ছোট্ট একটা পটভূমিকা:
সূর্য উঠার মত ধ্রুব সত্য প্রতি শুক্রবার কর্তা গ্রামের বাড়ি যান , মায়ার টান এড়িয়ে নগরবাসী হতে পারলেন না তিনি ।ব্যত্যয় ঘটলো কোন কারণে এই নিয়মের । প্রিয় শখ বাজার করা , ল্যাপটপে প্রিয় গান শোনা , টকশো দেখা আর ঘুমেই গুজরান করলেন দিনটা।খেতে বসলেন কর্তা ,কত্রী ও তাদের একমাত্র কন্যা ।ল্যাপটপে ফুল ভলিউমে গান বাজছে ,কন্যা উঠে ভলিউম প্রায় মিউটের পর্যায়ে নিয়ে এল। এমন সময় বেজে উঠলো, ‘ চিরদিনই তুমি যে আমার / যুগে যুগে আমি তোমারি। তিনজনই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। বাবা হাসলেন কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে প্রিয় গানের বেহাল দশায় ।মা হাসলেন – আহারে ,বেচারার প্রিয় গানে খড়গহস্ত !আর মেয়ে-আহা , কি মেলোডিয়াস গান!মুগ্ধতা ছিলো না এই বলায় বলাবাহুল্য।এটাই জেনারেশন গ্যাপ।
এখনকার জেনারেশন ,যাদের শ্লোগান-“নো স্ট্রিং এটাচড।নো কমিটমেন্ট ,গো উইথ দ্য ফ্লো।”সালমান মুক্তাদির এর মত আইকন তো আছে,ফ্রেন্ডস উইথ বেনেফিট।অনেকে দ্বিমত করতে পারেন আমার এই লেখায় খুব স্বাভাবিক। আমিও রক্ষণশীল ধারণায় অভ্যস্ত ,ভাবতে পছন্দ করি এসব সত্য না হোক ।
আজকের জেনারেশন নিজ সম্পর্কে খুব সচেতন।ভাবনায় চৌকস ,ধ্যান-ধারণায় আলো আঁধারির লুকোছাপা নেই, একদম পষ্টাপষ্টি।একটা অস্থির সময়ের মধ্যে পার হচ্ছে।সময়টা তাদের খুব স্বাভাবিকভাবে প্রভাবিত করছে ।নিজের ভাবনায় সৎ ,আনকোরা এই তরুণেরা চোখের সামনে কী দেখছে ? নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে কোন এক সংলাপে তরুণরা স্পষ্টভাবে তাদের মতামত তুলে ধরছে।তারা নষ্ট রাজনীতিকে দোষারোপ করছে ,বিচারবিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে ,অধিকারের সীমাবদ্ধতায় হতাশ প্রকাশ করছে ।তাদের ভেতরের এই প্রশ্নগুলো তাদেরকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে , নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে। তারা চমৎকার একটা কথা বললো ,মুক্তবুদ্ধির চর্চা কারা করেন ? যারা বিপরীত মতকে শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু আমরা অভিভাবকেরা আর শ্রদ্ধার আসনে নেই । নেই বলে মূল্যবোধে ধ্বস নেমেছে । আমাদের সন্তানরা খেলাধুলার মাঠ পান না। মাঠগুলো কতৃপক্ষের ইচ্ছানুযায়ী স্থাপনায় পরিণত । শিক্ষাঙ্গনে পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য। সাংস্কৃতিক মননশীলতা বা চর্চার অভাব তাদের মানসিক দৈন্যতাকে প্রকট করে তুলছে । সময় কাটবে কিভাবে ? পড়াশোনা করে ? এই যে বিতিকিচ্ছিরি একটা শিক্ষাব্যবস্থা , ইদূর দৌড়ের এই প্রতিযোগীতায় তাদের মনোবল নিঃশেষ হয়ে যায় । সমগ্র বাংলাদেশ পর্যটন হয়ে উঠে ভর্তি পরীক্ষার বদৌলতে । এরপর প্রলোভনের হাতছানি তো আছেই । পরীক্ষার শেষে ক্যারিয়ারের অনিশ্চয়তা ( গবেষকরা জানেন, কি আশংকাজনক হারে বেকারত্ব বাড়ছে) । এই স্ট্রেস , এই অস্থিরতায় তারা হাঁপিয়ে উঠছে । ক্রমেই সরে যাচ্ছে আমরা যাকে নৈতিক মূল্যবোধ বলে জাহির করি সেইস্থান থেকে। সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের ভাবনা – চিন্তায় ঘটছে আলোড়ন , তারা থিতু হতে পারছে না কোথাও। আকাশ সংস্কৃতি , মোবাইলের আযাচার ব্যবহার ও প্রবাস জীবন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় একটা প্রভাব ফেলছে । কি গ্রাম , কি শহর সর্বত্রই একই চরিত্র ।ভিক্টিমাইজের চরিত্রও পাল্টাচ্ছে ।এখন ছেলেরাও ভিকটিম হচ্ছে সহজে ।
সম্পর্ক নিয়ে তাদের মনোভাব , ” এমনি করে যায় যদি দিন যাক না “। ” জনম জনম কাঁদিব আমি তোমার লাগি ” এই ভাবনা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে । প্রথমত নিজের পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার সচেতন এই তরুণরা বিনোদনের জন্য সম্পর্কে জড়ায় । মোবাইলের বিভিন্ন অ্যাপস তাদের এই উৎসাহে খড়ি যোগাচ্ছে । Tinder , Tantan এইসব ডেটিং অ্যাপসগুলো তরুণদের রোমাঞ্চকর উত্তেজনায় জাগিয়ে রাখে রাতভর । তারা বেছে নেয় তাদের ডেটিং পারসন । ডেটিং পারসন এক বা একাধিক নো ম্যাটার । কমিটমেন্টের ব্যাপার তো নেই ।
দ্বিতীয়ত রিলেশনের ক্ষেত্রে ‘ ভার্জিন ‘ শব্দটা প্রাগৈতিহাসিক এখন । ফিজিক্যাল নীড এখন প্রাধান্য পাচ্ছে । অন্যকিছু ভাববার অবকাশ নেই।
আমি কয়েকজনের মতামত জানতে চেয়েছি, বিয়ে নিয়ে তোমার ভাবনা কি ? ‘ বিবাহ ‘ এই সামাজিক প্রতিষ্ঠানে তাদের প্রচন্ড ভয় আর অনীহা । স্বাধীনতা হারাবার ভয় দুপক্ষেরই । আগে ক্যারিয়ার , তারপর নাহয় ভেবে দেখা যাবে এই মনোভাব ।
এই আমাদের বর্তমান প্রজন্ম । আমি কোনক্রমেই তাদের ভুল বলছি না ।ভুল আমাদের আমরা তাদের ভুল মেসেজ দিচ্ছি । আমাদের লোভের টোপ বানাচ্ছি ।অস্বীকার করার জো নেই আর্থিক সামর্থের দিক থেকে এগিয়েছে এই দেশ। সেই সামর্থের অপব্যবহারে আমরা তাদের সহায়তা করছি।
আমি আশাবাদী কারণ তাদের চিন্তা – চেতনায় এখনো দেশ আছে , দেশ নিয়ে স্বপ্ন আছে। মেধা আছে , প্রতিভা আছে। দুঃখ সেগুলো লালনের চর্চাটা তারা অব্যাহত রাখতে পারছে না অন্ধকার সময়ে বিচরণের কারণে । বাতিঘরের সুইচটা নিভে গেছে বলে । হ্যামিলনের বংশীবাদক আসছে না বলে ।
লেখক: ফাতেমা জোহরা