ডাঃ অর্জুন দে :

সালটা 1997, ইন্টার্নশীপ শেষ করে চট্টগ্রাম এর একটা ক্লিনিকে কাজ করি, নাম মাত্র বেতনে, নিতান্তই পেটের তাগিদে l চোখে বড় স্বপ্ন, স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিব, পড়াশোনা চলছে তুমুল, কিন্তু রুটি রুজির একটা ব্যবস্থা তো থাকা দরকার l ডাক্তার হয়ে যাওয়ার পর পড়াশোনার জন্যে বাড়ি থেকেতো টাকা চাইতে পারি না l বলা বাহুল্য সেই পরিস্থিতি আমার ছিলও না, বরং দায়িত্ব নিতে হয়েছে বেশ খানিকটা l

যা হোক, কোনো এক দিনের ঘটনা, আমি ক্লিনিকে কর্মরত l গভীর রাত, সারা শহর ঘুমে অচেতন, মাঝে মধ্যে দু একটা গাড়ির হরণ কেবল কানে আসে l ইন্ডোর রোগীদের রুটিন মাফিক রাত্রিকালীন রাউন্ড শেষ করে ‘গাইটন ফিজিওলজি’ এর কোন এক দুর্বোধ্য বিষয় আত্মস্থ করার প্রাণপণ চেষ্টায় রত আমি l এমন সময় হঠাৎ কোলাহল, কলরব l অর্ধ নিদ্রা ভেঙে পুরো হাসপাতাল যেন জেগে উঠল l তন্দ্রlয় আচ্ছন্ন ওয়ার্ড বয়, আয়া, নার্স সবাই যেন চকিতেই চাঙ্গা হয়ে গেল l
উচ্ছ্বসিত ওয়ার্ড বয় অগ্রিম খবর নিয়ে এল l স্যার, এক ভি আই পি রোগী এসেছে, মনে হয় বড় কোন সমস্যা, অনেক চিল্লা – পাল্লা চলছে l

হোক না ওয়ার্ড বয়, অভিজ্ঞতায় আমার চেয়ে তো অনেক এগিয়ে l আমার চোখ মুখ দেখে কি যেন তার মনে হলো l অভয় দিয়ে বললো, ‘স্যার সাহস রাখেন, আল্লাহ ভরসা, কিচ্ছু হবে না l আপনি পারবেন, ভয় পেলে চলবে না’ l

আমি প্রমাদ গুণলাম, বুকে একটু সাহস সঞ্চয় করে নিলাম l ওয়ার্ড বয় কি ভেবেছে জানিনা, বিশ্বাস করুন, পেশার গোড়া থেকেই রোগী চিকিৎসা করতে গিয়ে আমার কখনও আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি হয়নি l মাঝে মাঝে সাহসটা নতুন করে ঝালাই করে নিতে হয়েছে কেবল l

শিশু রোগীটি যখন বাবার কোলে আমার রুমে প্রবেশ করল আমি কিছুটা হলেও বিস্মিত, উত্তেজিত আবার বিরক্ত l এটেনডেন্ট হিসেবে জনা দশেক ভদ্র মহিলা এত রাতে এত পলিশ করে সেজে গুঁজে উপস্থিত, মুহূর্তেই আমার নিতান্ত সাদামাটা ক্লিনিক কক্ষটি আলো ঝলমলে ফ্যাশন শো এর মঞ্চে পরিণত হল! খালি মনে হল, এরা এত রাতে, এই বিপদেও, এতটা ফিটফাট!

লক্ষ করলাম, এর মধ্যে সবচেয়ে নিরীহ গোছের প্রাণী দুটি l এক, আমার তিন কি চার বছর বয়সী ক্ষুদে রোগীটা, আর আমি, তার গোবেচারা চিকিৎসক l

আমাকে দেখেই মা খালা কেউ একজন আর্তনাদ করে উঠল, আমাদের তো বড় ডাক্তার লাগবে! প্রকাশ্যে যা বলেনি তা হল, এ তো ছোকরা ডাক্তার, এ কি সমাধান করবে আমাদের!

আমার ক্লিনিকটা শহরের মধ্যে হলেও, একটু দূরে, চাইলেই চট করে, একজন বিশেষজ্ঞ যখন তখন পাওয়া যায় না l
বয়সে নবীন হতে পারি, মেডিকেল কলেজ থেকে তো সদ্য বের হয়েছি, সাহসের ঘাটতি ছিলনা মোটেও l দেরি না করে বলে ফেললাম, আমাকে কি একটু বলবেন, সমস্যাটা কি? আমি একটু চেষ্টা করে দেখি l
রাজ্যের তাচ্ছিল্য আর অবিশ্বাস নিয়ে, বাবা কর্কশ স্বরে বললেন, ‘ওই যে, দেখা যায়? ও নাকের মধ্যে কি জানি একটা ঢুকিয়ে দিয়েছে l মটর শুটি বা কিছু একটা হবে l আমরা যতো চেষ্টা করি বের করতে, ওটা আরও ঢুকে কেবল’l

কি আশ্চর্য, ওদের ভাব ভঙ্গিতে মনে হল, এসবের জন্য আমিই দায়ি!

টর্চ জ্বালিয়ে দেখি আসলেই সেরকম কিছু একটা দেখা যাচ্ছে l ই এন টি আমার তেমন পছন্দের বিষয় ছিলনা কখনো, এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক ভাবেই কখনও পড়িনি আগে l কিন্তু এখন কি ওসব ভাবার সুযোগ আছে! সাহস সঞ্চয় করে বললাম, আমি একটু চেষ্টা করি?

চোখ রাঙ্গীয়ে বলল, দেখতে পারেন, তবে যদি আরো ভিতরে ঢুকে পড়ে? তাহলে বিপদ বাড়বে না?

মনে মনে ভাবি, তেমন কিছু ঘটলে বাচ্চার বিপদ নিশ্চয়ই বাড়বে, তবে তার চেয়ে ঢের বেশি হবে আমার বিপদ!

যাহোক আমি শুধু নিচু স্বরে একটা কথাই বলেছি, উপকার না হোক, যেন ক্ষতি না হয় সেই চেষ্টা করব l

যে নাকে ঘটনা তার উল্টো দিকটা চেপে ধরলাম, বাচ্চাটা কে বললাম সজোরে নাকটা ঝাড়ো বাবা, যতো জোরে পারো l এক বার, দু বার, তিন বার, কিছুই হল না l একটু সময় দিলাম ওকে l এবার বললাম আবার চেষ্টা করবে বাবা? চতুর্থ বা পঞ্চম চেষ্টায় হঠাৎ ফ্লোর এ একটা হালকা টুক করে শব্দ হল l আমি ওর নাকের দিকে তাকিয়ে দেখি সেই মুক্তl দানাটি আর নেই! খুঁজে বের করে দেখি, আসলেই মটরশুটি!

আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, তার চেয়ে বড় কথা অপ্রীতিকর কোন পরিস্থিতি থেকে মান রক্ষা হল l অতিশয় আনন্দে দলের কেউ হাসল, আবার কেউ কেউ উচ্চ শব্দে কাঁদল l এতক্ষণ নিশ্চুপ, সন্ত্রস্ত, উদ্বিগ্ন শিশুটিও এবার ফোকলা দাঁতে হাসতে শুরু করল!

কাজটি তেমন কিছু হয়তো নয়, তবে পরিস্থিতি বিচারে আবার অনেক কিছু l
বেসিনে হাত ধুতে ধুতে আয়নায় দেখি আমার চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে, মুখ খানি অনেক উজ্জ্বল l মন যেন বলছিল, কপালে নিশ্চয়ই আজ বড় কিছু আছে l ওদের শরীরের ভাষা বলছে ওরা আমাকে সম্মানি যা দিবে তাতে দামী একটা স্যুট না হোক, একটা ভালো শার্ট না হোক, মা’র জন্য ক’টা টাকা তো পাঠাতে পারব l এইটুকু লোভ বোধ হয় আমি করতেই পারি!

ভাগ্যের পরিহাস, চরম আস্থাহীন ছোকরা ডাক্তার যখন আশাতীত দ্রুততায় আপাত কঠিন সমস্যা সমাধান করে দিল তখন ধারণা করতে পারেন, চলে যাওয়ার সময় আমাকে কি জিজ্ঞেস করল?

হাঁ, আমাকে বললো, ডাক্তার সাহেব আপনাকে কি কিছু দিতে হবে?!

আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল l আমি হত বিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ নির্বাক তাকিয়ে থাকলাম l কিছুক্ষন পর আমার হুশ ফিরলে বুকের পাথর সরিয়ে আশ্বাসের স্বরে বললাম, না ঠিক আছে, কিছু লাগবেনা!

অর্থ, প্রতাপ আর দাপটে শক্তিমান মহান ব্যক্তিবর্গ শিশুর মত হাসতে হাসতে মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেল l

আমার উৎসাহী ওয়ার্ড বয়, যে দ্বিগুণ উৎসাহে আমাকে সাহায্য করল এতক্ষণ, সদা হাস্যময় মুখখানি তার রাজ্যের আঁধারে ছেয়ে গেল l নিজে সান্ত্বনাহীন, তবু ওকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম এটা সেটা বলে l

ক্ষোভ, দুঃখ, বেদনা সামলে আমার কেবল নিষ্পাপ শিশুটির কোমল হাসিটাই মনে পড়ছিল l মনে হল, আমরা ওই ‘একটি মুখের হাসির জন্য যুদ্ধ করি’!

এখনও যখন ওই উদ্ধত, অবিবেচক, অকৃতজ্ঞগুলোর কথা মনে পড়ে, তখন রাগে, দুঃখে, অপমানে সারা শরীরে যেন বিদ্যুতের প্রবাহ অনুভব করি l

তবে সৃষ্টিকর্তার কাছে এই বলে এখনো প্রার্থনা করি, হে প্রভু, ওরা যে তোমার সৃষ্টি, তুমি ওদের নিঃশর্ত ক্ষমা করে দিও!

 

ডাঃ অর্জুন দে, চিকিৎসক এবং লেখক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading