
উন্নয়নশীল দেশের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রঃ একটি রূপরেখা” পুস্তিকায় খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতির সমন্বয়ে একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপরেখা দিয়েছেন। আমার মতো অনেকের উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শ্রদ্বেয় শিক্ষক। তাই পুস্তিকাটি গভীর মনোযোগের সাথে পড়বেন। অনেকেই সংবিধানের গণতন্ত্র,ও সমাজতন্ত্র সমন্বয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থাও ভাববেন। পঞ্চাশোর্ধ সমাজতন্ত্রমনা অনেকেই আকাংখিত মডেল হিসেবে গ্রহণও করবেন।
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ কৈশোর–যৌবনে সমাজতন্ত্রবাদী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা এবং এসএম হলের ছাত্র–সংসদের ভিপি বা সম্পাদক ছিলেন। পূর্ব–ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পতনের পরে রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে এখন হয়তো গণতন্ত্রে আস্থাশীল হয়েছেন। অন্যদিকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিপণ্য ও বৃহৎ উৎপাদন সংস্থা বাদে ভোগপণ্য ও ক্ষুদ্র–উৎপাদন–বিপনণ এখন বাজার ব্যবস্থাতেও আস্থাশীল হয়েছেন। এ চেতনা থেকে হয়তো পুস্তিকাটি রচনা।
সমাজতন্ত্রের প্রতি ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের আস্থা না ভাঙার ব্যর্থতার দায় আমার উপরও পড়ে। আমার রাষ্ট্রচিন্তা ও উদ্যোগসমূহে যে “উচ্চতর সমৃদ্ধিশীল গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ” গড়ে উঠছে, তা ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি জানেন। আমার “প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠামো–প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা, ১৯৮৫”, প্রগতিশীল গণতন্ত্র (১৯৯১) বই, সংসদে (২০১০) ও সুপ্রীমকোর্টে (২০১১) উপস্থাপিত প্রতিবেদনদ্বয় এবং কিছু নিবন্ধও তাঁকে দিয়েছি। কয়েকবার মত–বিনিময়ও হয়েছে।
ধর্মের মতো মার্ক্সবাদও ‘প্রকৃতিদর্শন’ ও ‘সমাজদর্শন’–এর সমন্বয়ে হওয়ায় এর বিশ্বাসও মানুষের “গভীর ও মৌলিক” হয়। তাঁর এ রূপরেখাটি প্রকাশের আগে সংঘর্ষিক গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র একসাথে যায় কিনা সেটা বিবেচনার কথাও ফেসবুকে জানাই। অর্থনীতিতে তিনি পন্ডিত হলেও প্রচলিত তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন, প্রচলিত অর্থনীতিতে পুঁজিবন্টণের কোন তত্ত্ব নেই। আমার মতো সাধারণ ছাত্রের “প্রগতিশীল/সুষম গণতান্ত্রিক তত্ত্ব, তথ্য ও রাষ্ট্রচিন্তায় তাঁর গভীর মৌলিক বিশ্বাস ভাঙেনি।
–২–
মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রবক্তা হলেও এড্যাম স্মিথের তত্ত্বে উংপাদন–শ্রম বিভাজন ও দক্ষতা–প্রযুক্তি ছাড়া বৃটেনের সমৃদ্ধিশীল বাজার অর্থনীতির ভিত্তি, স্বরূপ ও ধারার মৌল–কারণগুলো উন্মোচন নেই। তাই ইউরোপের অর্থনীতির বাজারগুলোর পার্থক্য এবং ধনতন্ত্রের একচেটিয়ামুখী বিবর্তনের কারণ উন্মোচিত হয়নি। শিল্পবিপ্লবোত্তর রাষ্ট্রব্যবস্থা গণতন্ত্রমখী সংস্কার, প্রতিযোগী বাণিজ্য ও প্রান্তিক তত্ত্বগুলো দিয়ে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শ্রেণী–অসাম্য–মন্দাচক্রের সমাধানের চেষ্টা করা হয়।
উদাহরণসহ ব্যক্তি মালিকানায় উৎপাদন–বন্টণ প্রক্রিয়া, পুঁজির একচেটিয়ামুখী বিবর্তন, মহামন্দা এবং বাড়ন্ত অর্থনৈতিক শ্রেণী–অসাম্য–মন্দাচক্রের ধারা ব্যাখ্যা করলেও মার্ক্স ধনতন্ত্রের ভিত্তি ও ধারার মূলকারণ উন্মোচন করেনি। সমাজ বিবর্তনের তত্ত্বসহ বলেছেন, পুঁজির সমষ্টিক মালিকানায় তথা সমাজতন্ত্রে হলে এসকল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট থাকবে না। বাস্তবে কম–উৎপাদনশীল এবং একদলীয় রাজনতিক ও সরকারব্যবস্থার স্বৈরতার জন্যে সমাজতন্ত্রে বহুমুখী সংকটসমূহ আরও বাড়ন্ত হয়।
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও গণতন্ত্রকে রাজনৈতিক ও সরকারব্যবস্থা এবং ধনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতিকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে দেখেছেন। তাই ভেবেছেন, সরকারব্যবস্থা গণতান্ত্রিক হলে রাজনৈতিক সংকট কম থাকবে। অবকাঠামোসহ উন্নয়নশীল দেশে পুঁজিপণ্য ও বৃহৎউদ্যোগ সরকারীখাত বা সহায়তায় থাকে। তাই ভোগ্যপণ্য উৎপাদন–বিপনণ ব্যবস্থা ব্যক্তি পুঁজি–মালিকানা ও বাজার অর্থনীতিতে থাকলে অর্থনীতির বাড়ন্ত সংকটও থাকবে না।
ড. ও. মাহমুদের এমন রাষ্ট্রচিন্তার মূলে প্রচলিত পশ্চিমা সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের তত্ত্বগত সীমাবদ্ধতা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থার তত্ত্বসমূহ এখনও প্রাচীন গ্রীক বা ছোট–রাষ্ট্র আদলের। আর পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহের দেড় হাজার বছরের সামন্ত–ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর ক্রমশঃ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংস্কার হলেও শতবছরে এর রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক তত্ত্বসমূহ এখনও উন্মোচন হয়নি। তাই ধনতন্ত্র, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ব্যবস্থার ভিত্তি ও মৌলতত্ত্বগুলো অজ্ঞত।
–৩–
সামন্ত–ধনতন্ত্র–গণতন্ত্রে ব্যক্তি–সম্পত্তি প্রজন্মোত্তর স্থানান্তর হয়। ব্যক্তি মালিকানা নয়, সামন্ত–ধনতন্ত্র ব্যবস্থার ভিত্তি ও ধারার মূলে রোমান–ক্যাথলিক ধর্মের সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিধান। এ বিধানে প্রজন্মোত্তর সম্পত্তি একমাত্র জ্যৈষ্ঠতর উত্তরাধিকারীর কাছে স্থানান্তর হয়। বাকী সন্তানেরা বঞ্চিত হয়। এ পরিবারিক একচেটিয়া (Monopoly) বিধানে রাষ্ট্রে মুষ্টিমেয়মুখী (Oligopoly) মালিকানা ও বাজারের ধারা দেয়। এজন্যে সামন্ত–ধনতন্ত্রে প্রজন্মোত্তর অর্থনৈতিক শ্রেণী ও অসাম্যের সংকট বাড়ন্ত।
হিন্দু–বৌদ্ধ ধর্মের সম্পত্তি উত্তরাধিকার বিধানে পুরুষরা সমাধিকারী হলেও নারীরা বঞ্চিত। পরিবার ও রাষ্ট্রে এ আধা–গণতান্ত্রিক বিধান আয়ের অসাম্য বিন্যাস ছাড়া মালিকানা ও মালিকানাহীন অর্থনৈতিক শ্রেণীর ধারা দেয় না। কেবল পুরুষসন্তান ভিত্তিক আন্তঃপরিবারে পুঁজি–সম্পদ বন্টণের ধারা থাকায় এ বিধানে সামাজিক–শ্রেণীর ধারা দেয়। প্রজন্মোত্তর আধা–গণতান্ত্রিক বন্টন–মালিকানা ও সামাজিক–শ্রেণীর ধারা দেয়ায় এ বিধান স্বল্প–প্রতিযোগী বাজার অর্থনীতি ও স্বল্প–সমৃ্দ্ধির ধারা দেয়।
পুরুষ–নারীরা সম–অধিকারী হওয়ায় খৃষ্টধর্মের উত্তরাধিকার বিধান পরিবার ও রাষ্ট্রে সম–গণতান্ত্রিক। পুরুষ বা নারীরা সম–অধিকারী এবং বৈবাহিক অর্থনৈতিক বিধানের সমন্বয়ে পুরুষ ও নারীর উত্তরাধিকার বিধান অর্ধানুপাতিক। খৃষ্টীয় বিধানের উচ্চমাত্রার বিপরীতে নিম্নমাত্রায় বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ায় মুসলিম পাারিবরিক (অর্থনৈতিক ও উত্তরাধিকার) বিধান সুষম–গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল। উভয় বিধানে প্রতিযোগী বাজার অর্থনীতিসহ গণতন্ত্রমুখী আয় বন্টনের ধারা দেয়। আন্তঃ ও অন্তর পারিবারে পুঁজি–সম্পদ বন্টণ হওয়ায় অর্থনৈতিক বা সামাজিক শ্রেণীর ধারা দেয় না ।
সভ্যতা ও প্রযুক্তির প্রাগ্রসর, ব্যক্তি–মালিকানা রোমান সম্রাজ্যভুক্ত ও রাষ্ট্রধর্ম রোমান–ক্যাথলিকের একচেটিয়ামূখী উত্তরাধিকার বিধানের ধারাবাহিকতার জন্য ইউরোপে আদিমসমাজ থেকে দাসতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র ও ধনতান্ত্রিক সমাজ/রাষ্ট্রব্যবস্থার উৎপত্তি ধারাবাহিকতা। সামন্ত বা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অর্থনৈতিক শ্রেণী–অসাম্য–শোষণের একটি বিদ্রোহী ধারা হলো সমাজতন্ত্র যা চলে রাষ্ট্র/সমাজ মালিকানায়। খৃষ্ট/মুসলিম উত্তরাধিকার বিধানসহ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আরও উন্নতর ও সমৃদ্ধিশীল আর্থ–সমাজব্যবস্থা।
মানবজীবনের সহজাত প্রকৃতি, কর্ম–দায়িত্ব ও ভোগ–সঞ্চয় বোধের সাথে সঙ্গতিহীন হওয়ায় সমাজতন্ত্রের অর্থনীতিক ব্যবস্থা ক্ষয়িঞ্চ ও কম–উৎপাদনশীল। মানবজীবন একইসাথে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক। মানবজীবনের সহজাত প্রবণতা হলো স্বাধীনতা ও সমাধিকার ভিত্তিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা/ও সামাজিক সমদ্ধিশীলতা। তা স্থবির বা হ্রাস হলে বিদ্রোহ করে। এজন্যে একদলীয় ও স্বৈর–সরকার ছাড়া সমাজতন্ত্র ধারাবাহিক নয় (প্রগতিশীল গণতন্ত্র, ১৯৯১) ।
–৪–
সম্পত্তি উত্তরাধিকার বিধান মূখ্যত প্রজন্মোত্তর ব্যক্তি–মালিকানার স্থানান্তর ও বন্টণের ধারাসহ বাজার অর্থনীতির স্বরূপ ও ধারা দেয়। অগণতান্ত্রিক, আধা–গণতান্ত্রিক বা গণতান্ত্রিক উত্তরাধিকার বিধান প্রাতসংঙ্গীক আয়বন্টণেরও স্বরূপ ও ধারা দেয়। তবে অর্থনীতির বাজারব্যবস্থাসহ আয়বন্টণের স্বরূপ ও সমৃদ্ধির ধারা প্রধানতঃ রাষ্ট্র–অবকাঠামোর স্বরূপের উপর নির্ভরশীল। বৃহত্তর রাষ্ট্র প্রদেশ/অঞ্চল/বিভাগ–জেলা–উপজেলায় ক্রম–বিভক্তি/সমন্বয়ের জন্যে রাষ্ট্র–অবকাঠামো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে।
রাষ্ট্র–অবকাঠামো হলো বৃহত্তর রাষ্ট্রের রাষ্ট্রব্যবস্থার মূখ্য, মৌল ও, নৈব্যক্তিক প্রতিষ্ঠাণ যার উপর ভিত্তি করে সরকারী–বেসরকারী, জাতীয়–স্থানীয় ও ব্যক্তিক–সমষ্টিক সংস্থা–প্রতিষ্ঠাণ গড়ে উঠে এবং ক্রমশঃ বিভাজিত–সমন্বয় হয়। তাই রাষ্ট্র–অবকাঠামোর স্বরূপের পুনর্গঠণ হলো একইসাথে লক্ষ–কোটি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠণ/সংস্কার। আইনী প্রতিষ্ঠান এর প্রভাব হ্রাস–বৃদ্ধি করা যায়, কিন্তু নিঃশেষ করা যায় না।
রাষ্ট্র–অবকাঠামোর স্বরূপ স্বৈরমুখী, গণতন্ত্র ও সন্ত্রাসমুখী হলে বাজার অর্থনীতির স্বরূপও যথাক্রমে কম, সুষম ও অতি প্রতিযোগী হয়। কেবল অর্থনীতির স্বরূপই নয়, রাষ্ট্র–অবকাঠামো একইসাথে সামঞ্জস রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্রম–বিভক্তি/সমন্বয়ের স্বরূপও দেয়। রাষ্ট্রের এলাকা, জনগণ ও সংস্থাসমূহের প্রথম বিভাজন হওয়ায় প্রদেশ/অঞ্চল/বিভাগ প্রধানতঃ (প্রায় দুই–তৃতীয়াংশ) প্রভাবশীল। জেলা–উপজেলা–পল্লীর বিভাজনের প্রভাব আনুপাতিক ক্রমহ্রাসমান। রাষ্ট্র–অবকাঠামোর স্বরূপ গণতন্ত্রমুখী হলে উদার–আরোহ নগরচেতনাসহ সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ও রাজনৈতিক দিকগুলো সমৃদ্ধিশীল হয়।
গ্রেটবৃটেন–জাপান–কোরিয়ার অভিজ্ঞতামতে বৃহত্তর এককরাষ্ট্র বিভাগ–জেলা–উপজেলায় ক্রমবিভক্তির অনুপাত যথাক্রমে গড়ে ১: ৯ হলে গণতন্ত্রমুখী এবং ১: ১০ ১: ৯ ও ১: ৮ সুষম–গণতন্ত্রমুখী (প্রগতিশীল গণতন্ত্র, ১৯৯১)। গড় ১: ৯ থেকে ক্রমকম বা ক্রমবেশী হলে গণতন্ত্রমুখী স্বরূপ ক্রমহ্রাস পায়। গড় ১: ৫–এর ক্রমকম হলে স্বরূপ ক্রমবেশী স্বৈরমুখী এবং গড় ১: ১৩–এর ক্রমবেশী হলে ক্রমবেশী সন্ত্রাসমুখী স্বরূপ হয়। যুক্ত/ইউনয়ণ রাষ্ট্র হলো একাধিক এককরাষ্ট্র বা প্রদেশের সমন্বয়।
সুষম–প্রতিযোগী বাজারব্যবস্থাসহ সামগ্রীক উচ্চতর সমৃদ্ধিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থার রাষ্ট্র–অবকাঠামো গঠণের জন্যে থানাগুলোকে মহকুমায় এবং মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নীতসহ বাংলাদেশকে ৯টি বিভাগে (ভবিষ্যতের প্রদেশ) বিভক্তির আমার প্রস্তাবনা/উদ্যোগ (১৯৮২)। পরবর্তীতে পল্লীইউনিয়নগুলোকে ৯টি পল্লীতে পুনর্গঠণে প্রস্তাবনা/উদ্যোগ (প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠামো–প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা, ১৯৮৫)। মেঘনা ও পদ্মা বিভাগ হলে রাষ্ট্র–অবকাঠামো সুষম–গণতন্ত্রমুখী হবে।
–৫–
সরকারব্যবস্থা ও পারিবারিক প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বরূপের উপর ছোটরাষ্ট্রের রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বরূপ নির্ভর করে। এলাকা বা/ও জনতা বৃদ্ধিতে অঞ্চল/বিভাগ–জেলা–উপজেলা–শহর/পল্লীতে ক্রম–বিভক্তির জন্যে রাষ্ট্র–অবকাঠামো প্রতিষ্ঠান ক্রমে প্রভাবশীল হয়। বৃহত্তর রাষ্ট্রে সরকারব্যবস্থা ও পারিবারিক প্রতিষ্ঠানসমূহের চেয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বরূপের জন্যে রাষ্ট্র–অবকাঠামো বেশী প্রভাবশীল হয়। রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্যে এই তিনটি প্রতিষ্ঠান মৌল, স্বকীয়, অবিচ্ছেদ্দ ও সমন্বিত যা ভিতর–কাঠামোর প্রতিষ্ঠানগুলোকেও রূপ দেয়।
স্বকীয় ও মু্খ্যতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি হলেও রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠামো–প্রতিষ্ঠানগুলো একইসাথে ভিন্ন অনুপাতের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ও রাজনৈতিক। এজন্য রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারব্যবস্থা, পারিবারিক ও রাষ্ট্র–অবকাঠামো প্রতিষ্ঠানত্রয় সর্বদা অনান্য প্রতিষ্ঠানের স্বকীয় প্রভাব সংরক্ষণ করে রাষ্ট্রব্যবস্থার সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ও রাজনৈতিক দিকগুলোর প্রত্যক্ষ–পরোক্ষভাবে সমন্বয় ও সামঞ্জস আনে। সমন্বয় ও সামঞ্জস হলে সংকট বাড়ে। পুনর্গঠণ/সংস্কার অপরিহার্য হয়।
সামন্ত–ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি ও ধারাবাবাহিকতা মূলে রোমান–ক্যাথলিক উত্তরাধিকার বিধান। রোমান সম্রাজ্যভুক্ত ও ক্যাথলিক রাষ্ট্রধর্ম হওয়ার পরে ইউরোপে সামন্ত–ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি ও ধারা হয়। প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর প্রচলিত উত্তরাধিকার বিধানের স্থলে গণতান্ত্রিক খৃষ্টীয় উত্তরাধিকার বিধান চালু হলে (বৃটেনে ১৯২৫ সালে) তিন–প্রজন্মে অর্থনীতিসহ সামন্ত–ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্রমে গণতান্ত্রিক রূপ নেয়। ফলসূতিতে উত্তরাধিকার ভিত্তিক লর্ডহাউজসহ বৃটেনের সরকারব্যবস্থার গণতান্ত্রিক ক্রমসংস্কার হয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর এশিয়ার দেশগুলোতে প্রচলিত হিন্দু–বৌদ্ধ উত্তরাধিকার বিধানের স্থলে ক্রমশঃ গণতান্ত্রিক ভূমি–সংস্কারসহ গণতান্ত্রিক খৃষ্টীয় উত্তরাধিকার বিধান চালু হওয়ায় সামন্ত–ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্রমে গণতান্ত্রিক রূপ নেয়। বিশ্বে এখন সামন্ত–ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি ও ধারা নেই। অথচ প্রধানতঃ ব্যক্তি মালিকানায় হওয়ায় আমরা চলমান অর্থব্যবস্থাকে ধনতান্ত্রিক বলছি। তেমনি গ্রীক ও রোমান প্রতিনিধিত্বশীল সংসদীয় সরকারব্যবস্থাকে আমরা গণতন্ত্র বলছি।
–৬–
গ্রীক ও রোমান গণতন্ত্র ছিল কেবল ৭.৫% জনতা ভোটের প্রতিনিধিত্বশীল সরকারব্যবস্থা। তবে ১০টি অঞ্চলে বিভক্ত, ভূমি–সংস্কার এবং হিন্দু–ইহুদী আদলে পারিবারিক বিধান চালু থাকায় গ্রীকরাষ্ট্রগুলোর গণজীবন আধা–গণতান্ত্রিক ছিল। আর অগণতান্ত্রিক পারিবারিক বিধান প্রচলিত থাকায় রোমরাষ্ট্রে গণজীবন বাড়ন্ত অগণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক শ্রেণী ও অসাম্যের ছিল। তবে রাষ্ট্র–অবকাঠামো প্রতিষ্ঠানের স্বরূপ গণতন্ত্রমুখী হওয়ায় গ্রেটবৃটেনের মতো রোমরাষ্ট্র সমৃদ্ধিশীল ছিল।
গ্রীক–রোমান গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা চালু হওয়ার হাজার বছর পরে মধ্যপ্রাচ্যে গণতান্ত্রিক খৃষ্ট ও মুসলিম পারিবারিক–সামাজিক বিধান চালু হয়। এতে দেশগুলোর ব্যক্তি–পরিবার–সমাজ জীবন ক্রমশঃ গণতান্ত্রিক হতে থাকে। কোন কোন দেশ–প্রদেশের রাষ্ট্র–অবকাঠামো প্রতিষ্ঠানের স্বরূপ গণতন্ত্রমুখী হওয়ায় উদার ও আরোহমুখী চেতনার বিকাশ হয়। মিশর–ব্যাবিলন–গ্রীকের অবরোহমুখী জ্ঞান–প্রজ্ঞানকে ধারণ করে মধ্যপ্রাচ্যে আরোহমুখী জ্ঞান–প্রজ্ঞানের উন্মেষ হয়। পরে তা ইউরোপে বিকশিত হয়।
গ্রীক–রোমান গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা এবং খৃষ্ট–মুসলিম গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সমন্বয়ে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। তবে বিপুল জনসংখ্যর বৃহত্তর রাষ্ট্রে গণতন্ত্রমুখী রাষ্ট্র–অবকাঠামো প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেবল গণতান্ত্রিক পরিবারিক ও সরকারে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক এবং জনজীবণ সমৃদ্ধিশীল হয় না। বাংলাদেশে মুসলিম/সুষম গণতান্ত্রিক পরিবারিক প্রতিষ্ঠান থাকায় মেঘনা–পদ্মা বিভাগ হলে রাষ্ট্র–অবকাঠামো সুষম–গণতন্ত্রমুখী এবং সুপ্রশসানসহ রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রগতিশীল/সুষম গণতান্ত্রিক হবে।
বৃহত্তর রাষ্ট্রের পরিবার, রাষ্ট্র–অবকাঠামো ও সরকারব্যবস্থার প্রতিষ্ঠান গণতান্ত্রিক হলে রাষ্ট্রব্যবস্থা একদিকে স্ব–সমৃদ্ধিশীল গণতান্ত্রিক হয়। অন্যদিকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় ও সামঞ্জস বাড়তে থাকে। সেটা বিবর্তন প্রক্রিয়া নাহলে বিপ্লবী প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রব্যবস্থা অসামঞ্জস হয়ে পড়ে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতি সমন্বয়মুখী ও সামঞ্জস অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নয়।
–৭–
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক ব্যাষ্টিক ভিত্তি হলো, স্বাধীনতা ও সমাধিকার ভিত্তিক নাগরিক/ব্যক্তি জীবনব্যবস্থা। নাগরিক/ব্যক্তি জীবন–ব্যবস্থা কেবল রাজনৈতিক নয়, একইসাথে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক। গণতান্ত্রিক পরিবার, রাষ্ট্র–অবকাঠামো ও সরকারব্যবস্থা পুনর্গঠণ/সংস্কারের মাধ্যমে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় নাগরিক/ব্যক্তির অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাগুলোকে ক্রমশঃ গণতান্ত্রিক এবং রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রগতিশীল–সমৃদ্ধিশীল গণতান্ত্রিক করে।
সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক ব্যাষ্টিক ভিত্তি হলো, ব্যক্তিসম্পদ ও উত্তরাধিকার বিধান, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সমাধিকার ভিত্তিক পরিবার–সমাজজীবনের বিলুপ্তি এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে ও নিয়ন্ত্রণে অর্থনৈতিক–রাজনৈতিক ব্যবস্থা। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কেবল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয় বা থাকে না। তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রনীতি ও সরকারব্যবস্থার সাথে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সংঘর্ষিক ও সংকটময়। সরকারব্যবস্থা বদল হলে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রনীতি অবসান হয়।
উত্তরাধিকার বিধান ও/বা রাষ্ট্র–অবকাঠামোর স্বরূপের উপর অর্থনীতির বাজারব্যবস্থার স্বরূপ নির্ভর করে। গণতান্ত্রিক উত্তরাধিকার বিধান ও/বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র–অবকাঠামো গণতান্ত্রিক বাজারব্যবস্থার ধারা দেয়। আর অগণতান্ত্রিক উত্তরাধিকার বিধান ও/বা স্বৈর–সন্ত্রাসমুখী অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র–অবকাঠামো কম–বেশী অগণতান্ত্রিক বাজারব্যবস্থার ধারা দেয়। অগণতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক বাজার ব্যবস্থার সাথে যথাক্রমে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র সংঘর্ষিক ও অস্থিতিশীল।
অসামঞ্জস ও সংঘর্ষিক হওয়ায় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতির সমন্বয় হয় না। সরকারী ও বেসরকারীখাত মিলে অর্থনৈতিকব্যবস্থা মিশ্র–অর্থনীতি নামে পরিচিত। প্রযুক্তির অনাগ্রসরতায় ও বিনিয়োগ সম্পদের অপ্রতুলতায় অনূন্নত–উন্নয়নশীল দেশে পুঁজিপণ্য উৎপাদন সরকারীখাতে থাকে। এটা সমাজতান্ত্রিক নয়, গণতান্ত্রিক অর্থনীতিরই একটা দিক। কম–দায়িত্বশীল ও পশ্চদপদ সরকারীখাত সীমিত এবং স্বদায়িত্বশীল বেসরকারীখাত বৃদ্ধি করা সর্বদাই কাংখিত।
পরিবার, রাষ্ট্র–অবকাঠামো ও সরকারব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রগতিশীল বা প্রতিক্রিয়াশীল হতে পারে। ৯০% জনতা মুসলমান হওয়ার হাজার বছর প্রচলিত বাংলাদেশের পরিবারিক প্রতিষ্ঠান সুষম–গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল। জেলা–উপজেলা পুনর্গঠণসহ ৬টি বিভাগে বিভক্ত হওয়ায় (১৯৯৫) বাংলাদেশের রাষ্ট্র–অবকাঠামো প্রতিষ্ঠান গণতন্ত্রমুখী এবং ৮টি বিভাগে বিভক্তি পরে আরও গণতন্ত্রমুখী হয়। মেঘনা ও পদ্মা বিভাগ হলে রাষ্ট্র–অবকাঠামো সুষম–গণতন্ত্রমুখী হবে।
এখন দুইকক্ষ সংসদ ও জাতীয়–স্থানীয় সরকার–প্রধানপদে সর্বোচ্চ দুবারে সীমিত, মেঘনা ও পদ্মা বিভাগ এবং জাতীয় আয়বন্টে সামঞ্জসে জাতীয় বেতন স্কেল হলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক হবে। ১০টি বিভাগ প্রদেশে রূপান্তরিত হলে বাংলাদেশ কয়েক শতাব্দী উচচতর সমৃদ্ধিশীল গণতান্ত্রিক থাকবে। ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র ও আমার প্রগতিশীল গণতন্ত্র রাষ্ট্রচিন্তার অন্তর্দর্শী সমলোচনা বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আরও পরিশীলিত করবে।
মোহম্মদ আহসানুল করিম
রাষ্ট্রবিশেষজ্ঞ, সাবেক বিসিএস কর্মকর্তা ও মু্ক্তিযোদ্ধা। প্রগতিশীল গণতন্ত্র (১৯৯১), সুপ্রীমকোর্টে (২০১১) পেশকৃত প্রতিবেদন), Essays on Democratic Political Economy (2022), Two Submissions to Parliament and Supreme Court (2022) বই, সংসদে (২০১০) ও এবং পুনর্গঠণ/সংস্কারের নিবন্ধ লেখক।