
ছলেবলে কলে কৌশলে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে ব্যর্থ হলে তত্বাবধায়ক ছাড়া যে গত্যন্তর নাই এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে! আমেরিকা যেভাবে ঝাকিজাল নিয়ে নেমেছে তাতে চৌদ্দ’র মত বিএনপিকে বাদ দিয়ে বা আঠারোর মত ধোঁকা দিয়ে এনে রাতের আধারে কাম সেড়ে ফেলার নির্বাচন পরেরবার আর সম্ভব হচ্ছে না। যদিও দিল্লী শেষ পর্যন্ত দেওয়ানি রিনিউ করাতে সক্ষম হয় কিনা তা বলার সময় এখনও আসে নাই।
তত্বাবধায়কে আওয়ামী লীগের ভয় মূলত: ক্ষমতা হারানোর। তারা মনে করে ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করাতে না পারলে হেরে যাবে, অতএব নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা বেঁচে থাকা এবং নানাবিধ কারনে তাদের কেয়ামত পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা দরকার। তার জন্য ক্ষমতায় থেকেই নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু হিসাবে বলে বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রশাসনিক কাঠামোয় তত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগের জেতার সম্ভাবনা চৌদ্দ আনা। যদি গনঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন না হয়, যদি সমঝোতার মাধ্যমে অর্থাৎ ’৯৬এর মত সংবিধান সংশোধন করে তত্বাবধায়ক গঠিত হয় তাহলে সুবিধা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ফুল ফর্মে থেকেই নির্বাচন করতে পারবে। কিছু সমস্যা আছে। লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরীতে খালেদা জিয়াসহ বিরোধী দলের বন্দী নেতা কর্মীরা মুক্ত হয়ে যাবেন, সেই সাথে পুলিশ এবং প্রশাসনকে এটিচুড বদলাতে হবে। তাতে বিরোধীরা চাঙ্গা হবেন সরকার দলীয়রা হতদ্দোম হবেন। এখানে বড় সমস্যা হবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং চলাফেরায়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বর্তমানে তিনি যে আবাস এবং নিরাপত্তা সুবিধা পাচ্ছেন, কোথাও যেতে হলে এক ঘন্টা আগে রাস্তা বন্ধ করে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা- সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এসব সুবিধা কারোরই পাওয়ার কথা না। নির্বাচনী কর্মকান্ড বা প্রচারণায় আর দশজন নেতার মত অবাধ চলাফেরাও তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ক্ষমতা ছাড়ার আগ দিয়ে যদি নিজের জন্য এসব সুবিধা নিশ্চিত করতে আইনও পাশ করেন তত্বাবধায়ক সরকার লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরীতে তা কতটা কার্যকর করতে পারবে সে ব্যপারে সন্দেহ আছে। ক্ষমতা ছাড়ার আগ দিয়ে এরশাদ বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল করে দিয়েছিলেন, বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের সরকার তা মানে নাই। ওই আইনেই তাকে দীর্ঘদিন আটক করে রেখেছিল।
এত সবের পরেও তত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জিতে আসার সমূহ সম্ভাবনা! কিভাবে?
আসুন একটু হিসাবটা দেখে নেওয়া যাক।
১। প্রশাসন এবং পুলিশ।
মাঠ পর্যায়ে নির্বাচনটা করায় প্রধানত: পুলিশ এবং সিভিল প্রশাসন। স্থানীয়ভাবে তারাই নির্বাচন কমিশন। বাংলাদেশের বাস্তবতায় সরকার যতই নিরুপেক্ষ হোক, নির্বাচন কমিশন যতই কঠোরহস্ত হোক, মাঠের পুলিশ-প্রশাসন যেভাবে চাইবে ফলাফল সেভাবেই হবে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। চৌদ্দ বছরে আওয়ামী লীগ মোটামুটি সিভিল এবং পুলিশ প্রশাসনের পুরোটাই দলীয় লোকজন দিয়ে সাজিয়ে ফেলেছে। প্রথম দ্বিতীয় তো বটেই তৃতীয় চতুর্থ টায়ার পর্যন্ত দলের লোকজন। তত্বাবধায়ক সরকারের ওপর চাপ থাকবে পুলিশ এবং মাঠ প্রশাসনকে দলীয় লোকজনমুক্ত করতে। যদি তিন মাস মেয়াদী তত্বাবধায়ক হয়, এই অল্প সময়ের মধ্যে সারা দেশে দল নিরুপেক্ষ প্রশাসন সাজানো রীতিমত অসম্ভব ব্যপার। কাকে সড়িয়ে কাকে আনবে। দল নিরুপেক্ষ বা বিরোধীদলীয় ভাবাপন্ন যারা ছিলেন তাদেরকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে অনেক আগেই। এখন যারা, সবাই মোটামুটি সরকারদলীয় বা সরকারের অনুগ্রহভাজন, আশীর্ব্বাদপুষ্ট বা বিভিন্নভাবে লাভবান। এরা সর্বতোভাবে চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করতে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীদেরকে জিতিয়ে আনতে- তা সে সরকার বা নির্বাচন কমিশন যতই নিরুপেক্ষ থাকার চেষ্টা করুক। বেনিফিশিয়ারি গ্রুপের জন্য আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনেই দরকার।
এখানে একটা কথা আছে। নির্বাচনটা হতে হবে তিন মাসের মধ্যে। আশার কথা- এ ব্যপারে আওয়ামী লীগ বিএনপি একমত। আওয়ামী লীগকে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনে যেতে হবে কারন যত দেরী হবে তত তাদের সাজানো প্রশাসন শক্তি হারাতে থাকবে। বিএনপি তো বলেই রেখেছে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন হতে হবে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত কথা উঠেছিল দুই/তিন বছর জাতীয় সরকার রেখে, তাদের দিয়ে নিরুপেক্ষ পুলিশ এবং প্রশাসন সাজিয়ে তারপর নির্বাচন করা। বিএনপি তাতে সায় দেয় নাই। তাদের ভয় তত্বাবধায়ক বা জাতীয় সরকার দীর্ঘায়িত হলে শেষে তারাই না দল গঠন করে থেকে যায়। তাতে আখেরে আটের মত কলা খেতে হবে। মোদ্দা কথা এই দুই দল যদি একমত থাকে তাহলে তত্বাবধায়ককে তিন মাসের মধ্যেই নির্বাচন করাতে হবে। এমনটা ঘটলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না- তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের দাবীতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি গলাগলি ধরে আন্দোলন করছে, যেমনটা করেছিল উদ্দিনদের সরকারের আমলে ‘মাইনাস টু’ কথা উঠলে! আর তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের জন্য যে সোনায় সোহাগা সে কথা আগেই বলেছি।
২। ভোটার তালিকা।
বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ আছে বিদ্যমান ভোটার তালিকায় প্রচুর ভূয়া ভোটার রয়েছে। একই লোক একাধিক আইডি কার্ড বানিয়ে বা ভূয়া আইডিতে বিভিন্ন এলাকায় ভোটার হয়েছে। এরা সবাই সরকার দলীয়। প্রশ্নবিদ্ধ ভোটার তালিকা সংশোধন করা বা ভূয়া ভোটার বাদ দিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া যা তিন মাসের মধ্যে কোনভাবেই সম্ভব না। তেমনটা হলে লাভ আওয়ামী লীগের।
৩। টাকা।
বলার অপেক্ষা রাখেনা আগামী নির্বাচনে টাকা হবে সবচাইতে বড় ফ্যাক্টর। সেই ’৯১ থেকে নির্বাচনে টাকা নিয়ামক হয়ে উঠে আসছে। হাল আমলে নির্বাচন মানেই টাকার খেলা। কথাই চালু হয়ে গেছে, টাকা যার ভোট তার। টাকা দিয়ে প্রশাসন পুলিশ কেনা হয়, ইলেকশন অফিসারদেরকে বশ করা হয়, প্রতিদ্বন্ধিকে বসিয়ে দেওয়া যায়, ভোটের এজেন্ট বা সাপ্লায়ারদেরকে হাত করা যায়, ভোট কেনা হয়। দিনে দিনে এই প্রকোপ এতটাই বেড়েছে যে দেশে ভোট আর ভোট নাই। আগামী জাতীয় নির্বাচন যে টাকাশক্তির প্রভাবমুক্ত করা যাবে এটা কোন পাগলেও বিশ্বাষ করে না। টাকার খেলায় আওয়ামী লীগ চ্যাম্পিয়ন। গ্রাম এলাকায় এখন ভোটের চিত্র বদলে গেছে। টাউট বাটপাররা ভোটের ঠিকাদার। সাধারন মানুষ বিশেষ করে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল যারা- ক্ষমতায় কে গেলো এলো তা নিয়ে মাথাব্যথা কম। এদের কথা- ভোটে জিতে তুমি পাঁচ বছর খাবে আমাকে তো তখন চিনবেও না, আমাকে যা খাওয়ানোর এখনই খাইয়ে যাও। বাকির নাম ফাঁকি। নীতি-নৈতিকতা এতটাই গেছে একই দোহাই দিয়ে এই টাকা সবার কাছ থেকেই আদায় করা হয়!
সাধারন হিসাবে প্রতি আসনে রিজার্ভ ভোট বেনিফিশিয়ারি ভোট মিলে আওয়ামী লীগের কমবেশী ৩০ থেকে ৫০ হাজার করে ভোট আছে। দলীয় ভোট আরও ২০/৩০ হাজার। সেই সাথে যদি ৫০ হাজার কেনা যায়- জয় ঠেকায় কে! ভোটপ্রতি ১০ হাজার করে হলে মাত্র ৫০ কোটী। ‘কেনাকাটা’ প্রচার প্রচারণায় যদি আরও ৫০ কোটী যায় মোট খরচা ১০০ কোটী। এই টাকা আওয়ামী লীগের ক্যান্ডিটেদের জন্য হাতের ময়লা। জেলা পর্যায়ের ছাত্রলীগ নেতা যদি ২ হাজার কোটী টাকা কামিয়ে থাকে সহজেই অনুমেয় উর্দ্ধতনদের কি অবস্থা! যদি দেড় শ’ আসনে এমন টার্গেট নেওয়া হয় লাগে মাত্র পনের হাজার কোটী টাকা। ক্যান্ডিডেটরা যদি অতিশয় গরীবও হয়ে থাকে সামিট এস আলম দরবেশদের মত পাঁচ সুবিধাভোগী ৩ হাজার কোটী করে দিলেই হয়ে যায়। অন্যান্ন সোর্স থেকে তো আছেই।
কাজেই টাকার দিক থেকেও আওয়ামী লীগের কাছে অন্যরা ছাগশিশু বৈ কিছু হবেন না। সে হিসাবে তত্বাবধায়ক হলেও যদি তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করানো যায় ক্ষমতায় ফিরে আসা আওযামী লীগের জন্য সময়ের ব্যপার মাত্র!
রিষ্কটা তারা নেবেন কি! অবশ্য না নিয়ে গত্যন্তরই বা কি !
সাঈদ তারেক , লেখক এবং সাংবাদিক ।