আইন থেকে আইন, ডিজিট্যাল থেকে সাইবার, কালাকানুন যেন না হয়

জলের শ্যাওলা- ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইনের’ বয়স পাঁচ বছর পাড় হয়ে গেছে। যে কোনো আইন পাঁচ বছর কার্যকর থাকার পরে অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকারিতাও হারিয়ে ফেলে কেননা অপরাধের ধরন বদলায় বিধায় (যুক্তিহীন নয় )।

 

না, উপরের বচনটি আমার নয়। স্বয়ং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বচন। কারণ আছে নিশ্চয়ই। ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইনটি নিয়ে কত আলোচনা- সমালোচনা এবং কালেভদ্রে প্রতিবাদের ফলেই সরকার শেষ অব্দি সরিয়ে নিচ্ছে। (কালেভদ্রে বলছি কারণ একটি রাষ্ট্রে এমন একটি আইন এত বছর যাবৎ চলছে এবং এই আইনের মাধ্যমেই শাস্তিও হয়েছে বলেই কেননা একটি রাষ্ট্রে এমন একটি আইন সাধারণত চলতে পারে না তবে আমাদের দেশে চলেছে ! )। তবে কোনো সরকারই হার মানতে সাধারণত নারাজ থাকে। সরকারের ইমেইজ বলে কথা। সরকার কি ভাষায়, কি ব্যাখ্যা দিলো ? তারচেয়েও বড় বিষয়, ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইনটি বাতিল হচ্ছে। বাতিল হচ্ছে বলতে, নতুন আইন পাস হলে আগের আইনটি বাতিল হবে।

 

সরকারের ভাষ্য :

সরকার মনে করেছে বর্তমানে সাইবার অপরাধ অনেক বেশি হচ্ছে। তাই ডিজিট্যাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অনেকগুলো ধারাকে সংযুক্ত করে, “সাইবার নিরাপত্তা আইন” নামে নতুন একটি আইন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র অনুযায়ি, ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইনটি বিলুপ্ত নয়, নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন- ২০২৩ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে।

 

আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও একই ভাষ্য দিয়েছেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার রোধ করার জন্য এই আইনের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে”। গতকাল সোমবার (৭ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

 

নতুন আইনটিতে কী থাকছে ? সেটা ঘেঁটে দেখতে হলে পুরাতন আইনটিকেই ঘাঁটতে হচ্ছে। পুরাতন আইনের কতগুলো ধারার কথাই সামনে চলে আসে। ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইনের ২১/ ২৮/ ২৯/ ৩১/ ৩২ ধারাগুলোর জামিন/ জামিন অযোগ্য এবং জরিমানার পরিবর্তন হচ্ছে বলেই সূত্রের খবর। এই ধারাগুলোতে কী ছিলো ? এবং পরিবর্তন হয়ে কী থাকছে ? সেগুলোকে একটু দেখা প্রয়োজন।

 

ধারা- ২১ ) ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইনের ধারা-২১-এ বলা আছে, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনও প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার জন্য দণ্ডের বিধান রয়েছে। যদি কোনও ব্যক্তি এই অপরাধ করেন, তাহলে তিনি অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। নতুন আইনে এই সাজা কমিয়ে সাত বছর কথা হয়েছে। এ ছাড়াও অনেকগুলো ধারায় দ্বিতীয়বার অপরাধের জন্য সাজা দ্বিগুণ বা সাজা বাড়ানো ছিল। প্রস্তাবিত আইনে প্রত্যেকটি ধারায় যেখানে দ্বিতীয়বার অপরাধের ক্ষেত্রে বাড়তি সাজার কথা আছে, সেগুলো বাতিল করা হয়েছে।

 

ধারা- ২৮ ) ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার বা উসকানি অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনও ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহলে সেই ব্যক্তির এমন কাজ হবে একটি অপরাধ। কোনও ব্যক্তি এই অপরাধ সংঘটন করলে তিনি অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। আর এই অপরাধ দ্বিতীয় বার করলে সাজা আরও বেশি হবে।

 

প্রস্তাবিত আইনে ধারা- ২৮ পরিবর্তন করে জামিনযোগ্য করা হয়েছে (আগে অজামিনযোগ্য ছিল) এবং সাজা কমানো হয়েছে। নতুন পরিবর্তিত আইন অনুযায়ী অপরাধের সাজা হবে সর্বোচ্চ দুই বছর।

 

ধাদা- ২৯ ) ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারায় মানহানির বিষয়টি রয়েছে। এই ধারায় বলা আছে, যদি কোনও ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনও ইলেকট্রনিক বিন্যাসে পেনাল কোডের (দণ্ডবিধি) সেকশন ৪৯৯-এ বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, সে জন্য তিনি অনধিক তিন বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর যদি কোনও ব্যক্তি উপধারা (১)-এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ সংঘটন করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। প্রস্তাবিত আইনে এই অপরাধের জন্য কারাদণ্ড বাদ দিলেও জরিমানার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে।

 

 

ধাথা- ৩১ ) ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইনের ৩১ ধারাও পরিবর্তন করা হচ্ছে প্রস্তাবিত আইনে। এই ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনও ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিট্যাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটার উপক্রম হয়, তাহলে ওই ব্যক্তির অনধিক ৭ বছর কারাদণ্ড, বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। প্রস্তাবিত নতুন আইনে সাজা কমিয়ে ৫ বছর করা হয়েছে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধের বাড়তি সাজা বাতিল করা হয়েছে।

 

ধারা- ৩১ ) ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধের জন্য অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান ছিল। এটি কমিয়ে সাত বছর করা হয়েছে। হ্যাকিংয়ের জন্য অনধিক ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে এই ধারায়।

 

মোটাদাগে এই ধারাগুলোর পরিবর্তন হচ্ছে বলেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রেই পাওয়া। মন্ত্রিপরিষদের দাবী অনুযায়ী, ৯০ শতাংশ ধারাই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট থেকে প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে এবং নতুন আইনে মোট ৬০ টি ধারা থাকছে। এছাড়াও আগের আইনে জেলের বিধান বেশি ছিল। নতুন আইনে জরিমানার পরিমাণ বেশি রাখা হয়েছে। নতুন আইনে জামিনঅযোগ্য ধারাগুলো হচ্ছে— ১৭, ১৯, ২১ ও ৩৩। আর জামিনযোগ্য ধারাগুলো হচ্ছে— ১৮, ২০, ২২, ২৪, ২৬, ২৮, ২৯। ভেটিং (আইন মন্ত্রণালয়ের যাচাই-বাছাই) শেষ করে আবার মন্ত্রিপরিষদে আসবে আইনটি। নতুন আইন অনুযায়ী একটা সাইবার সিকিউরিটি এজেন্সি থাকবে। তবে আইনটি পাশ হলেই এই সাইবার সিকিউরিটি এজেন্সির কাজটি আরও পরিষ্কার হবে নিশ্চয়ই।

 

বলাই বাহুল্য, সরকার অস্বীকার করলেও যে কোনো কারণেই হোক, হতে পারে সেটা নির্বাচন পূর্ববর্তী কিংবা দেশি- বিদেশী কিংবা উপলব্ধি, যাই বলি না কেনো (তবে উপলব্ধি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়) ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইনটি রুপান্তর করছে। এই যে রূপান্তর এর জন্য সরকারকে ধন্যবাদ দেওয়াই যায় তবে সেই ধন্যবাদটি আপাতত সিকেয় তুলে রাখাটাই আপন উপলব্ধির অংশ । কেননা পুরাতন আইনের ধারা (যে কয়েকটা উপরে উল্লেখ করেছি) যা যা পরিবর্তন করা হয়েছে (সূত্র অনুযায়ী), সেখান থেকে কতটা ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইন বাতিল হয়ে কতটা সাইবার নিরাপত্তা আইনের নামে কি কি প্রয়োগ হবে এবং কিভাবে প্রয়োগ হবে, সেগুলো ভবিষ্যতে চর্চার পরেই শতভাগ অনুভব হবে। কেননা আমাদের দেশে আইনের অভাব নেই (ভাল/ মন্দ) তবে প্রয়োগ নিয়েই যত সমস্যা। কথায় বলে না আইনের ফাঁকফোকর। সেই ফাঁকফোকরের প্যাচে পরে কত কি যে এই রাষ্ট্রে হয় তার ইয়ত্তা নেই ।

 

এই দেশেই পূর্বের বিএনপি-জামায়াত সরকার ব্লাসফেমী আইনটি বানাতে পারেনি বলেই আইসিটি অ্যাক্ট বানিয়েছিল, ইহাই সত্যি এবং সেই সময়ে ক্ষমতায় আসতে পারলে প্রয়োগটিও নিশ্চিত ভিন্ন হতো (আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা তেমনটাই বলে )। সেই আইসিটি অ্যাক্টকেই কব্জা করে এই সরকার হেফাজতের পরামর্শে ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইন তৈরী করে আরও কঠোর হয়ে উঠেছিল। জেল- জুলুম – জরিমানার সহ মৃত্যুর কাহিনীও কম নেই কিন্ত।

 

কথায় বলে সরকারের লম্বা হাত। সেই লম্বা হাতে কালাকানুন কব্জায় আসলেই সব সরকারই অসহিষ্ণু হয়ে উঠে, আমাদের মতন দেশে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এমন বহু প্রমাণ আছে। সেই ভয় থেকেই হয়তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই পরিবর্তীত ও রূপান্তরিত সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট নিয়ে মাতম বা কটাক্ষ চলছে। এটা কি আবার সেই নতুন বোতলে পুরাতন মদ কিনা ? এখানে পাবলিককে দোষারোপ করে কোনও লাভ নেই কেননা পাবলিকতো বরাবরই ভুক্তভোগীদের অংশ।

 

আমাদের দেশে মূলত গোড়ায় সমস্যা। চিন্তা ও মত প্রকাশে। আমাদের সরকারগুলোর চিন্তাচেতনায় আরও অনেক বেশি পজেটিভ ভাবনায় প্রসারিত হওয়াটা জরুরি। আমাদের সরকারগুলো সংকীর্ণ ও দীনতা মনমানসিকতার কারণেই মত প্রকাশে স্বাধীনতাকে পেটোয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা চালায় যা কখনোই রাষ্ট্রের জন্য ও জনগণের জন্য সুখকর হতে পারে না এবং কল্যাণকরতো নয়ই। শুধুমাত্র আইন থেকে আইনকে রূপান্তর করলেই আইন ফুলবাগিচার গোলাপ হয়ে যাবে না। প্রত্যাশা থাকবে (সংসদে আইনটি পাশ হবার পরেই বুঝা যাবে) সাইবার অ্যাক্ট যেন ডিজিট্যাল অ্যাক্টের পুনর্জন্ম হয়ে তামাশায় পরিণত না হয়। চিন্তা ও মত প্রকাশের উপর কোনও প্রকার হস্তক্ষেপ ও বাঁধা হয়ে যে কোনো কানুন হোক, তেমন কানুনকে কখনোই সমর্থন করি না।

 

বুলবুল তালুকদার 

যুগ্ম সম্পাদক/ শুদ্ধস্বর ডটকম 

 

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.