গত সপ্তাহে নাগার্নো-কারাবাখ এলাকা আজারবাইজানের দখলে যাওয়ার পর থেকে হাজার হাজার জাতিগত আর্মেনিয়ানরা ওই এলাকা ছেড়ে যেতে শুরু করেছে।

এ পর্যন্ত সাড়ে ছয় হাজারের মতো বাসিন্দা ছিটমহলটি ছেড়ে আর্মেনিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে। এলাকাটিতে এক লাখ বিশ হাজার জাতিগত আর্মেনিয়ানের বাস ছিল।

আর্মেনিয়ার সরকার যুদ্ধের কারণে বাস্তুহারা মানুষকে স্থানান্তরের পরিকল্পনা ঘোষণা করার পর থেকেই তারা এলাকা ছাড়তে শুরু করে।

আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন যে ওই এলাকায় ‘জাতিগত নিধন’ চলছে।

গত সপ্তাহে আজারবাইজানের সেনারা আক্রমণ চালালে রাশিয়ার পাঁচজন শান্তিরক্ষী এবং দুই শ’ জন জাতিগত আর্মেনিয়ান এবং কয়েক ডজন আজারবানি সেনা নিহত হয়।

আর্মেনয়িয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বর্তমানে সেখানে এটাই চলছে এবং এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। কারণ এ বিষয়ে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে অনুরোধ জানানোর চেষ্টা করছি।’

আজারবাইজান বলেছে যে তারা জাতিগত আর্মেনিয়ানদেরকে ‘সমান নাগরিক’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়।

স্থানীয় মানবাধিকার কর্মী গেগহাম স্টিপানিয়ান এক্স-এর (সাবেক টুইটার) মাধ্যমে এক পোস্টে জানিয়েছেন, কারাবাখের প্রধান শহর স্টেপানাকার্টের একটি পেট্রোল স্টেশনে বিস্ফোরণে দুই শ’র বেশি মানুষ মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে।

তবে বিস্ফোরণের কারণ সম্পর্কে এখনো কিছু জানা যায়নি।

মানুষের ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কারণে আর্মেনিয়ার সীমান্তে যানবাহনের দীর্ঘ লাইন তৈরি হয়েছে।

রোববার আর্মেনিয়ার গোরিস শহরে যেসব শরণার্থীরা এসে আশ্রয় নিয়েছেন এমন কয়েক জনের সাথে কথা বলেছে বিবিসি। শহরটি কারাবাখের সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত।

এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমি আমার জীবন মাতৃভূমির প্রতি উৎসর্গ করেছি। এভাবে পালিয়ে আসার চেয়ে তারা যদি আমাকে মেরে ফেলত তাহলে বেশি ভালো হতো।’

ভেরোনিকা নামে এক নারী বিবিসি-কে বলেন, দ্বিতীয়বারের মতো শরণার্থী হয়েছেন তিনি। ২০২০ সালের লড়াইয়ের সময় প্রথমবার শরণার্থীতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি।

‘আমাদের কিছুই নেই’
গোরিস শহরের প্রধান চত্বরে ভিড় জমে গেছে। কাছাকাছি থাকা থিয়েটারকে রেড ক্রসের একটি ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

টিটিয়ানা ওগানেসিয়ান, যিনি নিজে একজন চিকিৎসক এবং একই সাথে চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবী একটি ফাউন্ডেশনের প্রধানও, তিনি এখন গোরিস শহরে আসা শরণার্থীদের সহায়তা দিচ্ছেন।

তিনি বিবিসিকে বলেন, যারা চিকিৎসকদের কাছে আসছেন তাদের বেশিরভাগই ক্লান্ত, অপুষ্টিতে আক্রান্ত এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।

‘মানুষ হতবিহবল, তারা আমাদের বলছে, আমার বড়ি দরকার, সেগুলো নীল রঙের,’ তিনি বলেন। চিকিৎসকদের বুঝতে হচ্ছে যে তারা কী ওষুধ সেবন করতো এবং পরে সেগুলো তাদের জন্য খুঁজে বের করতে হচ্ছে।

‘আমাদের কিছুই নেই,’ বলছিলেন সদ্য গোরিসে আসা এক বয়স্ক নারী। তিনি তার পরনে থাকা জাম্পারটি দেখিয়ে বলছিলেন, শুধুমাত্র সেটিই তিনি তার সাথে করে নিয়ে আসতে পেরেছেন। তার ছেলে তার পাশে ক্র্যাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

করনিডজর নামে কাছের একটি গ্রামে যেসব শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছেন তারা বলছেন যে আজারবাইজানের শাসনে তারা নিজেদেরকে সুরক্ষিত মনে করেন না এবং তারা যে আবার বাড়িতে ফিরতে পারবেন সেটাও আশা করেন না।

রোববার আর্মেনিয়ার সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে যে শত শত শরণার্থীদের এরইমধ্যে সরকারি খরচে বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

কিন্তু মানুষের এই স্রোতকে কিভাবে সামাল দেয়া হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত কোনো পরিকল্পনা এখনো প্রকাশ করা হয়নি।

আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী পাশিনিয়ান গত সপ্তাহে এক ঘোষণায় বলেছিলেন, ৪০ হাজার শরণার্থীকে দেখাশোনা করার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।

যেসব আর্মেনিয়ানদের সাথে বিবিসি কথা বলেছে তারা জানিয়েছেন, শরণার্থীদের নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিতে প্রস্তুত তারা।

স্থানীয় একটি সংবাদ মাধ্যমে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাত দিয়ে বলেছে, ইরেভানে সাম্প্রতিক সরকার বিরোধী বিক্ষোভের জেরে ১৪০ জনের বেশি মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

সংবাদ সংস্থা তাস জানিয়েছে, ইরেভানে যেসব বিক্ষোভকারী রাস্তা আটকে বিক্ষোভ করেছে, তাদের আটক করতে শুরু করেছে বিশেষ বাহিনী।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং আরো যেসব সরকারি দফতরে বিক্ষোভকারীরা প্রবেশ করার চেষ্টা করেছে সেগুলোসহ প্রধান প্রধান সরকারি দফতরের বাইরে অবস্থান নিয়েছে পুলিশ।

সরকারের নাগার্নো-কারাবাখের পরিস্থিতি সামাল দেয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে গত সপ্তাহে প্রথম বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।

পাশিয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি আজারবাইজানকে খুব বেশি ছাড় দিয়েছেন এবং তার পদত্যাগের দাবি তোলা হয়েছে।

আজারবাইজানের সামরিক বাহিনীর দ্রুত গতির অভিযানের পর বুধবার আর্মেনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনী অস্ত্র জমা দিতে রাজি হয়েছে।

আর্মেনিয়া বারবারই বলে আসছে, আজারবাইজানের কর্তৃপক্ষের ভুলের কারণেই ওই অঞ্চলে মানুষ গণভাবে উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে।

রোববার এক টেলিভিশন ভাষণে পাশিনিয়ান বলেন, আজারবাইজান যদি মানুষকে ‘বাস্তবসম্মত বাসস্থানের সুযোগ’ এবং ‘জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে কার্যকর সুরক্ষা ব্যবস্থা’ সরবরাহ না করে তাহলে ওই এলাকায় ‘মানুষের বাড়ি-ঘর ছেড়ে যাওয়া ছাড়া আর উপায় থাকবে না।’

তিনি আবারো বলেন, তার সরকার ‘আমাদের ভাই-বোনদের স্বাগত জানাতে’ প্রস্তুত।

নাগার্নো-কারাবাখের জাতিগত আর্মেনিয়ানদের নেতা স্যামভেল শাহরামানিয়ানের উপদেষ্টা ডেভিড বাবায়ান রয়টার্সকে বলেন, তিনি আশা করছেন যে প্রায় সবাই চলে যাবে।

তার জনগণ ‘আজারবাইজানের অংশ হয়ে বসবাস করতে চায় না-৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ বাসিন্দা আমাদের ঐতিহাসিক ভূমিতে চলে যেতে চায়,’ তিন বলেন।

তিনি রয়টার্সকে বলেন, ‘আমাদের দরিদ্র জনগণের ভাগ্য ইতিহাসে আর্মেনিয়ার জনগণ এবং পুরো সভ্য বিশ্বের জন্য কলঙ্ক আর লজ্জা হিসেবে উল্লেখ থাকবে।’

‘আমাদের এমন পরিণতির জন্য যারা দায়ী, তাদের একদিন স্রষ্টার কাছে তাদের পাপের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।’

রোববার আজারবাইজানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, তারা রকেট, কামানের গোলা, মাইন এবং গোলাবারুদের মতো অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করেছেন।

আজারবাইজান জনসমক্ষে নিশ্চিত করার পরও নাগার্নো-কারাবাখের বাসিন্দাদের মধ্যে ভীতি রয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা অস্ত্রবিরতিতে রাজি হওয়ার পর থেকে ওই এলাকায় ৭০ টন খাদ্য সামগ্রীবাহী মাত্র একটি ত্রাণ সরবরাহকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়েছে।

জাতিগত আর্মেনিয়ান নেতারা বলছেন, হাজার হাজার মানুষ খাদ্য ও আশ্রয় বঞ্চিত হয়ে পড়েছে এবং তারা বেজমেন্ট, স্কুল ভবন বা বাইরে ঘুমাতে বাধ্য হচ্ছে।

সূত্র : বিবিসি

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.