
“জলের শ্যাওলা”– বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডে ৭০ বছরের উপর ডলার রাজ চালাচ্ছে। তবে সেই রাজের উপর রাজত্ব করতে প্রকাশ্যই হাত বসিয়েছে চীন। বলাই বাহুল্য বেশ আক্রমণাত্মক ও কৌশলী প্রক্রিয়ায় এগুচ্ছে চীন। ইতিমধ্যেই বিশ্বের ৪৫ টির মতন দেশ চীনের সেই আক্রমণাত্মক কৌশলের সাথেই আছে। মার্কিনীদের ডলারের রাজত্ব আগামীর সামনের দিনগুলোতে যে মুখথুবরে পড়তে পারে, সেটা ধীরে ধীরে অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে আসছে।
ডলারের রাজত্বকে পথে বসাতে মাস্টার মাইণ্ড প্ল্যান মূলত চীন দীর্ঘদিন ধরেই করে আসছে তবে এ যাবৎ তেমনভাবে এগুতে পারেনি। এবার রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ সেই মাস্টার প্ল্যানকে কার্যকর করতে বেশ সহযোগি ভূমিকায় রয়েছে। এই যুদ্ধ চীন রাশিয়াকে বেশ কাছাকাছিই এনে দিয়েছে। বিশেষ করে এখন অব্দি জ্বালানির মূল্যর বিনিময়ে যে পেট্রডলার ব্যবহার হয়ে আসছে বিশ্ব জুরে সেখানে আধিপত্য ঘটতে যাচ্ছে চীনের ইউয়ানের।
বিশ্ব জুরেই তেল বানিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু সৌদীর আরব। যে সৌদী মার্কিনীদের পরম বন্ধু বলে শোনা যায়, সেই সৌদীই এখন চীনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে বলেই বিশ্ব খবরে প্রকাশীত হচ্ছে। বেশ লক্ষ্যণীয় যে, মার্কিন ডলারের বর্তমান বিশ্ব বাজারে বেশ সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকট কিন্ত হঠাৎই আসেনি। পিছনে অনেক অনেক উপসর্গ নিহিত আছে।
সাম্প্রতিককালে ব্রাজিলের নির্বাচনে নতুন সরকার এসেছে। ল্যাটিন আমেরিকার এই দেশটির সরকার স্পষ্টতই ঘোষণা দিয়ে মার্কিনীদের বলয় থেকে বেরিয়ে এসে চীনের সাথে জুরেছে। এর কারণটিও বেশ পরিষ্কার কেননা ব্রাজিল ও চীন সব ধরণের বানিজ্য তাদের স্থানীয় মুদ্রায় করছে। বিশ্ব অর্থনীতির পত্রিকাগুলো খবর ছাপিয়েছে ব্রাজিল ইতিমধ্যেই চীনের সাথে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বানিজ্য করেছে। যেহেতু স্থানীয় মূদ্রায় লেনদেনে চীন হাত বাড়িয়েছে, সেই ক্ষেত্রে ডলারের জন্য আলাদা মূল্য শোধরানোর কোনো ঝামেলা নেই। এই সহজ বানিজ্য ব্যবস্থায় ইতিমধ্যেই দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া, তানজানিয়ার মতন দেশগুলো যোগ দিয়েছে চীনা মুদ্রার লেনদেনে।
মার্কিনীদের চোখ রাঙানিকে তোয়াক্কা না করে অন্যদিকে রাশিয়া রীতিমত ঘোষণা দিয়েই চীনের সাথে রুবেল ও ইউয়ানের মাধ্যমে লেনদেন করছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্য গত প্রায় এক বছর ধরে রাশিয়ার সাথে ভারতও রুপী ও রুবেলে বানিজ্য করে আসছে। এটা যে সামনের দিকে আরও বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে, সেটা অনেকটাই নিশ্চিত। চীনের সাথে ভারতে স্থানীয় মুদ্রায় বানিজ্যও চলছে বেশ জোরেসোরেই। কেবলমাত্র চীন রাশিয়াই নয় বিশ্বের ৪৫ টি দেশের সাথে ভারত স্থানীয় মুদ্রায় বানিজ্যের চুক্তিতে ইতিমধ্যেই আবদ্ধ হয়েছে। যেখানে চীন মূল কারিগর। ফলাফল বিগত এক বছরে মার্কিন ডলারের ধার অনেকটাই পিছিয়ে পরেছে।
চীনের অর্থনীতিক কৌশল অনূযায়ী আগামীতে চীনের মূদ্রা মার্কিনীদের ডলারে আঘাত হানবে বলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা ইতিমধ্যেই মত প্রকাশ করছেন। যদিও বর্তমানেও মার্কিন ডলারের আধিপত্যই বিরাজমান তবে এটাও সত্য ডলারের দূর্বলতা বেশ প্রকাশ্যই সামনে চলে এসেছে।
বিশ্বে একটি বড় ধাক্কা লেগেছে কোভিডের কারণে যেখানে অর্থনীতির বাজারে বিশ্ব জুরেই একপ্রকার ধ্বস নেমেছিলো। কোভিডের ধাক্কা সামলানোর পরপরই আসলো রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধ নতুন করে বিশ্ব অর্থনীতির বাজারে ধাক্কা দিয়েছে। কোভিডের মন্দা শেষ হতে না হতেই যুদ্ধের কারণে নতুন করে বিশ্ব জুরে মন্দা অর্থনীতি। ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের জের ধরে মস্কোর উপর পশ্চিমাদের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা হীতে হয়েছে বিপরীত। কেননা বিশ্বের অন্যতম তেল রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়ার উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ডালারের পরিবর্তে ভিন্ন মুদ্রা ব্যবহার করতে বাধ্য করেছে। ঠিক সেই সুযোগটাই চীন বেশ কৌশলের সাথে গ্রহণ করেছে কারণ চীন বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে বেশ শক্তিশালী দেশ এবং সেই অর্থের শক্তিকেই সামনে কাজে লাগিয়ে ডলারের উপর চাপ বাড়িয়ে চীন নিজেদের মূদ্রা ইউয়ানকে বিশ্ব বাজারে তুলে আনার প্রয়াশেই আছে এবং চীন এমন একটি দেশ যে, তাদের আপন স্বার্থের কারণে অর্থনীতির বাজারে বহুদূর পর্যন্ত হাত লম্বা করবে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোকে কড়া আয়ত্ত করতে । চীনাদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কাছে ডলার সামনের সময়ে নিশ্চিত হোঁচট খেতে যাচ্ছে, এটা বলাই যায় ।
মূলত পেট্রোডলার এর জায়গাটি পেট্রোইউয়ান করতেই চীন মরিয়া। তবে পেট্রোডলারে ধ্বস নামিয়ে পেট্রোইউয়ান গড়তে চীনকে বিশ্বের সব চাইতে বড় তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদীকে চীনের পাশে আনতেই হবে এবং সেটা হবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেবার কোনো সুযোগই নেই। লক্ষ্যণীয় যে, জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে ইরানও চীনের ইউয়ানে বানিজ্য করছে। চীন শুধু এখন টোপ গিলাতে সৌদীর দিকেই এগুচ্ছে। বলাই বাহুল্য সৌদী যদি নিজেদের স্বার্থে চীনের মাস্টার প্ল্যান বানিজ্যের পথেই পা বাড়ায় তাহলে চীনকে আর ধরে রাখার সামর্থ্য স্বয়ং মার্কিনীদের থাকবে না। তবে কাজটি যে চীন খুব সহজভাবে করে ফেলবে বিষয়টি কিন্ত অত তরল জল নয়।
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে ডলার যেভাবে টিকে থেকে বিশ্বকে শাসন করতে পেরেছে বিগত ৭০ বছর এবং এখনও করছে, আগামীর ভবিষ্যতেও কি বর্তমান সংকট থেকে বেরিয়ে এসে মার্কিন ডলারের মূল্য ও মান ধরে রাখতে সক্ষম হবে ? নাকি, ধীরে ধিরে ডলার তার মান ও রাজ হারিয়ে ইউয়ান- রুবেল- রূপীর সাথে সাথি হবে ? উত্তরটির জন্য খুব বেশিদিন অপেক্ষা যে করতে হবে না, সেটা স্বয়ং বিশ্ব অর্থনীতির বিশ্লেষকরাই বলছেন।
লেখার শেষে আমাদের মতন ছোটো অর্থনীতির দেশ নিয়ে বলেই শেষ করবো। আমাদের দেশটি জন্মের পূর্ব থেকেই মার্কিনীদের চোখ রাঙানি দেখে আসছে এবং সেই চোখ রাঙানি বেশ বহাল তবিয়তেই আছে। সেখানটায় বর্তমান সরকার অনেকটা বাধ্য হয়েই চারিদিকে হাত- পা ছড়িয়ে দিয়ে সাঁতরানোর প্রচেষ্টায় আছে। কৌশলটি সাম্প্রতিককালের তবে খুব বেশি মন্দ নয় বলেই প্রতিয়মান হয়। কেননা বিশ্বে একটি কথা চালু আছে, মার্কিনীরা যে দেশের বন্ধু, সেই দেশের শত্রুর প্রয়োজন হয় না। সেই সূত্রে বলাই বাহুল্য যে, আমাদের যদি মরতেই হয় সবার সাথেই মরা ভালো।
এটাতো জানা কথাই আমাদের মূল বানিজ্য মার্কিন মুল্লুক সহ পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে। অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলোও আবার মার্কিনীদের সাথেই মূল বানিজ্যের বাজার। সুতরাং বিশ্ব বাজার অর্থনীতিতে আমাদেরকে একটু বেশি সাবধানী ও বেশি কৌশলী হওয়াটাই বাণ্চনীয়।
বুলবুল তালুকদার
যুগ্ম সম্পাদক- শুদ্ধস্বর ডটকম