গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদের মধ্যে লড়াই

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে একুশশতকজুড়ে বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যবস্হায় গণতন্ত্র এবং কর্তৃত্ববাদ সম্পর্কিত মতবাদ নিয়ে বড়ধরণের রাজনৈতিক লড়াই অব্যাহত থাকবে, যতক্ষণ না কোনো একটি মতাদর্শের পতন ঘটবে,ততক্ষণ পর্যন্ত এটি শীতল যুদ্ধের আকারে চলতেই থাকবে।
গণতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু হলো, জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি, যেখানে ব্যক্তির “স্বশাসন” নীতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। গণতন্ত্রে স্বীকার করা হয় যে, রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা জনগণের উপর ন্যস্ত থাকে এবং সেই ক্ষমতা জনগণের পক্ষে তাদের প্রতিনিধিরা প্রয়োগ করেন। একটি সাংবিধানিক কাঠামো, অবাধ, সুষ্ঠু, সকলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় গঠিত সার্বভৌম আইনসভা ও একটি সরকার, বহুত্ববাদী নীতি, স্বাধীন বিচার বিভাগ, মতপ্রকাশের স্বাধীন অধিকারসহ মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নিয়ে গঠিত হয় গনতান্ত্রিক শাসনব্যবস্হা, যেখানে নির্বাহী বিভাগ তথা সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জনগণের পক্ষে, জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।
কর্তৃত্ববাদীতা সম্পর্কে রাষ্ট্রদার্শনিক এবং ইতালির ফ্লোরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফুরিও
সেরোটি বলেন, এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো- “রাজনীতির স্বাভাবিক উপাদান হিসেবে দ্বন্দ্ব ও বহুত্বকে গ্রহণ না করা,স্থিতাবস্থা “বজায় রাখার ইচ্ছে” এবং সমস্ত রাজনৈতিক গতিশীলতাকে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শক্তির একক ও ঘনিষ্ঠ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে পরিচালনা করা।” “কর্তৃত্ববাদী শাসনের রাজনীতি” বইয়ের লেখক ইলিনয়(ইউএসএ) বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনীতিবিজ্ঞানী মিলান ডাব্লিউ. সোভলিক বলেছেন, “একটি সরাসরি স্বাধীন,অবাধ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগের নির্বাচন অনুষ্ঠান করা অসম্ভব করে তোলে কর্তৃত্ববাদ।”
মূলত একজন মাত্র ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী রাষ্ট্রের সবকিছুর এবং প্রত্যেকের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে এবং যেকোনো ভিন্নমতকে জোরপূর্বক দমন করে থাকে, জোরপূর্বক ভিন্নমত দমন করাকে কর্তৃত্ববাদ তাদের অধিকার হিসেবে গণ্য করে। ফলে স্বশাসন, সুশাসন, ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার প্রাপ্তি সহ সকল গণতান্ত্রিক অনুশীলনকে বিপন্ন করে তোলে ও ক্রমেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হতে থাকে এবং নাগরিকরা রাষ্ট্র ও কর্তৃত্ববাদী শাসকের দাসে পরিণত হতে বাধ্য হয়। কারণ নাগরিকরা হারায় রাষ্ট্রের উপর তাদের সার্বভৌম ক্ষমতা, পছন্দের প্রার্থী ও পছন্দের সরকার নির্বাচনের অধিকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীন অধিকার। স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারকে কর্তৃত্ববাদীরা তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে গণ্য করে।
মার্কিন রাষ্ট্রচিন্তক ও দার্শনিক ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা প্রায় তিনদশক আগে নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তার লিখিত বিখ্যাত, ” দ্য এন্ড অফ হিস্ট্রি এন্ড দ্য লাস্ট ম্যান” বইয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন, কমিউনিজমের পতনের ফলে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বিশ্বব্যাপী বিস্তারের পথ পরিষ্কার হয়েছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্হা পর্যবেক্ষণ করে রাষ্ট্রচিন্তকগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে ফুকুইয়ামার তিনদশক আগে করা ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক হয়নি, বরং বিশ্বব্যবস্হায় কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে উদারনৈতিক গণতন্ত্র একটি স্হায়ী সংকটের আবর্তে পড়েছে।
মার্কিন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতন্ত্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ল্যারি ডায়মন্ড মনে করেন, গণতন্ত্র এবং কর্তৃত্ববাদী ধারার মধ্যে লড়াই আগামী দীর্ঘমেয়াদের জন্য একটি কঠিন এবং অত্যন্ত অগোছালো পরিস্থিতির মতো হতে চলেছে।”
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে এক ঘরোয়া খোলামেলা কথাপ্রসঙ্গে, (বাইডেনের জবানী মতে ) চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যুক্তিদিয়ে বলেছিলেন যে, “একুশশতকে গণতন্ত্রের উপর “এক মানুষের শাসন” প্রাধান্য পাবে, কারণ বিশ্বে দ্রুতগতির পরিবর্তনের মূখে “গণতন্ত্রের জন্য ঐক্যমত্য প্রয়োজন এবং সেই ঐক্যমত্য পাওয়া কঠিন।”
ব্রিটিশ সাংবাদিক গিডিয়ান রাচম্যান তার “দ্য এজ অফ দ্য স্ট্রংম্যান” গ্রন্হে লিখেছেন, “আমরা এখন ১৯৩০ এর দশকের পরে, উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর সবচেয়ে টেকসই বৈশ্বিক আক্রমণের মধ্যে রয়েছি।” তার মতে, ব্রাজিল, চীন, রাশিয়া, ইরান, বেলারুশ উত্তর কোরিয়া, হাঙ্গেরি, তুরস্কের মতো দেশগুলোতেও কর্তৃত্ববাদী শাসন জেঁকে বসেছে। আমেরিকান পলিটিক্যাল সোসিওলজিস্ট ল্যারি ডায়মন্ড বলেছেন, ভারতও “কর্তৃত্ববাদী প্রবাহের দিকে” চলা অব্যাহত রেখেছে। চীন, রাশিয়ার মতো অন্যান্য একনায়ক শাসকরা- “গণতন্ত্রই সমৃদ্ধির ও নিরাপত্তার একমাত্র কার্যকর পথ” এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হয়েছে এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনই সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি হিসেবে শাসনের জন্য কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্হাকে উৎসাহিত করেছে এবং ফলে কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে ঝুঁকেছে বেশি সংখ্যায় দেশগুলো।
ফ্রিডম হাউসের প্রেসিডেন্ট মাইকেল জে. আব্রামোভিটজ বলেছেন, “গণতন্ত্র সারাবিশ্বে সত্যিকারের বিপদের মধ্যে রয়েছে। পক্ষান্তরে কর্তৃত্ববাদ সাহসী হয়ে উঠছে।” কর্তৃত্ববাদী নেতারা ক্রমবর্ধমানভাবে একে-অপরের সাথে নতুন ধরনের দমন-পীড়ন ছড়িয়ে দিতে এবং গণতান্ত্রিক চাপকে প্রত্যাখ্যান করতে সহযোগিতা করে চলেছে। বেইজিং, মস্কো ও অন্যান্য স্বৈরাচারীরা বিশ্বব্যাপী প্রকৃত গণতন্ত্রকে ক্ষুন্ন করে তাদের নিজস্ব বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য গণতন্ত্রের লেভেলটিসহ-অপ্ট করতে চায় কারণে বৈশ্বিক স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধি ঝুঁকির মধ্যে আছে।
কর্তৃত্ববাদী শাসকদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা সমগ্র জাতিগোষ্ঠীকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলের দেশগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন কর্তৃত্ববাদী অপব্যবহারের শিকার হয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে কর্তৃত্ববাদীরা ক্ষমতাকে একত্রিত করে গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকারের উপর তাদের আক্রমণ ত্বরান্বিত করতে একসঙ্গে কাজ করছে। ফলে নাগরিক স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকার বিশ্বব্যাপী হ্রাস পেয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনে সমর্থন দিয়ে চলেছে চীন, উত্তর কোরিয়া, প্রভৃতি কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠী। তুরস্ক একসময় চীনের নির্যাতিত উইঘুর মুসলিমের জন্য আশ্রয়স্হল ছিলো। কিন্তু এরদোয়ান বেইজিংয়ের দাবি পূরণের জন্য উইঘুর মুসলিমদের প্রতি তার অবস্হান পরিবর্তন করেছেন।
বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদী শাসনগুলো এখন গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্রমেই প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করছে এবং ফ্রিডম হাউসের মতে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২০ শতাংশ উদারনৈতিক গণতন্ত্রে এবং বাকীরা মুক্ত নয় বা আংশিক মুক্ত দেশগুলোতে বসবাস করছে। ২০২২ সালে প্রকাশিত সুইডেন-ভিত্তিক ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিবেদনে আরও ভয়াবহ চিত্র তোলে ধরা হয়েছে, যেখানে দেখা গেছে উদার গণতন্ত্র বিশ্বের মাত্র ৩৪ দেশে বিদ্যমান, যা ২০১২ সালে ছিলো ৪২, যা সারা বিশ্বের মেট জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ। পক্ষান্তরে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ বা ৫.৪ বিলিয়ন মানুষের আবাসস্থল হলো স্বৈরশাসকদের অধীনে। প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়েছে যে ১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর থেকে গণতন্ত্রের জন্য প্রায় সমস্ত বিশ্বব্যাপী অগ্রগতি “নিশ্চিহ্ন” হয়েছে। কারণ ওই সময়ের পরে, রাষ্ট্রদার্শনিকদের মধ্যে উদার গণতন্ত্রের উত্থানের আশাবাদ সত্ত্বেও এটি স্বীকার্য যে বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদী শাসকদের ব্যাপক উত্থান ঘটেছে। রাচম্যান তাই বলেছেন, “কর্তৃত্ববাদের সাফল্য, উদারনীতির সংকটের লক্ষণ।” মার্কিন জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির রাজনীতিবিজ্ঞানী চার্লস কুপচান বলেছেন, “বড় বৈশ্বিক প্রবণতা লাইন উদ্বেগজনক এবং এর কারণ হলো ইতিহাসের সেই প্রগতিশীল চাকাটি পেছনের দিকে বাঁকানো হয়েছে।”
ফ্রিডম হাউসের বিশেষজ্ঞ বিবিন্স সেদাকা মন্তব্য করেছেন, গণতন্ত্র রক্ষার জন্য একটি নতুন উদ্দীপনা রয়েছে, যেখানে কর্তৃত্ববাদকে একটি চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে এবং একটি নতুন আশা যে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্হা “কোনো লোহার দূর্গ নয় যেটিকে চ্যালেঞ্জ করা যায় না। তারা নিজেদের যতটা শক্তিশালী ভাবে, ততটা শক্তিশালী নয়।” “বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদ ও গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে একটি তুমুল যুদ্ধ দেখতে পাচ্ছি এবং মানুষ সেই স্হানটিতে পা রাখছে।”-বলেছেন বিবিন্স। ” মানুষ বুঝতে পারছে কর্তৃত্ববাদ কেবল একটি পার্শ্ব সমস্যা নয়,বরং একটি কেন্দ্রীয় অস্তিত্বের বিষয়, এটিই ইতিবাচক দিক” যোগ করেন বিবিন্স।
আশার বিষয়, সাধারণ মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতার দাবিতে জীবন ও জীবিকার ঝুঁকি নিয়ে দেশে-দেশে ওইসব কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন ও লড়াই করে চলেছে এবং তাদের মৌলিক আকাঙ্ক্ষার চুড়ান্ত জয় একদিন পূর্ণ হবেই।
সূত্র : ফরেন পলিসি, ওয়াশিংটন পোস্ট, জার্নাল অফ ডেমোক্র্যাসি, ফ্রিডম হাউসের ওয়েবসাইট, ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইট, জেরুজালেম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জেএল তালমন এর বই, দ্য অরিজিন অফ টোটালিটারিয়ান ডেমোক্রেসি।
অ্যাডভোকেট আনসার খান , আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ।