“জলের শ্যাওলা” –

অর্থপাচারের কথা আসলেই সবার মননে যে ব্যাংকটি কল্পনায় আসে সেটা নিশ্চয়ই সুইস ব্যাংক। সেই বিখ্যাত সুইস ব্যাংকের বিষয়ে আসার আগে একটু ইউরোপের ভৌগোলিক বিষয ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথায় আসতে হয়।

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথায় আসতে হলে আবার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কথা অনেকটা “কান টানিলে মাথা চলে আসার মতন”। খুব সংক্ষেপে বলি : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপের দেশগুলোর বড় বড় দেশগুলোর মাথায় একটি বিষয় বেশ কাজ করলো, সেটা আগামীর যেকোনো বিশ্বযুদ্ধের হাত থেকে ইউরোপের দেশগুলোকে অর্থাৎ ইউরোপ মহাদেশকে কিভাবে সুরক্ষা রাখা যায় ?

 

যেই ভাবনা সেই কাজ। সঠিক দিনক্ষণ বলতে পারবো না তবে যতটুকু জেনেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপের বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বড় বড় দেশ প্রথম ১৯৫৩ সালে একটি সভা করে। সেই সভার মূল ও একমাত্র এজেণ্ডাই ছিলো ইউরোপকে একত্রিত করণ নিয়ে । অর্থাৎ কিভাবে ইউরোপ মহাদেশকে একটি দেশের আদলে আনা যায়। সহজভাবে বললে, সব দেশ তাদের নিজেদের মতনই থাকবে তবে একটি ইউনিয়নের আণ্ডারে থাকবে। যেখানে একটি সেন্ট্রাল পার্লামেন্ট থাকবে এবং ইউনিয়নের আইন- কানুন সবার জন্য প্রযোজ্য হবে ও বাধ্যতামূলক হবে।

 

ভাবনাটি পরিষ্কার ছিলো তবে শুরু ছিলো প্রায় অসম্ভব। ইউরোপ বলে কথা। ভাবনা ভাববে আর কার্যকর হবে না, সেটা হতে পারে না । লক্ষ্যণীয় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৩৯ এ শুরু হলো এবং ১৯৪৫ এ শেষ হলো। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রথম সভা হলো ১৯৫৩ সালে। প্রথমবারের মতন ইউনিয়নের রূপ লাভ করলো কয়েকটি দেশ মিলে ১৯৭৩ সালের পহেলা জানুয়ারি। অতঃপর আজকের দিনে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মোট দেশের সংখ্যা ২৭ টি এবং যেখানে অফিসিয়াল ভাষা আছে ২৪ টি এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোতে একি মূদ্রা (the currency) চালু হলো ২০০২ সালের পহেলা জানুয়ারিতে ইউরো (Euro) নামে।

 

সালগুলো লক্ষ্য করুন, ১৯৫৩ থেকে ভাবনা ও সভা অতঃপর কত কাঠখড় পুড়িয়ে ৭৩ এ ইউনিয়ন গঠিত হলো এবং টাকা বা মূদ্রা ২০০২ সালের পহেলা জানুয়ারি এবং বর্তমানে ২৭টি সদস্য দেশ। সালগুলো উল্লেখ করার কারণটি হলো কোনো কিছু গড়তে সময়, ধৈর্য ও ইচ্ছাশক্তীর প্রয়োজন হয়। ইউরোপ তেমনই একটি মাহাদেশ যেখানে বিশ্বের যেকোনো মহাদেশের আগেই চলে।

 

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কথা বলার উদ্দেশ্য হলো ভৌগলিক বিষয়ে আসার জন। ইউরোপের ভৌগোলিক দিক থেকে অষ্ট্রিয়া (আমার বসবাসের দেশ) ও সুইজারল্যাণ্ডকে ইউরোপের হার্ট বা হৃদপিণ্ড বলা হয়।কেননা অষ্ট্রিয়া ও সুইজারল্যাণ্ড ইউরোপের ভুগোলের মধ্য দেশগুলোর অন্তর্ভুক্ত। পাশাপাশি অষ্ট্রিয়া ও সুইজারল্যাণ্ডকে মৌখিক ভাষায় যমজ দেশ বলেও বলা হয়। কারণ এই দুইটি দেশ দেখতে একে অপরের সাথে পুরোপুরিই এক বা সাদৃশ্য। দুইটি দেশই ছোটো- বড় পাহাড়- টিলা, নদ- নদী, হ্রদ, বন- জঙ্গলে ভরপুর।

দুই দেশ আবার একে অপরের পার্শ্ববর্তী দেশ।

 

অষ্ট্রিয়ার ফরালবেয়ার্গ ও টিরোল ( Vorarlberg & Tirol) এর সাথেই সুইজারল্যাণ্ডের কান্টন সেন্ট গালেন ও গ্রাউবুন্ডেন (Kantone St. Gallen & Graubünden) এর বর্ডার। আমার বেশ স্মরণ হয়, ৮০ দশকে বাংলাদেশে অনেকের ঘরেই (আমাদের ঘরেও ছিলো) সুইজারল্যাণ্ডের একটি বড় ম্যাপ ফ্রেমে বাঁধানো ড্রয়িংরুমের দেয়ালে ঝুলতো। যেখানে পাহাড়- হ্রদ- সুবুজে ঘেরা সুইজারল্যাণ্ড। এখনও যদি কারও ঘরে সেই ম্যাপ থেকে থাকে দেখবেন সেখানে উপরে উল্লেখিত নামগুলো পাবেন। সেই ম্যাপে সুইজারল্যাণ্ড এর জায়গায় অষ্ট্রিয়া নামটি বসালেও কোনো পার্থক্য হবার নয়।

 

কেনো আমি অষ্ট্রিয়া ও সুইজারল্যাণ্ডের বর্ডারের কথা উল্লেখ করছি ? এর পিছনে দুটো কারণ নিহিত আছে। আডলফ হিটলার অষ্ট্রিয়ার ব্রানাও (Braunau ) শহরে জন্ম গ্রহণ করেন এবং আডলফ হিটলার দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের মূলে। একটি কারণ হলো ( ইতিহাস ঘাঁটলেই পেয়ে যাবেন) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলোনায় সুইজারল্যাণ্ডে বোমা নিক্ষেপ হলেও ক্ষয়ক্ষতি ছিলো কম। ইতিহাসেই পাওয়া যায় (বিস্তারিত লিখছি না, আজকে) স্বয়ং জার্মানি থেকেই নির্দেশ ছিলো তেমন। অনেক সুইস ফ্রান্কেন ( সুইস কারেন্সি) ক্রেডিট এগুলোর সাথে জড়িত। এমনকি ইতিহাসে পাওয়া যায় অষ্ট্রিয়ার বর্ডার শহর দুটো সেকারণেই অনেক বোমা নিক্ষেপ থেকে রক্ষা পায়। সেটা ভিন্ন আলোচনা ও ইতিহাস, আজকের বিষয় নয়।

 

দ্বিতীয় কারণটি বর্তমান। সেই বর্তমানটি কি ? লক্ষ্য করুন, ইউরোপে ভৌগোলিকভাবে সুইজারল্যাণ্ড মধ্য দেশ হলেও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশ কিন্ত সুইজারল্যাণ্ড নয়। বিষয়টি আজকে এখানেই রাখলাম তবে অর্থপাচারের আলোচনার কারণেই বিষয়গুলো হালকা উল্লেখ করা মাত্র। এখানে ভাববার কোনো কারণই নাই যে, সুইজারল্যাণ্ডের ইচ্ছা হয়নি তাই সদস্য হয়নি। ডালে কিছু কালা আছে বলেই।সেই কালা ডালের আলোচনাও বৃহৎ হবে, তাই আজকে এখানে নয়।

 

এখন আসি অর্থপাচার বিষয়ে। মূলত পৃথিবীতে যেদিন থেকে মুদ্রার চালু হলো, সেদিন থেকেই মুদ্রার অপব্যবহারের শুরু। মুদ্রার এই অপব্যবহারই মূলত মানি লণ্ডারিং (Money Laundering) বা অর্থপাচার।

 

সংক্ষেপে বলি, ১৯৭০ সালের শুরুর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সকল প্রকার সন্দেহজনক লেনদেন ঠেকাতে অর্থাৎ অর্থপাচার রোধে প্রথম একটি আইন করে। যে আইনটি ব্যাংকের গোপনীয়তা আইন (Bank Secrecy Act) নামে চালু হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই আইনে উল্লেখ করে, ১০ হাজার ডলারের বেশি যেকোনো লেনদেন (বৈদেশের সাথে) অবশ্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হবে। সেই আইন কাজে এসেছে বটে তবে মোটেও উপযুক্ত ছিলো কিনা ? সেটা একটি বড় প্রশ্নবোধকেই থেকে যায় তবে শুরু বলে কথা।

 

এখানে বলা ভালো যে, আজকের দিনেও ১০ হাজার ডলারের বিষয়টি কার্যকর রয়েছে। যেমনটা ইউরোপের দেশগুলো থেকেও ১০ হাজার সর্বোচ্চ ইউরো বিনা ঘোষণায় লেনদেন হতে পারে। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি দেশ থেকে দেশে ভ্রমণের সময় সর্বোচ্চ ১০ হাজার কারেণ্সি সাথে নিতে পারবে। অর্থপাচার নিয়ে এখানে অবশ্য হুণ্ডির বিষয়টি একটু বলা প্রয়োজন। হুণ্ডি হলো সর্বাধিক ব্যবহারিক পদ্ধতি। হুণ্ডির আরও মূল উপসর্গ হলো ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির মাধ্যমে ঘটে এবং মৌখিক ও বিশ্বাসের বিষয় জড়িয়ে। হুণ্ডি অর্থপাচারেরর ক্ষেত্রে বহু পুরানো, সহজ ও অতিরিক্ত ব্যবহারিক পদ্ধতি। আমাদের দেশেও হুণ্ডির মাধ্যমে অর্থপাচার অহরহ ঘটে। হুণ্ডির মাধ্যমে অর্থপাচার মানেই একটি দেশের সরকার তার বৈধ পদ্ধতির উপার্জন থেকে বঞ্চিত হয়।

 

লেখার এই পর্যায়ে একটি বহুল আলোচিত ইতিহাসের কথায় আসি। ওয়াটারগেইট কেলেঙ্কারির কথা আমরা জানি। নির্বাচন প্রচারাভিযান চলাকালে ১৭ জুন, ১৯৭২ সালে ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান দল ও প্রশাসনের ৫ ব্যক্তি ওয়াশিংটন ডিসির ওয়াটার গেইট ভবনস্থ বিরোধী ডেমোক্র্যাট দলের সদর দফতরে আড়িপাতার যন্ত্র বসায় এবং নিক্সনের প্রশাসন কেলেঙ্কারিটি ধামা-চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। বিশ্বে বেশ সুপরিচিত এই কেলেঙ্কারির কথা। যদিও শেষ রক্ষা নিক্সনের হয়নি এবং পদত্যাগ করেছিলেন।

 

মূলত মুদ্রার অপব্যবহার অর্থাৎ মানি লণ্ডারিং ( Money laundering) বা অর্থপাচার এই ওয়াটারগেইট কেলেঙ্কারির পরেই সামনে আসে। ইতিপূর্বে মানি লণ্ডারিং শব্দটি সুপরিচিত ছিলো না। যদিও ওয়াটারগেইট কেলেঙ্কারি রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি তবে অর্থ এর সাথে বেশ জড়িত।

 

ঠিক সেখান থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থপাচার নিয়ে নতুন করে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর পিছনের কারণটিও বেশ জটিল। সেই সময়ে মেক্সিকোর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাদক ব্যবসা বড় সমস্যার দেখা দেয় এই অর্থপাচারে। ৮০ দশকে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে ভাবতে থাকে। অতঃপর ১৯৮৬ সালে এসে ব্যাংকের গোপনীয়তা আইনকে (Bank Secrecy Act) নতুন করে ঢেলে সাজায় এবং আইনটিকে আরও কার্যকর করে তোলার প্রয়াশে মানি লণ্ডারিং অ্যাক্ট ( Money Laundering Act) তখন চালু হয়।

 

এই মানি লণ্ডারিং অ্যাক্ট ( Money Laundering Act) বিশ্বে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পরে। মূলত G – 7 এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো বেশ দ্রুত এমন আইনকে বেশ গ্রহণ করে। অতঃপর ১৯৮৯ সালে এই G-7 একটি আন্তর্জাতিক কাঠামো গড়ে তুলে যেখানে প্রথম অবস্থায় ৩৯ চল্লিশটি দেশ G- 7 এর অন্তর্ভুক্ত ছিলো। যদিও G -7 ভুক্ত দেশগুলো মানি লণ্ডারিং অ্যাক্ট নিয়ে কাজ শুরু করে তবে এর সঠিক প্রয়োগ ঘটে তারও আরও অনেক অনেক পরে ২০০১ সালের দিকে।

 

সবার স্মরণে আছে সেই নাইন/ এলিভেনের কথা। ট্যুইন টাওয়ার ধ্বংসের কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণার তথ্য বলে যে, নাইন/ এলিভেনে সন্ত্রাসীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক ব্যাংকে নানান ফন্দিফিকিরের আওতায় কালো টাকার লেনদেন করেছিলো অস্বাভাবিক মাত্রায়। ফলাফল ট্যুইন টাওয়ার ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। সন্ত্রাসীদের এই কালো টাকা রুখতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবার নতুন করে মানি লণ্ডারিং আইনটি নিয়ে ভাবে এবং নতুন করে কার্যকর করে।

 

অতঃপর ২০০৫ সালে এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অ্যাক্টটিতে নতুন করে যুক্ত করেন দূর্ণীতি এবং এটার প্রসার ঘটান মূলত আইএমএফ দ্বারা। সেটা কিভাবে ? বিশ্বের সকল দেশই আইএমএফের নিকট ঋণ নিয়ে থাকে। সেই ঋণের শত শর্তাবলীতে বিষয়টি জড়িয়ে দেয়। আইএমএফের ঋণ মানেই শত শর্ত এবং সেখানে অ্যাক্টের নতুন যোগ দূর্ণীতির বিষয়ে বেশ কার্যকর হয়।

বলাই বাহুল্য সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশেও আইএমএফের নিকট ঋণ নিয়েছে (পত্রিকার খবর)। আইএমএফের সকল শর্তেই দূর্ণীতির বিষয় বেশ জোড়ালো উল্লেখ আছে।

 

একটু দেখা প্রয়োজন বাংলাদেশে মানি লণ্ডারিং অ্যাক্ট কবে এবং কোথা থেকে শুরু হয়। শুরুটা হয়েছিলো মূলত ২০০১ সালের দিকে। অতঃপর ২০০৮ সালে তথাকথিত সেনা শাসনের আওতাভুক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইনটিকে পরিবর্তন- পরিবর্ধন করে যা একপ্রকার বাতিল করে নতুন করে অধ্যাদেশ জারি করে আইনটিকে আরও কার্যকর করার ভূমিকা গ্রহণ করে। কতটা কার্যকর হয়েছিলো সেটাও প্রশ্ন সাপেক্ষ অবশ্যই।

 

বাংলাদেশে ২০০৮/ ২০০৯ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন করে রাজনৈতিক সরকারের শাসন শুরু হয়। ক্ষমতাসীন হয় আওয়ামী সরকার। এই আওয়ামী সরকার ২০১২ সালে এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইনটি বাতিল করে আরও একধাপ এগিয়ে ২৭ টি অনুচ্ছেদ যোগ করে মানি লণ্ডারিং আইনটি নতুন করে কার্যকর করা হয়। এই ২৭ টি কারণ (Cause) এ যোগ হয়, সন্ত্রাসী কার্যক্রম/ দূর্ণীতি/ মাদক ব্যবসা/ জিম্মি করে টাকা আদায় ইত্যাদি ইত্যাদি। বলাই বাহুল্য যে অ্যাক্টটি মোটাদাগে বেশ শক্তভাবেই পরিগণিত হবার কথা। তবে বর্তমানে দেশ থেকে টাকা পাচারের কথা নিত্যদিনের জাতীয় পত্রিকায় পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে বড় রকমের প্রশ্নবোধক চিহ্ন থেকেই যায় । প্রশ্ন উঠবেই কেনো তাহলে টাকা পাচার রোধ করা যাচ্ছে না ?

 

একটি তথ্য দেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিং ইন্টিগ্রিটি (Global Financing Integrity) এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর আনুমানিক ৮০ হাজার কোটি টাকা বৈদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

 

লক্ষ্যণীয় একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আছে ( কিভাবে ? সেটা আজকের আলোচনার বিষয় নয়) এবং তাদের ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থাতেই এমনটা ঘটছে। সরকার কিন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল ফাইন্যান্সিং ইন্টিগ্রিটি (Global Financing Integrity) এর তথ্যকে কখনোই চ্যালেঞ্জ করেনি। বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। ভাববার বিষয় ৮০ হাজার কোটি টাকা প্রতি বছর। এই টাকায় দেশে কত কি গড়ে উঠা সম্ভব। ভাবতেই হীম হবার জো হয়।

 

উপরেই লেখার শুরুতে সুইস ব্যাংক নিয়ে কেনো বলেছি ? এবার আসি একটু সুইস ব্যাংকের তথ্য কি বলে ? ২০২০ সালে সুইস ব্যাংকের তথ্য বলে বাংলাদেশ থেকে সুইস ব্যাংকে ৩ হাজার ৪৭ কোটি টাকা জমা করা আছে ( সুইস ব্যাংক অবশ্যই তথ্য গোপন রেখেছে/ কে বা কারা ?)। বর্তমানে সুইস ব্যাংকের তথ্য বলছে, সেই টাকার পরিমাণ ৮ হাজার ২০০ শত ৭৫ কোটি টাকা। ভাববার বিষয় ২০২০ সালের চেয়ে মাত্র ৩ বছরে দ্বিগুণের বেশি টাকা সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশ থেকে জমা পড়েছে। ভাবতেই যে কোনো বাংলাদেশী যার সামান্যতম দেশপ্রেম অবশিষ্ট আছে, তার বা তাদের শরীর শিহরিত হবার কথা নিশ্চয়ই।

 

এখানে একটু বলা প্রয়োজন আমাদের বিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী (যিনি আবার লোটাস) গত কয়েকদিন পূর্বেই সংসদে বলেছেন, তিনি অর্থপাচারকারীদের চেনেন না। এমনকি তিনি আবার উল্টো সংসদ বা বাহির থেকে তাদের পরিচয় জানতে চেয়েছেন। অথচ অর্থমন্ত্রী দেশের সামগ্রিক অর্থের দায়িত্বে নিয়োজিত। মন্ত্রী বলে কথা, সাথে লোটাস।

 

এখানে বলা ভালো যে, পৃথিবিতে এমন কোনো ব্যাংক ব্যবস্থাই নাই যেখানে মুনাফাই মূল সূত্র নয়। ব্যাংক মুনাফা করার জন্যই গড়ে উঠেছে, এটাই প্রমাণীত সত্য। সেই দিক থেকে সুইস ব্যাংক মুনাফা করুক তাতে সমস্যা নয়। সমস্যাটি ভিন্ন জায়গাতে। সুইস ব্যাংক তাদের ইতিহাসের রেকর্ড অনুযায়ী বিগত ২৫০ বছরের উপরের ব্যাংকের গোপনীয়তার চর্চা করে আসছে। সেই গোপনীয়তা দিনে দিনে কঠিন থেকেও কঠিনতর হয়েছে। ইন্টারেস্টিং বিষয় যে, পৃথিবীর বহু দেশের টাকা সুইস ব্যাংকে জমা থাকলেও অনেক টাকার কোনো মালিকানার দাবীই নাই বহু বছর যাবৎ । কত পরিমাণ সেটা ? সেই তথ্য অবশ্য সুইস ব্যাংক দেয়নি।

 

বাংলা প্রবাদ আছে, “কত ধানে কত কুড়া ?” ধানের সাথে কুড়ার একটি হিসেব আছে। সাম্প্রতিককালে সুইস ব্যাংক সেই কুড়ার ঝামেলায় পড়েছে। “বার্কেনফিল্ড ডিজক্লোজার” নামের একটি ঘটনার কথা অনেকেই হয়তো শুনে থাকবেন। ঘটনাটি ঘটেছিলো ২০০৭ সালে। বার্কেনফিল্ড মূলত ছিলেন একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নাগরিক এবং সুইস ব্যাংকের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের একজন। তিনি সুইস ব্যাংকের গোপন তথ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের কাছে ফাঁস করে দিয়েছিলেন। সেই ফাঁস করা তথ্য থেকেই সুইস ব্যাংক ঝামেলায় পড়েছে।

 

বার্কেনফিল্ডের ফাঁস করা তথ্য নিয়ে মার্কিন মুল্লুকের এফবিআই তদন্তে নামে। সেই তদন্তের ফলাফল দেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই সময়কার প্রেসিডেন্ট “বারাক ওবামা” সরকার নতুন একটি আইন করেন যা,

“Foreign Account Tax Compliance Act” যা বাংলায় পররাষ্ট্র অ্যাকাউন্ট ট্যাক্স সম্মতি আইন নামে পরিচিত। এই আইনটিতে একেবারেই সহজ ভাষায় পরিষ্কার করে বলা আছে, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো নাগরিক পৃথিবীর যে কোনো দেশের ব্যাংকেই টাকা রাখুক, সেই ব্যাংক সেই নাগরিকের ব্যাংক তথ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দিতে বাধ্য থাকিবে”।

 

এখন প্রশ্ন হতে পারে বিশ্বের ভিন্ন দেশের ব্যাংক কেনো সেই তথ্য দিতে বাধ্য হবে ? বিষয়টি একেবারেই সহজ। পৃথিবীর এমন কোনো দেশের এমন কোনো ব্যাংক নাই, যে ব্যাংকগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর সাথে লেনদেন নাই। সেটা যেভাবেই হোক। এই একটি জায়গাতেই বিশ্বের সকল দেশের ব্যাংকগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নত স্বীকার করে তথ্য দিতে বাধ্য হচ্ছে। ঠিক সেখানেই সুইস ব্যাংক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গ্যারাকলের স্বীকার এবং বর্তমানে সুইস ব্যাংক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়মিত সব তথ্য দিতে বাধ্য হচ্ছে।

 

লক্ষ্যণীয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অ্যাক্টটি বিশ্বের সকল দেশগুলোর জন্য দরজা- জানালা খুলে দিয়েছে। কিভাবে ? খুব সহজ বিষয়। পৃথিবীর সব দেশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্যবসা- বানিজ্য করে। এখানে একটু বলে রাখি, G- 20 এবং OCD দেশভুক্ত দেশগুলো তথ্য আদান- প্রদানের জন্য একটি অভিন্ন কার্যক্রম কাঠামো গড়ে তুলেছে, কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (Common Reporting Standards) নামে।

 

এই Common Reporting Standards এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে। এটার কাজ হবে Country to country ( দেশে দেশে) একে অপরের সাথে তথ্য আদান- প্রদান করা। লক্ষ্যণীয় যে, এই Common Reporting Standards এর সদস্য এশিয়া থেকে ভারত/ মালদ্বীপ এমন কি পাকিস্তানও এটার সদস্য। অথচ আমাদের বাংলাদেশ এর সদস্য নয় বা এখন অব্দি গ্রহণ করেনি।

 

এখন আসতে হয় আমাদের অর্থমন্ত্রীর বচনে, “তিনি অর্থপাচারকারীদের চেনেন না”। প্রশ্ন হলো, চিনবেন কি করে ? আমাদের সরকার থেকে বেশ অনেকবার বলা হয়েছে,” ভিন্ন দেশগুলো অর্থপাচারের তথ্য প্রদান করে না”। করবে কেনো ? তথ্য পেতে হলেতো আমাদের দেশকেও পদক্ষেপ নিতে হবে। বিনা পদক্ষেপে তথ্য আসবে কি করে ? প্রশ্নটি হলো আসলেই কি সরকার তথ্য চায় ? যদি সরকার তথ্য চায়, অর্থপাচারকারীদের আয়ত্তে আনতে চায় অথবা পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে চায়, তাহলে সরকারকে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। এটা স্পষ্ট যে বিনা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এটা সম্ভব নয়।

 

কি সেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ? লক্ষ্যণীয় যে, আমাদের দেশে সুশাসন, জনগণের নিকট তথ্য প্রদান, খেলাপি ঋণ প্রক্রিয়া বা ঋণ গ্রহণের প্রক্রিয়া ও কেলেঙ্কারি এই সবকিছুতেই প্রক্রিয়া ও কাঠামোগত অবস্থান একেবারেই শিথিল পর্যায়ের। প্রথম শর্ত হতে হবে এই শিথিলতা কমাতেই হবে। সরকারকে রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এইসব প্রক্রিয়ায় গুণগত মান বাড়াবেন কিনা ? অতঃপর Common Reporting Standards এর সদস্যপদ গ্রহণের সরকারী ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে আসতে হবে। তবেই না তথ্য পাওয়া যাবে। নতুবা কোটি কোটি টাকা খরচ করে সংসদে দাঁড়িয়ে অযথাই তথ্য দেয় না/ তথ্য পাওয়া যায় না/ অর্থপাচারকারীদের চিনি না- চিনিয়ে দেন এগুলোই বলেই যেতে হবে। কাজের কাজ হবে কাচকলা। অদ্ভুত বিষয় যে, এই সরকার কোনো এক দুরভিসন্ধি থেকে সদস্যপদ গ্রহণে কোনো আগ্রহই দেখাচ্ছে না।

 

লেখার শেষে এসে কুম্ভকর্ণের কথায় আসতেই হয়। কুম্ভকর্ণের কথা সবাই নিশ্চয়ই জানেন বা শুনেছেন। রাক্ষসরাজ রাবণের দ্বিতীয় ভ্রাতা যিনি ছয়মাস একটানা ঘুমের পর একদিন জাগ্রত হতো। নিদ্রাপ্রিয় রাক্ষস বটে। সরকারকে বলছি, দীর্ঘদিন থাবৎ আপনারাই ক্ষমতাসীন হয়ে আছেন এবং সেটা যেভাবেই হোক। যত যুক্তি- তর্ক বা কুতর্ক করুন না কেনো, মহা সত্য হচ্ছে দেশ থেকে অর্থপাচার হচ্ছে এবং সেই সংখ্যাটি নেহাত ছোটো নয়। উল্টো ভয়ঙ্করো শংকার এবং মহা বিপদির। অর্থপাচারের মাধ্যে দেশ একপ্রকার খোকলা হয়ে যাচ্ছে। এমনকি সেই অর্থপাচার কিন্ত ভিন্ন কেউ করার সুযোগ পাচ্ছে না। যা হচ্ছে আপনাদের দলের লোকেরা এবং আপনাদের দ্বারাই ঘটছে। অনেক হয়েছে, এবার কুম্ভকর্ণের ঘুম ভেঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। নতুবা সেই ঘুম ভাঙ্গবে না কিন্ত। ফলাফল আপনাদেরও বেশ ভালো জানা এবং এত রক্তের স্বাধীন দেশটিকে ভয়ানকভাবে ভুগতে হবে।

বুলবুল তালুকদার 

যুগ্ম সম্পাদক/ শুদ্ধস্বর ডটকম 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading