গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের এই দিনে পদত্যাগ করেন তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ সামরিক আইন জারির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদ দীর্ঘ নয় বছরের শাসনামলে আন্দোলন-সংগ্রাম ঠেকাতে অনেক জাতীয় রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করেন। অন্তরীণ করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সিনিয়র নেতাদের কারারুদ্ধ করেন এরশাদ।

images

বর্তমানে মহাজোট সরকারের মূল দল আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আবদুস সামাদ আজাদ, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী সাহারা খাতুন, মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন প্রমুখও রেহাই পাননি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন দুই জোটসহ বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর টানা আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। মুক্তি পায় গণতন্ত্র।

images (2).jpg

নব্বইয়ে দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে ৪ ডিসেম্বর রাতে এরশাদ অনেকটা নাটকীয়ভাবে তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় পরদিন (৫ ডিসেম্বর) সব রাজনৈতিক দলের অনুরোধে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ শর্তসাপেক্ষে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। আর ১৯৯০ সালের এই তারিখে (৬ ডিসেম্বর) আনুষ্ঠানিকভাবে এরশাদ পদত্যাগ করেন এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ঘটনাপ্রবাহে তখন সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূর উদ্দিন খান দেশে ফেরার পর সেনাবাহিনীর সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সেনা সদস্যরা সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং প্রেসিডেন্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) এইচ এম এরশাদের আদেশ অনুযায়ী মাঠে থাকলেও তার আদেশ পুরোপুরি অমান্য করতে পারছিলেন না। তবে প্রায় নিষ্ক্রিয় থেকে তারা আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তারা নিজেদেরকে রাজনীতির অংশ করতে চান না, এক সাবেক জেনারেলের ক্ষমতার জন্য জনগণের রক্ত ঝরাতে রাজি নন। তারপরও তাদের পক্ষে সরাসরি সর্বাধিনায়কের আদেশ অমান্য করার সুযোগ ছিল না। এক্ষেত্রে যিনি ভূমিকা রাখতে পারেন তিনি সেনাপ্রধান, কিন্তু পূর্ব নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী দেশে জরুরি অবস্থা জারির আগেই তিনি ঢাকা ছেড়েছিলেন। সৌদি আরবের উদ্দেশে সেনাপ্রধানের বিমান ছেড়েছিল ২৭ নভেম্বর সকাল ১০টায়, আর জরুরি অবস্থা জারি হয় ওইদিন সন্ধ্যায়।

Download.jpg

সফর সংক্ষিপ্ত করে পাঁচদিনের জায়গায় তিনদিন পরই সেনাপ্রধান ঢাকায় ফিরে আসেন। বিমানবন্দরে অনেক সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা অপেক্ষা করছিলেন। তারা সেখানেই সেনাপ্রধানকে দেশের অবস্থা সম্পর্কে জানান। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি সেনা সদরে গিয়ে নিজের অফিসে জরুরি বৈঠকে বসেন নূর উদ্দিন খান। সিনিয়র কর্মকর্তাদের বক্তব্য শোনার পাশাপাশি আরো কয়েক জায়গায় ফোন করে তিনি মতামত জানতে চান। ঢাকার বাইরে থাকা সিনিয়র কয়েক কর্মকর্তাকে ঢাকায় জরুরি তলব করা হয়। এর মধ্যেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যায় যে সেনাবাহিনী ব্যক্তিস্বার্থের বদলে জনগণের পক্ষে দাঁড়াবে। তবে নিজেরা কাউকে কোনো কিছুতে বাধ্য করবে না, শুধু তাদের অবস্থান জানিয়ে সবপক্ষকে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হবে।

Download (1).jpg

সেনাবাহিনীতে তখনো যে এরশাদের পক্ষে কিছু কর্মকর্তা ছিলেন না, এমন নয়। শুরুতে তারা সরাসরি সর্বাধিনায়কের সঙ্গে বৈঠকের পরামর্শ দিলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হয়। মনে করা হয়, একদিকে রাষ্ট্রপতি এবং অন্যদিকে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কের সঙ্গে কমান্ডারদের বৈঠক হলে সেখানে সরাসরি তার আদেশ প্রত্যাখ্যানে জটিলতা হতে পারে। এর চেয়ে তাকে সেনাবাহিনীর অবস্থান জানিয়ে দেওয়াই ভালো।

সেনা সদরে কয়েকদিন যে দফায় দফায় বৈঠক হয় সেখানে কেউ কেউ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সামরিক শাসন জারির প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। কিন্তু, সেই সম্ভাবনাও নাকচ করে দেন সেনাপ্রধান। এর একটি কারণ ছিল যে তিনি কোনোভাবেই সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক ক্ষমতার যে খেলা তার অংশ করতে চাননি। সেনাবাহিনী এবং কর্মকর্তাদের বেশিরভাগও তাই মনে করতেন। সামরিক শাসন জারি না করার পক্ষে সেনা সদরের অবস্থান নেওয়ার আরেক কারণ ছিল যে তারা পরিস্থিতির উত্তরণে সাময়িকভাবে সামরিক শাসন জারির উদ্যোগ নিলে তখনকার অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে মানুষের কাছে তা প্রকারান্তরে এরশাদের পক্ষেই কোনো উদ্যোগ বলে বিবেচিত হতো যাতে পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কা ছিল। এছাড়া, সাময়িক সামরিক শাসন জারি হলে সেনাবাহিনী আরো একবার সরাসরি ক্ষমতার অংশ হয়ে গেলে তাদেরকে ব্যারাকে নিয়ে যেতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে বলেও নূর উদ্দিন খান মনে করতেন।

images (1).jpg

সেসময় সেনাবাহিনী যে এরশাদের আদেশ অমান্য করছে এবং তাকে যে সেনাবাহিনীর শক্তির উপর ভর করে ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া হবে না সেটা বোঝাতে একটা উপায় ছিল মোতায়েন করা সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু, একজন পেশাদার সেনা কর্মকর্তা হিসেবে সেনাপ্রধান নূর উদ্দিন খান সরাসরি সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কের আদেশ অমান্য করার পক্ষে ছিলেন না। তিনি চাচ্ছিলেন পট পরিবর্তন হলে নতুন রাষ্ট্রপতি এবং সশস্ত্র বাহিনীর নতুন সর্বাধিনায়কের আদেশেই সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাবে যাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে তার সুপ্রিম কমান্ডারের আদেশ অমান্য করতে না হয়। সেনা সদরের এ বিবেচনাও ছিল যে হঠাৎ করে সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হলে দেশজুড়ে অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে যা পরে আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।

তবে, এক্ষেত্রে সেনাপ্রধান সিনিয়র কর্মকর্তাদের পাশাপাশি সৈনিকদের মতামত জানতেও আগ্রহী ছিলেন। ইতিহাস সাক্ষী যে সৈনিকদের চাওয়া-না চাওয়াকে পরোয়া না করার কারণে এ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেই অতীতে অনেক রক্তাক্ত ঘটনা ঘটেছে। তিনি এরকম কোনো পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হোক সেটা কোনোভাবেই চাচ্ছিলেন না। সেজন্য সিনিয়র কিছু কর্মকর্তাকে সৈনিকদের মতামত জানার নির্দেশ দেওয়া হয়। সঙ্গে সাধারণ মানুষের আসল চাওয়াটাও যেন তারা বুঝে নেন সেই নির্দেশ দেওয়া হয়।

ওইদিন সৈনিকদের মতামত জানার জন্য যে পাঁচজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাদের একজন সেনাবাহিনীর সেসময়কার ডিরেক্টর (মিলিটারি অপারেশন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। তিনিও সেনাপ্রধানের সঙ্গে সৌদি আরব থেকে মাত্রই দেশে ফিরেছিলেন।

Download (2).jpg

দেশের বাইরে আকাশে বসে দেশে জরুরি অবস্থা জারির কথা জেনেছিলেন জেনারেল ইবরাহিম। সেদিন গুরুত্বপূর্ণ ওই দায়িত্ব পালনের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে তিনি বলেন: রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনটা দানা বেঁধে উঠেছিলো অনেক বছর যাবত। কোনো সময় একটু গরম কখনো একটু ঠাণ্ডা। নব্বই’র নভেম্বরে বিরোধীরা আন্দোলনকে শক্তিশালী, চোখা ও উত্তপ্ত করতে চেষ্টা করছিলেন যাতে এরশাদ সাহেব কোনোমতেই সেটা আর দমন করতে না পারেন।

১৯৯০ সালের অক্টোবরের ১০ তারিখ ঢাকা মহানগরে কিছু রাজনৈতিক ‘দুর্ঘটনা’ ঘটে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেদিন থেকেই আন্দোলনটা অতীতের তুলনায় আরো তীব্র হয়ে যায়। সাধারণতঃ পুলিশ এবং বিডিআর এরকম আন্দোলনকে সামাল দেয়। সেনাবাহিনী সর্বাবস্থায় সবদিন মোতায়েন হয় না। সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সবশেষ বাহিনী। তাই ঘন ঘন সেনাবাহিনীকে দিয়ে জনগণের মোকাবেলা করালে জনগণেরও অসুবিধা, সেনাবাহিনীরও অসুবিধা।

জেনারেল ইবরাহিম সেসময়ের কথা স্মরণ করে বলেন: যখন ২৭ নভেম্বর শাহবাগ মোড়ের কাছে ডা. মিলন গুলিবিদ্ধ হলেন তখন হঠাৎ করেই ঢাকা মহানগরের পরিস্থিতি বদলে গেলো। তুমুল বিক্ষোভ, তুমুল প্রতিবাদ। মহাসড়ক ও রাজপথ দখল হয়ে গেলো। সবকিছুই প্রতিবাদকারী ও বিক্ষোভকারীদের আয়ত্ত্বে। এরশাদ কারফিউ জারি করলেন। মিছিল নিষিদ্ধ করলেন। এবং স্বভাবতঃই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়োজিত করলেন এবং তাদেরকে সহায়তা করার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করলেন।

20181203_223401.jpg

তিনি জানান, তিনদিন পর যখন তিনি ও সেনাপ্রধান নূর উদ্দিন খান দেশে ফিরে এলেন তখন সেনাপ্রধানকে সবকিছু সম্যকভাবে বুঝিয়ে দিলেন চিফ অব জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আব্দুস সালাম। সেসময় ঢাকা মহানগরে যে সেনা মোতায়েন ছিলো তারা মূলতঃ ঢাকা ও মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে যাওয়া সৈনিক। ঢাকা সেনানিবাসে ছিলো ৪৬ পদাতিক ব্রিগেড, আর্মি ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেড, এন্টি এয়ারক্রাফট ব্রিগেড, আর্মি সিগন্যালস ব্রিগেড এবং যেটাকে ‘সিডান্টারি’ বলা হয় সেটা ছিল লজিস্টক বা লগ এরিয়া।

আমরা সৈনিকদের মনোভাব, রিক্সাওয়ালার মনোভাব, সাধারণ মানুষের মনোভাব এবং এমনকি গৃহবধূদের মনোভাবও যাচাই করেছি। সবাই বলছিল, তারা রাজনৈতিক পরিবর্তন কামনা করেন।

জেনারেল ইবরাহিম বলেন: আমি ডিরেক্টর মিলিটারি অপারেশন্স ছিলাম। আর যেসব ইউনিটের সেনা মোতায়েন হয়েছে সেসব ব্রিগেডের কমান্ডারসহ আমরা মোট পাঁচজন ব্রিগেডিয়ার একসঙ্গে সারারাত ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াতাম। উদ্দেশ্য ছিলো সবাই সরেজমিনে যেন পরিস্থিতি দেখি। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোয়াজ্জেম, মূসা এবং ফারুক আহমেদ চৌধুরিও তখন ছিলেন। আমরা সৈনিকদের মনোভাব, রিক্সাওয়ালার মনোভাব, সাধারণ মানুষের মনোভাব এবং এমনকি গৃহবধূদের মনোভাবও যাচাই করেছি। সবাই বলছিল, তারা রাজনৈতিক পরিবর্তন কামনা করেন।

‘সৈনিকগণের মনোভাব ছিলো আমরা পরবর্তী কোনো মার্শাল-ল’র অংশীদার হতে চাই না। এ সমস্যার সমাধান যেন রাজনৈতিকভাবে হয়। দেশের মানুষের উপর গুলি চালিয়ে আমরা কোনো শাসনকে পৃষ্ঠপোষকতা করবো না। অতএব দিন ১৫ আগে সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাগণ যে মনোভাব রাষ্ট্রপতি মহোদয়কে জ্ঞাত করেছিলেন সেটাই আরো পোক্ত হয়ে গেলো,’ বলে সেনা সদরকে তাদের উপলব্ধি জানিয়েছিলেন ইবরাহিমসহ পাঁচ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল।

জেনারেল ইবরাহিম আরও বলেন, চিফ অব জেনারেল স্টাফ এবং সেনাবাহিনী প্রধান রাষ্ট্রপতিকে মানুষের এবং সেনাবাহিনীর মনোভাব জানিয়ে দিলেন এবং ‘আমিও অন্যান্য যেসব জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে জানানো প্রয়োজন তাদেরকে সেই তথ্য জানিয়ে দিলাম। সেসময় এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তৎকালীন রাষ্ট্রপতিকে একটি ইংরেজি লাইন বলেছিলেন: স্যার, ইউর টাইম ইজ আপ।’

এমন সব ঘটনায় এরশাদ যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন জানিয়ে জেনারেল ইবরাহিম বলেন, তিনিও (এরশাদ) আর রক্তপাত চাননি। আর চাননি বলেই ৪ ডিসেম্বর পদত্যাগের ঘোষণা দেন এরশাদ।

তবে, শেষদিকে এসেও এরশাদ কিছু নাটক করতে চেয়েছিলেন। ৩ ডিসেম্বরের ঘোষণায় তিনি নির্বাচনের আগে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। সেটা যেমন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি তেমনি সেনাবাহিনীও বুঝতে পারে তাদের সাবেক প্রধান তাদের উপর ভর করে ক্ষমতা আরো দীর্ঘস্থায়ী করতে চাচ্ছেন। সে কারণেই ওই সিনিয়র কর্মকর্তা সেনাবাহিনীর পক্ষে তাকে সাফ জানিয়ে দেন যে তার সময় শেষ।

এরপরই এরশাদ বুঝতে পারেন যে তার পায়ের নীচে আর এক ইঞ্চি মাটিও নেই। তাকে সেটা বুঝাতে এবং পদত্যাগে রাজি করাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সেসময় রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মনজুর রশীদ খান। এরশাদ পদত্যাগে রাজি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি যাতে আবার উল্টে যেতে না পারেন সেজন্য তাৎক্ষণিকভাবে জেনারেল মনজুর রাষ্ট্রপতির তথ্য সচিবের মাধ্যমে বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বেতারে ওই খবর প্রচারের ব্যবস্থা করেন। সেনা সদরও দ্রুত খবরটি প্রচার করতে বলে। এসব কারণে ওইদিন সন্ধ্যায় উপ-রাষ্ট্রপতি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ছাড়াও যে মন্ত্রীরা এরশাদের সঙ্গে ছিলেন এবং পরে বাড়ি ফিরে গেছেন তারাও আগে জানতে পারেননি যে প্রেসিডেন্ট পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাদের সবাই টেলিভিশনের খবরে তাদের জন্য চরম সেই ‘দুঃসংবাদটি’ জানতে পারেন।

এরশাদের পদত্যাগের বিষয়ে সিদ্ধান্তের প্রথম খবরটি আসে বাংলাদেশ টেলিভিশনে। বিটিভিতে তখন রাত ১০টার ইংরেজি সংবাদ চলছিল। হঠাৎ দেখা যায় সংবাদ উপস্থাপক একটু থেমে একটি কাগজ নিলেন। এরপর তিনি পড়লেন: হিয়ার ইজ অ্যা ফ্লাশ নিউজ। প্রেসিডেন্ট এরশাদ হ্যাজ ডিসাইডেড টু রিজাইন।

সাধারণ সময়ে বিটিভি’র খবর খুব বেশি মানুষ না দেখলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় ওইসময় অনেক মানুষই খবর দেখছিলেন। তবে তার চেয়েও বেশি মানুষ খবরটি জানতে পারেন বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকা থেকে। ঠিক সেসময়ই ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা খবর চলছিল। তাতে টেলিফোনে লাইভে ছিলেন সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী। বিটিভির খবরের কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তিনি ফোন লাইভে জানিয়ে দেন যে আন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট এরশাদ পদত্যাগে সম্মত হয়েছেন। আর এর কয়েক মিনিটের মধ্যে শুরু হয় বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান। সেখানে শুরুতেই এরশাদের পদত্যাগ সিদ্ধান্ত এবং সঙ্গে প্রতিক্রিয়ার খবর জানান সাংবাদিক আতাউস সামাদ।

এ বিষয়ে সাবেক ছাত্রনেতা শফী আহমেদ বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশে সেনা বাহিনী প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাকে দখল করে জেনারেলরা সামরিক শাশনের অবতারণা ঘটায় এবং ১৫ আগষ্টের পর থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত একাধিকবার অভ্যুথান ও পাল্টা অভ্যুথ্যান হয়। ৩রা নভেম্বর, ৭ নভেম্বর এর পর জেনারেল মঞ্জুরের হত্যাকান্ড, কর্ণেল তাহেরকে হত্যাকান্ড, ১৯৮১ সালের মেজর জিয়া হত্যাকান্ড সহ নানান কিছু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ঘটে। তখন সামরিকতন্ত্র বাঙ্গালি জাতির কাধের উপর চেপে বসে, যে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিলো সেই সামরিক শাসন আবার বাংলাদেশে ফিরে আসে।

১৯৭৫ সালের পর থেকে এদেশের তৎকালীন ছাত্রসমাজ যে আন্দোলন শুরু করেছিলো তা বেগবান হয় ১৯৮২ সালে ২৪ শে মার্চ জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে। সেই এরশাদ বিরোধী আন্দোলন পরিপূর্ণতা লাভ করে ১৯৯০ সালে। এই ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি ১৫ দলীয় ঐক্যজোট, ৭ দলীয় ঐক্যজোট, পরবর্তীতে ৮ দল, ৭ দল, ৫ দল, সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য, সকল শ্রেণী পেশার মানুষের ঐক্য যেমন শিক্ষক সমিতি, আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ সাংবাদিক  সমিতি, চিকিৎসকদের সংগঠন (বিএমএ)সহ সমস্ত পেশাজীবী সংগঠনগুলো আন্দোলনে নেমে আসে। ২৭ নভেম্বর ডা. মিলন হত্যার পর বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ, এবং সমস্ত পেশাজীবীরা রাজপথে নেমে আসে পাশাপশি সাধারণ জনগণও রাজপথে নেমে আসে। এর ফলে সমস্ত রাস্তা জনগণের দখলে চলে আসে। এমতাবস্থায় এরশাদের পদত্যাগ করা ছাড়া আর কোন বিকল্প ছিলো না।  এর ফলশ্রুতিতে ৪ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দেয়।

এরশাদের পদত্যাগের পর তৎকালীন সংবিধান ছিলো রাষ্ট্রপতি শাষিত সরকার আর আমরা চেয়েছিলাম সংসদীয় গণতন্ত্র। সেই সংসদীয় গণতন্ত্রে দেশ ফিরে আসলেও তা এখনও পূর্ণতা লাভ করেনি। যা এখনও অনেক দুর্বল এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এখনও নিজ নিজ ভিত্তির উপর দাঁড়ায় নাই। তাই আগামীতে যে নির্বাচন আছে সে নির্বাচনে যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর পুনুরুত্থানের একটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, যা দেশে একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। সেক্ষেত্রে আগামী নির্বাচন যথাযথভাবে ও শান্তিপূর্ণভাবে না হয় এবং গণতান্ত্রিক শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সমস্ত শক্তি যদি ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত না হয় তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যত আবার হুমকির মুখে পড়তে পারে এবং গণতন্ত্র বিপন্ন হতে পারে।

ডিসেম্বর মাসের চার তারিখে জেনারেল এরশাদ যখন পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন রাস্তায় মানুষের যে ঢল নেমেছিল সেটি ৬ই ডিসেম্বর বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের কাছে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা হস্তান্তর পর্যন্ত বজায় ছিল।   শুদ্ধস্বর রিপোর্ট

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading