১৯৭১ সালের এই দিনে (২৩মে) মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লোহাগড়া উপজেলার পূর্বাঞ্চলের ইতনা গ্রামে গণহত্যা চালায় ও একের পর এক ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা ইতনা স্কুলে প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলে ও সেখানে স্থানীয় যুবকরা সেখানে প্রশিক্ষণ গ্রহন করে। ১৯৭১ সালে এই গ্রামে প্রায় ১২ হাজার মানুষ বসবাস করতো। ১৯৭১ সালে ভাটিয়াপাড়ার ওয়্যারলেস স্টেশনকে কেন্দ্র করে ভাটিয়াপাড়া বাজারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী একটি শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে। গ্রামের স্বাধীনতাবিরোধীদের সাথে এই ঘাঁটির সৈন্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে ওঠে। তারা ইতনা স্কুলে স্থাপিত প্রশিক্ষণকেন্দ্রের খবর পাকিস্তানিদের কাছে পৌঁছে দেয়। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাই ইতনা গ্রামে আক্রমণ চালানোর জন্য প্রস্তুত হয়।
একাত্তরের ১৫ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রথম ইতনা গ্রামে অভিযান চালায়। তারা মধুমতি নদী দিয়ে লঞ্চযোগে ইতনা গ্রামে পৌঁছায়। পরে প্রথমে তারা ইতনা গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় আক্রমণ করে। বিশেষ করে গ্রামের বিভিন্ন হিন্দু বাড়িগুলো খুঁজে তাতে অগ্নিসংযোগ করে। সুশীল সেনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের সময় তারা ওই বাড়ির অতুল পালকে খড়ের গাদার মধ্যে নিক্ষেপ করে অগ্নিসংযোগ করে। পেনু ঘোষকেও হত্যা করে পাকবাহিনী।
সেদিন পাক সৈন্যরা এই গ্রামের আরো ২ জনকে হত্যা করে। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা সিকদার হেমায়েতুল ইসলাম ধলু। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করছিলেন। আজিজুর রহমান কোরেশী ইতনা পশ্চিমপাড়া মসজিদের ইমাম ছিলেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন কোরেশীর বাড়িতে আসে তখন হেমায়েত সেখানে লুকিয়ে ছিলেন। সৈন্যরা সেখান থেকে তাকে বের করে সিঁড়ির ওপর থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। তিনি যখন ‘লা ইলাহা ’ পড়ছিলেন ঠিক তখনই পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে গুলি করে হত্যা করে।
ইতোমধ্যে একজন পাকিস্তানি সৈন্য এসে হিন্দুপাড়ার সংবাদ দেয়ার পর অন্যান্য সৈন্যরা সেদিকে রওনা দেয়। তারা হিন্দুপাড়ার প্রায় প্রতিটি ঘরেই আগুন ধরিয়ে দেয় । অল্প সময়ের মধ্যেই গ্রাামটি জনশূন্য হয়ে পড়ে। সন্ধ্যা নেমে এলে, পাকিস্তানি সৈন্যরা সেদিনের মতো তাদের অপারেশন শেষ করে ফিরে যায় ভাটিয়াপাড়ায়। যাওয়ার আগে তারা বারইপাড়াতে কাজী সিরাজুল হকের বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করে। সেদিনের অপারেশনে প্রায় ৫০ জন পাকিস্তানি সৈন্য অংশ নেয়।
এর কিছুদিন পর ১৯৭১ সালের ২২ মে আবার পাকসেনারা ভাটিয়াপাড়া গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম চর ভাটপাড়ার একটি হিন্দুপাড়ায় অভিযান চালায়। অভিযানের এক পর্যায়ে এক পাক সৈন্যের সঙ্গে অনিল কাপালির হাতাহাতি হয়। সাহসী অনিল কাপালি হঠাৎ সেই সৈন্যের রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে মধুমতি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অনিল কাপালির এই দুর্র্ধষতায় পাকিস্তানি সৈন্যরা অপমানিত বোধ করে এবং ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তারা চর ভাটপাড়ার প্রতিটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। আত্মরক্ষার জন্য কয়েকজন গ্রামবাসী পাক সেনাদের জানান, অনিল কাপালির বাড়ি পার্শ্ববর্তী ইতনা গ্রামে। এরই ধারাবাহিকতায় পরদিন ২৩ মে ভোরে সেখানে উপস্থিত হয় পাক সৈন্যরা। তারা ৫টি লঞ্চ বোঝাই সৈন্য নিয়ে পুরো গ্রামটি ঘিরে ফেলেই ব্যাপক গণহত্যা শুরু করে। তারা ইতনা মধ্যপাড়াতে সিকদার হাবিবুর রহমান, সিকদার ওয়ালিয়ার রহমান, সিকদার হাদিয়ার রহমান ও রাশেদ গাজিকে একসঙ্গে হত্যা করা হয়। ইতনা দক্ষিণপাড়াতে নবাব আলীর চার সহোদরকে ও ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসার আবদুস সাত্তার মিনারের দুই সহোদরকেও হত্যা করে পাকসেনারা। ইতনা স্কুলের শিক্ষক হিরু মিয়াও তাদেও হত্যার শিকার হন। গ্রামে গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগ শেষে ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হিরু মিয়াকে কাতরাতে দেখে আবার গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। তা ছাড়া তারা কানাই স্বর্ণকারকে গুলি করে হত্যা করে। পাকসেনারা ইতনার দক্ষিণপাড়াতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ হত্যা করে । মাত্র আধঘন্টায় তারা ৩৯ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে এবং বহু ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
অল্প সময়ের মধ্যে ইতনা গ্রামটি রক্তের বন্যায় ভেসে যায়। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। যারা ঝোপজঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন তারাই কেবল বেঁচে যান। গণহত্যা শেষে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের ছাউনিতে ফিরে যায়।
পওে শহীদদের আত্মীয়স্বজনরা দ্রæত তাদের সমাহিত করেন। শহীদদের সমাহিত করার পর গ্রামবাসীরা প্রাণভয়ে নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যান। সেদিনের গণহত্যার পর ইতনা গ্রামের কিশোর ও যুবকদের একটি বড়ো দল মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে চলে যান।
তারপরেও ইতনা গ্রামে পাক বাহিনীর ৮ জন গ্রামবাসীকে তারা হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইতনা গ্রামের ৫০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে পাকিস্তানবাহিনী হত্যা করে।
১৯৭১ সালে এদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা যে গণহত্যা চালিয়েছিল, তা ইতিহাসের নির্মম ঘটনা । সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অসংখ্য নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড ঘটেছে যা দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধকেও হার মানায়। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাঙালীর স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা যাদের হারিয়েছি তাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।
তথ্যসুত্র- মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
কাজী সালমা সুলতানা লেখক এবং গণমাধ্যম কর্মী ।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading