
প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী কয়েকজনের কিছু ছবি দু’দিন যাবত সোস্যাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। কয়েকজন সাংবাদিককেও দেখা গেল। সবাই সিনিয়র। এবং বলাই বাহুল্য সবাই সরকারের অনুগত এবং প্রিয়ভাজন। হালচর্চায় সেটাই হবার কথা। বিরুদ্ধ মত বা সরকারের সমালোচনাকারি কারও তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হবার কোন কারন নাই।
এ নিয়ে আমার কোন বক্তব্য নাই। তবে এ প্রসঙ্গে অনেকদিন আগের একটি স্মৃতি মনে পড়লো, পাঠকদের সাথে সেটাই শেয়ার করছি।
’৭৩ সালের কোন এক মাসের কথা। বঙ্গবন্ধু যাবেন সদ্য মেরামতকৃত ভৈরব রেল সেতু উদ্বোধন করতে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ব্রিজটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলো, ভারতীয় সেনাবাহিনী খুব অল্প সময়ের মধ্যে সেটি মেরামত করে দেয়। তখন আওয়ামী লীগের দোর্দন্ড শাষনকাল। বঙ্গবন্ধু স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী। সর্বত্র তারই জয়গান। কিন্তু মজার ব্যপার হচ্ছে এই অবস্থার মধ্যেও বিরোধী রাজনীতি প্রবল পরাক্রমে বিরাজমান ছিল। আমি তখন সরকারবিরোধী গনকন্ঠ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার। সে আমলে সাংবাদিকদের অনেক মর্যাদা ছিল। আর বিরোধী মতের সাংবাদিক হলে তো কথাই নাই। মন্ত্রী আমলা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের সরকারি কর্মচারিরা ভয় পেতো। সমীহ করতো। কার নামে কি লিখে দেই, এই ভয়ে তটস্থ থাকতো। পুলিশকে ফোন করলে স্যার বলে সম্বোধন করতো, থানায় গেলে দারোগা ওসিরা দাঁড়িয়ে সালাম দিতো।
তো বঙ্গবন্ধু যাবেন ট্রেনে। ট্রেন বলে সাথে নিয়ে যাবেন মন্ত্রীসহ দলের সিনিয়রনেতা কর্মীদের। সাথে একদল সাংবাদিক। তখনও সরকারিভাবে সাংবাদিকদেরকে তুমি কার দল, আমার দল না ওর দল, সরকারি দল না বিরোধী দল- এসব বাছবিচারের চল অতটা চালু হয় নাই। সাংবাদিকদের ইউনিয়ন একটাই। ফলে দলমত নির্বিশেষে আমরা সাংবাদিকরা সকল সরকারি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রন পেতাম, মন্ত্রীদের পিআরওরা আমাদেরকে একটু বিশেষ তদবীর করতেন। সেবার প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে আমাদের কাগজের একজন প্রতিনিধিকেও আমন্ত্রন জানানো হলো। অফিস এ্যাসাইন করলো আমাকে।
ট্রেন ছাড়বে কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে, সকাল ৮টা কি সাড়ে ৮টায়। সাংবাদিকদেরকে প্রেসক্লাব থেকে কমলাপুর নিয়ে যাওয়া হবে সরকারি গাড়ীতে করে। ডিপিআইও আব্দুস সোবহান সাহেব একজন সিরিয়াস এবং নিষ্ঠাবান সরকারি কর্মকর্তা, তিনি দায়িত্বে সাংবাদিক দেখভালের। নির্দিষ্ট সময়ে সবাই প্রেসক্লাবে গাড়ীতে উঠে বসে আছে, আমি তখনও রাস্তায়। কলিগরা তাড়া দিচ্ছিলো গাড়ী ছেড়ে দিতে। সোবহান সাহেব আর একটু দেখি বলে সময় নিচ্ছিলেন। বিলম্বে ক্লাবে পৌঁছে দেখি সবাই অধৈর্য হয়ে আছে। আমি তখন বয়সে নবীন। গাড়ীতে বসা কেউ কেউ তাচ্ছিল্যের সাথে মন্তব্য করলেন, এই এর জন্য আমাদেরকে বসিয়ে রেখেছেন! ছিলেন ডিএফপির ক্যামেরাম্যান রফিক ভাই। তিনি তার স্বভাবসূলভ হাসি মিশিয়ে বললেন, ছোট মরিচের ঝাল বেশী! ও হলো গনকন্ঠের রিপোর্টার, ওকে রেখে গিয়ে সোবহান ভাই কি চাকরি খোয়াবেন!
এই ছিল তখন সাংবাদিকদের প্রতি সরকারি কর্মকর্তাদের এটিচ্যুড। আমি একটি অপজিশন পেপারের রিপোর্টার, প্রধানমন্ত্রীর সাথে সফর থেকে যেন বাদ না পরি তার জন্য একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার দায়িত্ববোধ।
যাই হোক, কমলাপুর থেকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ ট্রেন সময়মতোই ছাড়ে। বেশ কয়েকটা বগি ছিল। সবগুলোই বর্ণিল সাজে সজ্জিত। বঙ্গবন্ধু সিনিয়র মন্ত্রীদের নিয়ে বিশেষভাবে তৈরী কম্পার্টমেন্টে বসলেন। আমরা সাংবাদিকদের জন্য একটা সংরক্ষিত বগিতে। বঙ্গবন্ধু রেলপথে ভৈরব যাচ্ছেন, পথিমধ্যে সবগুলো স্টেশনেই গাড়ী থামলো। তিনি সব স্টেষনেই নেমে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখছিলেন। সে আমলের ট্রেনে এক বগি থেকে অন্য বগিতে যাওয়ার সুবিধা ছিল না। ফলে চলতি অবস্থায় আমরা আমাদের বগি থেকে বঙ্গবন্ধুর বগিতে যেতে পারছিলাম না। তারপরও একবার স্টেশনে দাঁড়ানো অবস্থায় সে কামড়ায় উঠে তার সাথে দেখা করলাম।
গাড়ীতে হালকা নাশতা দেওয়া হয়েছিল। পথেপথে থামায় ট্রেন ভৈরব এসে পৌঁছে দুপুরের পর। দেরী হয়ে গেছে, কোথায় যেন দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নাকেমুখে খেয়ে ছুটি অনুষ্ঠানস্থলের দিকে। বঙ্গবন্ধু জনসভায় ভাষনের পর ফিতা কেটে মেরামতকৃত ব্রীজের উদ্বোধন করেন। পরে ওই ব্রীজের ওপর দিয়েই ট্রেনে চেপে ওপার আশুগঞ্জ যান। আমরাও তার সাথে যাই।
আনুষ্ঠানিকতা এখানেই শেষ। এরপর তিনি বোধহয় হেলিকপ্টারে ঢাকা ফেরেন। কিন্তু আমাদের, মানে সাংবাদিকদের ফেরার কোন ব্যবস্থা দেখতে পাই না। ভীড়ে সোবহান সাহেবও যেন কোথায় হারিয়ে গেলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে ট্রেনে এসেছি ওটি এখনই ঢাকা যাবে না। সফরসঙ্গী অন্যরা যে যার মতো চলে গেছে। সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে, দ্রুত অফিসে গিয়ে রিপোর্ট লিখতে হবে। আমরা কয়েকজন হন্যে হয়ে এখানেওখানে ছুটে বেড়াতে থাকি। কোথাও থেকে কোন ব্যবস্থা না পেয়ে রাগে সোবহান সাহেবের পিন্ডি চটকে চলি। অবশেষে ভৈরবের স্টেশন মাষ্টার জানান একটু পরেই একটি মালগাড়ী ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। চাইলে তাতে চাপতে পারি। ডাইরেক্টই যাবে তবে পথে কোথাও ক্রসিংবিরতি নিতে পারে। অগত্যা কি আর করা, সোবহান সাহেবের উদ্দেশ্যে কিছু মধুর বচন ছুড়ে তাতেই চাপি। আমার সাথে বোধহয় আরও দুইএকজন ছিলেন। তাদের নাম আজ আর মনে নাই। অন্য সাংবাদিকরা কে কিভাবে সেদিন ঢাকা ফিরেছিলেন তাও জানি না।
সে রাতে অফিসে ফিরতে ফিরতে দুইটার ওপর হয়ে গেছিল। রিপোর্ট আর লেখা হয় নাই। বার্তা সম্পাদক নজরুল হক ভাই বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে বিএসএসের রিপোর্ট ছেপেছিলেন। আমি লিখেছিলাম পরের দিন। সোবহান সাহেবকে বাস্বুফাই করে। একটি প্রতিবেদন পেছনের পৃষ্ঠায় তিন কলামব্যপী ছাপা হয়েছিল। পরে একদিন দেখা হলে সোবহান ভাই মুখটা মলিন করে বলেছিলেন ছোটভাই, এইভাবে দিলা! জানা গেছিলো সেদিন সেই অব্যবস্থাপনার জন্য সোবহান সাহেবকে জবাবদিহি করতে হয়েছিল।
সাংবাদিকতার সেকাল এখন আর নাই। বঙ্গবন্ধুর পর জিয়াউর রহমান বা এরশাদ আমল পর্যন্ত সাংবাদিকদেরকে সম্মান সমীহের দৃস্টিতে দেখা হতো। সরকারি অনুষ্ঠান বা সরকারপ্রধানের প্রেস ব্রিফিংয়ে সব দল বা মতের সাংবাদিকরা আমন্ত্রন পেতেন। সরকারপ্রধানের সফরসঙ্গী হিসেবে পেশায় সিনিয়ররা অগ্রাধিকার পেতেন,তা সে তিনি যে মতেরই হোন না কেন। এখনকার মত শুধু অনুগতরাই সুযোগ পেতেন না ।
সাঈদ তারেক , লেখক এবং সাংবাদিক ।