জলের শ্যাওলা- 

ঢাকার জ্যাম নিয়ে লিখতে গিয়েই ঝামেলা বাঁধলো কেননা বুঝেই আসছে না, কোথা থেকে শুরু করবো এবং কোথায় গিয়ে শেষ করবো ? ঢাকার জ্যাম নিয়ে সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, দিনে একটির বেশি দুটি কাজ করা মুশকিল এবং যে বা যারা দুটি কাজ করতে সক্ষম হন, উনারা সত্যিই ধৈর্যশীল, এ কথা জোর গলায় বলাই যায়।

 

ঢাকার জ্যাম নিয়ে বলার আগে গাও- গ্রামের একটি সমস্যার কথা বলা প্রয়োজন (এবার নিজের চোখে দেখে এসেছি)। অনেকেই হয়তো ভাবছেন, ঢাকার জ্যামের সাথে গাও- গ্রামের সমস্যার কি সম্পর্ক ? হ্যা আছে এবং বেশ ভালোভাবেই সেটা আছে।

 

এবার যখন আমার বাপ- দাদার (এখন আমরা/ আমাদের পরিচয়) গাও- গ্রামে গেলাম, তখন চলছিলো সরিষা ফসল তোলার সময়। অনেকের উঠানেই সরিষার মলন হচ্ছিলো, রোদে শুকানো হচ্ছিলো, ইত্যাদি ইত্যাদি।

 

কথায় কথায় জানলাম, গ্রামে পূর্বের সময়ে (মোটামুটি এক যুগ পূর্বে) ফসল লাগানো, ফসলের যত্ন নেওয়া (nursing), ফসল কাটা, ঘরে তুলে আনা এবং সেই ফসলকে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তৈরি করা ও বাজারজাত করার জন্য যে জমিতে মোটাদাগে ১০ জন শ্রমিক (রাখাল- কামলা) লাগতো, সেই জমিতেই বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে ১০ জনের জায়গায় ২ জন শ্রমিক হলেই যথেষ্ট। খরচ মোটামুটি সমান থাকে বা বাজারের সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে কিছুটা এদিক- সেদিক হয়।

 

শুনতে মনে হচ্ছে তাহলে বিশাল বিপ্লব হয়েছে। আসলে বিপ্লব হলেও সুবিধের কিছুই হয়নি উল্টো কৃষকেরা পরেছে বিপদে। কেনো বিপদে ?

কারণটি হলো গাও- গ্রামে সেই দুইজন শ্রমিকও পাওয়া যায় না বা অবশিষ্ট নেই। অবশিষ্ট নেই বলছি কারণ গ্রামে কাজের কোনো মানুষই নেই। সবাই দেশের কোনো না কোনো শহরে। ফলাফল খেত- খামারের মালিকরা ফসল চাষে বিপদে আছে এবং আগ্রহ বেশ হারিয়ে ফেলছে, শ্রমিকের অভাবেই। কেননা ফসল ফলানোতো আর সহজ বিষয় নয়, বিনা শ্রমিকে যে আরও অসম্ভব।

 

এমনকি বেশি পয়সা দিয়েও সেই দুইজন শ্রমিক জোগাড় করা মুশকিল। গ্রামের অবশিষ্ঠ থাকা সেই দুইজন শ্রমিক কত জায়গাতেই আর শ্রম দেবে? সেটাতো সম্ভব নয়। ফলে ফসল ফলানোতে বড় সমস্যা চলছে। আমি নিজেই দেখেছি অনেক জমি শুনশান পরে আছে। ফসল ফলানো হচ্ছে না। যে সকল জমিতে ফসল ফলানো একটু বেশি কষ্টের সেগুলোতো ভাবনার বাহিরেই চলে যাচ্ছে।

 

এখন আসি মূল আলোচনায, ঢাকার জ্যাম। না, ঢাকার জ্যামের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখবো না কারণ সেই সব ঘটনা এক এক করে লিখতে গেলে মোটা একটি বই লিখতে হবে। আমি মূলত যা লিখতে চাচ্ছি, সেটা হলো জ্যামের মূল কারণ, জ্যাম কমানোর উপসর্গ কি হতে পারে? সেদিকেই বেশি নজর দেবো।

 

লক্ষ্যণীয় যে, এই সরকার মৃলত সমগ্র বাংলাদেশেই বড় বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সেখানে ঢাকাতেও চলছে রাস্তা- ঘাট সহ নানান প্রকল্প। প্রথমেই স্পষ্ট করে বলছি এগুলো ভালো এবং আজ বা কাল প্রয়োজন হবেই হবে। সেটা নিয়ে প্রশ্ন নেই।

 

ঢাকায় মেট্রোরেল হয়েছে (সম্পূর্ণ কাজ শেষ হয়নি), কত কত ওভারব্রীজ, অন্যদিকে পদ্মাসেতু সহ দেশে অনেক বড় বড় সেতু হয়েছে, চারিদিকে চার লেন রাস্তা হচ্ছে, সাম্প্রতিককালে ঢাকায় Underground Rail (পাতাল রেল) প্রকল্প হাতে নিয়েছে, সবই ঠিক আছে। তবে এত কিছুর পরেও বেশ স্পষ্ট যে ঢাকার জ্যাম কমছে না এবং ভবিষ্যতেও কমবে না। উল্টো জ্যাম আরও বাড়বে (এটা লিখে রাখতে পারেন)।

 

তাহলে এই জ্যাম কমানো উপায় কি ? উপায় শত বলেও লাভ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হবে। হ্যা শত ভাবনা আমরা সবাই মুখে মুখে বলতে পারি, এটা কর- ওটা কর, ইত্যাদি। কাজ তখনই হবে যখন সঠিক পথে এগুনো যাবে।

 

ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ (Decentralization) করার কথা আমরা প্রায়শই শুনি তবে কাজের কাজ কিছুই দেখি না। হ্যা এটা তো মৌলিক ও প্রাথমিক কাজ হবার কথা জ্যাম কমানোর জন্য। আমার বুঝে আসে না, বন বিভাগ- মৎস বিভাগ, কৃষি বিভাগ এমন অনেক বিভাগ আছে যা ঢাকা শহরে বসে থাকার কি আছে ? এগুলো অবশ্য অনেক পুরানো কথা। অনেক আলোচনা আছে তবে কাজের কাজ কিছুই হয় না।

 

বিকেন্দ্রীকরণ সেটাতো অনেক বড় আলোচনা। সেটা বাদ দিয়েই একান্তই ছোটোখাটো কিছু বিষয়ে কাজ না করলেই নয়, জ্যাম কমাতে। সেগুলোই বলি।

 

শত- হাজার রাস্তা, ওভারব্রীজ, সুপার elevate উন্নত করে, গড়েও কোনো কাজে আসবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত ঢাকার ফুটপাত খালি করা না হবে। ঢাকার ঐতিহ্য ধরে রেখে রিক্সাগুলোকে কেবলমাত্র গলির ভিতরে চলার ব্যবস্থা করাও হবে জরুরী, মূল রাস্তায় রিক্সার অনুমতি দিয়ে কোনদিনই জ্যাম কমবে না। স্কুটার/ সিএনজি এগুলো ট্যোটাললি ঢাকায় ব্যাণ্ড করতেই হবে। অতঃপর বড় কাজটি হতে হবে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বিশেষ করে বাসগুলোকে একটি কোম্পানির আওতাভুক্ত করা। এটা নিয়েও অনেক আলোচনা হয়েই আসছে তবে কাজে শূণ্য। পাশাপাশি হোণ্ডা/ বাইক এগুলোর জন্য সর্বত্রই মাত্র একটি লেন নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে ফরজে হালাল।

 

হ্যা প্রশ্ন উঠবে তাহলে রিক্সা- সিএনজি- স্কুটার এবং ফুটপাতের হকারদের আয়- রোজগারের কি হবে ? ঠিক সেটাই পরিষ্কার করতে লেখার প্রথমেই গাও গ্রামের শ্রমিক সমস্যার কথা উল্লেখ করেছি। মূলত গাও- গ্রামে শ্রমিকদের ভালো রোজগারের ব্যবস্থা করাটা অতীব জরুরী। সেটা হতে পারে, কৃষি পণ্যের বাজার গাও- গ্রামে সঠিক নির্ধারণ করা। আর্থাৎ গ্রামেই যেনো কৃষি পণ্যের দাম উৎপাদনের চেয়েও ভালো বা দ্বিগুণ তিনগুণ মূল্য পায় কৃষক।

 

তাহলেই উৎপাদনকারী শ্রমিকদের শ্রমের মূল্য বেশি দিতে পারবে এবং শ্রমিকরাও উৎসাহীত হয়ে নিজ থেকেই দেশের শহরগুলো ছেড়ে গ্রামের মুখে পুনরায় ধাবিত হবেই হবে। মনে রাখতে হবে বর্তমান দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি ও সহজ হয়েছে। এই যোগাযোগ ব্যবস্থকে সর্বোচ্চ কাজে লাগাতেই হবে। কেননা গ্রামে শত টাকা খরচ করে যে জীবন উপভোগ করবে শ্রমিকেরা, সেই জীবনের চেয়েও নিম্নমানের বস্তি জীবন ঢাকায় তিনগুণ বেশি মূল্য কিন্ত।

 

ইদানিংতো শুধুমাত্র কৃষি নয়, বিভিন্ন রকমে গরু- ছাগল- হাস- মুরগি- মাছের খামার হচ্ছে। কাজ অনেক আছে তবে শ্রমিক নেই। সেই সব বিষয়গুলোকে একটু নজরদারীতে আনলেই এবং একটু শ্রমিক বান্ধব হলেই শ্রমিকেরা শহর ছেড়ে গ্রামেই ছুটবৈ। লক্ষ্যণীয় যে, গার্মেন্টস শিল্পের কারণে আজকাল ঢাকা শহরে তথাকথিত কাজের বুয়া পাওয়া অনেকটা লটারির মতন। সুতরাং গ্রামে যদি কৃষি সহ সব খামারের প্রভাব বাড়ে এবং শ্রমিকদের রোজগারে একটু বেশি নজর সরকার প্রদান করে, তাহলে কম পয়সায় দেশের নানান শহর সহ ঢাকার জ্যামেরও মৃত্যুঘন্টা বাজবেই।

 

চ্যালেঞ্জ করেই বলতে পারি, উপরে লিখিত বিষয়গুলোর বাহিরে দেশের কোনো শহর এবং ঢাকার জ্যাম কমবে না এবং কখনোই কমবে না। সরকারকে ভাবতেই হবে, শুধুমাত্র বড় বড় প্রকল্প করে জ্যাম শেষতো হবেই না, মানুষ আরও ঢাকামুখি হবে। এভাবে চলতে থাকলে ঢাকা একদিন collapse (পতন) করবেই করবে।

 

বর্তমানেই ঢাকার যে জ্যাম, শব্দ দূষণ এবং বায়ু দূষণ আছে, এই শহর নিয়ে আরও খামখেয়ালি করলে আগামীর যে কোনদিন ঢাকা হবে এই রাষ্ট্রের গলার ফাঁস। এখনই কিন্ত ফাঁস একপ্রকার ফেঁসেই আছে।

বুলবুল তালুকদার 

যুগ্ম সম্পাদক- শুদ্ধস্বর ডটকম 

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading