এখানে।ওর কাছে থাকলে ছেলেবেলা কিছুটা ফেরত পাওয়া যায়।শেষ কামরায় খুব ভিড়। ভেতরে ঢোকা যাচ্ছে না। শরীরের অনেকটা কামরার বাইরে। একটু ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই কাঁধের ব্যাগ খুলে প্ল্যাটফর্মে।গাড়ির যথেষ্ট গতি এখন। চলন্ত অবস্থায় নামা আত্মহত্যার সামিল। মুখ ঘুরিয়ে ব্যাগটার দিকে তাকালো ও। ষ্টেশনের বোতল কুড়োনো একটা ছেলে ব্যাগটা তুলছে। ছেলেটাকে ভালো করে লক্ষ্য করলো ও। গায়ে চেক জামা,নীল হাফ প্যান্ট,মাথায় কোঁকড়া চুল।গবেষণার কিছু কাগজপত্র,বই, নতুন কেনা দামী মোবাইলপ , পাঁচশ টাকা ও আর সাধের মাউথ অর্গানটা আছে ব্যাগের মধ্যে।পাবে তো ব্যাগটা? বিশেষ করে ওর মাউথ অর্গানটার জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।বছর তিনেক আগে ওরা চার বন্ধু মিলে ব্যাঙ্কক পাটায়া বেড়াতে গিয়েছিল ।সেখানেই কিনেছিল ওটা।বেশ দামী।ওর অনেক দিনের শখ ছিল বিদেশী মাউথ অর্গানের।সাংহাই কোম্পানির চেঞ্জার অর্গানটা। দুটো দিকেই বাজানো যায়। এতো সুরেলা আওয়াজ হয় যে আশপাশে একটা ভালোলাগার মহল তৈরি হয় সুরের ঝর্ণাধারায়।
ভিড় ঠেলে একটু ভেতরে ঢুকলো ও। তাপসকে ফোন করে সব জানালো। ব্যাগটার বিষয়ে নিশ্চয়তা দিল তাপস।ও এখনি যাচ্ছে বললো। তবে চলন্ত ট্রেনে ওঠার জন্য খুব বকাবকি করলো ওকে।মশাগ্রাম ষ্টেশনে ও জানলার ধারে বসার জায়গা পেল একটা।চোখ বুজে হাওয়ার আদর খেতে লাগলো।
অভীক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করছে।বিষয়: গ্রামীণ উন্নয়নে ক্ষুদ্র ঋণের প্রভাব। স্বনির্ভর গোষ্ঠী বিষয়টায় জুড়ে গেছে বলে বিগত তিন বছর হুগলি জেলার গ্রামগুলোতে চষে বেড়িয়েছে তথ্য সংগ্রহের জন্য।’ঘোড়ার মুখের তথ্য’ সমৃদ্ধ করেছে ওর লেখা।সবই প্রাথমিক তথ্য নির্ভর লেখা।কোন গৌন তথ্যের ওপর নির্ভর করে নি। এতে গবেষণার বিষয় আরো বাস্তবোচিত ও গ্রহণযোগ্য হবে।এটা ওর বিশ্বাস। প্রতি শণিবার স্কুল করে ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে চলে আসে। স্যারের সাথে সারা সপ্তাহের কাজ নিয়ে আলোচনা করে। গ্রন্থাগারে যায়। নোটস নেয়।এসব করতে করতে একদম শেষ ট্রেন হয়।আজ ও স্যারের কাছে এসেছিল অন্য শণিবারের মতোই। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল ! মনখারাপের কালো মেঘ ওর সারা হৃদয় জুড়ে।
পরদিন আরামবাগের একটা গ্রামে ফিল্ড ভিজিট সেরে ও বর্ধমানে পৌঁছল প্রায় সন্ধেয়।তাপস অফিসেই ছিল। হারানো ব্যাগটা এগিয়ে দিল তাপস। অভীক দেখল সব ঠিক আছে। শুধু মাউথ অর্গানটা নেই।চা টিফিন করে ওরা বেড়লো হারানো অর্গান উদ্ধারে। যদি বুঝিয়ে ফেরত পাওয়া যায় ! বড়ো ব্যথা ওর বুকের ভেতর।ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল ওটা। বন্ধু বিচ্ছেদের কষ্ট যেন সারা মন জুড়ে।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা গিয়ে পৌঁছল ছেলেটাদের আস্তানায়। হঠাৎ কানে এলো সুর।সি শার্পএ অগোছালো সুর। কিছু রিড মিস্ হচ্ছে। তবুও এক অদ্ভুত ভালোলাগা আছে সুরটায়।শুনেই বোঝা যায় কতো ভালোবাসা নিয়ে বাজাচ্ছে।অভীক বুঝলো সব।উৎসের দিকে একটু এগোতেই নজরে এলো, সেই কালকের ছেলেটা চোখ বুজে তন্ময় হয়ে বাজিয়ে চলেছে অভীকের প্রিয় মাউথ অর্গানটা।আধো অন্ধকারে যেন আত্মমগ্ন ও।ওর সারা শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক আনন্দ খেলা করছে। মুখে যেন সব পাওয়ার আলপনা।
বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো অভীকের। অদ্ভুত এক ভালোলাগায় মনটা ছেয়ে গেল ওর। অনেক না পাওয়ার মাঝে ছেলেটা একটা বাঁচার অবলম্বন খুঁজে পেয়েছে যেন ।ওর এই পাওয়াটুকু আর কেড়ে নিতে চায় না অভীক ।বাজাক মাউথ অর্গান ওর প্রাণের সুরে সুখের অঞ্জলিতে। তাপসের হাত ধরে ফেরার পথ ধরলো অভীক মাউথ অর্গানের সুর পিছনে ফেলে।
লেখক: দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়,
হুগলি, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত।
dmukherjee557@gmail.com ।