গত দুই বছর করোণার ভয়াল ছোবলে আয়োজকরা অক্টোবর ফেস্টের আয়োজন করতে পারেনি। কিন্তু চার বছর আগে আমার এই মেলা উপভোগ করার সূযোগ হয়েছিলা। দুই যুগের বেশি আমি জার্মানির বায়ার্ন প্রদেশের নুরেনবার্গে বসবাস করছি। এই প্রদেশের রাজধানী মুনসেনে(মিউনিখ) আয়োজন করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় লোক-মেলাটির। যতদূর জানি এর অনুকরণে এখন জাপান ও চীনেও এরকম মেলার আয়োজন করা হচ্ছে।

 

এত বছর বায়ার্নে থেকেও আমার এই মেলায় যাওয়া হয়ে ওঠেনি। সেবার সিদ্ধান্ত নিলাম যেভাবে হোক এই মেলায় যাব। সব কিছু ঠিক ছিল কিন্তু হঠাৎ আমার বাচ্চাটা অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় প্রথম দিকে যেতে পারলাম না। মনে হয়েছিল সে বছরও আমার মেলায় যাওয়া হবেনা। কিন্তু ৮ই অক্টোবর ২০১৮ ছিল আমার ছুটি আর মেলার শেষ দিন সেই সুযোগটাই কাজে লাগালাম। আমার বাচ্চাও আমাকে ঠেলে পাঠিয়ে দিলো; বাবা তুমি যাওনি কখনও কিন্তু যেতে চেয়েছিলে আজ যখন সুযোগ আছে ঘুরে আসো। সকালে ঘুম থেকে উঠে সব কিছু প্রস্তুত করে তারপর রেলস্টেশনের দিকে রওনা দিলাম। স্টেশনে যেয়ে টিকেট কেনার পর জানতে পারলাম পরবর্তী ট্রেন আরও একঘণ্টা পরে। তার আগে ট্রেন আছে কিন্তু আমি যদি সেটাতে যাই তাহলে পরের ট্রেনের পরে মিউনিখ যেয়ে পৌঁছাব কারণ ওটা বাঁকা পথে যাবে। যে ট্রেনে আমি গেলাম সেটা ইংগোলস্টাডের উপর দিয়ে যাবে ওখানে আমাকে ট্রেন পরিবর্তন করতে হবে। ইংগোলস্টাড আওদির(Audi) হেডকোয়ার্টারের জন্য বিখ্যাত। মিউনিখে টেলিফোন করে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চু চাচাকে জানিয়ে দিলাম আমি তিনটা ২ মিনিটে মিউনিখে পৌঁছাব।

 

আমাকে যে প্লান দিয়ে দিয়েছিল নুরেনবার্গ স্টেশন থেকে সেটাতে শুধুমাত্র মেইন রেলস্টেশনের নামগুলো লেখা ছিল, খেয়াল করিনি যে ট্রেনটা ইংগোলস্টাড উত্তরেও থামে। কিছু একটা পড়ছিলাম তাড়াহুড়োতে নেমে পড়ার পর ভুলটা বুঝতে পারলাম। কিন্তু তখন আর ট্রেনে ফেরার উপায় ছিল না, ট্রেন ছেড়ে গেল। পরের ট্রেন ছিল মিউনিখের উদ্দেশ্যে আধা ঘণ্টা পরে কিন্তু ট্রেনটা ১৫ মিনিট দেরিতে আসলো। ৪৫ মিনিট সময় কি করি টেলিফোন করলাম আমার এক পুরনো বান্ধবী দেবীকে।

 

১৮ বছর আগে তার সাথে পরিচয় হয়েছিল ইংল্যান্ডের নাগরিক। যেই ফোন করেছি অমনি দেবী আমার সাথে মজা করলো ফোনটা কনফারেন্স কলে দিয়ে চুপ করে আছে আমি কথা বলে যাচ্ছি। তারপর চটুল হেসে বলল তুমি তো আমার ছোট বোন বনার সাথে কথা বলছিলে এতক্ষণ। আমি বললাম সেতো আরও ভাল তোমার মত বুড়ির সাথে আর জমেনা। ওর বোনের সাথেও আমার চমৎকার সম্পর্ক। তবে এই দুবোনের স্বামীদের কারোর সাথেই আমার দেখা বা পরিচয় হয়নি আজও। তারপর সে অভিযোগ করলো কি সমস্যা হল যে ফোন করলে? তুমি তো কারণ ছাড়া আমাকে ফোন করো না।

 

আমি বললাম তোমার কথা ভাবতে ভাবতে ভুলে ট্রেন থেকে নেমে পড়েছি এই জন্য তোমাকেই ফোন করলাম। পরে দেবীকে বললাম আমি আমার কুমারত্ব মোচন করার জন্য আজকে মিউনিখ অক্টোবর ফেস্টে যাচ্ছি দেবী খিলখিল করে হেসে দিল। কুমারত্ব মোচন করতে কেউ কি অক্টোবর ফেস্টে যায়? আমি বললাম তাও যায়, তার কারণ কেউ ২৪ বছর জার্মানিতে থেকে যদি অক্টোবর ফেস্টে না যেয়ে থাকে তাহলে সেটা অনেকটা মেয়েদের কুমারীত্ব ধরে রাখার মতোই। আমার সেই কুমারত্বই আজ মোচন হতে যাচ্ছে। ও বলল আমি তো প্রথমে মনে করেছিলাম তোমার মতিভ্রম হয়েছে এক বাচ্চারা বাবা কুমারত্ব মোচন করতে যাচ্ছে।

 

গলায় কিশোরী ভাব এনে সে আমাকে বলল তোমার বউকে ফোন করো আমাকে কেন জ্বালাচ্ছ, আজ রোববার রান্না করতে হবে। আমি বললাম বউ তো বাসায় নেই মসজিদে গেছে নামাজ পড়তে। এভাবে সময় ভাল কেটে গেল পরবর্তী ট্রেনে উঠে আবার বাচ্চু চাচাকে জানিয়ে দিলাম আমি ৪৫ মিনিট দেরীতে পৌঁছাব। চাচাকে চেপে গেলাম আসল কারণ উনি জার্মান রেলের চৌদ্দ-গুষ্টি উদ্ধার করতে থাকলেন। ঘুণাক্ষরেও বুঝলেন না ভাস্তে ফোনে প্রমোদ আলাপে ব্যস্ত।

অক্টোবরের এই লোক-মেলা প্রথম শুরু হয়েছিল ১৮১০ সালে। রাজপুত্র লুডভিগ পরবর্তীতে রাজা লুডভিগ রাজকুমারী টেরেজেকে বিয়ে করেন ১৮১০ সালের ১২ই অক্টোবর। মিউনিখের নাগরিকদের সেই বিয়ের উৎসবে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। রাজকুমারীর সম্মানে এই মাঠটা টেরেজিয়ানভিজে নামে পরিচিত ছিল, এবং সেই নামটাই এখনও ধরে রেখেছে।

 

এই লোক মেলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ বিয়ারের তাঁবুগুলো। এখানে ১৪টা বড় প্রতিষ্ঠান বিয়ার বিক্রির জন্য তাঁবু খাটায় যার ভিতরে প্রায় ৭২৭৬৩ জন এবং বাইরে ২৬০৭২ জন, সর্বমোট এইসব তাঁবুগুলোর অতিথি ধারণ ক্ষমতা ৯৮৮৩৫জন।

 

প্রতিবছর এখানে এক বিলিয়ন ইউরোর ব্যবসা হয়। দু’সপ্তাহ ধরে চলে এই মেলা। সাধারণত সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে শুরু হয় এবং অক্টোবরে শেষ হয়। এখানে যারা দু’সপ্তাহ কাজ করে তারা ছয় মাসের উপার্জন করে এই চৌদ্দদিনে। তবে সে পরিশ্রম খুবই কঠিন। প্রতি বছর কি পরিমাণ দর্শনার্থীর আগমন হয় তার একটা তালিকা নিচে দেওয়া হলঃ

 

সাল দর্শনার্থীর সংখ্যা বিক্রিত বিয়ারের পরিমাণ
২০০৭ ৬.২ মিলিয়ন ৬.৯ মিলিয়ন লিটার
২০০৮ ৬.০ মিলিয়ন ৬.৪ মিলিয়ন লিটার
২০০৯ ৫.৭ মিলিয়ন ৬.৬মিলিয়ন লিটার
২০১০ ৬.৪ মিলিয়ন ৭.১ মিলিয়ন লিটার
২০১১ ৬.৯ মিলিয়ন ৭.৫ মিলিয়ন লিটার
২০১২ ৬.৪ মিলিয়ন ৭.৪ মিলিয়ন লিটার
২০১৩ ৬.৪ মিলিয়ন ৬.৭ মিলিয়ন লিটার
২০১৪ ৬.৩ মিলিয়ন ৭.৭ মিলিয়ন লিটার
২০১৫ ৫.৯ মিলিয়ন ৭.৫ মিলিয়ন লিটার
২০১৬ ৫.৬ মিলিয়ন ৬.১ মিলিয়ন লিটার

 

প্রচুর পরিমাণ বিদেশী আসে এই মেলায়। এই সময় মিউনিখ বা আশেপাশের শহরের হোটেল এবং সাময়িক ভাড়া দেওয়া বাড়ীগুলো পরিপূর্ণ থাকে। আর ভাড়া হয়ে যায় তিন/চার গুন।

 

এই মেলায় এক লিটার বিয়ারের দাম ১৩ ইউরো। বাচ্চু চাচাকে বললাম চাচা বিয়ার খাবেন নাকি, উনি ধমক দিলেন নামাজ পড়তে হয় ওসব করা যাবে না। আমি বললাম চাচা মদমুক্ত বিয়ার আছে সেটা তো শরীরের জন্য ভাল। উনি বললেন না বাপু। আর বাস্তবতা হল আমি নিজেও বিয়ার ছুঁয়ে দেখিনা। তবে আমি বিয়ার খেলে কোন পয়সা লাগতো না, কারণ আমার বসের বিয়ারের কারখানা আছে। সে আমাকে ফ্রি বিয়ারের পাস দিয়ে দিয়েছিল। শুধুমাত্র ১ ইউরো সার্ভিস চার্জ দিয়ে এক লিটার বিয়ার আমি পেতে পারতাম।

 

মেলা শেষ করে রাত এগারোটায় বাসায় ফিরলাম। ট্রেনে বসে কেমন চঞ্চল লাগছিল পড়া লেখা ভাল লাগছিল না দেবীকে খানিক জ্বালালাম চ্যাট করে কখন যে সময় চলে গেল। ও সবকিছু জানতে চাইল কেমন কাটল তোমার সময়, আমি বললাম খুব ভাল তুমি সারাদিন মন জুড়েছিলে যে তাই। বালিকার মত অনুযোগের সুরে বললো, “থাক আমাকে আর ফুলিয়ো না। বউয়ের কাছে যাও।” আমি বললাম তুমি জান বউকে ছাড়া তো কোথাও যায় না আজ তাকে পুরোপুরি বাসায় রেখে এসেছি বাচ্চার জিম্মায়।

 

অদ্ভুত ছিল এই মেলা হরেক রকম জাতি গোষ্ঠীর সমাগম হয়েছিল এখানে। কতরকম ভাষাভাষী আর রঙয়ের মানুষের সমাগম। মেলার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল নিখুঁত সেখানে ব্যাগ নিয়ে ঢোকা নিষেধ গত তিন বছর থেকে। বায়ার্নের ঐতিহ্যবাহী পোষাকে অপরূপ লাগছিল নারী-পুরুষ আর বাচ্চাদের। এই পোশাক আমারও আছে একটি। আমার বাচ্চাও মেলা হলে ঐতিত্যবাহী এ পোষাক পরে। পুরুষরা যে চামড়ার প্যান্ট পরে তা এখন তৈরি হয় ভারতে। কিন্তু দাদারা গরু কাটা বন্ধ করলে এ ব্যবসা মার খাবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুযোগ আছে। আর শার্ট, মেয়েদের ড্রিনডেল তো বাংলাদেশ সরবরাহ করছে আগে থেকেই।

মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দার

লেখক,সাংবাদিক এবং গবেষক ।

 

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading