বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাফেটেরিয়ায় সহপাঠীদের আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। অন্যান্য বিভাগের বন্ধু ও পরিচিতজনরাও যুক্ত হচ্ছে। আলোচনার বিষয় কোন বিশেষ  বিষয়ের মধ্যে সীমিত নয়। আড্ডার বড় বৈশিষ্ট্য হলো এখানে কোন কিছুর গুরু গম্ভীর আলোচনা হয় না। যে যেমন খুশী আলোচনা করতে পারে, কোন ধরনের উপসংহার জরুরি নয়। আবার কেউ হয়তো পরিবারের নানা মুখরোচক ঘটনার কথা বলছে অর্থাৎ নানা জনের নানামুখী স্বাভাবিক আলাপ- আলোচনাই হলো আড্ডা। আজকের আড্ডার মুল কেন্দ্রবিন্দু হলো ফেসবুক।

” আচ্ছা ফেসবুক সম্পর্কে তোমারদের ধারনা কি?”প্রশ্ন নাবিলার।

“কেন বলছো” জিজ্ঞাসা জাবেদ, করিম, হীরা, মিলন, মিজান, সালমা, রুবীসহ সকলের।

“না, তেমন কিছু নয়”। জানো, রহিমের আইডি হ্যাকড হয়েছে?” উত্তর দিলো নাবিলা।

কবে? একযোগে সবার জিজ্ঞাসা।

“গত পরশু বিকালে” নাবিলা বললো।

“আমাদেরকে বলেনি কেন? তুই কিভাবে জানলি?  সকলে প্রশ্ন করলো নাবিলাকে।

“আমার কাছে গতকাল রাতে একটা মেসেজ আসলো এ ভাষায়  “আমি তোমাকে ভালবাসি। আজকের মধ্যেই আমাকে হ্যা বা না বলবে এবং কারো সাথে আলাপ- আলোচনা করবে না। এতে দুই জনেরই ক্ষতি।”

আমি তো মহা অবাক। কারণ যে ছেলে কোন মেয়ের সাথে কথা বলতে সংকোচবোধ করে, সমীহ করে তার কাছ থেকে এ জাতীয় মেসেজ আমার মনে সন্দেহ সৃষ্টি করলো।

আমি সবুর ও লিরাকে কল করি। ওরা তো আমার কথা বিশ্বাসই করছে না, মনে করছে আমি দুষ্টুমি করছি। পরে আমি সরাসরি ওকেই কল করি এবং

জানতে পারি ওর আইডি হ্যাকড হয়েছে”।

তখন এসে হাজির হলো  সালাম, বন্ধু  মহলে সবাই বলে “রোমান্টিক সালাম” । ক্ষোভ ও উত্তেজনার সাথে বললো “আমার আইডি সকালে হ্যাকড হয়েছে। তবে সেটার জন্য কোন দুঃখ নেই, কস্ট পাচ্ছি এ জন্য যে আমার অনেক মুল্যবান তথ্য ও ডেটা হারিয়ে গেলো।”

“ফেসবুক জগতে ঝামেলা হচ্ছে  হ্যাকারদের জন্য” মন্তব্য করলো আজাদ।

” তা হলে কি একাধিক আইডি ব্যবহার করবো?” জানতে চাইলো জব্বার।

“না সেটা কোন সমাধান নয়। হ্যাকিং থেকে বাঁচার উপায়গুলো রপ্ত করতে হবে যদিও ইতোমধ্যে পথ ও পন্থাও আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোও জানতে হবে। গতানুগতিক ধারায় আমরা মোবাইল, টুইট্যার, লিনকডইন, ফেসবুক ইত্যাদি ব্যবহার করছি অথচ সঠিক ব্যবহারের নিয়মগুলো

জানি না বা জানার আগ্রহও পোষণ করি না। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রী হয়েও যদি এ ধরনের অনীহায় ভুগি বা অলসতাকে প্রশ্রয় দেই তাহলে অন্যেরা কি করবে ও বলবে, একবার ভেবেছো?

এটাতো মেনে নেয়া যায় না।” বলে পকেট থেকে চুইংগাম বের করে চিবুতে লাগালো নুরল আমিন।

পাশের থেকে অপু জিজ্ঞেস করলো “আচ্ছা বলো তো আফজল কোথায়?

“কোন আফজল যিনি অধিকাংশ সময়েই ফেসবুকে ডুবে থাকে অর্থাৎ

ফেসবুক ক্রেজী আফজাল।” টিপ্পনী  কাটলো ওয়াজেদ কামাল।

“ওকে একা অপবাদ দিচ্ছো কেন?

জামিল, শফিক, আফতাব, কামাল, রেহানা,আসমা, জুবিলী এরাই বা কম কিসের?” উচ্চস্বরে ঘোষনা দিলো অরুন কুমার গোস্বামী।

হঠাৎ আসমাকে দেখে স্বপ্না চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো “ওই তো আসমা এসে গেছে। আচ্ছা আসমাকেও জিজ্ঞেস করা যায়, ওরা আসলে এতো সময় ফেসবুকে কি করে, কি আনন্দ পায়?”

আসমাকে প্রশ্ন করলে সে বললো

“সে অর্থে তেমন কিছু না। অযথা সময় কাটানো আর কি। তবে এটা এক ধরনের নেশা ও মুলতঃ সৃজনশীলহীন অধ্যায়।”

“মানে কি?” প্রশ্ন করলো ইকবাল হোসেন মোল্লা।

“দেখো, ফেসবুক মুলতঃ বুদ্ধিবৃত্তিমুলক কোন কর্মকান্ডের জগৎ নয়। সীমিত সংখ্যক ব্যক্তিত্ব জীবন, প্রকৃতি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র  ও বিশ্বকে নিয়ে ভাবে, অবদান রাখে বা রাখতে চায়। অধিকাংশ পোস্টেই হলো ব্যাক্তিতগত, পারিবারিক, সামাজিক, বৈবাহিক, চুটকি ও রম্য বিষয় ও ছবিকে ঘীরে। বিভিন্ন গুণীজনের উক্তি, সংগৃহীত তথ্য, বানীসহ ছবি ইত্যাদি। তবে কিছু কিছু পোস্ট ইতিহাস, ভুগোল, সাহিত্য, কবিতা, প্রকৌশলী ও কারিগরি বিষয় নিয়েও হয়ে থাকে।

মন্তব্য বা মতামতের বিষয়গুলো এখনো অবিকশিত,প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। মন্তব্যের ধারা ও ধরণও লক্ষণীয়। ৯৮% মন্তব্যই হলো বুঝে না বুঝে শুধু ” লাইক” – এ টিক মারা। লেখার চর্চা খুবই সীমিত। কম ও অর্ধ শিক্ষিতজনেরা “লাইক”করতে পারে কিন্ত অধিকাংশ শিক্ষিতজনেরা কেন “লাইক” করে তার কোন ব্যাখ্যা নেই”।

লেখায় মন্তব্য না করলে বুঝা যায় না আগ্রহ আছে কি নাই।  লাইক কোন মুল্যায়নমুলক মন্তব্য নয়। এটা বুঝে না বুঝেও অধিকাংশ পাঠকের এক ধরনের সুবিধাবাদী অবস্থান। কিছু সমালোচক না থাকলে কোন লেখকই লেখার গুনগত  অবস্থান  সহজে বুঝতে পারে না।সমালোচকরাই লেখক গড়তে বড় ভুমিকা পালন করে।” বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ পন্ডিতের ভাবধারায় কথাগুলো বললো আসমা।

 

দুইঃ/ ফেসবুক

মাসুদ এতক্ষণ চুপচাপ সবার কথা ও মতামত গভীর আগ্রহভরে শুনছিলো এবং স্বভাবসুলভ ধারায়  চীনা বাদাম চিবাচ্ছিলো। মৌনতা ভেঙে হঠাৎ প্রশ্ন করলো “বলতে পারবে ফেসবুক জগতের বাসিন্দাদের মধ্যে  শিক্ষিত ও অশিক্ষিতদের হার কতো?

কেন এখানে নতুন ধরনের

এক ভাষা সৃষ্টি করা হচ্ছে যার নাম বাংলা ইংরেজি বা বাংরাজী ভাষা।

কথাগুলোর গুরুত্ব মেনে নিয়ে সোরহাব মুখ খুললেন এবং পাণ্ডিত্যভাবে বললেন “হ্যা, ঠিক বলেছো, এটা নিয়ে বিদগ্ধ ও শিক্ষিত মহলে আলোচনা চলমান থাকলেও তা জোড়ালো নয়। সাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিক এবং  বাংলা ভাষা, সাহিত্য  ও কবিতা নিয়ে যারা নাড়াচাড়া করেন তাদেরই সোচ্চার ও প্রতিবাদী হতে হবে। বিষয়টা ধীরে ধীরে নতুন প্রজন্মের মাঝে একেবারে ক্যানসারের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ছে।

আমাদের মা- খালা- চাচী-মামা- চাচা- খালুদের মধ্যে  এ প্রবনতা দিন দিন বেড়েই চলছে। বুঝাতে গেলে বিরক্তির সুরে বলে অসুবিধা কোথায়, বুঝতে পারলেই তো হলো। এবার বিলকিস বুদ্ধিজীবিসুলভ ভঙ্গিতে জানতে চাইলো “আচ্ছা এটা কি শুধুমাত্র আমাদেরই সমস্যা নাকি অন্যান্য ভাষাভাষীদের ক্ষেত্রেও ঘটছে?

বিষয়টার উপযোগিতা বুঝে সাথে সাথেই ববি বলে উঠলো “ভালো একটা প্রসঙ্গ তুলে ধরেছো। হ্যা, এটা অন্যান্য ভাষার জনগোষ্ঠীর মাঝেও ব্যাপ্তি ঘটাচ্ছে বল্গাহীনভাবে।

বলা যায়, এ ধারাটা সামগ্রিকভাবে সব ভাষার উপরেই নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে চলছে।”

“আরেকটা ঘটনাও  কিন্ত নজরে পড়ার মতো” পাশ থেকে সুব্রত যোগ করলো।

সেটা আবার কি? উৎসুকভরে জিজ্ঞেস করলো খায়রুজ্জামান হীরা।

তড়িৎগতিতে সুব্রত শুরু করলো “ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে এক ধরনের মানুষ বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠায় কিন্ত তাদের পরিচয় বা প্রোফাইল লকড করা থাকে। এ ধরনের অনুরোধে  সাড়া দেয়া কি ঠিক?

এর জবাবটা আমি দিচ্ছি “এখানে দুই ধরনের যুক্তি উথাপন করা যেতে পারেঃ

এক. ফেসবুক অর্থ হলো নিজের ছবিসহ প্রোফাইল সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া। এজন্যই এ মাধ্যম কে ফেসবুক বলা হয়। অতএব, যেখানে ফেস বা ছবি নেই সেটা তো আর ফেসবুক জগতে প্রবেশ বা অবস্থান হলো না। এটা ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা জুকারবার্গসহ সকল চিন্তাবিদ ও উদ্যোগত্তাদের মৌলিক চিন্তা ও চেতনা বিরোধী।  তবে আনন্দের ব্যাপার হলো এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পোস্টে প্রতিবাদ চলমান রয়েছে।

দুই. এ অবস্থায় যদি কেউ সাড়া দেয় তবে সে ক্ষেত্রে বলারও কিছু নেই। এটা অনেকটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপারও বটে।

আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। কামরুল ও শীলা এরই মধ্যে চা ও ডাল পুড়ির অর্ডার দিয়ে রেখেছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেগুলো নিয়ে হাজির হলো আসিফ ও এমদাদ।সবাই ওদের এ মহতী আপ্যায়ণে আবেগাপ্লুত ও প্রশংসামুখর হয়ে উঠলো। বিলম্ব না করে চা ও পুড়ি খাওয়া নিয়ে সবাই মেতে উঠলো।ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের  টিএসসির এ ধরনের পরিবেশ ছাত্র- ছাত্রীদের নিকট খুবই  এক আনন্দঘণ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বলে বিশেষভাবে সমাদৃত ও আলোচিত।

এবার মুনমুন নড়েচড়ে বসে উৎকন্ঠিত হয়ে বললো “আচ্ছা আরেকটা বিষয়ও কিন্ত একেবারে হালকা নয়।

সেটা আবার  কি? জিজ্ঞেস করলো মালতি।

মুনমুন ক্ষোভের সাথে ব্যাক্ত করলো

“একজনের আইডি অবৈধভাবে আরেকজনে ব্যবহার করা যেমন অনৈতিক ও আইনবিরোধী  তেমনি মেয়েদের ছবি ব্যবহার করে কিছু কিছু লোক, বিশেষতঃ যুবক ও কিশোর বয়সের ছেলেরা, যেভাবে প্রতারনা করে যাচ্ছে সেটাও বিপদের কারণ। সত্যি বলছি, আমি নিজেও এর শিকার হয়েছি”।

স্বল্পভাষীখ্যাত মহব্বত এবার যোগ দিয়ে উচ্চারণ করলো “দেখো, নুতন কোন প্রযুক্তি আসার অর্থই হলো নেতিবাচক উপাদানও ধারন ও বহন করা। এগুলো সম্পর্কে জানা ও সতর্কতা অবলম্বনই হলো বড় নিরাপত্তা।”

“আর কতো আড্ডা মারবে। আমাদের তো ক্লাস আছে, সময়ও সমাগত বলেই” উঠে পড়লো তৌহিদ।

“তাইতো, সময় যে কিভাবে চলে যায় বুঝাই যায়না। তার উপরে যদি হয় আড্ডার আসর। আজকের মত আড্ডা এখানেই ইতি হলো। চলো যার যার শ্রেনী কক্ষের দিকে ধাবিত হই। আল্লাহ  হাফেজ” বলতে বলতে রিফাতসহ সকলে উঠে পড়লো।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading