
ছোটবেলায় পড়া গল্প যে জীবনের পরতে পরতে কাজে লাগবে তা কি আমরা কেউ ভেবেছিলাম? সেই যে বুদ্ধিমান বিদূষক যিনি রাজদরবারে রাজার সামনে কথা বলতে এসে বিনয়ে বিগলিত হয়ে জানতে চেয়েছিলেন মহারাজ! সভয়ে বলব না নির্ভয়ে বলব? মহারাজ বললেন, নির্ভয়ে বলো। এত বড় রাজার সামনে কথা বলা, রাজা অভয় দিয়েছেন, সংশয় তো তবুও যায় না। তিনি জানতে চাইলেন, প্রিয় কথা বলব, না প্রয়োজনীয় কথা বলব? এটা একটা গল্প কিন্তু তা যেন জড়িয়ে আছে আমাদের বর্তমান সময়ের সঙ্গে।
ভয়ে ভয়ে কথা বলা বা চুপ করে থাকার সংস্কৃতি প্রবল রূপ নিয়েছে। প্রিয় কথা বলার নামে তোষামোদি প্রায় শিল্পের রূপ নিয়েছে আর নির্ভয়ে প্রয়োজনীয় কথা বলা ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাংবাদিক শামসুজ্জামানের তৈরি সংবাদের কারণে তাকে গ্রেপ্তার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের; র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যু নিয়ে তোলপাড় হয়েছে দেশ। সংবাদ প্রকাশ করা সঠিক হয়েছে কিনা, গ্রেপ্তার করা এবং মামলা দেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। বিতর্কটা তুমুল এবং বিষয়টাও তুচ্ছ নয়।
যদি প্রশ্ন করা হয়, একের স্বাধীনতা কি অন্যের নিরাপত্তাকে বিপদাপন্ন করে তোলে কিনা? স্বাধীনতার সীমা এবং নিরাপত্তার মাপকাঠি কী হবে? আইন করে নিরাপত্তা সুরক্ষিত হবে নাকি স্বাধীনতাকে সংকুচিত করা হবে? বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ বলতে কী বোঝাবে? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কাকে নিরাপত্তা দেবে? এসব প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সাম্প্রতিক প্রয়োগ নিয়ে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আশঙ্কা, আতঙ্ক ও আলোচনা তো কম হলো না। আইন প্রণয়নের সময় থেকেই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বলেছিলেন এবং এখনো বলছেন এই আইনের অপপ্রয়োগ হবে না এবং আইনটি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না। গত বছর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করার সঙ্গে সঙ্গেই কোনো সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হবে না। (সমকাল, ২১ মে ২০২২)। এতেই স্বস্তি ফেরেনি। কারণ আইনটা এমন যে, এর প্রয়োগটাও ভয় ধরাতে পারে।
২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়েরকৃত ৪২৬টি মামলা বিশ্লেষণ করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) দেখিয়েছে যে, এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৯১৩ জনকে। তাদের মধ্যে ১১ শতাংশের বেশি রাজনীতিবিদ এবং ১০ শতাংশের বেশি সাংবাদিক। এসব মামলায় আটক হয়েছেন ২৭৩ জন, যাদের মধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশ হচ্ছেন সাংবাদিক। গবেষণা থেকে যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে তাতে দেখা যায়, রাজনীতিবিদরা বেশি অভিযুক্ত হলেও আটকের তালিকায় সাংবাদিকরাই আছেন বেশি।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কোনো সংবাদের বিরুদ্ধে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে তিনি প্রতিকার পাওয়ার জন্য প্রেস কাউন্সিলে যেমন যেতে পারেন আবার মানহানিকর কোনো বিষয়ে প্রতিকার পাওয়ার জন্য দণ্ডবিধিতেই (৪৯৯ ধারা) বিধান রয়েছে। কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হওয়ার পর থেকে কোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো সংবাদ বা সমালোচনামূলক এমনকি ইঙ্গিতপূর্ণ বা রসিকতামূলক ফেসবুক পোস্টদাতার বিরুদ্ধেও মানহানির অভিযোগ এনে মামলা হচ্ছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এমন সব ব্যক্তি মামলা করছেন, যারা সরাসরি ওই সংবাদ ও ফেসবুক পোস্টের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত নন।
এই আইনের সবচেয়ে বড় ভয় এবং যে দুর্বলতা (অনেকের ধারণা তা রাখা হয়েছে সচেতনভাবেই) সেটা হলো, এই আইনে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা’র কোনো সংজ্ঞা নেই। ফলে রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিক অন্য যেকোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা করতে পারছেন এবং এ আইনের এমনই দারুণ ক্ষমতা যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এমনকি মামলা হওয়ার আগেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে ফেলছে।
নাগরিকের ব্যক্তিগত সুরক্ষার কথা বলা হলেও এই আইনের প্রধান লক্ষ্য যে সেটি নয়, তা বেশকিছু ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে। ফলে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যা সংবাদমাধ্যম বা গণতন্ত্রের পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক।
ঘটনা যা ঘটে, তা বলা বা লেখা কি বিপদের কারণ হবে? সিজিএসের ‘দ্য আনএন্ডিং নাইটমেয়ার : ইমপ্যাক্টস অব বাংলাদেশ’স ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত ২৬ মাসে এই আইনের অধীনে ৮৯০টি মামলা দায়ের হয়। প্রতি মাসে গড়ে ৮৬ জনের বেশি মানুষসহ ২ হাজার ২৪৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।’
‘দ্য গ্লোবাল ফ্রি এক্সপ্রেশন রিপোর্ট-২০২২’-এর প্রতিবেদন অনুসারে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতায়’ সবচেয়ে তলানিতে থাকা ৫টি দেশের একটি। স্বাধীন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার এটাই বাস্তব চিত্র!
যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের আবেগ এবং গর্ব সেই যুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বা ফিরে এসেছিলেন, বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন-আশার জায়গা ছিল অভিন্ন। সবারই প্রত্যাশা ছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তা হবে সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক দেশ।
স্বাধীন দেশে শোষণমুক্ত অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে, সেখানে মানবাধিকার নিশ্চিত করা হবে, প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণ প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি প্রত্যেকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, নিরাপত্তা থাকবে জীবন ও সম্পদের।
সেই স্বপ্ন-আশার যেটুকু অর্জিত হয়েছে, যেটুকু হয়নি, না হলে কেন হয়নি দেশ স্বাধীনের পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসব প্রশ্ন জনগণের মনে আসাটাই তো স্বাভাবিক। সেই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে মানুষের মনে আবেগ তৈরি হওয়াটাও তো স্বাভাবিক! সেই আবেগ প্রকাশকে যদি স্বাধীনতার প্রতি কটাক্ষ আর ষড়যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাহলে স্বাধীনতা আর পরাধীনতার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ হবে কীভাবে?
ভোট ও ভাতের লড়াই এ দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের। কিন্তু এত উন্নয়নের পরও মানুষের পেটে ভাতের অবস্থা কী? গত ২৯ মার্চ বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম তাদের এক গবেষণায় উল্লেখ করে, ‘প্রয়োজনের তুলনায় খাবার কম খাচ্ছেন নিম্ন আয়ের ৭১ শতাংশ পরিবার। গত ছয় মাসে তাদের জীবিকার খরচ ১৩ শতাংশ বেড়েছে। একবেলা না খেয়ে থাকছে ৩৭ শতাংশ নিম্নআয়ের পরিবার। ৭৪ ভাগ নিম্ন আয়ের পরিবার ধার করে চলছেন। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের নিম্ন আয়ের মানুষ ব্যাপকভাবে খরচ কমিয়েছে। পোশাক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।’
আবার বিবিএস রিপোর্টে বলছে, দেশের মূল্যস্ফীতি গত মার্চে ৯ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এই রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে কোনো শ্রমিক সংগঠন যদি বলে, এই সামান্য মজুরি দিয়ে কী করব? এই মজুরিতে সংসার চলে না। তারা যদি মজুরি বৃদ্ধির দাবি করে আন্দোলনে নামে, তাহলে কি গবেষকরা দায়ী হবেন? শিল্পে অসন্তোষের দায়ে অভিযুক্ত হবেন?
শাসক দলের কর্তাব্যক্তিরা সব সময় বলতে পছন্দ করেন যে, তাদের আমলে যে উন্নতি হচ্ছে তা বিগত কোনো আমলেই হয়নি। কথা তো সত্য। কারণ আগে যা হয়েছে, তা তো আর হওয়ার উপায় নেই। এখন যা হবে সব তো নতুনই হবে। ফলে সফলতার শ্লাঘা থাকবেই। কিন্তু এই আলোচনাও তো থাকতে হবে যে, আর কী কী হতে পারত? কেন হলো না সেই প্রশ্ন এবং সমালোচনাও তো থাকবে। ক্ষমতায় থাকলে সমালোচনা হবে, কেউ করবেন ভালোর জন্য আবার কেউ করবেন ত্রুটি দেখিয়ে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য।
কিন্তু সমালোচনাটা হবেই এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে জনগণের স্বার্থে সমালোচনা করতেই হবে। আর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা না থাকলে এবং গণতান্ত্রিক মানসিকতা থাকলে জবাবদিহির পরিবেশ থাকে না আর তখন শাসকরা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। অগণতান্ত্রিক পরিবেশে সমালোচনা করা সম্ভব হয় না সেটা তো সবার জানা কথা। সে কারণেই নিবর্তনমূলক আইনের বিরোধিতা হয়েছে স্বাধীনতাপূর্ব এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সব সরকারের আমলেই।
কিন্তু জনগণ স্বাধীনতা চাইবে তার স্বপ্নের কথা, তার স্বপ্নভঙ্গের কথা বলার জন্য এবং নিরাপত্তা চাইবে তার স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া আছে। জনগণের বাকস্বাধীনতা আর ভাব প্রকাশের স্বাধীনতাকে কোনোভাবেই খর্ব করা হয়নি। বরং রাষ্ট্রকে বলা হয়েছে, যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ ছাড়া আর কোনোভাবে স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করা না হয়। ফলে জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ, তাই যদি কোনো নিরাপত্তা আইন দ্বারা জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করা হয় তখন প্রতিবাদ করেই স্বাধীনতাকে রক্ষা করার অধিকার সংবিধান জনগণকে দিয়েছে।
রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক দ্বিপক্ষীয়। রাষ্ট্র যদি তার কর্তব্য পালন করতে না পারে তাহলে সমালোচনা করার একটি নৈতিক এবং রাজনৈতিক অধিকারও থাকে। এই সমালোচনা করলে ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়ার আতঙ্ক থাকলে রাষ্ট্র এবং সরকার নিপীড়নের আইনি এবং আইনবহির্ভূত পদক্ষেপ নিতে থাকে। এতে শুধু গণতান্ত্রিক অধিকারই হুমকির মধ্যে পড়ে না, সরকারের প্রতি অসন্তোষটাও তীব্র হতে থাকে।
লেখক: রাজেকুজ্জামান রতন, রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট ।