সকালে ঘুম থেকে উঠে চা পান করা ছাড়া অনেকেই দিনটি শুরু করতে পারেন না। গ্রাম কিংবা শহরের বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত, আড্ডা ছাড়াও ফুটপাতে অসংখ্য চায়ের দোকান জানান দেয় এ পানীয়ের জনপ্রিয়তার। কাক ডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত লোকজনে পরিপূর্ণ থাকে চায়ের দোকানগুলো। চায়ের পেয়ালায় এক চুমুক দিয়েই এমনই গল্পে মুখর হয়ে যান যে চায়ের কথাই ভুলে যান অনেকেই। চায়ের দোকানে পারিবারিক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ক সংবাদ পাওয়া যায়। বেশ ফুরফুরে মেজাজে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে ক্রেতারা পাঠ করেন সংবাদ। চায়ের স্টলই শ্রেষ্ঠ তথ্য ভাণ্ডার। যেন সবাই এক একজন গবেষক! কোথাও এত তথ্য পাওয়া যায় না যত পাওয়া যায় ৫ টাকার চায়ে। এখানে চায়ের সঙ্গে সংবাদ ফ্রি বলা যায়। অনেকে আছেন যাদের সময় কাটে না তারা প্রতিদিন সকাল হলেই একটি চায়ের দোকানে গিয়ে বসে বসে মানুষের মুখে নানান খবর শুনে বেশ আনন্দঘন অবকাশ ঘটান। আমি গ্রামের একটি চা দোকানে বসে বসে চা খাচ্ছিলাম। আমার পাশের টেবিলে তিনজন বয়স্ক (৬০ এর কাছাকাছি বয়স হবে) লোক বসে বসে চা খাচ্ছে আর সরকারের গোষ্ঠী উদ্ধার করছিলো। সরকারের গোষ্ঠী উদ্ধার করা দোষের না। সরকার ভুল করলে, তার সমালোচনা করা জনগণের অধিকার। এমন সময় এক তরুণী চা দোকানের সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছে। তখন তিনজনের একজন প্রশ্ন করলো- এই মেয়ে টা কে? অপর দুইজনের একজন বললো-অমুক, অমুকের পোয়ার লগে ইটিসপিটিস। এরপর শুরু হলো সেই তরুণীর বড়বোন কার সাথে পালিয়ে গেছে। সেই তরুণীও কার সাথে ফস্টিনস্টি করে। এইসব বলতে বলতে তারা সেই তরুণীর মা ও ফুফুরও হালখাতা বাহির করলো। এটা শুধু সেই চায়ের দোকানের আড্ডায় হয় না। গ্রামের চায়ের দোকানে বয়স্ক অবসরপ্রাপ্ত লোকরা, অনেক সময় যুব-তরুণদের দেখা যায়। তারা চা’য়ের দোকানে চা খেতে যেয়ে আড্ডা জমায়। তারপর শুরু- কার মেয়ে কার সাথে ফস্টিনস্টি করে! কোন প্রবাসীর বউ ঘনঘন মার্কেটে যায়! কার মা অতীতে কি করেছে। কার কয়টা বিয়ে হয়েছে! কার মেয়ে কোন ছেলের সাথে সন্ধ্যাবেলায় পাটক্ষেতের দিকে যেতে দেখেছে! কার মেয়ে বিয়ের আগে গর্ভপাত করেছে! ইত্যাদি ইত্যাদি আরো কতো কি! তবে তাদের এইসব প্রসঙ্গ পুরোপুরি সত্য না। অর্ধসত্য। রঙ মাখানো কথাবার্তা। এইসব আড্ডা কতোটুকু ভয়ঙ্কর তা বুঝিয়ে বলছি- মনে করুন মদন, জরিনার স্বামী। বিয়ের আগে জরিনা ধর্ষিতা হয়। ঘটনাটি কেউ জানে, কেউ জানে না। জরিনার বিয়ে হবে না দেখে জরিনা ও তার মা-বাবা চুপ থাকে। মদনের সাথে বিয়ে হওয়ার এক বছর পর। মদন জরিনাদের গ্রামে একটি চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছি। পাশের টেবিলে যারা চা খাচ্ছে তারা মদনকে চিনে না। এমন সময় মদনের শালি চা দোকানের সামনে দিয়ে ক্ষেতে যাচ্ছে বেগুন আনতে। তখন তাদের একজন বললো- জরিনার মা’র আজো আক্কেল হলো না। জরিনাকে নিয়ে এতো কিছু হলো তবুও মাইয়াগো ক্ষেতে পাঠায়। অপর জনে জানতে চাইলো- কি হইছে জরিনার লগে। তখন সে বললো- জরিনার তখন চৌদ্দবছর বয়স। জরিনা ক্ষেতে মুলা তুলতে গেছিলো। মেম্বারের পুত আক্কাইসা ধরি………। এইসব শুনে মদন যদি পশুজ্ঞানি হই জরিনারে তালাক দিবো। যদি মানবজ্ঞানি হই জরিনারে বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিবো বা চুপচাপ থাকব! আমি আমার জীবনে অনেক সংসার তছনছ হতে দেখেছি এই চা দোকানের আড্ডার কারণে। আমি অনেক সম্পর্কে ফাটল হতে দেখেছি, এই চা’য়ের দোকানের কারণে। মা-বাবা সাথে সন্তানের, ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের সম্পর্ক নষ্ট হতে দেখেছি, এই চা দোকানের আড্ডার কারণে। আজ দু বছর করোনার কারণে মানুষজনের অবসর বেড়েছে। লকডাউনের কারণে অনেকে বাড়িতে অবসর সময় কাটাচ্ছে। যতই নিষেধজ্ঞা থাকুক না কেন গ্রামে বা পাড়া মহল্লার চায়ের দোকানের আড্ডার পরিসর বেড়েছে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় পুলিশ র্যাব যায় না ঐসব এলাকার চায়ের দোকানে জমজমাট আড্ডা হচ্ছে। গ্রামের ভিতরে আনাচেকানাচে যেসব চা দোকান আছে তাতে অবসরপ্রাপ্ত আর বেকারদের আড্ডা চলছে। আড্ডায় রাজনীতি, বিশ্বনীতি, পরিমণি, কোপা আমেরিকা, করোনা, টিকা সহ নানা আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে, তাতে সমস্যা নাই। সমস্যা দেখা দেয় যখন পাড়া মহল্লার কোনো পরিবারের বা কোনো ব্যক্তির বিষয় নিয়ে আলোচনা হলে। আড্ডায় যখন সখিনা খাতুনের অতীত সম্পর্কে আলোচনা করা হয় তখনি সমস্যা। কারণ সখিনা খাতুনের অতীত যদি এমন হয় যে অতীত সখিনা খাতুনের স্বামী বা স্বামীর আত্মীয়স্বজন শুনলে সখিনার সংসারে অশান্তি নেমে আসবে। যেমন বুঝিয়ে বলি- সখিনার বয়স যখন দশ বছর তখন সখিনার গৃহশিক্ষক সখিনাকে যৌন নিপীড়ন করেছে। সখিনার বয়স এখন ত্রিশ বছর, স্বামী সন্তান আছে। সখিনার বাপের বাড়ির পাশে একটি চা দোকানে কুদরত মোল্লা বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। কুদরত মোল্লা পরীমণি সম্পর্কে আলোচনা করছে। বলছে পরিমণি এই পরিমণি সেই! সেই আড্ডায় একজন পরিমণির পক্ষে বলতে গিয়ে বললো- যদি তাই হতো তাহলে বাঁশভাঙা বাড়ির আক্কাস মিয়ার মাইয়া সখিনা দশ বছর বয়সে…….ব্যস সখিনার ইতিহাস চর্চা শুরু হয়ে গেল। কিন্তু সেই চায়ের দোকানে সখিনার শ্বশুরপক্ষের কোনো আত্মীয় উপস্থিত থাকলে, যাকে কেউ জানে না। তখন সখিনার সংসারে কটতুকু ঘূর্ণিঝড় শুরু হবে তা কি অনুমান করতে পারছেন! তাই চায়ের দোকানে চা খান, খেয়ে চলে যান অহেতুক আড্ডা দিবেন না। যদিও দেন পাড়ার কোনো ব্যক্তি বা পরিবার নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা করবেন না। মনে রাখবেন বর্তমান পরিস্থিতিতে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে থাকা মানেই পুরো পরিবারকে সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলা। মহামারি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত সচেতনতা অনেক বড় ভূমিকা রাখে। সতর্কতা অবলম্বন করুন। সবাইকে ঈদের আগাম শুভেচ্ছা। ঈদের শপিং করতে গিয়ে কারও যেন এই ঈদ যেন কারো শেষ ঈদ না হয়, সেই কামনাই করি। পরিবারের শিশু ও বয়স্কদের যত্ন করুন। সবাই ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, ঘরে থাকুন,নিরাপদে থাকুন।

 

লেখক: আবু জাফর শিহাব (এল এল বি)

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading