বাঙালির জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে রয়েছে এক সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। এই সংগ্রাম কখনও হয়েছে বেগবান, কখনও শ্লথ। দীর্ঘ এই সংগ্রামের পথে কোনো কোনো ঘটনা প্রবাহ আন্দোলনকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে গেছে। ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণআন্দোলন,  ’৭০-এর নির্বাচন এমনই ঘটনার উদাহরণ। এই পথপরিক্রমায় প্রবাসী সরকার গঠনও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে। সেদিনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বৈদ্যনাথতলা গ্রামের নামকরণ হয় মুজিবনগর। মুজিবনগর সরকারের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়েছিল বলে এ সরকারকে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার বলা হয়।

প্রবাসী সরকার গঠন মুক্তিযুদ্ধকে সঠিক পথে পরিচালনা ও যুদ্ধের সফল পরিণতি ছিল এর মূল লক্ষ্য। প্রকৃতপক্ষে প্রবাসী সরকার গঠন করা হয় ১১ এপ্রিল, ১৯৭১। এদিন সরকার গঠনের আগেই গোয়াহাটি বেতারে তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাষণ দেন। সরকার গঠনের পর তাজউদ্দীনের সেই ঘোষণার সন্নিবেশ করতেই ১০ এপ্রিল সরকার গঠনের ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হয়। মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আবদুল মান্নান এমএনএ এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ। নবগঠিত সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়।

কেমন ছিল সেই সরকারের কাঠামো: মুজিবনগর সরকারকে ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ভাগ করা হয়। এছাড়া কয়েকটি বিভাগ মন্ত্রিপরিষদের অধীনে থাকে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্যক্রম ছিল; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি; সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি (রাষ্ট্রপতি পাকিস্তানে অন্তরীণ থাকার কারণে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত); তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা, তথ্য, সম্প্রচার ও যোগাযোগ, অর্থনৈতিক বিষয়াবলি, পরিকল্পনা বিভাগ, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম, সমাজকল্যাণ, সংস্থাপন এবং অন্যান্য যেসব বিষয় কারও ওপর ন্যস্ত হয়নি তার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী; খন্দকার মোশতাক আহমদ মন্ত্রী, পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়; এম মনসুর আলী মন্ত্রী, অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়; এএইচএম কামরুজ্জামান মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রণালয়।

মুজিবনগর সরকারের উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং প্রধান সেনাপতি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এসএ সামাদ প্রতিরক্ষা সচিব। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানী, চিফ অব স্টাফ কর্নেল আবদুর রব, উপ-সেনাপতি একে খন্দকার এবং ডিজি মেডিকেল সার্ভিস ও বিভিন্ন পদবির স্টাফ অফিসার এ দপ্তরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যুদ্ধরত অঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে প্রতিটিতে একজন করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। তবে ১০ নম্বর বা নৌ-সেক্টরে কোনো সেক্টর কমান্ডার ছিল না, কমান্ডোরা যখন যে এলাকায় অভিযান করত সে সেক্টরের কমান্ডারের অধীনে থাকত। এছাড়া জেড ফোর্স, কে ফোর্স ও এস ফোর্স নামে তিনটি ব্রিগেড গঠন করা হয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুদ্ধের সময় বিদেশে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করে এবং বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে বহির্বিশ্বের সরকার ও জনগণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে। এ লক্ষ্যে কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, স্টকহোম প্রভৃতি স্থানে কূটনৈতিক মিশন স্থাপন করা হয় এবং জাতিসংঘ, আফগানিস্তান, সিরিয়া-লেবানন, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, জাপান প্রভৃতি দেশের সমর্থন আদায়ের জন্য কূটনৈতিক প্রতিনিধিদল পাঠায়। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে এ মন্ত্রণালয় থেকে পত্র প্রেরিত হয়। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোর প্রধান ছিলেন কলকাতায় হোসেন আলী, দিল্লিতে হুমায়ুুন রশীদ চৌধুরী, ইউরোপে বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, ওয়াশিংটনে এম আর সিদ্দিকী। স্টকহোমে আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশ মিশনের প্রতিনিধিত্ব করেন।

বাংলাদেশ সরকার প্রেরিত কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সিরিয়া-লেবাননে মোল্ল জালাল উদ্দীন এমএনএ ও ড. মাহমুদ শাহ কোরেশি, আফগানিস্তানে আবদুস সামাদ আজাদ, আশরাফ আলী চৌধুরী এমএনএ, মওলানা খায়রুল ইসলাম যশোরী ও অ্যাডভোকেট নূরুল কাদের। নেপালে প্রেরিত হন আবদুল মালেক উকিল, সুবোধচন্দ্র মিত্র ও আবদুল মোমিন তালুকদার। অ্যাডভোকেট ফকির শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে শামসুল হক ও জ্যোতিপাল মহাথেরো শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও জাপান গমন করেন।

স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে প্রথম কাজ শুরু হয়। পরে মহাপরিচালককে সচিবের মর্যাদা দেয়া হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের কাজ দুই ভাগে বিভক্ত ছিল: (ক) সেনাবাহিনী তথা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা ও (খ) বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ বা সরাসরি অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেনি এমন জনগণকে চিকিৎসা প্রদান।

তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে বসবাসরত বাঙালিদের মনোবল উজ্জীবিত রাখার প্রয়োজনে এ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ মন্ত্রণালয় প্রধানত চারটি মাধ্যমে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত: (ক) বেতার (স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র, (খ) চলচ্চিত্র, (গ) প্রকাশনা, (ঘ) চারুকলা ও ডিজাইন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মুক্তাঞ্চল, শরণার্থী ক্যাম্প ও ট্রেনিং ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা এ মন্ত্রণালয়ের প্রধান দায়িত্ব ছিল। মুক্তাঞ্চলে প্রশাসনিক কাঠামো তৈরির ব্যাপারে সরকারকে সহায়তা এবং যুদ্ধ এলাকা ও মুক্তাঞ্চলে গোয়েন্দা তৎপরতা পরিচালনার জন্য গোয়েন্দা বিভাগ গঠন করা হয়।

ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। শরণার্থীদের আবেদন বিবেচনা করে তাদের সাধ্যমতো সহায়তা দেয়া হতো।

কৃষি বিভাগ যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ এবং যুদ্ধকালীন ক্ষতির বিবেচনায় কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে কীভাবে খাদ্য সংকট কাটিয়ে ওঠা যায়, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার জন্য এ বিভাগ কাজ করে। নুরুদ্দিন আহমদ কৃষি সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।

প্রকৌশল বিভাগ যুদ্ধে সেক্টরগুলোয় প্রকৌশলবিষয়ক সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষ করে দ্রুত রাস্তা নির্মাণ ও মেরামত এবং সেতু মেরামতের জন্য কিছুসংখ্যক প্রকৌশলীকে এ বিভাগের অধীনে নিয়োগ করা হয়।

পরিকল্পনা সেল আওয়ামী লীগের ছয় দফা এবং ১৯৭০-এর নির্বাচনে এ দলের ইশতেহারের পরিপ্রেক্ষিতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে দেশকে গড়ে তোলার জন্য, বিশেষ করে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কীভাবে দ্রুত কাটিয়ে ওঠা যায় সে বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য সরকার এ সেল গঠন করে।

যুব ও অভ্যর্থনা শিবির নিয়ন্ত্রণ বোর্ড মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী যুবকদের প্রথমে অভ্যর্থনা ক্যাম্পে এবং পরে সেখান থেকে যুবক্যাম্পে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হতো। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে মোট ১০৬টি যুব ক্যাম্প ও ১১২টি অভ্যর্থনা ক্যাম্প ছিল।

প্রবাসী সরকার, বিপ্লবী সরকার, অস্থায়ী বা মুজিবনগর সরকার যে নামেই ডাকা হোক না কেন, যুদ্ধকালীন সরকার পরিচালনায় দক্ষতায় নেতৃত্ব দিয়েছিল এই সরকার। একাত্তরের ৯ মাসে বিভিন্ন অবিস্মরণীয় কীর্তি সম্পন্ন করে, যা ইতিহাসের বিচারে অতুলনীয় গৌরবগাথা।

তথ্যসূত্র: হাসান হাফিজুর রহমান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র

কাজী সালমা সুলতানা , লেখক, গবেষক  এবং গণমাধ্যম কর্মী ।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading