
‘হাতে লাগে ব্যথা রে, হাত ছাইড়া দাও সোনার দেওরা রে…।’ কোক স্টুডিও’র ‘দেওরা’ শিরোনামের এই গানটি এখন সবার মুখে মুখে। মাত্র ১০ দিনে গানটি দেখেছেন প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। এই গানের সুবাদে দেশ-বিদেশের শ্রোতাদের কাছে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন ইসলাম উদ্দিন পালাকার। যার কণ্ঠে প্রাণ ফিরে পেয়েছে ‘দেওরা’ গানটি। আর এই মানুষটিকে খুঁজে বের করেছেন সংগীতশিল্পী প্রীতম হাসান। গল্পে গল্পে ইসলাম উদ্দিন পালাকার জানালেন তার ফেলে আসা কথা।
শুরুতেই তিনি জানান, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার নোয়াবাদ গ্রামের দারিদ্র্য বাসিন্দা রবিউল্লাহ’র ছেলে তিনি। অভাবের সংসারে চার ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার বাবার চলতে খুব কষ্ট হতো। বাবার ইচ্ছে ছিল, ছেলেরা সংসারের দায়িত্বে অংশ নেবে। কিন্তু ছোট ছেলে ইসলাম উদ্দিন ছিল ডানপিটে। ছোটবেলা থেকেই গান-বাজনা আর যাত্রা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। আর এ কারণে বাবার বহু বকুনিও খেতে হয়েছে তাকে।
মাত্র ১২ বছর বয়সে যাত্রাপালায় নাম লিখান ইসলাম। বিষয়টি বাবা রবিউল্লাহ ভালো ভাবে নেইনি। বাবার শাসনের ভয়ে একদিন হঠাৎ করেই ঘরে থেকে পালিয়ে যান তিনি। ঠাঁই নেন বাউলগানের শিল্পী কুদ্দুস বয়াতির বাড়িতে। অল্প ক’দিনেই বনে যান তার শিষ্য। এভাবেই বাউল ও পালাগানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ছোট্ট সেই ইসলাম। ১৯৮৯ সালের শেষের দিকে ‘ইসলাম উদ্দিন কিচ্ছাকার ও তার দল’ নামে একটি পালাগানের দলও গঠন করেন তিনি।
ইসলাম উদ্দিন পালাকার কাছে জানতে চাওয়া হয়, কোক স্টুডিওতে গান গাওয়ার প্রস্তাব কীভাবে এল। তার কথায়, ‘কিছুদিন আগে কোক স্টুডিও থেকে এক ভাই ফোন করে যোগাযোগ করতে বলে। দেখা করতে গিয়ে দেখি অর্ণব ভাই, প্রীতম ভাইসহ অনেকেই আছেন। গান গাওয়ার বিষয়টি নিয়ে শুরুতেই তাদের সঙ্গে কথা হয়। প্রথমে একটু ভয়ে ছিলাম, এমন বড় একটি স্টেজে গান গাইবো! এরপর গানের সুরটা শুনলাম। তখন মনে কিছুটা সাহস পেলাম। কারণ এমন সুর নিয়ে প্রায়ই আমাকে মঞ্চে উঠতে হয়। আর গানের কথাগুলোও ছিল তাল ধরে রাখার মতো। মূলত, এটি নৌকা বাইচের গান, দোহারে বেশি দেখা যায়। তাই সাহস নিয়েই গানটি গেয়ে ফেললাম।’
অভিজ্ঞতা কেমন ছিল জানতে চাইলে ইসলাম উদ্দিন পালাকার বলেন, ‘এক কথায় খুব ভালো। গানটি গাইতে গিয়ে আমিও অনেক কিছু শিখেছি। অর্ণব ভাই, প্রীতম হাসান ভাইসহ যারা ছিলেন সবাই খুব ভালো। এই গানের বড় কারিগর প্রীতম ভাই। আমি আগেই বলেছি, “দেওরা” হলো বাইচের গান। তিনি এটাকে মজা করে সবার সামনে উপস্থাপন করেছেন। আর আমাদের অভিনয়টাও হয়েছে আনন্দের মধ্য দিয়ে। গানটা সবার ভালো লাগবে- এমনটা রেকর্ডিংয়ের সময়ই কিছুটা বুঝতে পেরেছিলাম আমরা।’
‘দেওরা’ তো সুপারহিট। এর প্রাপ্য সম্মানি কি পেয়েছেন? উত্তরে তিনি বলেন, ‘সব কিছু টাকা দিয়ে বিচার করা যায় না। আমি মনের আনন্দের জন্য গান করি। কে, কত টাকা দিল সেটা বড় কথা না। গানটি গেয়ে নিজে তৃপ্ত হয়েছি এবং অন্যদের আনন্দ দিতে পেরেছি- এটাই আমার বড় পাওয়া। আর আমি কোনো অনুষ্ঠানেই বলি না যে, আমাকে এত টাকা দিতে হবে। সেদিক থেকে কোক স্টুডিও আমাকে যা দিয়েছে তাই অনেক। তারা পারিশ্রমিক দিয়েছে, বড় মঞ্চে গান গাওয়ার সুযোগ দিয়েছে- এটাই আমার জন্য অনেক। যদি সুযোগ পাই বারবার কোক স্টুডিওতে আমি গাইতে চাই।’
আপনি তো গ্রামে থাকেন। শহরে থাকতে ইচ্ছা করে না? জানতে চাইলে পালাগানের এই শিল্পী বলেন, ‘কাজ না থাকলে আমি ঢাকায় থাকি না। গ্রাম আমার খুব ভালো লাগে আর গ্রামই আমার সব। আরেকটা বিষয় শহরের মানুষের কাছে পালাগানের খুব একটা কদর নেই। গ্রামের মানুষের কাছে এর মর্যাদা অনেক। তা-ই আমার গ্রামে থাকা। আমি সেখানেই ভালো আছি।’
নিজ পরিবার সম্পর্কে এই শিল্পী বলেন, ‘আমার বাবার নাম রবিউল্লাহ ও মা আমেনা। আমরা চার ভাই ও এক বোন। আমি সবার ছোট। আমার দুই মেয়ে ও এক ছেলে আছে। সবাইকে নিয়ে আমরা গ্রামেই থাকি।’
নিজের পালাগানের সংখ্যা কত জানতে চাইলে ইসলাম উদ্দিন পালাকার বলেন, ‘এসব গান তো পুরোনো কিচ্ছা-কাহিনি নিয়ে তৈরি। তাই গানগুলো আমার লেখা এমনটা বলা যাবে না। এসব গল্প নিজের মতো করে সাজিয়ে পরিবেশন করাটাই আমার কাজ। কিচ্ছার ফাঁকে ফাঁকে নানা রকম গান থাকে। সেগুলোই আমি লিখি। অনেক পালা আমি করেছি। আমার সংগ্রহে অনেক অনেক গানও আছে।’ সুত্র, আমাদের সময় ।