কারো ঘরে আগুন লাগলে সেই ঘরে অনেকেই আলু পোড়ানোর চেষ্টা করে। অথচ আমাদের সমাজের হাজার বছরের ঐতিহ্য আগুন লাগা ঘরে পানি নিয়ে যাওয়া।  পড়শি আমাদের আত্মার আত্মীয় হয়। সেই দিনগুলো যেন দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। পাশের ফ্ল্যাটের পড়শিকে আমরা আজকাল চিনি না। সমাজে কেমনজানি এক প্রকার স্বার্থপরতার ছোঁয়া দিনকে দিন বেড়েই চলছে। সেই ছোঁয়াটি রাষ্ট্রের ভিতরেও বেশ লক্ষণীয় বটে।

রাষ্ট্র তার আপন শক্তি দিয়ে সবার আগে জনগণের পাশে থাকবে। এটাই খুব সাধারণভাবে রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হবার কথা । কেননা একটি রাষ্টের জনগণ ভালো থাকলেই তো রাষ্ট্র ভালো থাকবে বা ভালো আছে বলা যাবে। রাষ্ট্রের জনগণ ভালো নেই মানে সহজ বাংলায় রাষ্ট্র ভালো নেই । এমন বিবেচনায় আমাদের রাষ্ট্রের কি অবস্থা ? সেটার বিচার রাষ্ট্রের আগে জনগণ করবে এটাও স্বাভাবিক বটে। তবে জনগণ যেন সেই বিচার করতে পারার অধিকারটিও হারিয়েছে বসে আছে । অথচ রাষ্ট্রের মূল মালিক জনগণ।

আধুনিক গণতন্ত্রের সংজ্ঞায়নটি আব্রাহাম লিঙ্কনের সেই সূত্রে- জনগণ, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য।  আজ অব্দি এর চেয়ে ভালো পদ্ধতি আর আসেনি। সুতরাং বাজারে শেষ আগমন পন্যটি যেমন মর্ডান থাকে। গণতন্ত্র নামক দর্শনটি আজ অব্দি শ্রেষ্ঠ হয়ে আছে। তবে চর্চায় হেরফের দেশভেদে বেশ লক্ষণীয় বটে। সঠিক গণতান্ত্রিক চর্চা করে চলে এমন দেশগুলোর দিকে তাকালে স্পষ্ট হয় যে, সেই সকল দেশে সমস্যা সামনে এলেও সমাধান দ্রুত মেলে, এমনকি সকল ক্ষেত্রেই । কেননা গণতন্ত্রের চর্চার কল্যাণেই জাতীগত বিষয়টি সবার আগে স্থান পায় যে। আর জাতীগত বিষয়টিতেও সেই জনগণ প্রথম সারির । সুতরাং বলাই বাহুল্য গণতন্ত্রের চর্চা দেশভেদে আপন ভঙ্গিমায় হলেও মূল সূত্রটি সেই জনগণ। বিনা জনগণে রাষ্ট্র কেবলি একটি ভূখণ্ড বিহিন কিছুই না ।  শূণ্য গোয়ালে মাছিও ঢুকে না।

এই যে এত জনগণের কথা বলছি। এর পিছনের কারণটিও জনগণ।  একটি দেশের যত প্রকার কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় সব কিছুর পিছনেই জনগণ।  দেশের ব্যবসা- বানিজ্য থেকে শুরু করে সবই জনগণের জন্য।  একটি দেশের ব্যবসা- বানিজ্যের সুযোগ তৈরি করে দেয় রাষ্ট্রের পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্তরা । দেশের জনগণ যেন আপন শক্তিকে কাজে লাগিয়ে, ব্যবসা- বানিজ্য করে দেশ পরিচালিত হতে সহায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে, সেই জন্যই রাষ্ট্র পরিচালনাকারিগন নানাবিধ সুযোগ- সুবিধার সুযোগ তৈরি করে থাকে। আবার ঠিক উল্টোটিও সরকার করে। যেমন রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হবে না, সেখানে রাষ্ট্র তার লম্বা হাতের ব্যবহার করে। সেটাও রাষ্ট্র জনগণের জন্যেই করে।

দেশে আজকে নোবেল করোনার ভয়াবহতা চলছে। প্রথম ধাপে সরকার মোটাদাগে ভালোই ব্যবস্থাপনার মধ্যে দিয়ে একটি কুল কিনারা করতে পেরেছিলো। এবার দ্বিতীয় ধাপেও হয়তো পেরে উঠবে।  একটি বিষয় বেশ লক্ষণীয় যে সরকারের আপন কর্মের কল্যাণেই সরকারকে আজকে করোনার সাথে এককভাবে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। পাশে মূলত কেউ নাই । কারণটিও সরকার নিজে। বিশ্বের অন্য দশটি গণতান্ত্রিক দেশ যেমন দেশের সকল বিরোধী দল সহ সকল অঙ্গনের সকলকে এক সাথে নিয়ে জাতীয়ভাবে করোনার মোকাবিলা করছে। আমাদের দেশে সেই গণতান্ত্রিক চর্চার অভাবেই সরকারকে এককভাবে করতে হচ্ছে।

সরকারের এই একক কর্মকাণ্ডের কল্যাণে অনেক থাকার পরেও নানাবিধ ধুম্রজালের তৈরি হচ্ছে। টিকা তার মধ্যে একটি। প্রথমে বলতেই হয় সরকার টিকার ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক দেশের সাথে মোটামুটি পাল্লা দিয়ে ভালোই বন্দবস্ত করতে পেরেছে। এমনকি প্রথম সারির দিকেই অবস্থান করছে। এখন টিকা আমদানির ক্ষেত্রে পড়েছে বিনা নোটিশে ঝামেলায়।  ভারতকে  অগ্রিম টাকা দিয়েও এখন টিকা না পাওয়ার ঝামেলায়।  খুব স্বাভাবিক কারণেই দেশের জনগণ বুঝে বা না বুঝেই ভারত সরকারকে দোষারোপে ব্যস্ত। কিন্তু মূল সমস্যায় নজর দিচ্ছে না।

আমাদের সরকারের সাথে সরকারের কোনো চুক্তি ভারত সরকার করেনি। টিকা আমদানির চুক্তিটি একান্তই প্রাইভেট। কোম্পানি টু কোম্পানি। সরকার টু সরকার নয়। কেনো কোম্পানি টু কোম্পানি ? সমস্যাটি সেখানেই। দুটি দেশের প্রাইভেট চুক্তি দেশের নানান জটিলতায় চুক্তির বরখেলাপ হতেই পারে। ধরুন, যে সরকারের আমলে চুক্তি প্রাইভেটলি হলো হঠাৎ সেই সরকারের পতন ঘটলো ( যা হতেই পারে ) । নতুন সরকার এসে সব নীতি পরিবর্তন করলো অথবা নতুন নীতি ঘোষণা করলো। সেই সময়ে প্রাইভেট চুক্তিগুলো ঝামেলায় পড়তেই পারে। কিন্তু সরকার টু সরকার চুক্তি কখনোই এমন ঝামেলায় পরে না। অনেকেই বলবেন ভারততো আমাদের বৃহত বন্ধুরাষ্ট্র।  অগ্রিম টাকা নিয়ে এমনটা করতে পারে না। তবে মনে রাখা ভালো এটার পিছনে ভারত সরকার থাকলেও দোষারোপ করার কোনো সুযোগ নেই। এখন সামনে হয়তো বন্ধুত্বের ভাব দখিয়ে বা রাজনৈতিক কটু চালে টিকা চলে আসবে। তবে মনে রাখা ভালো এখানেও একটি কটু রাজনৈতিক খেলা হয়ে থাকলেও থাকতে পারে । তবে সেটা নিয়ে আপাতত লিখছি না। তবে যথা সময়ে অবশ্যই লেখার ইচ্ছা রইলো।

মোদ্দা কথা সরকার প্রাইভেটে যে সুযোগটি তৈরি করে দিয়েছে সেটা সরাসরি জনগণের সাথে খামখেয়ালিপনা অথবা দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দলের একটি প্রভাবশালী স্তরকে ফয়দা লুটতে সহায়তার জন্য । কথা হলো সরকার জনগণের মহাবিপদে এমন সুযোগ কাউকেই কি তৈরি করে দিতে পারে ? উত্তরটি হচ্ছে সরাসরি না। তাহলে সরকার এমন কাজ কেনো করে বা করার হীম্মত দেখায় । সেখানেই সেই গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক চর্চার বিষয়টি চলে আসে। গণতান্ত্রিক চর্চা মানেই জনগণ।

জনগণের এমন বিপদের সময় সরকার কখনোই দলের স্বার্থে দলীয় লোকদের ব্যবসার সুযোগ করে দিতে পারে না এবং করাটা সরাসরি অনুচিত । সরকারকে বলবো মানবিক বিষয়গুলোকে আলাদা দৃষ্টি দিয়ে দেখুন। সামনেই রাশিয়ার সাথে টিকা স্পুটনিক তৈরির চুক্তি হচ্ছে। ভালো এবং খুবই উপযোগী সিদ্ধান্ত হবে। তবে এ ক্ষেত্রে যেন কোনো অবস্থাতেই প্রাইভেটলি চুক্তির আওতায় না আসে এবং কোনো প্রকার কমিশন বানিজ্য না হয় । এই ক্ষমতা জনগণ আপনাদেরকে দেয়নি । মহামারীকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখুন। আর ব্যবসায়ীদের বলবো, জনগণের বিপদে ব্যবসা করার চিন্তাভাবনা করা দেশ দ্রোহীতার সামিল। আজকে সরকারের কল্যাণে পাড় পেলেও ভবিষ্যতে জনগণের কাঠগড়ায় একদিন না একদিন দাঁড়াতেই হবে। সুতরাং মানবিক বিষয়টিকে ব্যবসার মনোভাবে দেখবেন না। এমন ব্যবসায় জড়িতদের ব্যবসায়ী বলে না। সরাসরি বলে প্রতারক ।

 

 

বুলবুল তালুকদার

যুগ্ম সম্পাদক শুদ্ধস্বর ডটকম

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading