দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি শুধু বাজারকে অস্থির করে তুলেছে তাই নয়, সাধারণ মানুষের জীবনের স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে। সরকারি হিসাবেই দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের আশপাশেই। মানুষের আয় বেড়েছে নাকি ৫ শতাংশ তাহলে মূল্যস্ফীতি ও আয় বৃদ্ধির বিবেচনায় দেখা যায় মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। এটা তো হলো যাদের কাজ বা চাকরি আছে তাদের কথা। যাদের চাকরি নেই বা যারা চাকরি খুঁজছেন তাদের অবস্থা তো আরও দুর্বিষহ। বিনিয়োগ সম্পর্কে যে রকম ধারণা করা হয়েছিল সে অনুযায়ী বিনিয়োগ না বাড়ায় কর্মসংস্থান তেমন বাড়েনি। যাদের চাকরি আছে তাদের আয় বাড়েনি আর যারা কাজ খুঁজছে তারা কাজ পায়নি, ফলে বেকারত্ব আর আয় স্বল্পতা মিলে সার্বিকভাবে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা গিয়েছে কমে। যার প্রভাব জীবনযাপন ও অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে।

রিজার্ভ কমেছে দ্রুতগতিতে, আমদানি কমিয়েও তা সামাল দেওয়া যায়নি। রপ্তানি বাড়লেও ডলারের তুলনায় টাকার অবমূল্যায়ন এক জটিল পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। গার্মেন্টস আর প্রবাসী আয়ের ওপর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নির্ভরশীল। কিন্তু গার্মেন্টসের রপ্তানি আয় পুরোটা দেশে আসে না আর প্রবাসী আয়ের একটা বড় অংশ হুন্ডিতে লেনদেন হয়। বিদেশে টাকা পাচার বহুল প্রচারিত কিন্তু তা রোধ করার কার্যকর পদক্ষেপ নেই। ব্যাংক খাতে তীব্র তারল্য সংকট। চাহিদা অনুযায়ী টাকার জোগান দিতে পারছে না তারা। ডলার সংকটের পাশাপাশি টাকার সংকট বাড়ছে, ফলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। কারণ চলতি অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার কথা ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা, কিন্তু গত জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঋণ নিয়েছে ২৪ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার ৫ ভাগের এক ভাগ মাত্র। একই সময়ে নন ব্যাংক খাত যেমন সঞ্চয়পত্র, ট্রেজারি বিল ও ট্রেজারি বন্ড বিক্রি থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৩ হাজার কোটি টাকা কিন্তু জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিয়েছে ১১ হাজার ২০৭ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক। ব্যাংক, নন ব্যাংক খাত থেকে সর্বমোট ঋণ নেওয়ার কথা ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা কিন্তু ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঋণ নিয়েছে ৩৬ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার ৪ ভাগের এক ভাগ মাত্র। আর বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ, কিন্তু অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ১১ শতাংশ। তাহলে সরকারি ও বেসরকারি খাতে লক্ষ্যমাত্রার চাইতে ঋণ কম নিলেও ব্যাংক খাত তারল্য সংকটে ভুগছে কেন? ব্যাংকে টাকা নেই কেন?

এ ধরনের সংকট ও সংশয়ের মধ্যে সরকার ডলারের নতুন ব্যবস্থা ‘ক্রলিং পেগ’ চালু করে ১১৭ টাকা মধ্যবর্তী দর নির্ধারণ করেছে। ফলে সরকারিভাবেই এখন প্রতি ডলারে পাঁচ টাকা বেড়েছে। আর আমদানিকারকদের কিনতে হচ্ছে ১১৯ থেকে ১২০ টাকায়। এর প্রভাব কোথায় পড়বে না? বেসরকারি খাতের ঋণের সামান্যই ভোক্তাঋণ। বেশিরভাগ ঋণ নেন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। সুদহার ও ডলারের দর বাড়লে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বাড়বে, যার প্রভাব সরাসরি পড়বে পণ্যমূল্যে। বাজার তদারকিতে দুর্বলতার কারণে পণ্যমূল্য যতটুকু বাড়ার কথা, তার চেয়ে বেশি বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সাধারণ মানুষ তাই কোনোমতে টিকে থাকার সংগ্রাম করছেন। ফলে সুদহার বাড়িয়ে চাহিদা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন ছিল না। বরং ডলার দরে অস্থিরতা ও সুদহার বৃদ্ধির কারণে নতুন বিনিয়োগ কমে গিয়ে কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়বে। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বলছেন, ডলারের সরবরাহ বাড়াতে রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে হবে। একই সঙ্গে হুন্ডি কমিয়ে রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। অর্থ পাচারে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে যারা রেমিট্যান্স পাঠায়, তারা উৎসাহিত হতো আর অর্থ পাচার বন্ধ হলে ডলার বাজার স্থিতিশীল হতো।

দেশ থেকে এলসিসহ বিভিন্ন উপায়ে ডলার বাইরে চলে যাচ্ছে। এ রকম চললে ডলার পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। আর ডলারের দর বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই মূল্যস্ফীতি বাড়বে। বিলাসী পণ্য আমদানি যদি ছয় মাস বন্ধ থাকে, তাতে দেশের তেমন ক্ষতি নেই। আমদানি নিয়ন্ত্রণের এত কথা বলার পরও তো রোলস রয়েস গাড়ির বা এসইউভি গাড়ি পণ্য আমদানি কমছে না। পরিস্থিতির যদি উন্নতি করতে হয় তাহলে অর্থ পাচার, বেনামি ও ভুয়া ঋণ বন্ধ করতে হবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা সংস্কার করে শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছে আর আমাদের মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। ফলে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সুদহার বৃদ্ধিই একমাত্র পন্থা নয়। আরও অনেক বিষয় রয়েছে। সেদিকেও নজর দিতে হবে। অর্থনীতি সংক্রান্ত যে কোনো আলোচনা এলেই করোনা এবং রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা ক্ষমতাসীন দলের নেতারা উল্লেখ করেন। কিন্তু এক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর পদক্ষেপ কি নজরে আনা উচিত নয়? বিশে^র বেশিরভাগ দেশ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরই সুদহার বাড়িয়েছিল। একই সঙ্গে আবার নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বিভিন্ন ভর্তুকি দিয়েছে। আর বাংলাদেশে ঘটেছে ঠিক উল্টো। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশে সীমিত রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। করোনার সময় রিজার্ভ বেড়েছিল মূলত রপ্তানি আয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধি, হুন্ডি প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। কিন্তু ২০২১ সালের আগস্টের ৪৮ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন নেমে এসেছে ১৩ বিলিয়ন ডলারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তাৎক্ষণিক নানা সিদ্ধান্তেও রিজার্ভের পতন ঠেকানো যায়নি। ঋণখেলাপিদের নিয়ে এত কথার পরও ২০২০ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ, ২০২১ সালে মাত্র ১৫ শতাংশ এবং পরের দুই বছর অর্ধেক দিলে তিনি আর খেলাপি বিবেচিত হবেন না আর সর্বশেষ ২০২২ সালে ঋণ পুনঃতফশিলের নীতিমালা ব্যাপকভাবে শিথিল করা হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে কখনো বিশেষ ব্যবস্থায় ঋণ পুনঃতফশিল, কখনো ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১২ বছরের জন্য নিয়মিত করা এবং কখনো ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছে। ২০১৯ সালে এক নির্দেশনার মাধ্যমে মেয়াদি ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ করার সময় এক বছর বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এভাবে ঋণ পরিশোধ না করার একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। যে কারণে ঋণ আদায় হচ্ছে না বরং গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। আর অনাদায়ী, নানা উপায়ে নিয়মিত দেখানো হচ্ছে এমন ঋণের পরিমাণ সাড়ে ৫ লাখ কোটি ছাড়িয়ে গেছে বলে অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন।

বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির একটা বড় কারণ কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতি, এমনকি খাদ্যপণ্যের বড় অংশ আমদানি করতে হয়। ফলে ডলারের দর ও সুদহার বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই মূল্যস্ফীতি বাড়ে। ডলারের দর দীর্ঘদিন ধরে ৮৪ টাকায় আটকে রাখার পর এক লাফে ১১০ টাকায় উঠে আর এখন আরও বেড়ে আনুষ্ঠানিক দর ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা। এই সিদ্ধান্তের কারণে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। ব্যাংকগুলোকে খারাপ অবস্থায় নিয়ে এলো কারা? তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ জনমনে উদ্বেগ তৈরি করেছে। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং নীতি-উপদেষ্টা গত মার্চ ও এপ্রিলে একে একে ১০ ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডিকে গোপনে ডেকে কে কার সঙ্গে একীভূত হতে হবে, তা ঠিক করে দেন। এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংকগুলোতে চরম অসন্তোষ দেখা দেয় আর আমানতকারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। ফলে অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন বলে জানা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ গত ১১ এপ্রিল ব্যাংকের বাইরে কী পরিমাণ টাকা আছে, তার হিসাব প্রকাশ করেছে। সেই হিসেবে দেখা যাচ্ছে, বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ দ্রুত বেড়ে গত ১১ এপ্রিল ৩ লাখ ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকায় ঠেকেছে। গত মার্চ শেষে যা ২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা ছিল। গত ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা। গত ঈদের পর টাকা তোলার প্রবণতা আরও বেড়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা তোলার চাপের কারণে চরম তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। শুধু বেসিক ব্যাংক থেকেই আমানতকারীরা আড়াই হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। টাকা চলে যাচ্ছে মানুষের হাতে। নির্বাচনকে টাকার খেলা বানিয়ে ফেলায় সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতেও টাকা ঘুরছে কিছু মানুষের হাতে।

ডলার সংকট, ডলারের দাম, দ্রব্যমূল্য, মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থানের অভাব, ব্যাংকে তারল্য সংকট, টাকা পাচার বা ডলার পাচার, বিদেশি ঋণের কিস্তি শোধ, দেউলিয়া ব্যাংকের দায় ইত্যাদি নিয়ে যে সংকট তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আইএমএফের পরামর্শসহ নানা চাপ। তাদের চাপেই বাড়ানো হয়েছে ডলারের দর, বেড়েছে সুদহার। নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে আমদানি। ভর্তুকি কমানোর জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে এবং আরও বাড়ানো হবে। এটা তো জানা কথা, এর ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। কিন্তু মানুষের আয় বাড়ানো ও কর্মসংস্থানের উদ্যোগ তো চোখে পড়ছে না। জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কারণে এখন কাউকে দরিদ্র বলার উপায় নেই। মাথাপিছু আয় মানে শিশু, বেকার, বৃদ্ধ সবাইকে ধরেই এই আয়। ২৭৮৪ ডলার মাথাপিছু আয় মানে প্রত্যেকের বছরে আয় গড়ে সোয়া ৩ লাখ টাকা। ফলে দেশে দরিদ্র নেই আছে নিম্ন আয়, স্বল্প আয়, সীমিত আয়ের মানুষ। মূল্যস্ফীতির আঘাতে এই মানুষদের টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়বে। এ থেকে বাঁচানোর নামে অর্থনীতির যে চিকিৎসা হচ্ছে, তাতে রোগ আরও বেড়েই যাচ্ছে।

রাজেকুজ্জামান রতন

রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক ।

Leave a ReplyCancel reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading