তখন ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ি। ডিসেম্বর মাস। রাজশাহীতে প্রচন্ড শীত পড়েছিল। ডিসেম্বর মাসের শেষের দিক হওয়ার কারণে হোস্টেল ছুটি ছিল। সবাই বাড়িতে গেলেও প্রত্যেক ছুটির সময়ের মতোন সেবারও হোস্টেলেই ছিলাম। মানে ছুটির সময় হোস্টেলে থাকতাম আবার যখন ক্লাস শুরু হতো তখন ক্লাস বাদ দিয়ে বাড়িতে যেতাম। তো সেইবার হোস্টেলে বসে বসে মজা করছি। স্বাধীন মতোন ঘুরছি পুরো শহর। বেশ মজার সময় কাটছিল। সেদিন ছিল মাসের ৩১ তারিখ। আমার জন্মদিন। আমি জন্মদিন কখনো মনে রাখতে পারি না। আর সেভাবে পালনও করতাম না কখনো। তো সেবারও বরাবরের মতোন জন্মদিনের কথা ভুলে বসে আছি। তখন তো আর ইন্টারনেট এত সহজলভ্য ছিল না যে জন্মদিনের কথা মনে করতে বাধ্য হবে। তখন সম্ভবত নোকিয়া ১২১০ মডেলের একটা ফোন ব্যবহার করতাম। সকাল বেলা ঘুমোচ্ছি হঠাৎ ফোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। ফোন চোখের সামনে নিতেই দেখি পূজার নাম্বার। ফোন রিসিভ করতেই বলল,তাড়াতাড়ি পদ্মার ধারে আয়। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে পদ্মার পাড়ে যেতেই দেখি ওমা! সে কি এলাহী কান্ড!!! বিশাল একটা কেক আর অনেকগুলো ছিন্নমূল শিশুদের নিয়ে অপেক্ষা করছে পূজা। অনেক মজা করে কেক কেটে জন্মদিন পালন করে সারাদিন পূজার সাথে ঘুরে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরবার সময় পূজার দেয়া গিফ্ট গুলো নিয়ে যেতে এক্সট্রা একটা রিকশা ভাড়া করতে হয়েছিল। ফেরার সময় পূজা বলেছিল,সামনের বছর অনেক বড় করে তোর জন্মদিন পালন করব। কিন্তু পূজার সাথে আমার আর কোন জন্মদিন পালন করা হয়নি!! তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। আমার আর ঘটা করে জন্মদিন পালন করা হয়নি। সেবার ২০১৪ সাল। ডিসেম্বর মাস যথারীতি প্রচন্ড শীত। সেই সাথে বিরোধী দলের প্রচন্ড আন্দোলনে স্থবির রাজধানী শহর ঢাকা। সেবারও জন্মদিন ভুলে বসে আছি। কাকডাকা ভোরে ঈশিতার ফোনে ঘুম ভাঙে। হুকুমের স্বরে বলে তাত্তাড়ি ফার্মগেট আসো। আমি কিছু বলার আগেই ফোন কেটে দেয়। কি আর করা তারাতারি ফ্রেস হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। রাস্তায় কোন গাড়ি ঘোড়া নেই। চারদিকে গোলাগুলি,পেট্রোল বোমার আতঙ্ক একদম খারাপ অবস্থা খুব। তারপরও অনেক কষ্ট করে এক ভদ্রলোকের বাইকে লিফট নিয়ে ফার্মগেট পৌছতেই দেখি ঈশিতা আর শাওন দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে অপেক্ষা করতে বলে ওরা দুজন কোথায় যেন চলে যায়। একটু পর ফিরে আসতেই হাতে দেখি কেক এর প্যাকেট। সেই বৈরী সময়ে কেক কিভাবে খুজে পেলো আল্লায় জানে। তো যাইহোক,ফার্মগেট থেকে হেঁটে হেঁটে মান্না আংকেলের মহাখালীর অফিসে গিয়ে কেক কাটা হলো। অনেক অনেক গিফটও পেলাম। সব শেষ করে যখন ও আর আমি একা একা ফিরছিলাম ফার্মগেটের দিকে ওকে বাসায় পৌছে দিতে তখন ও বলেছিল,তোমার আগামী জন্মদিন অনেক ধুমধাম করে পালন করবো। হিহি। ঈশিতার সাথে আমার আর কখনোই জন্মদিন পালন করা হয়নি। পরের বছর আর জন্মদিন পালন করা হয়নি। পরের ডিসেম্বরে সম্ভবত ভারতে ছিলাম। যাইহোক সেই ঘটনার ঠিক দুই বছর পর এক কাজে টাঙ্গাইল গিয়েছিলাম। উঠেছিলাম আন্টির বাসায়। ৩০ তারিখ রাতে। জার্নি করার কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। টাঙ্গাইলে প্রচন্ড শীত পড়েছিল। কম্বলের ভেতরে বেশ আরামেই ঘুমিয়ে ছিলাম। সকালে হঠাৎ শরীরের উপর কোলবালিশের আঘাতে ঘুম ভেঙে যায়। নিজের চোখ দুটোকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সামনে নৈঃশব্দবতী দাঁড়িয়ে আছে। আন্টি আর বোন দুটোর সাথে প্ল্যান করে জন্মদিনের বিশাল এক আয়োজন করে রেখেছিল ও। জীবনের শ্রেষ্ঠ বিস্ময় ছিল ওই দিনটা। সারাদিন অনেক আনন্দ করে ঢাকায় ফিরবার সময় দেখি জন্মদিনের গিফ্ট দিয়ে বিশাল একটা লাগেজ তৈরী হয়ে গেছে। যাওয়ার সময় নৈঃশব্দবতী বলেছিল,আগামীবার আরো অনেক বড় করে তোমার জন্মদিন পালন করব। হিহি। নৈঃশব্দবতীর সাথেও আমার আর কোন জন্মদিন পালন করা হয়নি। পূজা আর বেঁচে নেই। সেই জন্মদিন পালন করার কয়েক মাস পরেই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছিল। ঈশিতারও সেই জন্মদিনের কয়েকমাস পর বিয়ে হয়ে গেছিলো। এখন ঈশিতা তুমুল সংসারী। আর নৈঃশব্দবতীর সাথেও সেই জন্মদিনের মাসকয়েক পর থেকে আর কোন যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি। সময় বয়ে যায়। পূজা,ঈশিতা,নৈঃশব্দবতী কিংবা আমি সবাই নিজেদের জায়গায় হয়তো ভালই আছি। কালের নিয়মে সময় বয়ে যাচ্ছে ঠিকই। এখন আমার পাশে অসংখ্য মানুষ। অসংখ্য মানুষের ভীড়। জীবনের প্রয়োজনে সবাই আপন অনেক। তারপরও সেইসব দিনগুলোর মতোন সময় এখন অতটা মহান হয়ে উঠতে পারেনি। তাই আর ঘটা করে জন্মদিন পালন করা হয়ে ওঠেনা। ভালও লাগেনা খুব একটা। জন্মদিনগুলোতে অসংখ্য স্মৃতিরা ভীড় জমায় হৃদয়ের অলিন্দে। অসংখ্য মানুষের ভীড়ে নিজের একাকিত্বটা মাঝে মাঝেই পীড়া দেয় প্রচন্ড। তবুও ভালই আছি। কেটেই যাচ্ছে সময়….সময় এখন গোধূলী জীবন….

49116979_350754265708233_5547909578089299968_n

জাকওয়ান হুসাইন

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading