করোনায় আক্রান্ত হয়ে দিনে ২০১ জনের মৃত্যু, ১১ হাজারের বেশি শনাক্ত, পরীক্ষা ও শনাক্তের অনুপাত প্রায় তিনজনে একজন এসব শুধু সংখ্যা নয়। একটা ভয়ের শিহরণ জাগানো তথ্য। তবে একটা দুটো ঘটনা দিয়ে পুরো পরিস্থিতি বোঝা যায় না এটা যেমন সত্য, তেমনি ঘটনা দিয়ে পরিস্থিতি আঁচ করা যায় সেটা আরও বেশি সত্য। অনেকটা ভাতের হাঁড়ির একটা দুটো ভাত টিপে দেখার মতো।
করোনায় মৃত্যুর পাশাপাশি মানুষের অভাবের যে চিত্র সেটা চিকিৎসা পাওয়ার বা খাবারের জোগান দেওয়ার ক্ষেত্রে যাই হোক না কেন যা পত্রিকায় উঠে আসছে তা থেকে মানুষের দুর্দশা ও দুর্ভোগ বুঝতে পারা এখন সময়ের দাবি। একে উপেক্ষা করলে বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দিলে আরও কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। যা সামাল দেওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব হবে না।
সিএনজি চালক শাহ আলমের ঘরে ২২ দিন বয়সী শিশুসন্তান। চলমান কঠোর লকডাউনে তার আয় বন্ধ। তাই সন্তানের দুধ কিনতে পারছিলেন না। শিশুসন্তানের কান্না সহ্য করতে না পেরে পথে নেমে পড়েছেন তিনি। না কাজ করতে নয়, মানুষের কাছে হাত পাতছেন তিনি। যাকে পাচ্ছেন তার কাছেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে আর চোখে জল নিয়ে সাহায্যের জন্য আবেদন করছেন। এমন মর্মান্তিক দৃশ্য দেখা গেছে যশোরের শার্শা উপজেলার নিজামপুর বাজারে।
দিনমজুর দ্বীন ইসলাম আত্মহত্যা করেছে মুন্সীগঞ্জে। তার স্ত্রী শাহিদা বেগম বলেন, ঘরে বাজার-সদাই কিছু ছিল না। সংসারে অভাব। পোলাপানরে খাওয়াইতে পারছিলাম না। সংসারে অভাব দেইখা মনে করছে বাইচ্যা থাইকা কী করুম। করুণ পরিস্থিতির কী সহজ বর্ণনা! অবশ্য দ্বীন ইসলামের আত্মহত্যাই প্রথম নয়। ২০২০ সালে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন আত্মহত্যা করেছে বলে আত্মহত্যা নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান আঁচল ফাউন্ডেশন জানিয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ২০১৯ সালে আত্মহত্যা করেছে ১০ হাজারের বেশি মানুষ। সে হিসাবে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে আত্মহত্যার পরিমাণ বেড়েছে ৪৪ শতাংশের বেশি। এতে করোনার প্রভাব কতখানি তা নিশ্চয়ই গবেষণার দাবি রাখে।
নাজমার স্বামী কন্টেইনারবাহী লরির চালক। করোনায় আক্রান্ত হয়ে তীব্র শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে একটি শয্যার জন্য করুণ মিনতি করছেন ডাক্তরদের কাছে। রোগীর যন্ত্রণা, স্ত্রীর কান্নার সামনে ডাক্তার অসহায়। হাসপাতালের ১০টি আইসিইউ শয্যার একটিও খালি নেই। যারা ভর্তি আছেন তাদের মৃত্যু কামনা করছেন অনেকেই। কারণ তারা অপেক্ষায় আছেন তাদের স্বজনদের নিয়ে। চোখ-কান খোলা রাখছেন কখন কে মারা যাবেন এবং একটা সিট খালি হবে। নাজমার স্বামী সবুরের অপেক্ষা তাই দীর্ঘ। মৃত্যুর আগে আইসিইউ শয্যা পাবেন কি না তার নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না ডাক্তার।
কুষ্টিয়া করোনা হাসপাতাল অর্থাৎ সরকারি জেনারেল হাসপাতালে ২৫০ শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি ২৮৬ জন। মেঝেতে নয় বারান্দায় ঠাঁই হয়েছে অনেকের। ৬০ বছর বয়সী আব্দুল হান্নান বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন, তার স্ত্রী হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন আর যাকে দেখছেন তাকেই বলছেন, বাবা তোমার চাচার একটা শোয়ার জায়গার ব্যবস্থা করে দাও। ব্যবস্থা কী করবে, কোথায় করবে, কে করবে? বারান্দায় ৮০ জন। এমন সময় বৃষ্টির ছাঁট থেকে রক্ষা করতে স্বজনরা যা পারেন তাই বারান্দার গ্রিলে ঝুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
এ রকম চিত্র শুধু জেলার নাম পাল্টে সাতক্ষীরা, খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর লিখলে খুব একটা পার্থক্য হবে না। কিন্তু চিকিৎসা ক্ষেত্রে কেন এত সংকট? করোনা সংক্রমণ শুরুর পর ১৬ মাস পার হয়েছে। সময়ের অর্থে খুব কম সময় নয়। টাকার অভাব কি ছিল? করোনার প্রথম বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ ছিল, টাকার অর্থে এটাও কম নয়। কিন্তু ব্যয় হয়েছে ২৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৭৫০০ কোটি টাকা ফেরত গিয়েছে। এর জবাব কে দেবে? ২০২০ সালের ২ জুন এক সভায় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের। প্রতিটি হাসপাতালে উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা বাড়াতে বলেছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা নিয়ে প্রশংসা করার অনেকেই আছেন কিন্তু তার নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলো না কেন তার দায়িত্ব কে নেবে?
হাসপাতাল তো অনেক আছে কিন্তু করোনায় গুরুতর আক্রান্ত রোগী আইসিইউ পাবে কোথায়? রোগীর স্বজনদের আহাজারি, কান্না বা হুমকির কাছে তো ডাক্তাররা অসহায়। দেশের কয়েকটা নাম করা হাসপাতালের চিত্র দেখলে সমস্যার গভীরতা বোঝা যাবে। ঢাকা মহানগরীতে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে আইসিইউ নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ঢাকা মহানগরীসহ ঢাকা বিভাগের ১২টি জেলার মধ্যে আইসিইউ নেই কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী ও শরীয়তপুরেও। মুন্সীগঞ্জের ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালসহ কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই আইসিইউ নেই। আইসিইউ বসাতে ভবনে আরেকটি তলা তৈরির কাজ চলছে। তবে আইসিইউ কবে চালু হবে তা জানা নেই। রংপুর বিভাগে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয় ১৫টি হাসপাতালে। এর মধ্যে আইসিইউ আছে চারটিতে। দিনাজপুর, পঞ্চগড়, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট সদর হাসপাতাল, লালমনিরহাট সরকারি কলেজ (আইসোলেশন সেন্টার) এবং রেলওয়ে হাসপাতাল, রংপুর তাজহাট বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, হারাগাছ ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হলেও আইসিইউ নেই। কুড়িগ্রাম ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালসহ এ জেলায় সরকারি কিংবা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো আইসিইউ নেই। গুরুতর রোগীদের যেতে হয় ৫৫ কিলোমিটার দূরের রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
খুলনা বিভাগের নড়াইল, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহের কোনো হাসপাতালে আইসিইউ নেই। নড়াইলে আইসিইউ যন্ত্রপাতি এলেও তা খুলে লাগানো হয়নি বলে পত্রিকায় প্রকাশ। অথচ খুলনা বিভাগে গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে দৈনিক মৃত্যু আট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলার মধ্যে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৩টি এবং জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে রয়েছে মাত্র দুটি আইসিইউ বেড। নেত্রকোনা ও শেরপুরে আইসিইউ নেই। চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরীতে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত চারটি হাসপাতালের মধ্যে চট্টগ্রাম রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালে আইসিইউ নেই। এ বিভাগের বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতালেও নেই আইসিইউ।
এ ছাড়া ফেনীর সোনাগাজী মঙ্গলকান্দি ২০ শয্যা হাসপাতাল, নোয়াখালীর শহীদ ভুলু স্টেডিয়াম করোনা সেন্টার, লক্ষ্মীপুর ১০০ শয্যা সদর হাসপাতাল, চাঁদপুরের ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল, কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতাল ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতালেও আইসিইউ নেই। নোয়াখালীর শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামে সাময়িকভাবে স্থাপিত কভিড-১৯ হাসপাতালে আইসিইউ বেড রয়েছে দুটি। কিন্তু জনবলের অভাবে সেগুলো চালু করা যায়নি এখনো। সেখান থেকে আইসিইউর প্রয়োজন ছিল এমন অন্তত পাঁচজন রোগীকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল কিন্তু তারা পথেই মারা গেছেন। শুধু সাধারণ মানুষ নন, চিকিৎসকদের স্বজনরাও মৃত্যুবরণ করছেন আইসিইউ-এর অভাবে। নোয়াখালীতে আইসিইউ না পাওয়ায় একজন চিকিৎসকের বাবা চট্টগ্রাম নেওয়ার পথে মারা যান। রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর হাসপাতাল, নওগাঁ জেলা সদর হাসপাতাল, নাটোর আধুনিক হাসপাতাল, পাবনা জেনারেল হাসপাতাল, সিরাজগঞ্জের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতাল ও জয়পুরহাট সদর হাসপাতালে আইসিইউ নেই।
বরিশাল বিভাগের সাতটি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হলেও বরিশাল জেনারেল হাসপাতাল, পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পিরোজপুর জেলা হাসপাতাল, বরগুনা জেলা হাসপাতাল এবং ঝালকাঠি সদর হাসপাতাল অর্থাৎ পাঁচটি হাসপাতালেই করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ নেই। এদিকে, সিলেট বিভাগের সাতটি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হলেও আইসিইউ রয়েছে মাত্র দুটি হাসপাতালে।
এ তো গেল আমাদের অবকাঠামোগত দুর্বলতার চিত্র। ডাক্তার, নার্স, চিকিৎসা সেবক কতজন আছে? ২৫০০ মানুষের জন্য একজন ডাক্তার আর ৩৫০০ মানুষের জন্য একজন নার্স দিয়ে সাধারণ পরিস্থিতিতেই চিকিৎসা ব্যবস্থাকে চালিয়ে রাখা মুশকিল তার ওপর করোনার আঘাত সবকিছু তছনছ করে দিতে চাইছে। বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে ভলান্টিয়ার তৈরির চেষ্টা করলে তরুণ যুবকরা যে সাড়া দিত তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। শারীরিক দূরত্বের পরিবর্তে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করার কথা যত বলা হয়েছে তার পরিবর্তে সামাজিক দায়িত্ব পালনের কথা যদি বলা হতো তাহলে করোনা ভলান্টিয়ার হিসেবে একদল তরুণ যুবক আমরা পেতাম।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে দুর্বলতা এবং সক্ষমতা দুটোই ভালো করে বুঝে নিয়েই করোনা মোকাবিলার কৌশল নির্ধারণ করা দরকার। বাগাড়ম্বর দিয়ে রাজনীতিতে বাজিমাত করা গেলেও করোনাকে নিয়ন্ত্রণ বা পরাভূত করা যাবে না তা আমেরিকার ট্রাম্প আর ভারতের মোদি বিশ্বকে দেখিয়েছে। আমরা কি তা দেখেও না দেখার ভান করব?
মানুষ লকডাউন বা কোনো নিয়ন্ত্রণ মানছে না। পথেঘাটে তা আমরা দেখছি। ঘরের অভাব তীব্র হলে বাইরে বের হওয়া বন্ধ করা যাবে কি? ক্ষুধার যন্ত্রণা, অভাবের কামড় যে মহামারীর ভয়ের চেয়ে বেশি তা অভাবী মানুষের চেয়ে কে বেশি বুঝবে। মানুষকে শাস্তির ভয়ে আটকে রাখা যায় না এটা প্রমাণ হয়েছে। জিডিপি কত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কতটা রেকর্ড করেছে সে পরিসংখ্যানের বিশাল আকার দেখে তো গরিবের অভাব মিটবে না। সংক্রমণের বিস্তার রোধ করতে, চলাফেরা বন্ধ করা দরকার। কিন্তু করোনার ভয়াবহতা জেনেও যে মানুষ পথে নামে তাদের সমস্যা বুঝে তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে।
রাজেকুজ্জামান রতন
লেখক রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামনিস্ট