
.
ড. নূরুল হক ভুঁইয়া। তিনি ভাষা সৈনিক এবং দেশের গর্ব। দেশের এমন একজন কৃত্ত্বিমান বীর পুরুষের সন্তান হিসেবে আমি সত্যি সত্যিই গর্বিত।
ভাষা আন্দোলনে সময় আমার বাবা’র অবদান ছিলো অতুলনীয়। অন্যান্য ভাষা সৈনিকদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তিনি আন্দোলন করেছেন, সংগ্রাম করেছেন। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়োজনীয় সকল কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করে ভাষার অধিকার ছিনিয়ে এনেছিলেন ভাষা সৈনিক আমার বাবা ড: নুরুল হক ভূঁইয়া। তাইতো ভাষা আন্দোলনে আমারা বিজয়ী হয়েছিলাম । দেশমাতৃক পেয়েছিল একটি স্বাধীন ভুখন্ড আর এক গৌরবগাথা পতাকা । যা পৃথিবীর ইতিহাসে আমরাই একমাত্র উত্তরাধিকারী, আমাদের বিজয় হয়েছিল। পৃথিবীর বুকে অনন্য নজির স্থাপন করেছিল ভাষা সৈনিকরা। আজ আমরা অন্যন্য উচ্চতায় পৌঁছেছি। যার ভীত গড়েছিলেন ভাষা সৈনিকরা ভাষা আন্দোলনের সময়।
১৯৪৭ সাল থেকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ গংরা যখন রাষ্ট্র ভাষাকে উর্দু করার পায়তারা করেছিলো, তখন থেকেই প্রতিবাদে গর্জে ওঠে বাংলার ছাত্র-শিক্ষক তথা আপামর জনসাধারন। যার পূর্নতা পায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। এর অন্যতম অংশ ছিলেন ড. নুরুল হক ভূঁইয়া।
বাংলাদশের প্রাক্তন রাজধানী সোনারগাঁওয়ের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২৩ সালের ১ মে আমার বাবা জন্মগ্রহণ করেন। পুরোটা জীবনে দেশের প্রতি নিদারুন ভালোবাসায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। শিক্ষাজীবনে ড. নুরুল হক ভুঁইয়া বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। কর্মময় জীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাকতা করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক ছিলেন। এছাড়া এপ্লাইড ক্যামিস্ট্রি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন ড. নুরুল হক ভূঁইয়া।
অনেকগুলো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য আবিষ্কার ছিলো তাঁর। বাংলাদেশে ৭২-৭৩ সালে অনেকগুলো পাটকলে আগুন লাগে। এই সময় গবেষনা করে এমন একটি স্প্রে তৈরি করেন যা দিয়ে স্প্রে করলে আর আগুন ধরবে না। তাঁর তৈরী সেই প্যাটার্ন বর্তমানে নাসাতেও ব্যাবহৃত হচ্ছে।
কর্মময় জীবনে ১৯৮৯ ইং সালের ২ এপ্রিল দেশবাসীকে কাঁদিয়ে পৃথীবির মায়া ছেড়ে না ফেরার দেশে চিরস্থায়ী হন দেশের এই গর্বিত ভাষা সৈনিক। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের গোবিন্দপুর গ্রামে মহান এই মানুষকে দাফন করা হয়।
নিজের এই বর্নিল কর্মজীবনে নানা ধরনের সৃষ্টিশীল কাজের সাথে জড়িত ছিলেন আমার বাবা। সেখান থেকে কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি মাত্র।
১। ভাষা আন্দোলনের ‘জনক সংগঠন’ হিসাবে খ্যাত তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি।
২। ভাষা আন্দোলনের প্রাক্কালে করণীয় বিষয় নির্ধারণের জন্য অনুষ্ঠিত কয়েকটি পরামর্শ সভায় তিনি অংশগ্রহণ করেন।
৩। ভাষাআন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ড: নরুল হক ভুঁইয়া।
৪। ১৯৪৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ১৯ নম্বর আজিমপুরে ভাষা আন্দোলনের প্রথম অফিস উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন এই বীর ভাষাসৈনিক।
৫। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ভাষা আন্দোলনের ঘোষণাপত্র পাঠ ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন ড: নূরুল হক ভুঁইয়া।
৬। ১৯৪৭ সালের ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবীর পক্ষে জনমত গঠনের জন্য পালিত কর্মসূচীতে সক্রীয়ভাবে অংশ্রগহণ ও নেতৃত্বদান করেন তিনি।
৭। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে মাসব্যাপী গনসংযোগ, আইনপরিষদ ও মন্ত্রী পরিষদ সদস্যদের সাথে নেতৃবৃন্দের মতবিনিময় কর্মসূচী বাস্তবায়কদের অন্যতম ছিলেন এই বীর ভাষা সংগঠক।
৮। ১৯৪৭ সালের ১ নভেম্বর রশিদ বিল্ডিংয়ে ভাষা আন্দোলন অফিস স্থানান্তরের পর সেখানে নিয়মিত যাতায়াত ও সমাগত ছাত্র-জনতাকে ভাষা সৈনিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অবিস্মরনীয় ভূমিকা পালন করেন তিনি।
৯। ১৯৪৭-৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে অনুষ্ঠিত সমাবেশ, মিছিল, গণসংযোগ, স্মারকলিপি পেশ ও প্রশাসনের সাথে দেন-দরবার করাসহ সর্বক্ষেত্রে নূরুল হক ভূঁইয়াও অধ্যাপক আবুল কাসেমের সহযোগী ছিলেন।
১০। ১৯৪৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর তমদ্দুন মজলিসের রাষ্টভাষা সাব-কমিটি নামে গঠিত প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নিযুক্ত হন আমার বাবা
ড: নূরুল হক ভুঁইয়া।
১৯৪৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশ সফরে আসেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। এই সফরে জিন্নাহ সাহেবকে ছাত্র-শিক্ষক পরিষদ উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার কথা বলেন। তবে,
ড: নুরুল হক ভূঁইয়াসহ আরো অনেকেই তাঁর বক্তব্যের কঠোর প্রতিবাদ করেন।
১১। সেই সময় শিক্ষকদের রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও ড: নুরুল হক ভূঁইয়াসহ অনেকেই দেশ ও মাতৃকার প্রতি অগাধ ভালোবাসায় নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন।
●সূত্র::
★ভাষা আন্দলন মিউজিয়াম ।

লেখক , কামাল সাঈদ মোহন , ভাষা সৈনিক ড. নূরুল হক ভুঁইয়ার পুত্র , বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী ।
l