প্রসঙ্গ: মঙ্গল শোভাযাত্রা

ক’দিন ধরে ১লা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে বেশ কিছু লেখালেখি পড়ছি। কেউ বলছেন এটা আবহমান বাংলার বা হাজার বছরের বাঙ্গালী সংষ্কৃতি, কারও মতে কোন বিশেষ ধর্মীয় সংষ্কৃতি। এ প্রসঙ্গেই কিছু বলা।
ছোটবেলায় ১লা বৈশাখে দেখেছি ব্যবসায়ী বা মহাজনদের গদী দোকানে হালখাতা করতে। সেসব অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতরা এসে সারা বছরের বাকি শোধ করে খাতা হালনাগাদ করতেন। এ উপলক্ষ্যে আমন্ত্রিতদেরকে মিষ্টিমুখ করানো হতো। আমরা রসগোল্লা চমচম বা নিদেনপক্ষে কয়েকটা বাতাসার জন্য আশেপাশে ঘুরঘুর করতাম। কোন কোন গঞ্জে মেলা বসতো। থাকতো নাগরদোলা চরকী। তবে বড় মেলাগুলো বসতো পৌষ সংক্রান্তিতে। এসব আচার অনুষ্ঠানে কোন ধমীর্য় লেবাস থাকতো না। হিন্দু মুসলমান মিলিতভাবেই অংশ নিতো। তবে এই আচারগুলো বেশী প্রচলিত ছিল গ্রাম এলাকায়। শহুরে জীবনে এর খুব একটা প্রভাব দেখা যেতো না।
আমাদের দেশে সাধারনত: সাংষ্কৃতিক কর্মকান্ডের উৎকর্ষতা সাধিত হয়েছে অগনতান্ত্রিক শাষনকালগুলোয়। পাকিস্তান আমলে আইউব খান যখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করতে গনতন্ত্রের রাশ টেনে ধরেছিলেন তখন বিকল্প হিসাবে স্বাধীনচেতা বা রাজনীতির অগ্রসরমান অংশটি সাহিত্য সংষ্কৃতির অঙ্গনকে প্রতিবাদের মাধ্যমে হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েকটি প্রগতিশীল সাংষ্কৃতিক সংগঠন। স্বাধীনতার পর অস্থির সময়ে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন গড়ে ওঠে। মঞ্চস্থ হয় অনেক প্রতিবাদী এবং জীবনমুখী নাটক। কবি সাহিত্যিকদের কলম থেকে এ সময় বের হয়ে আসে অনেক বিপ্লবী এবং কালজয়ী রচনা। এই ধারা অব্যাহত থাকে জিয়াউর রহমানের মার্শাল ল’র শাষনকালেও। এরশাদ আমলের প্রথম দিকে রাজনীতি বন্ধ বা সীমিত থাকার সময় সাংষ্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে অনেক রাজনৈতিক এ্যাক্টিভিস্ট তাদের চিন্তাচেতনা তুলে ধরেন।
ঢাকায় স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত বাংলা নববর্ষ বলতে ওয়াহিদুল হক ভাইয়ের উদ্যোগে ছায়ানটের পরিবেশনায় রমনার এক পাইকর গাছের গোড়ায় (রমনার বটমূল বলে পরিচিত) প্রধানত: রবীন্দ্র সঙ্গীতের অনুষ্ঠান বোঝাতো। তাও এ অনুষ্ঠান ছিল খুবই সীমিত পরিসরের। স্বাধীনতার পর দিনেদিনে এর ব্যপ্তি বাড়তে থাকে। মানুষ ভোর বেলায়ই পাজামা পাঞ্জাবী পড়ে রমনায় হাজির হয়ে যেতো। এরশাদ আমলের গোড়ার দিকে এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে তরুন যুবকদের মধ্যে পান্তা খাওয়ার একটা চল শুরু হয়। ঘটনাটা ঘটে এভাবে- রমনা পার্কের পশ্চিম দিককার দেয়াল ঘেষে বেশ কিছু ছিন্নমূল মানুষ চট বা পলিথিনের ছাউনী তুলে বসবাস করতো। সকালে তারা নুন মরিচ বা কিছু সালুন দিয়ে পান্তা খেয়ে কাজে যেতো। একবার ছায়ানটের অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র সে দৃশ্য দেখে মজা করতে তাদের কাছ থেকে কিছু পান্তা চেয়ে খায়। পরের বছর থেকে এই প্রবনতা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ছাত্রদের দেখাদেখি কিছু সৌখিন বর্ষপ্রেমীও বসে যায়। পান্তার বিনিময়ে ছিন্নমূলরা টাকা পয়সা নেওয়া শুরু করে। এবং বছরের এই দিনটায় তারা পান্তা বিক্রিকে একটা ব্যবসা হিসেবে নেয়। অনুষঙ্গ হিসেবে যুক্ত হয় ইলিশভাজা নানা রকমের ভর্তা। দেখা যেতো পয়লা বৈশাখের ভোর থেকেই সাড়িসাড়ি ছাউনির সামনে ছিন্নমূলরা পান্তার হাড়ি নিয়ে বসে গেছে। খদ্দেররা তাদের সামনে বসে মাটির সানকি বা খোড়ায করে নুন মরিচ বা ভর্তা ভাজি দিয়ে পান্তা খাচ্ছে। দুইএক বছরেই মুখেমুখে ছড়িয়ে পরে পান্তা ইলিশের কথা। এর পর থেকে রমনার ভেতরেই পান্তা ইলিশের বড় বড় দোকান বসে যায়। ছায়ানটের গানবাজনার চাইতে এক শ্রেণীর বর্ষপ্রেমী পান্তা ইলিশে আগ্রহী হয়ে পড়েন বেশী। এই ধারাবাহিকতায় কয়েক বছরেই ঘরেঘরে পান্তা ইলিশ চালু হয়ে যায়। আর এখন তো বাংলা নববর্ষ মানেই পান্তা-ইলিশ! আগের দিন বাজারে ইলিশ পাওয়া যায় না। এভাবেই নববর্ষে পান্তা-ইলিশ সংষ্কৃতির চল।
আজকের যে মঙ্গল শোভাযাত্রা, তাও এই সময়কালটায়ই শুরু। প্রথমে এর নাম ছিল আনন্দ শোভায়াত্রা। চারুকলার ছাত্রছাত্রীরা এই নামে একটা মিছিল বের করতো। পরে কিছু অতি উৎসাহী বুঝে না বুঝে এই মিছিলে রাক্ষসখোক্কস পশুপাখি নানা জীবজন্তুর মুখোশ-প্লাকার্ড যুক্ত করেন। প্রশ্নটা তখন থেকেই ওঠে। কেউকেউ এসব মুখোশের সাথে সনাতন ধর্মাবলম্বিদের কিছু দেবদেবী বা বিশ্বাষের সংস্রব খুঁজে পান। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর এই মিছিলের জৌলুষ এবং কলেবর বাড়তে থাকে। নাম পাল্টে হয়ে যায় মঙ্গল শোভাযাত্রা। এক পর্যায়ে মিছিলে জীবজন্তুর মুখোশের সাথে দাড়িটুপীধারী কিছু বিকৃত বা বিভৎস চোহারা প্রদর্শিত হতে থাকলে এই শোভাযাত্রায় সাম্প্রদায়িকতার রং যুক্ত হয়। এক পক্ষ বলেন এটা হিন্দুয়ানি সংষ্কৃতি অপর পক্ষের দাবী আবহমান বাঙ্গালী সংষ্কৃতি।
ঘটনাগুলো নিজের চোখে দেখা। সে হিসাবে নির্দ্ধিধায় বলতে পারি পান্তা ইলিশ বা মঙ্গল শোভাযাত্রা কোন হাজার বছরের বা আবহমান বাঙ্গালী সংষ্কৃতি নয়। এটা হিন্দুয়ানি সংষ্কৃতিও না মুসলমানি সংষ্কৃতিও না। সেদিনের চল বলে বলা যায় বাংলাদেশের সংষ্কৃতি। নববর্ষের এক অনুষঙ্গ।
এই অনুষ্ঠানে রাজনীতি ঢোকানো দু:খজনক। কেউ যদি কোন ধর্মীয় বিশ্বাষ বা আচার আয়োজন প্রতিফলিত করতে চান তাও নিন্দনীয়। জ্ঞান বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষতার যুগে সনাতনী ধ্যানধারনাপ্রসূত পশুপাখি জীবজন্তুর মুখোশ বহন করে কোন মঙ্গল কামনা করা হয় সে প্রশ্নও কেউ কেউ তুলেছেন। তারপরও বিতর্ক এড়াতে একটি নির্মল আয়োজনই উত্তম। আশা করবো সংশ্লিষ্টরা অনুষ্ঠানটাকে নিষ্কলুষ রাখতে যথেষ্ঠ সচেতন হবেন।
সাঈদ তারেক , লেখক , সাংবাদিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ।