বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে প্রথম বার শীতকালে বিশ্বকাপ (Qatar World Cup 2022) অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মরসুমের মাঝপথেবিশ্বযুদ্ধের লড়াই। মধ্য এশিয়াতে প্রথম বার অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্বকাপ। আর মাত্র কয়েকদিন। তারপরই গড়াচ্ছে বল। ফুটবলপ্রেমীদের নজর আটকে থাকবে ওখানেই। ৩২ দেশ নামছে কাপ জয়ের স্বপ্নে। কাতার বিশ্বকাপে ফেভারিট দল হিসেবে মাঠে নামতেচলেছে ব্রাজিল (Brazil Football Team)। পাঁচ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের কাছে ষষ্ঠবার বিশ্ব জয়ের হাতছানি। ২০০২ সালেশেষ বার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। জাপান-দঃ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত সেই বিশ্বকাপে দাপট দেখিয়েছিলেন রোনাল্ডো, রিভাল্ডো, রোনাল্ডিনহো, কাফুরা। আবারও সাম্বা ম্যাজিক দেখার অপেক্ষায় ফুটবলবিশ্ব।
রোড টু কাতারঃ
ফিফা বিশ্বকাপ আসরে সর্বাধিক পাঁচবার শিরোপা জিতেছে ব্রাজিল। বিশ্বফুটবলে ব্রাজিলের সাফল্য নিয়ে নতুন করে বলার কিছুনেই। জিতেছে জগতের প্রায় সব বড় শিরোপা। এছাড়া, প্রায় প্রতিটা বিশ্বকাপেই ব্রাজিল থাকে হট ফেভারিটদের তালিকায়। ২০২২সালে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্বকাপেও যার বাত্যয় ঘটছে না!
টিটের অধীনে ব্রাজিল বিশ্বকাপ বাছাইয়ে কোন ম্যাচ হারে নি। ল্যাটিন আমেরিকার বাছাই পর্বে দারুণ সময় কাটিয়েছে ব্রাজিল।এখন পর্যন্ত খেলা ১৭টি ম্যাচের মধ্যে ব্রাজিল জিতেছে ১৪টি , ড্র ৩টি। সর্বাধিক ৪৫ পয়েন্ট নিয়ে ল্যাটিন অঞ্চলের শীর্ষে থেকেইবিশ্বকাপে যাচ্ছে ব্রাজিল।আর্জেন্টিনার সাথে একটি ম্যাচ বাতিল হয়েছে। সেই ম্যাচের ফলাফল না ধরেই শীর্ষস্থান নিশ্চিত হয়েছেসেলেসাওদের।
বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ১৭ ম্যাচে সর্বোচ্চ ৪০টি গোল করেছে ব্রাজিল। যেখানে দ্বিতীয় স্থানে থাকা আর্জেন্টিনা আর চতুর্থ স্থানেইকুয়েডর করেছে সমান ২৭ গোল। গোল হজমের ক্ষেত্রেও ব্রাজিল সবচেয়ে কম ৫টি খেয়েছে বাছাই পর্বে। বাছাই পর্বে নেইমার ব্রাজিলের হয়ে ৮ গোল করেন। আর রিচার্লিশনের ছিল ৬ গোল।
আমার মতে ব্রাজিলের শক্তি আর দুর্বলতাঃ
কাতার বিশ্বকাপে ক্যারিয়ার শেষ হচ্ছে ড্যানি আলাভেজ, থিয়াগো সিলভা, ক্যাসিমিরোদের। এমনকি নেইমারের জন্যেও এটাইহতে পারে শেষ বিশ্বকাপ যদিও তার বয়স মাত্র ৩০ বছর, সেই হিসেবে তার অন্তত আরও একটি বিশ্বকাপ খেলার সম্ভাবনা আছেযথেষ্ট। কিন্তু ইনজুরি-প্রবণ নেইমারকে নিয়ে আগাম ভবিষ্যৎবাণী একটু ঝুঁকিই হয়ে যায়। ২০২১ সালে নিজেদের মাঠে কোপাআমেরিকার ফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে হারার পর থেকেই অপরাজিত আছে ব্রাজিল। দলটিতে রয়েছে অভিজ্ঞ আরতারুণ্যের সমাবেশ। এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম সেরা দুই গোলরক্ষক অ্যালিসন বেকার আর এডারসন থাকছেন ব্রাজিলস্কোয়াডে। রক্ষণেও ব্রাজিল থিয়াগো সিলভা, দানিলো, ড্যানি আলাভেজ, আলেক্সান্দ্রো, এলেক্স টেলেস, এডার মিলিতাও আরমার্কুইনহোসদের নিয়ে সমীহ আদায় করে যাচ্ছে। মধ্যমাঠে ক্যাসিমিরো এখনও দলের মুল ভরসা। এছাড়া লুকাস পাকুয়েতা, ফ্রেড, ফ্যাবিনিও আছেন। আক্রমণভাগে নেইমার, ভিনিসিয়াস জুনিয়র, রাফিনহা, রিচার্লিশনরা দারুণ ফর্মে আছেন। এছাড়াগ্যাব্রিয়েল হেসুস আর রদ্রিগোরাও পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম।
তবে শংকার বিষয় হচ্ছে, ফিফা র্যাংকিং কিংবা ল্যাটিন অঞ্চলের বাছাইয়ে এক নাম্বারে থাকলেও ব্রাজিলের বিশ্বকাপ সফলতানিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে বিশেষ করে ইউরোপের শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে নক আউট পর্যায়ে ব্রাজিলের মুখ থুবড়ে পড়ার একটাসম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। ঠিক যেমনটা গত দুই আসরে হয়েছিল বেলজিয়াম আর জার্মানির বিপক্ষে। তার আগের দুই আসরেওব্রাজিলকে বিদায় নিতে হয়েছিল ফ্রান্স আর হল্যান্ডের সাথে হেরে। এবারেও তেমন ভয় থেকেই যাচ্ছে। এছাড়া, ব্রাজিলেররক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের বয়স আর মধ্যমাঠে ক্যাসিমিরোর সেরা ফর্মে না থাকা ভোগাতে পারে ব্রাজিলকে।
অভিজ্ঞতার দাপটঃ
ব্রাজিল দলে কাতার বিশ্বকাপে অন্যতম অভিজ্ঞ খেলোয়াড় হিসেবে দেখা যাবে থিয়াগো সিলভাকে। ইতোমধ্যে দেশের হয়ে তিনটিবিশ্বকাপে অংশ নিয়েছেন তিনি। ৩৭ বছরের এই অভিজ্ঞ খেলোয়াড় ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে নিজ দেশের মাটিতে ব্রাজিলেরনেতৃত্ব দিয়েছেন। কাতারের আসর নিশ্চিতভাবেই হতে চলেছে তার শেষ বিশ্বকাপ। ব্রাজিলের হয়ে কোপা আমেরিকা আরকনফেডারেশন্স কাপ জিতেছেন। ব্রাজিলের হয়ে ইতোমধ্যে ১০৯ ম্যাচে মাঠে নামা হয়ে গেছে তার। ক্লাব ফুটবলে সব মিলিয়ে২৯টি শিরোপা জেতা থিয়াগো বর্তমানে খেলছেন ইংলিশ ক্লাব চেলসিতে। জীবনের শেষ বিশ্বকাপে তিনি মাঠে নামবেন ব্রাজিলকেষষ্ঠ শিরোপা এনে দেয়ার লক্ষ্যে। ২৮ বছরের মার্কুইনহোস ব্রাজিল রক্ষণের অন্যতম সৈনিক। দেশের হয়ে খেলেছেন ৭১ ম্যাচআর করেছেন ৫ গোল।২০১৬ সালে ব্রাজিলের অলিম্পিক সোনার পদকজয়ী দলের সদস্য ছিলেন। জিতেছেন ২০১৯ সালেরকোপা আমেরিকা। ২০১৩ সাল থেকে ফ্রান্সের প্যারিস সেইন্ট জার্মেই দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ তিনি। মার্কুইনহোসের সবচেয়ে বড়গুণ দলের প্রয়োজনে সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার, রাইট ব্যাক এমনকি ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার পজিশনে খেলতে পারেন। তাই টিটের যেকোন কৌশলে তিনি নিজেকে মানিয়ে নিতে সক্ষম। ড্যানি আলাভেজকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। অভিজ্ঞতার আলোকেব্রাজিলের কোচ তাকে কাতার নিয়ে।
মুল ভরসা সেই নেইমারেইঃ
যাকে এক সময় মেসি আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মুল প্রতিদ্বন্দ্বী ধরা হত, সেই নেইমারকে নিয়েই ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়েরমিশনে পরিকল্পনা সাজাবেন টিটে – এটা পরিস্কার। যদিও ইনজুরির কারণে ক্যারিয়ারের লম্বা সময় তাকে থাকতে হয়েছে মাঠেরবাইরে। ফুটবল ইতিহাসে নেইমারের চেয়ে বেশী ইনজুরিতে পড়ার রেকর্ড আর কারো আছে কিনা সন্দেহ। সেই সাথে আছে তারউদ্দাম আর খেয়ালী জীবন-যাপন। ফুটবল ম্যাচের আগের রাতে পার্টি আর মদ্যপান নিয়ে অনেকবার নেতিবাচক শিরোনামহয়েছেন নেইমি। কিন্তু এতসব কিছুর পরেও ব্রাজিল তো বটেই, বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নেইমারকে হিসেবেরাখতেই হবে।
সর্বশেষ বিশ্বকাপ বাছাইয়ের দিকে তাকালেই বোঝা যায় নেইমার ব্রাজিলের জন্য কতটা গুরুত্বপর্ণ। ইনজুরির কারণে বাছাইয়েতিনি খেলেছেন মাত্র ১০টি ম্যাচ। সেখানে গোল করেছেন আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আটটি। যেখানে বলিভিয়ার মার্সেলো মারিনো১৬ ম্যাচ খেলে ১০ গোল নিয়ে আছেন শীর্ষে। আর উরুগুয়ের লুইস সুয়ারেজ আট গোল করতে খেলেছেন ১৪ ম্যাচ। এখন পর্যন্তব্রাজিলের হয়ে ১২১ ম্যাচে তার গোলের সংখ্যা ৭৫টি।
২০২২-২৩ মৌসুমের শুরু থেকেই পিএসজির হয়ে মাঠ মাতাচ্ছেন করেছেন ১৯ ম্যাচে ১৫ গোল আর ১২ এসিস্ট।ক্যারিয়ারেরশুরুর দিকে তরুণ নেইমারকে যেন পাওয়া যাচ্ছে ২০২২ সালে এসে। কাতার বিশ্বকাপে এই নেইমারকেই দেখতে চাইবে সবাই।
ব্রাজিল দলের উঠতি তারকারাঃ
ব্রাজিলের উঠতি তারকাদের মধ্যে ভিনিসিয়াস জুনিয়র সবচেয়ে প্রতিভাবান তিনি রিয়েল মাদ্রিদের সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন্স লীগএবং লা লিগা জয়ে রেখেছেন বড় ভুমিকা। ২২ বছর বয়সী উইঙ্গার গেলো মৌসুমে ৫২ ম্যাচে করেছিলেন ২২ গোল। চ্যাম্পিয়ন্সলীগ ফাইনালেও তাঁর একমাত্র গোলে শিরোপা জিতে নেয় রিয়েল মাদ্রিদ। চলতি মৌসুমে করেছেন ২১ ম্যাচে ১০গোল। ব্রাজিলেরহয়ে ১৬ ম্যাচে গোলের সংখ্যা ১টি। গত চার মৌসুম ধরে ইংলিশ ক্লাব এভারটনের হয়ে ধারাবাহিক পারফর্মেন্স করা রিচার্লিশনএখন টটেনহ্যামে । চলতি মৌসুমে করেছেন ১৪ ম্যাচে ২ গোল। ক্লাব ক্যারিয়ারে গোলের সংখ্যা ৮৮টি। ইতোমধ্যে ব্রাজিলের হয়েগ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আর ২০১৯ সালের কোপা আমেরিকা জিতেছেন। অলিম্পিকে পাঁচ গোল করে হয়েছিলেন সেরাগোলদাতা। ২৫বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড ব্রাজিলের জার্সিতে ৩৮ ম্যাচে করেছেন ১৭ গোল। ব্রাজিলের আরেক উইঙ্গার রাফিনহাখেলছেন বার্সায়। ব্রাজিলের হয়ে করেছেন ১১ ম্যাচে পাঁচ গোল। গ্যাব্রিয়েল হেসুস দারুণ সম্ভাবনা নিয়ে শুরু করলেও নিজেকেপ্রমাণ করতে পারেন নি এখনও। তবে চলতি মৌসুমে আর্সেনালে তিনি যেন ফিরে পেয়েছেন নিজেকে। এখন পর্যন্ত গানারদের হয়েসব মিলিয়ে ১৯ ম্যাচে ৫ গোল করেছেন। নিয়মিত এসিস্ট করছেন। ইংলিশ ক্লাবটি এখন পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে। যার বড়অবদান হেসুসের। সেলেসাওদের হয়ে ৫৬ ম্যাচে ১৯ গোল করা হেসুস জিতেছেন ২০১৯ সালের কোপা আমেরিকা।
ব্রাজিলের স্কোয়াডঃ
গোলরক্ষক- অ্যালিসন বেকার, এডারসন, ওয়েভারটন রক্ষণভাগ- মার্কুইনহোস, এডার মিলিতাও, থিয়াগো সিলভা, আলেক্সান্দ্রো, ব্রেমার, ড্যানি আলাভেজ, এলেক্স টেলেস, ড্যানিলো মধ্যমাঠ- ফ্যাবিনিও, ক্যাসিমিরো, ব্রুনো গুইমারেস, ফ্রেড , লুকাস পাকুইতা, এভারটন রিভেইরো আক্রমণভাগ নেইমার জুনিয়র, ভিনিসিয়াস জুনিয়র, রদ্রিগো, গ্যাব্রিয়েল হেসুস, রিচার্লিশন, এন্টোনি, রাফিনহা, পেদ্রো, গ্যাব্রিয়েল মার্তিনেল্লি
শেষ কথাঃ
বিশ্বফুটবলের অন্যতম সফল দল ব্রাজিল সন্দেহ নেই। কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফি জয়ে চাই ভাগ্যেরও পরশ। একাধিকবার সেরাস্কোয়াড নিয়ে ব্রাজিল বিশ্বকাপ পায়নি। যদিও এবারের দলটি দারুণ ব্যালেন্সড, কিন্তু সেরা কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ থাকছেই।
আবু জাফর শিহাব(এল এল বি)