সড়ক নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণ বিটুমিনের কোনো কারখানা নেই সংযুক্ত আরব আমিরাতে। অথচ ‘মেড ইন ইউএই’ দেখিয়ে কৌশলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস হয়ে গেল বিটুমিনের একটি জাহাজ।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞায় থাকা দেশ ইরান থেকে কেনা বিটুমিন আমিরাতের শারজাহ বন্দর এলাকায় এনে নতুন লেবেল লাগানো হয়। এরপর আরেকটি জাহাজে তুলে সেগুলো সোজা পাঠিয়ে দেওয়া হয় চট্টগ্রামের দিকে। কাস্টমস কর্মকর্তাদের চোখে ধুলো দিয়ে প্রকাশ্যে দিনের আলোয় তা খালাসও হয়ে গেল। জানা গেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে রপ্তানি হওয়া একটি বিটুমিনের জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে আসার পর তা জেটিতে ভেড়ার জন্য সুযোগ খুঁজছিল। কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্দেশে একপর্যায়ে জাহাজটিকে জব্দ করে সরকারের নৌ-বাণিজ্য দফতর। জব্দকৃত ওই জাহাজটিই কৌশলে আমদানিকারক দুটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ডিপোতে চলে যায়। এতে সংশ্লিষ্টরা বিস্ময় প্রকাশ করেন।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, বহির্নোঙর থেকে কীভাবে কর্ণফুলী নদী হয়ে আমদানিকারকের ডিপোতে জাহাজটি এসেছে কিছুই জানি না। এ ছাড়া বন্দরের কাস্টমস কমিশনার, সহকারী কমিশনার কেউই এ বিটুমিন বহনকারী জাহাজটির বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি। অথচ সরকারের জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে কঠোরভাবে বলা আছে, যথাযথ জায়গা থেকে মান পরীক্ষা সনদ ছাড়া আমদানিকৃত বিটুমিন কোনোভাবেই খালাস করা যাবে না।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চীনের পতাকাবাহী জাহাজ ‘গুয়াংজু ওয়ান’ আমিরাতের শারজাহ সংলগ্ন হামরিয়াহ বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে গত ৯ মে। জাহাজে ছিল বাংলাদেশের দুটি প্রতিষ্ঠানের মোট ১১ হাজার ২২০ টন বিটুমিন। এর মধ্যে দুটি চালানে ৬ হাজার ৭৭৩ টন বিটুমিন পিএইচপি গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বে টার্মিনাল অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের। বাকি পণ্য হচ্ছে এমইবি গ্রুপের।

জানা গেছে, মাত্র ১১ দিনের মাথায় ২০ মে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছায় ‘গুয়াংজু ওয়ান’। জাহাজটি যখন বন্দরের ডলফিন জেটিতে ভেড়ার সুযোগ খুঁজছিল, ঠিক ওই সময়ই সরকারের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আমদানির বিটুমিন কোনোভাবেই পরীক্ষা ছাড়া খালাস করা যাবে না। এর মধ্যে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গত ৯ জুন বিটুমিনের জাহাজটি জব্দ করে সরকারের নৌ-বাণিজ্য দফতর। দফতরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আদালত জাহাজটি আটকের নির্দেশ দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা জাহাজটি আটক করেছি। জাহাজটি পণ্যসহ বহির্নোঙরের ‘বি’ অ্যাংকরেজে আছে।’ কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগে গতকাল (রবিবার) সকালে জাহাজটি বহির্নোঙর থেকে সোজা চলে যায় সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ডিপোতে।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, বহির্নোঙর থেকে কীভাবে কর্ণফুলী নদী হয়ে আমদানিকারকের ডিপোতে জাহাজটি এসেছে কিছুই জানি না। তবে বিটুমিনের মান যাচাই করার দায়িত্ব কাস্টমসের। কাস্টমস বিভাগে কথা বললে বিষয়টি জানা যাবে।

কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, বিদেশ থেকে আসা বিটুমিনের মান যাচাই কিংবা পরীক্ষা করে খালাস করার বিষয়ে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়ে তিনি অবগত আছেন। কিন্তু গুয়াংজু ওয়ান জাহাজে আসা বিটুমিনের মান যাচাই ছাড়া খালাস হচ্ছে কি না তিনি জানেন না।

তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে জেটির দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (কাস্টমস) মো. তোফায়েল আহমেদ ভালো বলতে পারেন।’ পরে সহকারী কমিশনার তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বন্দরে তো অনেক জাহাজই আছে। বিএল না দেখে এখন কিছুই বলা যাবে না। সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র দেখে বিস্তারিত বলা যাবে।

এর আগে জানতে চাইলে জাহাজটির দেশীয় শিপিং এজেন্ট কসকোল বাংলাদেশের কর্ণধার রিয়াজ উদ্দিন খান বলেছিলেন, ‘জাহাজটিতে দুই আমদানিকারকের পণ্য ছিল। দুজন আমদানিকারক একসঙ্গে ডকুমেন্ট জমা দিয়ে বন্দর-কাস্টমস থেকে ছাড়পত্র নিতে পারেনি। সেজন্য জাহাজটি সঠিক সময়ে জেটিতে ভেড়ানো যায়নি।’

এদিকে, আমাদের হাতে আসে আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত বেশকিছু নথি। নথির তথ্যানুযায়ী, গুয়াংজু ওয়ান যে বিটুমিন নিয়ে এসেছে, এগুলো আমিরাত থেকে শিপিং করেছে দুটি প্রতিষ্ঠান। বে টার্মিনালের বিটুমিন শিপিংয়ের দায়িত্বে ছিল ইউনাইটেড ফিউচারিস্টিক ট্রেড ইমপেক্স (ইউএফটিআই) প্রাইভেট লিমিটেড। এমইবি গ্রুপের বিটুমিন শিপিং করেছে ভারেসকো এফজেডই নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে কয়েকটি সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ দুটি প্রতিষ্ঠান মূলত বিটুমিনের প্যাকেজিং করে থাকে। গ্রাহকের চাহিদা অনুসারে তারা বাল্কে অথবা ড্রামে প্যাকেজিং শেষ করে তা শিপিংয়ের ব্যবস্থা করে। কার্যত ইরান থেকে বিটুমিন কেনার পর সেগুলো সরাসরি অন্য কোনো দেশে রপ্তানি করা যায় না। তাই ইরান থেকে আগে বিটুমিনের চালান আসে আমিরাতে। এখানকার কয়েকটি এলাকায় ডিপোতে নামানোর পর পণ্যগুলো পুনঃরপ্তানির তৎপরতা শুরু হয়।

অন্যদিকে একটি নথির তথ্য অনুযায়ী, একটি চালানে বে টার্মিনালের ৪ হাজার ২৭২ টন বিটুমিনের মোট ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে ১৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৭৯ মার্কিন ডলার। সে হিসেবে টনপ্রতি বিটুমিনের মূল্য দাঁড়ায় ৪২০ ডলার। এ ছাড়া বিটুমিনের মান উল্লেখ করা হয়েছে ৬০-৭০ গ্রেড। উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে উল্লেখ রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কথা। কিন্তু সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশ কনস্যুলেট সূত্রে জানা গেছে, দেশটি বিটুমিন উৎপাদনই করে না। সেখানে কোনো কারখানাও নেই। মূলত পার্শ¦বর্তী দেশ ইরান থেকে বিটুমিনের চালান সে দেশে ঢোকার পর সেগুলো রিফাইন হয়। তারপর তা বিভিন্ন দেশে পুনরায় রপ্তানির প্রক্রিয়া শুরু হয়। কনস্যুলেট সূত্র জানায়, আবুধাবি, হামরিয়াহ উন্মুক্ত জোন, ফুজাইরাহ এবং আজমানে রিফিলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইউএই থেকে বিটুমিন বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়।

দুবাইভিত্তিক বিটুমিন রপ্তানিকারক একাধিক প্রতিষ্ঠান এবং ইরানের একটি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, ইউএই থেকে বাংলাদেশে আসা আমদানির সব বিটুমিনের একমাত্র উৎপাদনকারী দেশ হলো ইরান। আর সে দেশে উৎপাদিত বিটুমিনের গ্রেড ৮০-১০০। যার টনপ্রতি মূল্য সর্বোচ্চ ২৪০ ডলার। অথচ বে টার্মিনালের নথিতে এটিকে ৬০-৭০ গ্রেড উল্লেখ করে মূল্য দেখানো হয়েছে টনপ্রতি ৪২০ ডলার। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, ইরানের বিটুমিনকে আমিরাতের নাম দিয়ে খালাস করাই শুধু নয়, বিটুমিন আমদানির আড়ালে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে নীরবে অর্থ পাচারও করা হচ্ছে।

এর আগে বছরের পর বছর ধরে মানহীন ভেজাল বিটুমিন আমদানি হয়ে আসলেও মান নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ ছিল না। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ মনির হোসেন হাওলাদার স্বাক্ষরিত একটি আদেশে উল্লেখ করা হয়, আমদানি ও রপ্তানি (নিয়ন্ত্রণ) আইনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আমদানি নীতি আদেশ-২০১৫-২০১৮-এর এই সংশোধন করেছে সরকার। ওই আদেশে বলা হয়, পেট্রোলিয়াম কোক ও পেট্রোলিয়াম বিটুমিন ছাড়া পেট্রোলিয়াম তেলের রেসিডিউসমূহসহ সব পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ; তবে পেট্রোলিয়াম বিটুমিন আমদানির ক্ষেত্রে এইচএস কোড নম্বর ২৭১৩.২০.১০ ও ২৭১৩.২০৯০-এর পণ্য খালাসের আগে এর গুণগত মান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড থেকে পরীক্ষা করাতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মান পরীক্ষার বাধ্যবাধকতায় পড়ে কৌশলে উচ্চ আদালতে মামলা ঠুকে পার পেয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজছিল আমদানিকারক দুটি প্রতিষ্ঠান। আদালতের নির্দেশে জাহাজটি জব্দ করা হলেও কৌশলে তা ছাড়িয়ে নিজেদের ডিপোতে নিয়ে যায় প্রতিষ্ঠান দুটি। ফলে বিটুমিনের মান নিয়ন্ত্রণের সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষিতই রয়ে গেল।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading