
বাংলাদেশ নামক এই ভূখন্ডের সমসাময়িক ইতিহাসের প্রধান মাইলফলক বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম। এর ইতিহাস শুধুমাত্র ২৫শে মার্চের কালরাত্রি থেকে শুরু হয়নি। নানা ঘঠনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে, নানা আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে মিলিত হয়েছে একটি মহাসড়কে । যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করেছি । তিলতিল করে বাঙালি জাতি রাষ্ট্র গঠনের পথকে করেছে প্রশস্থ। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ধাপে ধাপে এক একটি ঘঠনা লিপিবদ্ধ হয়েছে ইতিহাসের অনুসংগ হিসেবে।
বাঙালি জাতির জেগে উঠার কাহিনীর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ছাত্রলীগ নামক সংগঠনটি। যার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আজ ইতিহাসের অংশ হয়েছে।দেশে দেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে একজন মানুষ প্রধান নেতা রুপে আবির্ভূত হয়েছেন। তেমনিভাবে শেখ মুজিব বাঙালি জাতীয়তাবাদী অান্দোলনের প্রধান নেতা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। ছাত্রলীগ তাকে প্রতিষ্ঠা করেছে বঙ্গবন্ধু রুপে। ‘‘রাজনীতিতে শেখ মুজিবের একক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ‘বঙ্গবন্ধু‘ শব্দটি বিরাট ভূমিকা রেখেছিল‘‘।
ছাত্রলীগের কর্মীরাই প্রথম জয় বাংলা ধ্বনি তোলে, কেন্দ্রীয় সংসদের সভায় ‘স্বাধীনতার প্রস্তাব‘ উত্থাপন করে, জাতীয় পতাকার নকশা তৈরী করে , প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে, স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের ‘সর্বাধিনায়ক‘ হিসেবে ঘোষণা করে, জাতীয় সংগীত নির্ধারণ করে এবং সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জাতির পিতা হিসেবে আখ্যায়িত করে। ঘঠনাগুলো অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ১৯৬৮ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭১ এর মার্চের মধ্যে সংগঠিত হয়েছে।
বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ তার সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বহুল আলোচিত বইয়ে লেখেন যে,
“২ মার্চ বিকেলে সিরাজুল আলম খান ইকবাল হলের ক্যানটিনে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মীকে নিয়ে বসলেন। কিছু কিছু বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার ছিল। তিনি কিছু একটা বলছেন আর কেউ একজন নোট নিচ্ছেন। তিনি বললেন, জাতীয় পতাকা কেমন হবে? কয়েকজন বলল, আজ বটতলায় যেটা তোলা হয়েছে, সেটাই হোক। জাতীয় সংগীতের প্রসঙ্গ উঠতেই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা‘ গানটির প্রস্তাব এল। কিন্তু এর দুটো সমস্যা ছিল।
প্রথমত, গানটির কোথাও ‘বাংলা‘ বা ‘বাংলাদেশ‘ শব্দটি
নেই। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি‘ গানটিকে জাতীয় সংগীত করা হোক। সিরাজুল আলম খান মাথা নাড়লেন। একজন সঙ্গে সঙ্গে নোট নিল। এরপর এল ‘জাতির পিতা‘ প্রসঙ্গ। অনেকেই আপত্তি জানিয়ে বললেন, এটা একটা
পাকিস্তান-মার্কা প্রস্তাব। জাতি থাকলেই তার একটা পিতা থাকতে হবে নাকি? যেমন আছেন জিন্নাহ সাহেব? সুতরাং সিদ্ধান্ত হলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হবেন স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের ‘সর্বাধিনায়ক‘।“
‘‘এরই এক পর্যায়ে জহুরুল হক হলে এসে উপস্থিত হন শেখ ফজলুল হক মণি। পরবর্তী পর্যায়ে শেখ মণি এবং সিরাজুল আলম খান গেলেন ইকবাল হলের ভেতরে। সঙ্গে নিয়ে গেলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংগঠক রায়হান ফেরদাউস মধুকে। তারা গিয়ে বসলেন তিন তলার ৩১৩ নাম্বার রুমে। এ রুমেই থাকতেন আ. স. ম. আব্দুর রব। শেখ ফজলূল হক মণি ও সিরাজুল আলম খানের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহারটি খসড়া লিখতে থাকেন রায়হান ফেরদাউস মধু। ইতোপূর্বে খসড়াকৃত স্বাধীনতার ইশতেহারটি উভয় নেতার সম্মতিতে চূড়ান্ত করে লিখলেন রায়হান ফেরদাউস মধু।’
পরবর্তীতে ৩রা মার্চ ১৯৭১সালে ছাত্রলীগের উদ্যোগে আয়োজিত পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে সংগঠনের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। ইশতেহারে শেখ মুজিবকে যদিও স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ঘোষনা করা হয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি‘ গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা করা হয় তথাপিও সেখানে জাতির পিতা প্রসঙ্গটি লেখা হয়নি।
কিন্তু উক্ত জনসভায় গৃহীত প্রস্তাবাবলির ৪ নাম্বার প্রস্তাবে শেখ মুজিবের নামের পাশে প্রথমবারের মত ‘জাতির পিতা‘ হিসেবে উল্লেখ করা হয় । চার নাম্বার প্রস্তাবটি হলো: ‘‘এই সভা স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা রাখিয়া সংগ্রাম চালাইয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছে‘‘। গণমোহন শেখ মুজিব ধীরে ধীরে যেভাবে বাঙালির মানসপটে বঙ্গবন্ধু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন ঠিক তেমনি ভাবে এদিনের পর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামের সাথে যুক্ত হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যেমনিভাবে ৩রা মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করা হয়েছিল ঠিক তেমনি ভাবে জাতির পিতা নামকরণের প্রস্তাবের দিন হিসেবেও ৩রা মার্চ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এবং স্মরণীয় একটি দিন।
প্রয়াত ছাত্রনেতা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাকের লেখা থেকে সংগৃহীত । তিনি ১৯৭১ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহদপ্তর সম্পাদক ছিলেন ।