নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন, সকলে মুখে মুখে বলছেন, সামনের নির্বাচন অনেক ক্রুশিয়াল। আমি মনে করি, কোন কিছুই ক্রুশিয়াল না। আমাদের সংবিধান আছে, নির্বাচন নিয়ে কারও মাথা ঘামাবার দরকার নাই। একটি নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একজন রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার যা কিছু করার আমি তা করবো।

রবিবার দুপুরে গুলশানে একটি কনফারেন্স রুমে তার লেখা “এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ” বইটি  আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

হস্তান্তর অনুষ্ঠানে আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গনি স্বাগত বক্তব্য দেন। গবেষক অধ্যাপক ড. এম.  আবদুল আলীম তার বইয়ের ওপর আলোচনা করেন। বই প্রকাশের অনুভূতি ব্যক্ত করে বক্তব্য রাখেন নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের। ছাত্র জীবন, রাজনৈতিক জীবন, সংগ্রাম, আইন পেশা, দুদকের থাকার সময়ে চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব পালনসহ নানা বিষয়ে স্মৃতি চারণ করেন নতুন রাষ্ট্রপতি।

 

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, দেশের সংবিধান অনুযায়ী স্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি) একদম তাদের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা প্রয়োগ করে সংবিধানের আলোকে একটি নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে সক্ষম হবে। সেখানে রাষ্ট্রপতি একজন সুপ্রিম কমান্ডার হিসেবে আমার যেটুকু দায়িত্ব এই নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য, সমস্ত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য জন্য যতটুকু প্রয়োজন করবো।

 

মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, সাহস না থাকলে রাজনীতি করা যায় না। রাজনীতি করতে হলে দৃঢ়চেতা হতে হবে। আমি যখন দুদকে কমিশনারের দায়িত্ব পালন করি, তখন সরকারের ভেতরে ছায়া সরকার ছিল। একজন সিনিয়র মন্ত্রী, তিনি প্রয়াত। আমি তাকে দেশপ্রেমিক বলি, ভাষা সৈনিক বলি। অবশ্যই তিনি দেশপ্রেমিক ও ভাষা সৈনিক। তিনি এবং আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বললেন, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যা বলবে, তাই করতে হবে। আমি বললাম, হোয়াই? ওয়ার্ল্ড ব্যাংক কি আমাদের ফাদার-মাদার? আমার সঙ্গে তর্কবির্তকে আসুক। ওয়াল্ড ব্যাংক যা বলবে, আমি তা করতে পারবো না। আমরা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। আপনারা পারলে করে নেন। আমার একার দৃঢ়তার কারণে বিশ্ব ব্যাংকের এজেন্ডা পূরণ করতে দেইনি।

 

১৯৯৬ সাল থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের লেখা একুশটি কলাম ও স্মৃতিচারণমূলক লেখা,তিনটি সাক্ষাৎকার এবং তার জীবন সম্পর্কিত একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে। এছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার দুষ্প্রাপ্য। ঐতিহাসিক কিছু আলোকচিত্র বইটিতে যুক্ত করা হয়েছে।

মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা আমাকে গুরু দায়িত্ব দিয়েছেন। অনেকে চমক বলছেন। আমিও চমক বলি। আওয়ামী লীগের সংসদীয় দল-নেত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছেন। নেত্রী আমাকে নির্বাচিত করেছেন। তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ-কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমি কি ছিলাম, কেমন ছিলাম তা এই বইটা পড়লে সবকিছুই জানতে পারবেন।

তিনি বলেন, আমি দুর্দান্ত প্রকৃতির ছিলাম। না হলে পায়ে ডাণ্ডাবেরি দেয় কেমনে? দুর্দান্ত না হলে, সাহস না থাকলে রাজনীতি করা যায় না। সাহসিকতার সঙ্গে পদ্মা সেতু ফেস করেছি আমি একা। কী অবস্থা তখন হয়েছে? একটা পত্রিকা আমাদের স্বপক্ষে লেখে না। সব ইলেকটনিক্স মিডিয়া ওয়াল্ড ব্যাংকের পক্ষে লেখে। এই হলো, ওই হলো। চিলে কান নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। কেউ কানে হাত দেয়নি। আমি বলতাম, এসবগুলো কথাবার্তা বদমাইসি। আমার দুজন কমিশনার, একজন চেয়ারম্যান সাহেব হঠাৎ করে চুপ হয়ে গেলেন। কথা বলতে হয় আমাকে। আমি বিচার বিভাগ থেকে এসেছি, ড. কামাল হোসেনের আইন দ্বারা আমাকে পরাস্থ করা যাবে না। ড. কামাল হোসেন আর বন্ধু রশিদের আইন দ্বারা কি পরাস্থ করা যাবে? উনারা ছিলেন ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের টিমের উপদেষ্টা। উনারা জানেন কোম্পানি আইন, শ্রম আইন, উনারা কি  পেনাল কোড জানেন? সিআরপিসি জানেন? পেনাল কোড , সিআরপিসি যারা জানেন, তারাই মাত্র বুঝতে পারবে পদ্মা সেতুতের কি দুর্নীতি হয়েছে কিনা? সে কারণেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম।

রাষ্ট্রপতি বলেন, আমি যখন দুদকের কমিশনার ছিলাম, আমার একার দৃঢ়তার কারণে বিশ্ব ব্যাংকের এজেন্ডা পূরণ করতে দেয়নি। আমি সেদিন প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম, সরকারের ভেতরে ছায়া সরকার আপনার বিরোধীতা করেছে। তারপরও আপনি জিতেছেন। কারণ আপনি বলেছেন, পদ্মা সেতু করবো। আমি দেড় বছর আগে রিপোর্ট দিয়েছি, কোন কিছু নেই। তখন টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান সংবাদ সম্মেলন করে বললেন, এখনই কেন দুদক রিপোর্ট দিয়ে দিল? হোয়াই? আমরা তো স্বাধীন দেশ, স্বাধীন সংস্থা। বলতে কোন সমস্যা আছে? আমরা দেড় বছর ধরে তদন্ত করে পেলাম, কিছুই নেই। রিপোর্ট দিয়েছিলাম। তখন একজন রিপোর্টার বললেন, তাহলে কী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল? আমি বলেছিলাম, অবশ্যই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। আমরা যা বলেছিলাম, কানাডার কোর্ট অব জাস্ট্রিট দেড় বছর পরই একই কথা বলেছে। তারাও বলেছেন, চায়ের কাপের ঝড় তোলার মতো। যে কারণে ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো আমার কার্টুন ছেপেছে। আমার ব্যাঙ্গাত্মক ছবি দিয়ে লিখেছে দুদক। আমি সত্যের পথে আছি। আমরা যা দেড় বছর আগে দিয়েছিলাম, কানাডার কোর্ট সে রকমই রিপোর্ট দিয়েছিল দেড় বছর পরে।

‘এগিয়ে যাও বাংলাদেশ’ বইয়ের লেখক সাহাবুদ্দিন বলেন, এই বইটা আমি কেন রাষ্ট্রপতি হলাম, সেটা পরিস্কার হবে। তখন সবাই বলবে, প্রধানমন্ত্রীর চয়েস রাইট ছিল। ড. মসিউর রহমান হয়নি, অমুক হয়নি, তমুক হয়নি, সাহাবুদ্দিন হয়েছে, ঠিকই যথার্থ মানুষই হয়েছে। যদিও আমি নিজেকে যথার্থ মনে করি না। কিন্তু যিনি বাছাই করেছেন, তার চয়েসকে যথাযথই মনে করি। তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা আলোর দিশারী। বাংলাদেশ আজকে গর্বে গর্বিত। বঙ্গবন্ধুকন্যাকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। যিনি আমাকে চয়েস করতে দ্বিধান্বিত হননি, সংকোচ বোধ করেননি, কোন সমালোচনার স্বীকার হবেন সেটাও ভাবেননি। আমি মনে করি, তিনি যথাযর্থই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আমি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা হয়েছি চার বছর আগে। এই আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদে ঠাঁই হয়েছে, যেখানে আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদের মতো বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ আছেন। আমাকে দলের প্রচার-প্রকাশনা উপ-কমিটির চেয়ারম্যান করা হলো। যেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন এইচটি ইমাম। উনি রাজনৈতিক উপদেষ্টাও ছিলেন।

আওয়ামী লীগের সম্মেলনে আমাকে নির্বাচন কমিশনার বানিয়ে দিলেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক একটি দলে নির্বাচন কমিশনার হয়েছি এটাও আমার বড় পাওয়া। রাষ্ট্রপতি হওয়ার তিন মাস আগে প্রধানমন্ত্রীকে সালাম করতে গেলে উনি সালাম নিতেন না। আমি মন খারাপ করতাম, প্রধানমন্ত্রীর চরণধূলি পাই না। এজন্য আমার মনের ভেতরে চরম মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। কিন্তু তখন যে রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার নাম ‘প্রধানমন্ত্রীর মনে প্রতিথ হয়ে গেছে’ সেটা জানা ছিল না। আমার সালাম নিতে বিব্রত কর মনে করতাম, সেটা তো পরে বুঝতাম। উনি আমাকে গুরু দায়িত্ব দিয়েছেন, আমিও চমক বলছি।

তিনি বলেন, কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমরা চিনি, কিন্তু দেশবাসী তো তাকে চেনেন না। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, উনি একজন দেশপ্রেমিক, মুক্তিযোদ্ধা, প্রচারবিমুখ মানুষ। সে কারণে হয়তো অনেকেই চোনেন না। টকশোতে অনেকই কথা শুনেছি। বেশির ভাগ ভালোই শুনেছি। একটা টকশো দেখেছিলাম, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক ডেপুটি প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকনের জন্মদিনে উইস করেছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক আসিফ নজরুল অনেক কিছুই বললেন। খোকনের জন্মদিনের উইস করা নাকি আমার যোগ্যতার মাপকাঠি। এ নিয়ে আমি আর কথা বাড়াতে চাই না।

তিনি বলেন, আমি শুধু জেলার নেতা ছিলাম না। আমি জাতীয় নেতাও ছিলাম। বাংলাদেশের নেতাও ছিলাম। এমন কোন স্ট্রেজ নাই, যা আমি পার করে আসিনি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১৯৬৬ সালে যদি দেখা না হতো তাহলে হয়তো আমার ইতিহাস অন্য ধারায় লেখা হতো। জাতির পিতার ৬ দফা নিয়ে পাবনাতে গেলেন, প্রচার করতে। আমাকে বললেন, মাঠে আয়। আমি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনলাম। আমার মন থেকে বের হলো শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি। এটা ছাত্রলীগের স্লোগান। সিনিয়র নেতারা আমাকে ছাত্রলীগের সদস্য হতে বললেন। ১৯৭০ সালে আমি ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমি সভাপতি, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হলে আমি আহ্বায়ক, পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি ২৩ মার্চ। এরপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে প্রতিরোধ যুদ্ধে টিকতে না পারে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেই। কলকাতায় পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন পাবনার। উনিও পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে বিদ্রোহ করে মুজিব সরকার- ১৭ এপ্রিল যখন মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়, তখন আমিও ছিলাম সেখানে। মুক্তিযুুদ্ধে আমার অবস্মরণীয় অবদান। তিনি তার বইতে ছাত্রজীবনে তোফায়েল আহমেদ , আব্দুর রাজ্জাক , শেখ ফজলুল হক মনি , সিরাজুল আলম খানের নিবিড় সান্নিধ্যে ছাত্ররাজনীতি করার কথা উল্লেখ করেন ।

আমি রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলাম। বঙ্গবন্ধু যখন বাকশাল গঠন করলেন, তখন পাবনায় আমাকে জয়েন সেক্রেটারি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা। একমাত্র টেলিভিশনে দেখলাম, আমার নাম। এরপর শানে নুযূল জানার চেষ্টার করলাম। সে সময়ে আমি একটা কলেজের প্রভাষক। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম মনসুর আলীকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে কেন করল? উনি বললেন, তোমার মাস্টার্স এবং আইনের ডিগ্রিটাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। কারণ তুমি তো পড়ালেখা জানো। এরপর ১৯৭৫ সালে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিমের মাধ্যমে খবরটি পাওয়ার পর আমরা প্রতিবাদ মিছিল বের করলাম। এরপর জেলার এসপি আমাকে বললেন, ঢাকায় বস বাহিনী মুশতাক সরকারের অনুগত স্বীকার করেছে। তোমরা আত্মগোপনে চলে যাও। এরপর ভারত চলে গেলাম। ফিরে এসে গ্রেফতার হলাম। আমি আমি একাই নয়, আমার স্ত্রী এবং ৬ মাসের সন্তান রনিকেও নিয়ে আসা হলো। আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি রনিকে কেন নিয়ে এসেছো? সে বলেছিল, এই জন্যই আসছি, ও যত কাঁদবে, পুলিশ তত বেশি দরদি হবে। দুদিন রেখে সত্যিই ওকে ছেড়ে দিয়েছিল।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading