
ওয়াজ অর্থ উপদেশ, নসিহত, বক্তব্য। যিনি ওয়াজ করেন তাকে ওয়ায়েজ বা বক্তা বলে। ওয়াজ নসিহত বা উপদেশমানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এটি মানব সমাজের উন্নতি ও সংশোধনের অতুলনীয় পন্থা।
ইসলামের শুরু থেকেই এর পবিত্র ধারা অদ্যাবধি চলে আসছে। এখন শীতের মৌসুম শীতের হিমেল হাওয়া আমাদের দেশেওয়াজের বার্তা নিয়ে আসে। শীত ছাড়া যেন মাহফিল জমে না। বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত হয়েছেওয়াজ-মাহফিল।
শীতকালে আমাদের দেশের গ্রাম-গঞ্জে এমনকি শহরে ওয়াজ মাহফিলের ধুম পড়ে যায়। শীতের রাতে পাড়া-মহল্লায়, গ্রাম-গঞ্জেখেটেখাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে সাধারণ এবং উচ্চ শিক্ষিতরাও ওয়াজ-মাহফিলে অংশগ্রহণ করে থাকেন। শীতকালেরাত্রিবেলার ওয়াজ-মাহফিল এক পরিচিত চিত্র। শীতকালে প্রায় প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ওয়াজ-মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।ওয়াজ-মাহফিল উপলক্ষে এলাকাবাসীর মাঝে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করে। গ্রাম-গঞ্জের মানুষ ওয়াজ মাহফিলেরজন্য বছরজুড়ে অধীর অপেক্ষায় থাকে।
সেই ছোটকাল থেকেই আমরা দেখে আসছি হুজুরদের সবাই খুব সম্মান করে, আমরা সবাই বুঝতাম যে ধর্মীয় শিক্ষা একটাজরুরি বিষয়। গ্রামের বাড়িগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য হুজুর দেখে লজিং রাখতো সবাই, যাতে পরিবারে ইসলামের চর্চা হয়। আজকের যুগে শিক্ষার দুয়ার অনেক প্রসারিত, চাইলেই আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে ইসলাম বা ধর্মীয় জ্ঞান আহরণ করতে পারি।কিন্তু হুজুররা কেন যেন তাদের শ্রদ্ধার স্থানটা হারিয়ে ফেলছেন দিনে দিনে। আজকাল হুজুররা একে অপরকে কাফের বলতেদ্বিধাবোধ করেন না, ওয়াজ মাহফিলে একজন অন্যজনের বিরুদ্ধে খিস্তি খেউর করেই ওয়ার্ম-আপ করে নেন। আর কিছু কিছুহুজুর আছেন তাদের লাফালাফি, ভাষার ব্যবহার, শব্দ চয়ন, অঙ্গভঙ্গী এসব দেখে লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে। উনারা কেউএকজন বিধর্মীকে মুসলমান বানাতে পেরেছেন ওয়াজের মাধ্যমে তাও নয়, বরং ইসলাম চর্চা যারা করবে তাদেরকেই উনারা দ্বিধায়ফেলে দেন, সঠিক পথ বেছে নেয়া তখন কঠিন হয়ে যায়।
মুসলমানদের আবেগ অনুভূতির একটা জায়গা হলো ইসলাম ও ধর্মীয় নানা ওয়াজ। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখনএই ওয়াজ নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের ট্রল ভিডিও। কিছু আলেম নামধারী ব্যক্তিদের জন্য সামগ্রিকভাবে ইসলাম ও আলেমউলামাদের সম্মান ও মর্যাদাহানি হচ্ছে। এমনকি তাদের হাস্যকর ওয়াজের কারণে ইসলামের সৌন্দর্য ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
এখন ওয়াজের মওসুম। শহরে, গ্রামে সবখানে চলছে এই ওয়াজ। আর সেই ওয়াজগুলো ইউটিউবে ছেড়ে দিচ্ছেন ইউটিউবাররা।কিন্তু সম্প্রতি ইউটিউবে ঢুকলে দেখা যায় কিছু বক্তার বিদ্বেষপূর্ণ ও হিংসাত্মক কথাবার্তা, অপছন্দের ওয়াজীদের ব্যক্তিগতআক্রমণ। আর এসব দেখে বক্তাদের সমালোচনা করছেন সাধারণ ধর্মপ্রাণ সরল মনের মানুষ। তারা বলছেন এক আলেম যদিআরেক আলেমকে গালমন্দ করেন, হিংসা করেন, কাঁদা ছোড়াছুড়ি করেন তাহলে আমরা সাধারণ মানুষ কাকে বিশ্বাস করবো।
এর কারণ হিসাবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে ওয়াজ মাহফিলের মৌলিক চরিত্র ও চিন্তায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বক্তারাএখন প্রাসঙ্গিক কথা বলার চেয়ে অপ্রাসঙ্গিক নানা বিষয়েই বেশি আলোচনা করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, তাদের মধ্যে একে অপরের কাঁদা ছোড়াছুড়ি ও গালিগালাজ। যেমন, জারজ, মাদারি, কুত্তা ইত্যাদি শব্দগুলো আমাদের দেশেজঘন্য ও নিকৃষ্ট গালি শব্দ হিসেবে বিবেচিত হয় অতএব একজন আলেম তথা নবীর ওয়ারিশের মুখে এমন শব্দ কথা কখনোইকাম্য হতে পারেনা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া বেশ কয়টি ওয়াজে দেখা গেছে, একজন বক্তা ২ ঘণ্টা ওয়াজ করলে এর মধ্যে ১ঘণ্টা ৫০ মিনিটই হয় পারস্পরিক বিদেষাগার, অশ্লীল শারীরিক অঙ্গভঙ্গি আর বিকৃত ওয়াজ। বিভিন্ন ওয়াজে দেখে যায়, একশ্রেণির বক্তার বয়ানের প্রধান অংশ হয়ে ওঠেছে কবি, সাহিত্যিক, চিত্রনায়ক, গায়কদের নিয়ে বিষোদ্গার। এমনকি ছেড়ে কথাবলেন না স্ব-গোত্রীয় আলেমদেরও। কাফির, মুশরিক, মুনাফিকসহ যতধরনের ইসলামি গালি আছে, সবই তারা প্রয়োগ করে।এছাড়াও ওয়াজ মাহফিলে এমন কিছু বক্তা আছে, যাদের সুরের তালে তার সামনে বসা সমর্থকরা উঠে নাচানাচি শুরু, এমনকিমাইক থেকে শুরু করে সামনে যা কিছু পায়, তাই ছুঁড়ে মারে।
আমরা কুরান হাদীসের প্রকৃত শিক্ষা থেকে কত দূরে সরে গেছি আপনি নিজেকে দিয়েই চিন্তা করুন। কোন আলেমকে পছন্দ নাহলে আমরা তাঁর পারিবারিক বিষয়ের গোপন কথাগুলোও প্রচার করতেছি। ভাইরাল করতেছি। হায় আফসোস! হায় আফসোস!
আল্লাহ পাক বলেছেন সত্য নিশ্চিত না হয়ে ধারণা করে কারো সম্পর্কে কিছু বলাও বড় পাপ। অথচ আমরা ফেসবুক পোস্ট পেয়ে সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই পোস্ট করতেছি, বিরোধীমতাদর্শের মানুষটিকে খারাপ প্রমাণের জন্য ভুল তথ্যকেও ভাইরাল করছি। ইসলামী এসব বক্তাদের বক্তব্যকে পুঁজি করে একটা শ্রেণি মেতে উঠেছে ইউটিউব ব্যবসায়। একদল তরুণ এইসব বক্তাদেরহাস্যরস ভিডিওগুলো থেকে চুম্বকাংশ নিয়ে ট্রল ভিডিও বানিয়ে ভাইরাল করছে।
আমরা কারো খারাপ কিছু প্রকাশ হলে আগে চিন্তা করি সে আমার দলের নাকি বিরোধী দলের? নিজের দলের হলে পজিটিভব্যাখ্যা খোঁজি আর বিরোধী দলের হলে এটার সাথে আরো কিছু সংযুক্ত করে বাতাসের সাথে ছড়িয়ে দিয়ে প্রচার করি। মানুষেরস্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হল নেতিবাচক বিষয়ে আগ্রহ বেশি। অপচন্দের মানুষের খারাপ কিছু প্রকাশিত হলে তিলকে তাল বানাতেএক মিনিট ও সময় নেয়না। কিন্তু এটা কোন মো’মিনের চরিত্র হতে পারেনা। কারণ কারো মন্দ বিষয়ে প্রচারণা করা আল্লাহ পছন্দ করেন না।
কিছুদিন পূর্বেই ফেসবুক ও ইউটিউবে এক মুফতির বিরক্তিকর ওয়াজ ভাইরাল হয়েছে। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া সে ভিডিওতেদেখা যাচ্ছে, নরসিংদীতে অনুষ্ঠিত ওয়াজ মাহফিলে এই মাওলানা সারাক্ষণ অপ্রাসঙ্গিক কথায় কান্না করে ওয়াজ করছেন।কান্নাস্বরে তিনি কোথায় কোনদিন ওয়াজ তারও বর্ণনা করেন। এছাড়া তিনি ভারতে ওয়াজ করতে গিয়েছেন দাবি করে কান্নাকরতে থাকেন। এ নিয়ে ফেসবুকে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। ওয়াজ মাহফিলে এরকম নিজের ব্যক্তিগত হাজারো কথা বলে, ওয়াজেরসুরে কান্না করতে থাকেন এই হুজুর। আমার ওয়াজ করতে রাজশাহী যাওয়ার কথা ছিল….বগুড়া যাওয়ার কথা ছিল……..সুরকরে টেনে টেনে নানাবিধ ভঙ্গিতে এসব বলতে থাকেন ওই হুজুর।
ওয়াজ শব্দের অর্থ হলো উপদেশ। ওয়াজ শুনলে মানুষের ভিতরে আল্লাহর মহব্বত ও রাসূলের মহব্বত পয়দা হয়। আল্লাহর প্রতিতার আনুগত্য, ঈমান বিশ্বাস ও আখেরাতের চিন্তা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ একজন ব্যক্তিকে প্রকৃত মানুষ বানানোর জন্য হলো ওয়াজ।এই ওয়াজ কখনও বিনোদনের কারণ হতে পারে না। কেউ যদি এটাকে হাস্যরস ও বিনোদনের মাধ্যম বানায়, তাহলে ওয়াজের মূললক্ষ্যই বিচ্যুত হয়ে যায়।
আমি মনে করি, দেশের সম্মানিত ও বিজ্ঞ আলেমদের তত্বাবধানে পরিচালিত ওয়াজ মাহফিলে বিশুদ্ধ কোরআন-হাদিসের চর্চাঅব্যাহত থাকবে। দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় মাসয়ালা- মাসায়েল জানার পাশাপাশি এখান থেকে শ্রোতারা নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত সম্পর্কে জানা ছাড়াও ইসলামি জীবন বিধানের সন্ধান পাবেন। এসব মাহফিল থাকবে অমুসলিমদের জন্যওউন্মুক্ত। এখান থেকে ইসলাম ধর্মের সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হবে যুক্তির আলোকে। গোঁড়ামি, উগ্রপন্থা, বিশেষ মতবাদ প্রচারযেনো ওয়াজ মাহফিলকে কলুষিত না করে সে বিষয়েও লক্ষ্য রাখবেন বক্তারা। আমাদের প্রত্যাশা এই কর্মশালায় মাহফিল চলারএকটি সময়সীমা নির্ধারণ করার পাশাপাশি ভিডিওধারণ, ফেসবুকে লাইভ সম্প্রচার, ওয়াজের বিষয় নির্ধারণ এবং উপস্থাপনাপদ্ধতি নিয়েও প্রয়োজনীয় আলোচনা হবে।
ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য দ্বীনের প্রচার। বর্তমানে বাংলাদেশেরওয়াজ মাহফিলগুলোর হালচাল দেখে দ্বীনবোদ্ধা আলেমরা এর ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। বাস্তবতা এমন যে, ওয়াজমাহফিল থেকে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য আয়োজকদেরও দায় আছে। উদ্যোক্তা বিশেষে ওয়াজ মাহফিলের ধরনভিন্ন হয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক কোনো কোনো মাহফিল আয়োজকদের কৃতিত্ব জাহির ও অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হতেদেখা যায়। দ্বীন প্রচারের পবিত্র উদ্দেশ্য সেখানে গৌণ। পক্ষান্তরে সীমিত উদ্যোক্তা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক কিছু মাহফিলে আর্থিকস্বার্থসিদ্ধি হাসিলের প্রবণতা দেখা যায়। মাহফিল শেষে অর্থ কুক্ষিগত করার অভিযোগ পাওয়া যায় অনেক ক্ষেত্রে।
লেখক: আবু জাফর শিহাব (এল এল বি)