চীন কি চেনা চরিত্রে হাজির হচ্ছে ?

জলের শ্যাওলা – মহা সত্য হলো, বাংলাদেশ একপ্রকার অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আছে। সেই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির কারণটি ইতিমধ্যেই সবার জানা হয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। গণতন্ত্রের প্লাকার্ড উঁচিয়ে ধরে মার্কিনীরা বেশ মুখর হয়ে উঠেছে সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিষয়ে। যদিও গণতন্ত্রের সূত্রেই বলতে হয়, এমন প্রক্রিয়ায় স্বয়ং গণতন্ত্র নিজেই প্রশ্নের মুখোমুখি হয় কেননা বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র বলেই। যদিও এখানে বলতেই হয়, বর্তমানে সেই মুখরিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা সহজ পথেই বা অনায়াসেই উপস্থিত হতে পেরেছে আমাদের অভ্যন্তরীণ অপরাজনীতির কল্যাণেই। আরও সহজ/ সরলভাবে বলতে হয় আমাদের রাজনৈতিক দল ও দলের নেতাদের কল্যাণেই। এটার শুরু এই দেশ স্বাধীন হবার পরপর থেকেই, ইহাই সত্য।
মার্কিনীরা স্যাংশন দেবে দেবে বহু কথা শোনা যাচ্ছিলো। কবে এবং কখন দেবে ? এমন আশা নিয়েও অনেকে ঘুমাতে যেতেন। ভাবখানা এমন যে, স্যাংশন দিলেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় ভোট- নির্বাচন’ গণতন্ত্র সব সাফসুত্রা হয়ে নতুন দিগন্তে বাংলাদেশের সূর্য উদয় হবে। শুরু হবে বাংলাদেশের নতুন যাত্রা। অবাক করা আমাদের ভাবনা। অবাক করা আমাদের মানসিকতা। এই দেশটি সার্বভৌম হয়য়েছে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে, ভাবা যায় ?
না, মার্কিনীরা এবার স্যাংশন দেয়নি। তবে দিয়েছে “ভিসানীতি”। এটা মূলত ভিসানীতি নামের নতুন রূপে ও বৃহৎ আকারের স্যাংশনই বলা চলে। বলাই বাহুল্য, অনেকটা আমাদের পুলিশ প্রশাসনের অজ্ঞাতনামা মামলার মতন । আসামী পাঁচ বা দশশতক। অর্থাৎ ওই মামলার নামে যাকে খুশি তাকেই ধরা যাবে, ছোঁয়া যাবে, অপদস্থ ও অপমান করা যাবে, বৈধ উপায়ে। এখানেও বলতেই হয়, গণতন্ত্র বলে কথা।
ভিসানীতি ঘোষণার পর, গত ২৭ মে হঠাৎই চিন থেকে উড়ে চলে এলেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার সুন ওয়েইংডং। এসেই সরকারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সনিকগতির বৈঠকে বসেন। বৈঠকে সরাসরি প্রস্তাব করলেন, ” চীনের প্রেসিডেন্টে শি চিন পিংয়ের বৈশ্বিক উন্নয়নের উদ্যোগে গ্লোবাল ভেডেলপম্যানট ইনিশিয়েটিভ জিডিআইয়ে বাংলাদেশকে যুক্ত হতে “।
এখানে একটু পূর্ব ইতিহাসে যেতেই হয়। পূর্ব ইতিহাসটি কি ? সালটি ১৯৭২ সাল, আগস্ট মাস। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের সদস্যপদ নিয়ে একটি ভোটাভুটি হয়। সেই ভোটাভুটিতে ১৫ দেশের মধ্য একমাত্র চীন তাদের ভেটোর ক্ষমতা ব্যবহার করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। বর্তমানে সেই ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে দেখলে দেখা যায়, বিগত পঞ্চাশ বছরের মধ্য চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বানিজ্য সহযোগী।
তবে এখানে ইতিহাসে আরও একটি পার্ট উল্লেখ করা প্রয়োজন। মার্কিনীরাও ৭১ এ ৭ম নৌবহর পাঠিয়েছিলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এবং পাকিস্তানীদের সেই সময় বিরাট অস্ত্রের যোগান আসে ওই মার্কিনীদের কাছ থেকেই। তবে একটু পার্থক্য অবশ্যই আছে। সেই সময়ে পাকিস্তানের সরাসরি পক্ষ নিয়েছিল সেই সময়কার মার্কিনী যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায় থাকা রিপাবলিকান পার্টি। তবে এখানে উল্লেখ করতেই হয়, রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট পার্টির যারাই সে সময়ে মার্কিনী মুল্লুকে ক্ষমতায় থাকতো, নিশ্চিত তারা কেউই পাকিস্তান ছেড়ে বাংলাদেশের পক্ষে গুণগান গাইতেন না, বাংলাদেশের পক্ষেও যেতেন না। কেননা বৃহৎ ভারতকে সামনে রেখে পাকিস্তান ভেঙ্গে টুকরো হোক, সাথে দূর্বল হোক, এটা নিশ্চয়ই মার্কিনীদের চাওয়া হতে পারতো না। যদিও পরবর্তীতে ডেমোক্র্যাট পার্টির মাধ্যমেই মার্কিনী মুল্লুকের সাথে ধীরে ধীরে সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে। এখানে আরও একটু ইতিহাসের অংশ বলা প্রয়োজন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের বহু পূর্বেই বাংলাদেশকে স্বীকৃত দেয়। যেখানে চীনের স্বীকৃত আসে ৭৫ এ বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যার পরে।
কেনো আমি চীন/ মার্কিন মুল্লুকের সেই ইতিহাস তুলে ধরছি ? সহজ উত্তর হলো, পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডে মার্কিনী বলেন বা চীনা বলেন, ওরা মূলত বিনাস্বার্থে বা ভৌগোলিক ক্ষমতার স্বার্থ বিহীন কখনোই কারও আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠে না। বর্তমানে চীন মূলত মার্কিনীদের বড় শত্রু, রাশিয়াকেউ পিছনে ফেলে। সুতরাং মার্কিনীদের ভিসানীতির স্যাংশনে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয় দ্রুত গতির যানে বাংলাদেশে হাজির হবে, ইহাই স্বাভাবিক বটে। প্রশ্নটি হলো, আমাদের সরকার কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ?
গত তিনদিন পূর্বে বাংলাদেশের জাতিয় গণমাধ্যমগুলোতে বেশ ফলাও করে প্রচার হয়েছে, ” ভারত সরকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হয়ে আর দেন- দরবার করবে না” – শ্রীরাধা দত্ত (বিস্তারিত যাচ্ছি না/ সবার জানা হয়েছে ইতিমধ্যেই)। যদিও বর্তমান সরকার আর ভারত বড় মিত্র। ঠিক সেখানটায় চীনের এমন আগ্রাসী আগমনে নয়াদিল্লির আকাশে কালোমেঘ জমবে না, সেটা হবার নয়। ভারতের শ্রীরাধা দত্ত কি বললো আর না বললো, সেটার তেমন কোনো মূল্য মূলত থাকে না বলেই মনে করি। কেননা চীন দিনকে দিন বড় পরাশক্তির রূপে প্রকাশ পাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের সাথে চীনের দহরম- মহরম হবে, চীন আবার ভারতে শত্রু স্বরূপ পড়শিদেশও বটে। সব মিলিয়ে ভারত বাংলাদেশের উপর হতে নিরবে তার প্রভাব সরিয়ে নেবে, এমনটা ভাবা বেশ মুশকিল বটে।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে নির্বাচন ও মানবাধিকার সুরক্ষা নিয়ে বেশ টানাপোড়ন চলছে। ঠিক সেই সময়ে চীনের আগমন। এই দুয়ের মাঝে কোনও না কোনও লিঙ্ক থাকবে না, এমনটা মোটেও হবার নয় নিশ্চিত। এই সব কিছু পিছনে রেখেই যদি ভাবি, চীনের জিডিআই(GDI) নিয়ে মূলত বাংলাদেশ কতটা আগ্রহী ? এখানে বলা ভালো যে, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে ভৃরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটেও চীনের বিআরইতে (BRI) বাংলাদেশ ২০১৬ সালেই সাক্ষর করেছিল। মৃলত বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই টানাপোড়েনের সুযোগের ফাঁকে BRI এর পর GDI কে উন্নয়নের প্রধান উপাদান ধরেই বিবেচনা করছে চীন। এই জিডিআই নিয়ে যদিও বলা হচ্ছে, মূলত স্বাস্থ্য- খাদ্য ও জ্বালানির সুরক্ষার করা এবং তথ্য ও প্রযুক্তির বিকাশ। এক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশকে পাশে চায়। কেনো হঠাৎই মার্কিনীদের ভিসানীতির পরে এত দ্রুত পাশে চায় ? সেখানে বড় ভাবনা।
প্রশ্ন হলো, জিডিআইতে যা সরলভাবে বলা হচ্ছে, আসলেই কি বিষয়টি অতটা সরল ? নাকি, এখানে ভূরাজনৈতিক গডরলতাও বেশ জড়িয়ে ? স্পষ্টতই মনে করি, খালি চোখে চিনের এই সরল- গরল জিডিআইতে বাংলাদেশ বিনা গভীরভাবনায় যুক্ত হলে কি পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে ? সেটা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকা লাগবে না। খুব দ্রুতই বিষয়টি বাংলাদেশ/ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র/ ভারত ঈস্যু হয়ে যাবে। চলে আসবে নানান হিসেব নিকেষ। শুরু হবে সাথে অর্থনৈতিক হিসেব- নিকেষও। ফুলেফেঁপে উঠবে অত্র অঞ্চলের রাজনীতির নামে রাজনৈতিক নতুন মেরুকরণ ।
বাংলাদেশকে অত্র অঞ্চলের ভূরাজনৈতিকপ্রভাব সহ রাজনৈতিক দিকটি বিশেষ বিবেচনা করা উচিত। নতুবা এর ফল একেবারেই ভিন্ন হয়ে সামনে আসতে পারে, যা সম্ভবত কল্পনারও বাহির। এখানে স্পষ্টতই বলছি, মার্কিনীদের চাপ বা প্রভাবের তলে এসে হুট করে এখনই সমঝোতাস্মারক সই করা হীতে বিপরীত হতে পারে। এই হীতে বিপরীত বিষয়টি বাংলাদেশ সরকার যতটা স্মরণে রাখবে ততই মঙ্গল সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য।
চীন জিডিআইতে মূলত উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়েই এগুতে চায়। তবে প্রশ্ন বারবার সামনে চলে আসে, কেনো এমন অস্বস্তিকর মূহূর্তেই এই সমঝোতাস্মারক সই হতে হবে ? যেখানে বাংলাদেশ ও ওয়াশিংটনের মধ্য চলছে টানাপোড়ন। এমন সময়ে মঝোতাস্মারক সই করা নিয়ে পরিস্থিতি আরও অস্বস্তিকর হবে দুই রাষ্ট্রের মাঝে, এটা চোখ বন্ধ করেই বলা যায়। চীন কিন্ত সেই সুযোগের সন্ধানে বসে আছে, এটা বলাই বাহুল্য। সুতরাং বলতেই হয়, ভাবিয়া কাজ করাই হবে সর্বোচ্চ উত্তম। নিশ্চয়ই এমন অস্বস্তিকর পরিবেশেও সরকার সঠিক সিদ্ধান্তেই পৌঁছাতে পারবে।
একজন সাধারণ আম জনতা হিসেবে শুধু বলতে পারি, বর্তমান বিশ্বে যে বচনটি চালু আছে,”মার্কিনীরা যাদের বন্ধু- তাদের শত্রুর প্রয়োজন হয় না” ঠিক উল্টোদিকে “বর্তমানে চীনারাও যাদের বন্ধু- তাদেরও শত্রু নতুন করে খোঁজার প্রয়োজন হয় না” কেননা এই দুই পরাশক্তি বর্তমান বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডে একে অপরের ঘাড়ে চড়ে অপরকে ঘায়েল করতে মরিয়া। এই দুই শক্তিধর রাষ্ট্রই একে অপরের ঘাড়ে চড়ে ঘায়েলের পথ খুঁজলেও, অপরের ঘাড়ে বন্দুক রেখে গুলি চালানোটাই তাদের জন্য সৎ সুযোগ হয়ে আসে। এমন বহু প্রমাণ সাম্প্রতিককালে উদহারণ হয়ে জ্বলজ্বল করছে।
লেখার শেষে বলি, সময়ের হিসেব সময়ে করুন। যতটুকু খবর জানি আগামী সেপ্টেম্বরে ভারত সফরে যাবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। চীন সেই সেপ্টেম্বরের আগেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে নেমন্তন করতে আগ্রহী বলেও বাতাসে খবর হয়ে ভাসছে। কেনো ? সেটার উত্তরটি সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের সরকারকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। আবেগ (emotion), জেদ (stubbornness), অপরিপক্ক (immature) কিংবা অপরিকল্পিত (unplanned) সবকিছুই যুদ্ধ জয়ী স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রকে বিপদে ঠেলে দিতে পারে। সত্যি বলতে, এই মূহূর্তে জাতিয় স্বার্থেই রাজনীতিবিদদের পরিপক্কতাই ১৮ কোটি জনগণের ভরসা হতে পারে। রাজনীতিবিদরাই সবসময় বলেন, সবার আগে দেশ।
প্রশ্ন করতেই হয়, যদি সবার আগে দেশ হয়ে থাকে তাহলে আপনারা বচনে নয়, কর্মে প্রমাণ রাখুন, সম্মিলিত। আমরা আপনাদের উপরেই ভরসা রাখতে চাই। মূলত আপনারাই রাষ্ট্রের মূল হর্তাকর্তা বা সর্বময় কর্তা।। জানি, আপনাদের মতন বিজ্ঞ ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের দৃষ্টিকোণে আমরা সাধারণ জনগণ কেবলমাত্র উচ্ছিষ্ট, এঁটো বা পরিত্যক্ত। আমরা না হয় পরিত্যক্ত থাকবো তবুও ১৮ কোটি জন
তার স্বার্থে সঠিক সিদ্ধান্তেই পৌঁছান। অন্তত দেশটি সার্বভৌম থাকুক।

বুলবুল তালুকদার
যুগ্ম সম্পাদক/ শুদ্ধস্বর ডটকম