
চলচ্চিত্রের পর্দা থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ–রাজনীততেও নায়ক হিসেবে ছিলেন ফারুক। তাকে অনেকে ডাকতেন ‘মিয়া ভাই’। মিয়া ভাই অর্থ হলো বড় ভাই যিনি দায়িত্ব নিতে জানেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের দায়িত্ব যেমন নিয়েছিলেন ‘মিয়া ভাই’, মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তার ওপর ভরসা করতেন জ্যেষ্ঠ নেতারা। পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহও। আওয়ামী লীগের জন্য অনেক কিছু করলেও কখনো পদ-পদবির পেছনে ছোটেননি ফারুক।
চিত্রনায়ক ফারুকের মৃত্যুর পর তার দুই তৎকালীন ছাত্রলীগকর্মী ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলে এসব জানা গেছে।
ফারুকের আসল নাম আকবর হোসেন পাঠান, যাক নাম দুলু। তাদের পরিবারের আদি ঠিকানা রূপগঞ্জের কালীগঞ্জের দক্ষিণসোম গ্রাম। তবে ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট তার জন্ম হয় মানিকগঞ্জে। তার চিকিৎসক বাবার কর্মস্থল ছিল সেখানে। যদিও কৈশোর ও যৌবনের পুরোটা সময তার কেটেছে পুরান ঢাকার মালিটোলায়। এটি তার পৈতৃক বাড়ি।
চিত্রনায়ক ফারুক বিষয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক লিনু হক বলেন, ঢাকা শহরে স্থাপিত দেশের প্রথম বেসরকারি বিদ্যালয় পোগোজ স্কুলে পড়ার সময় তার পরিচয় হয় শিক্ষক কাজী আরেফ আহমেদের সঙ্গে। কাজী আরেফ আহমেদ তখন ছাত্রলীগের নেতা। ঢাকা নগর কমিটিতে তিনি ছিলেন সভাপতি। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি শিক্ষকতাও করতেন। সেখানে গিয়ে দুলু তথা ফারুকের দেখা পান। কাজি আরেফের সান্নিধ্যে এসে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন ফারুক।
লিনু হক দেশ রূপান্তর অনলাইনকে আরো বলেন, ফারুক ছিলেন মাঠের কর্মী। তিনি কৈশোর থেকে নিজেকে তৈরি করেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ‘অনুশীলন দলের’ আদলে। নিয়মিত ব্যায়াম ও শরীরচর্চার মাধ্যমে আকর্ষণীয় বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী হন। দেখতেও ছিলেন লম্বা এবং সুদর্শন। ফলে সহজে অন্যদের আকৃষ্ট করতে পারতেন। কাজী আরেফের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং অন্য নেতাদের সঙ্গেও যুক্ত হন।
লিনু হক জানান, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা প্রণয়ন করলে প্রথম সমর্থন দেয় ছাত্রলীগের নগর শাখা। যার সভাপতি ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ, আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবুল কাসেম। ফারুক তখন ছয় দফার পক্ষে আরেফ ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করতে থাকেন। এ সময় রাজ্জাক ভাই (আবদুর রাজ্জাক, তখনকার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সেক্রেটারি এবং পরে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা) ভাইয়ের ঢাল হিসাবে কাজ করেন। রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে এ সময় সভাপতি পদে ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। রাজ্জাক ভাই সভাপতি হওয়ার জন্য জোর তৎপরতা চালিয়ে যান। এর পুরোটা সময় তার সঙ্গে ছিলেন ফারুক ভাই। সুঠাম দেহের পাশাপাশি তার ছিল প্রচন্ড সাহস। সেই সাহস আর বলিষ্ঠতা নিয়ে আব্দুর রাজ্জাক গ্রুপের হয়ে ছয় দফার পক্ষে কাজ করেন ফারুক। নিজে একটি গ্রুপও প্রতিষ্ঠা করেন। যাদের কাজ ছিল শক্তি-সাহস প্রদর্শন। এনএসএফ-এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করতে তার ওপর ভরসা রাখতেন আওয়ামী লীগ নেতারা। পুরান ঢাকায় এ সময় কিছু গ্রুপ ছিল, যেমন এখন আমার মনে পড়ছে রুচিতা গ্রুপের কথা।
লেখক লিনু হক দেশ রূপান্তর অনলাইনকে আরো জানান, ফারুক ভাই একাত্তরের উত্তাল মার্চের পুরোটা সময় ইংলিশ রোড, জজ বিল্ডিং, মালিটোলা, সদরঘাট, কলেজিয়েট স্কুল, নবাবাপুর রোড, টিপু সুলতান রোড, ভিক্টোরিয়া কলেজসহ পুরান ঢাকার বিশাল এলাকায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ কর্মসূচি পালনে প্রধান ভূমিকা রাখতেন। মুক্তিযুদ্ধে জিঞ্জারায় মালিটোলার নাদেরের (তখনকার স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি) সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে ভূমিকা রাখেন মুক্তিযুদ্ধে। নাদের পরে পাকিস্তান আর্মির গুলিতে নিহত হন।
তিনি বলেন, ফারুকের পরিবারের সাত ভাইবোন একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে মুজিববাহিনীর সদস্য হন।
নায়ক ফারুকের মৃত্যুর সোমবার সন্ধ্যায় কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ও জিএস, সাবেক এমপি, আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান’র সঙ্গে।
তিনি দেশ রূপান্তর অনলাইনকে বলেন, ফারুক ভাই বয়সে আমার সামান্য বড়। তিনি বড় হয়েছেন ঢাকা শহরে, আমি চট্টগ্রামে। ওনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতাম, বুঝতাম, শিখতে চাইতাম। উনি দেখতে খুব সুদর্শন ছিলেন। ছাত্রজীবনে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও চলচ্চিত্রে যাওয়ার পর সেখানেই বেশি ব্যস্ত হয়ে যান। সেখানেও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, চলচ্চিত্র শিল্পীদের বিভিন্ন কাজে নেতৃত্বে দিতেন, ডিস্ট্রিবিউটর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। আমরা এক পরিবারে প্রায় ১০-১২ জন পিঠাপিঠি ভাই। আমরা প্রায় সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিই। উনি শুরুতে ওই সত্তর-একাত্তরের দিনগুলিতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কারফিউ ভাঙার যে সংগ্রাম, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ব্যারিকেড দেওয়ার যে সংগ্রামে উনি পুরান ঢাকা শহর, কেরানিগঞ্জ-এসব এলাকায় ২৫ মার্চের আগে এবং পরে জীবনবাজি রেখে প্রতিরোধ সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। তবে ছাত্রলীগের পোস্ট ছিল না তার কখনো। কিন্তু উনি যেখানে যেতেন সবার মধ্যমণি হয়ে যেতেন। এ একটা গুণ ছিল ওনার। চলচ্চিত্রের সবাই ওনাকে ‘মিয়া ভাই’ বলতেন।
আখতারুজ্জামান বলেন, প্রথম ডাকসু নির্বাচন হয় ১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে। আমরা খুব কমিটেড রাজনীতি করতাম তখন। ডাকসু নির্বাচনের জন্য আমার ভালো পোশাক ছিল না। তখন ফারুক ভাই আমাকে নতুন জামা কিনে দেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও আমি যখন জেলে ছিলাম, ফারুক ভাই আমার দেখভাল করতেন। আমাকে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ জেলে নিয়ে যাওয়া হলো, তখন ফারুক ভাই তার ব্যক্তিগত গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে আসেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু তাকে দুলু নামে ডাকতেন। সেই ছোটবেলায় তার কথা জানতেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের প্রায়ত নেতা (আবদুর) রাজ্জাক ভাই ঢাকা শহরে যে কয়জন মানুষের ওপর ভরসা রাখতেন তিনি ছিলেন ফারুক ভাই। আওয়ামী লীগের কোনো মিছিলের প্রয়োজন পড়লে রাজ্জাক সাহেব তাকে ডাকতেন। এনএফএসকে মোকাবিলা করতে হলে যে কয়জনের ডাক সবার আগে পড়ত তাদের অন্যতম ছিলেন ফারুক ভাই। ঢাকা শহর, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তিনি ছাত্রলীগকে সুরক্ষা দিতেন। তার মতো চরিত্র পাওয়া যায় না। তিনি রাজনীতিতেও ছিলেন নায়ক।