এক
১৯৭২ থেকে ২০২২ সাল। জাসদীয় রাজনীতির ৫০ বছর। জাসদীয়  সমাজতান্ত্রিক ধারার শুরু বাঙালী জাতীয়তাবাদের গর্ভে।  ‘বাঙালী মনোভাবের ভিত্তিতে’ মেহনতী জনতা কে ঐক্যবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে জাসদের জন্ম ৩১ অক্টোবর ১৯৭২ সাল। সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে প্রতিশ্রুতিশীল প্রাণ প্রাচুর্যের  বিপ্লবী শক্তি সমবেত হয়েছিল জাসদে । জাসদের পতাকাবাহীদের আত্ম ত্যাগ ও নিষ্ঠার অভাব ছিল না। নেতৃত্বের ধৈর্য হীনতা, রাত পোহালেই বিপ্লব ও ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন – প্রচেষ্টা, বিপ্লবী  উচ্ছাস , বাম হটকারিতা ও সুবিধাবাদ নিত্য সহচর হয়ে দাঁড়ায় জাসদের পথ পরিক্রমার। ভুল নেতৃত্বে ও কর্মসূচি কারণে জাসদ  বহুধা বিভক্ত ও প্রায় নিঃশেষিত। রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু থেকে প্রান্তিকে ছিটকে পড়ার নানান উপখ্যান রয়েছে জাসদের ঝুলিতে। গত ৫০ বছরে দুঃখজনক ভাবে জাসদীয় ধারার ঝুলিতে জমা হয়েছে ডজন খানেক ভাঙনের অভিঘাত। (১)   জাসদের  প্রত্যয় ও প্রতিশ্রুতি এখন  বিস্মৃত অতীত। যুদ্ধত্তোর দেশে  একদিকে মুজিবাদী সমাজতন্ত্র এবং অন্যদিকে পরস্পর-বিরোধী রুশ- চীনপন্থী ধারার বিপরীতে  স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে বৈজ্ঞানিক  সমাজন্ত্রকে লক্ষ্য ঘোষণা  করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল – জাসদ গঠিত হয়েছিল। জাসদ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রুশ ও চীনপন্থী সমাজতন্ত্রবাদের বাইরে বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনার সমাজতন্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার সূচনা ঘটিয়েছিল জাসদ । তবে জাসদীয় সমাজতন্ত্র কি তার ব্যাখ্যা বর্ণনা জাসদের প্রকাশনায় পাওয়া যায় না।

‘ বাঙালী মনোভাবের ভিত্তিতে মেহনতী জনতার ঐক্য ‘ / ‘ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ‘ / জনযুদ্ধ , শ্রেণীশত্রু’ এই জাতীয় গুরু গম্ভীর  শব্দ স্থান পেয়েছে জাসদের প্রথম ঘোষণা পত্রে। ১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশকে চীন পন্থী  গুলির প্রচার পত্র ও সাহিত্যে  জনযুদ্ধ ও শ্রেণী শত্রু  শব্দ গুলির ব্যবহার ছিল আধিক্য। প্রথম ঘোষণাপত্রে জাসদ নিজেদেরকে ‘ সহায়ক শক্তি ‘ ও গণ সংগঠন হিসেবে বর্ণনা করেছিল। (২ )  জাসদ অন্য বামপন্থীদের থেকে নিজেদেরকে পৃথক বুঝাতে অথবা অন্য কোন কারণে সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র  ব্যবহার করে দৃষ্টি আকর্ষণ ও বিতর্কের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছিল।  বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র জাসদের উদ্ভাবিত কোন মতবাদ নয়।  মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্রই হল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র।  ইউরোপে প্রচলিত অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক ভাবনাকে এঙ্গেলস বলেছেন ইউটোপীয় – কাল্পনিক  সমাজতন্ত্র। ইউটোপীয় – কাল্পনিক  সমাজতন্ত্রের  বিপরীতে মাক্সীয় ধারার সমাজতন্ত্রকে আখ্যায়িত করেছেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র নামে। মার্ক্সবাদীরা মনে করে  মার্ক্স নির্দেশিত সমাজতান্ত্রিক তত্ব একমাত্র বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। (৩) বাংলাদেশের অপরাপর বামপন্থী দল গুলিও  মার্ক্সবাদী সমাজতন্ত্রে আস্থাশীল ছিল। বাংলাদেশের অপরাপর বামপন্থী দলের সমাজতন্ত্র ও  জাসদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কোন পার্থক্য নেই। নির্মম হলেও সত্য বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান তোলা দলের নাম রাখা হয়  জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ।

জার্মানীর হিটলারের মতবাদকে জাতীয় সমাজতন্ত্র বলা হয়। মার্ক্সবাদ – বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে আন্তর্জাতিক মতবাদ হিসেবে মনে করে। হিটলারের জাতীয় সমাজতন্ত্র মার্ক্সবাদ বিরোধী রাজনৈতিক চিন্তা। হিটলারের Mein Kampf ( আমার সংগ্রাম বা যুদ্ধ ) জাতীয় সমাজতন্ত্র বা নাৎসিবাদের ভিত্তি পুস্তক। জার্মানীর হিটলারের মতবাদ হচ্ছে গণবিরোধী, ও শ্রমিক – কৃষক বিরোধী। জাতীয় সমাজতন্ত্রের সাথে নামের মিল থাকলেও জাসদ কখনোই হিটলার ও নাৎসীবাদকে সর্মথন করে নাই। জাসদ অল্প বিস্তর যেটুকু সমাজতন্ত্রের চর্চা করেছে তা মার্ক্সবাদী সমাজতন্ত্রের। (৪) জাসদ গঠনের পরে হিটলারের নাৎসিবাদের সাথে জাসদের নামের মিল নিয়ে রাজনৈতিক মহলে কথা উঠেছিল। সিরাজুল আলম খানের ভাষায় ”   কোন মহল ‘জাতীয় সমাজতন্ত্র ‘ কথাটার সঙ্গে নাৎসিবাদের মিলের উল্ল্যেখ করে নতুন এই [ জাসদ ] দলের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে।(৫) জাসদের  ‘ জাতীয় সমাজতন্ত্র ‘ ও নাৎসিবাদের পার্থক্য নিয়ে কথা বলা থেকে বিরত থেকেছেন সিরাজুল আলম খান । নাৎসিবাদ ও জাতীয় সমাজতন্ত্র এই দুইটি শব্দ যে সমার্থক সে সম্পর্কে জাসদের উদ্যোক্তার কতখানি ওয়াকিবহাল ছিলেন তা বলা দুস্কর। তবে দলের নামের আগে জাতীয় রাখার পিছনে বিজয়ী বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রভাবকে উল্ল্যেখ করেছেন সিরাজুল আলম খান । (৬) ‘ জাসদের ভিতর থেকে ” জাতীয় সমাজতন্ত্র ” নিয়ে তেমন কোন সমালোচনার লিখিত রূপ চোখে পড়ে না।

জাসদ প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম মনিরুল ইসলামের  (মার্শাল মনি) ” জাতীয় সমাজতন্ত্র ” এর পক্ষে লিখেছেন। তবে মার্শাল মনির বক্তব্যে মধ্যে জাতীয় সমাজতন্ত্র শ্লোগান কিভাবে মার্ক্সবাদী আন্তর্জাতিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে মানিয়ে পথ চলবে তার কোন হদিস নেই।  মার্শাল মনির ভাষায় “৬৯য়ের আন্দোলন লক্ষ্য করেছে রাজপথে মারমুখি জনতার নিয়ন্ত্রক এক সুশৃঙ্খল কর্মীবাহিনীকে, যারা সমাজতন্ত্রের আদর্শে শুধু বিশ্বাসীই নয়, চলায়-বলায় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে আসছে, যে কারণে ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক-কর্মচারী সর্বত্র সমাজতন্ত্রের নতুন এ জয় যাত্রায় শামিল হয়েছে। এই প্রথম তারা কোন পন্থী নয়, জাতীয় চেতনার মাঝে সমাজতন্ত্রের বিজয়ের স্বপ্ন দেখতে সক্ষম। শেখ মুজিবের পরীক্ষিত নেতৃত্বের সাথে এরকম একটা সুশৃঙ্খল কর্মীবাহিনীর সমন্বয় সাধারণ শিক্ষিত সমাজ থেকে খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রের’ পরবর্তী পথপরিক্রমায় শুধু অপেক্ষা করছে একটার পর একটা বিজয়। “  (৭) মনিরুল ইসলামের বক্তব্য আবেগী অতিকথন। ছাত্রলীগে সমাজতন্ত্রের পক্ষে প্রস্তাব উঠেছিল ১৯৭০ সালের শেষের দিকে। ‘ ১৯৬৯-১৯৭০সালের ছাত্রলীগ  চীন পন্থীদের ব্যাঙ্গ – বিদ্রুপ করে স্লোগান ছিল -হো মাও- মাও / চীনে যাও / ব্যাঙ খাও। সিরাজুল আলম খান বা অন্য নেতারা কেউ  এর বিরোধিতা তো করেন নাই বরং এই জাতীয় স্লোগানে  মজা নিতেন। (৮) এই স্লোগান তৎকালীন ছাত্রলীগের মনন বুঝতে কিছুটা সহায়ক বটে।

১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক ভাবে জাসদের যাত্রা শুরু। আ স ম রব ও মেজর জলিলকে যুগ্ম আহবায়ক করে ৭ সদস্যের কমিটি ঘোষিত হয়েছিল। (৯)জাসদের প্রথম ঘোষণা পত্রের ছত্রেছত্রে  জাতীয়তাবাদী চেতনার কথা উচ্চারিত হয়েছে। এই ঘোষণা পত্রের ভাষ্যানুযায়ী  ” বিপ্লবী চেতনার অধিকারী বাঙালী জাতির জীবনে কৃষক , শ্রমিক ও প্রগতিশালী বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমেই কেবল একটি সফল সামাজিক বিপ্লব সংগঠন ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দ্বারাই সেই ইস্পিত শ্রেণীহীন সমাজ ও কৃষক -শ্রমিকের রাজ্ কায়েম করা যেতে পারে। শ্রেণী দ্বন্দ্ব অবসানের জন্য শ্রেণী সংগ্রাম তীব্রতর করে সামাজিক বিপ্লবকে ত্বরানিত করার জন্য পরিস্থিতি ও পরিবেশগত কারণে ‘ সহায়ক শক্তি ‘হিসেবে রাজনৈতিক গণ সংগঠনের যে ঐতিহাসিক প্রয়োজন, তা উপলব্ধি করেই এবং বাংলাদেশের লাখ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অনুমতি লাভ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বাংলাদেশের শোষিত , বঞ্চিত কৃষক- শ্রমিক , মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীদের নিজস্ব সংগঠন হিসেবে জন সমক্ষে আত্মপ্রকাশ করছে এবং এই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক জন যুদ্ধ ঘোষণা করছে। ” (১০) জাসদ ঘোষণা পত্রে ৮ দফা দাবী পেশ করে। এই দাবী গুলির অধিকাংশই জাতীয়তাবাদী আস্ফলন। এই দাবীর তৃতীয় ধারা ” সমাজতান্ত্রিক বিধি -ব্যাবস্থাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পূর্ব শর্ত  হিসেবে গণ্য করা। “ সাধারণ ভাবে গণতান্ত্রিক পরিবেশ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা  সমাজতান্ত্রিক মত ও পথ প্রচারের সহায়ক। জাসদের ঘোষণা পত্রে বিষয়টি উল্টা ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে ! সম্ভবতঃ ছাপার বিভ্রম ! জন্ম লগ্ন থেকেই জাসদ যে সমস্ত রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশ নিয়েছে তা সব গুলি গণতান্ত্রিক আন্দোলন।

১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে জাসদের প্রথম কেদ্রীয় সাংগঠনিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে অহ্বায়ক কমিটির বক্তব্য শিরোনামে জাসদ গঠনের কারণ ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করা হয় ।  ‘বিপ্লবী জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন এবং রায় ‘ নিয়ে জাসদ গঠনে কথা উল্ল্যেখ করা হয় এই পুস্তিকাতে । গঠনের পর জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পেয়ে ছিল জাসদ। তবে ‘ জনগণের রায়’  দিয়ে তৎকালীন জাসদ উদ্যোক্তারা কি বোঝাতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। সচরাচর নির্বাচনে জয় লাভকে জনগণের রায় হিসেবে গণ্য করা হয়। উল্লেখ্য ১৯৭২ সালে ডিসেম্বরের আগে পরে দেশে কোন নির্বাচন হয় নাই। এই পুস্তিকায় যুদ্ধত্তোর দেশের শাসন ব্যাবস্থাকে ‘এক ব্যক্তির শাসন ও ব্যক্তি পূজার  ‘ অভিযোগ এনেছেন জাসদ গঠনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে । ২৫ মার্চ ১৯৭১ পূর্ব সময় কালে আওয়ামী লীগের নীতির তীব্র সমালোচনা উঠে এসেছে এই পুস্তিকায়। ” পঁচিশে মার্চ [১৯৭১ সাল ] রাত্রি পর্যন্ত আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা সম্পর্কে জনগণকে কেন নির্দেশ তো দেয়নি বরং পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলেছিলেন। ………..আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়েছিল জাতিকে সঠিক পথের নির্দেশ দিতে। তাই কোন প্রকার নেতৃত্ব বা নির্দেশ ছাড়াই স্বতন্ত্র ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের বিপ্লবী জনতা। যুব সমাজের নেতৃত্বে কারখানার শ্রমিক , গ্রামের কৃষক, ছাত্র জনতা স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। ” (১১)

১৯৬০-৭০ এর দশক বিশ্বব্যাপী উপনিবেশবাদ বিরোধী সংগ্রামের জয়-জয়কারের সময় কাল। ঠিক একই সময় সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের বিকাশের যুগ। বিশ্বব্যাপী এই সময়ে নানা ধরণের যুদ্ধবিরোধী , নারীবাদী ও পরিবেশ বাদী আন্দোলনের বিকাশ কাল। বাংলাদেশ ও তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলিতে জাতিগত নিপীড়ণ – উপনিবেশবাদ বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক মতবাদ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল । এই ধারায় ১৯৪৭-১৯৭১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে পাকিস্তানের জাতিগত নিপীড়ন বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ছাত্র ফেডারেশন – ছাত্র ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের ছাত্র যুবকদের সংগঠন ছিল। শহরের মধ্যবিত্তের ছাত্র-যুবকদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ছাত্র ইউনিয়নের ভিত্তি ভূমি হয়ে উঠে শহুরে মধ্যবিত্ত। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের উৎপত্তি মুসলিম লীগের রাজনীতি থেকে। ছাত্রলীগের বিকাশ জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনৈতিক চিন্তা-দর্শনে। ১৯৭০ সালের অগাস্ট মাসে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ ‘ গঠনের প্রস্তাব পেশ করেছিল। এই প্রস্তাবের পক্ষের শক্তি যুদ্ধত্তোর দেশে প্রথমে ছাত্রলীগ ( বৈ: স ) এবং এর ধারাবাহিকতায় জাসদের জন্ম দিয়েছিলেন । এই ধারাবাহিকতায় শ্রমিক লীগ ও কৃষক লীগে ভাঙ্গন দেখা দেয় ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে। ১৯৭০ সালের ১২ অগাস্ট ‘ স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ ‘ প্রস্তাবনার স্বপক্ষে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা চেতনা কত টুকু প্রসারিত ছিল তা আলোচনার দাবী রাখে। জাসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কাজী আরেফ আহমেদ ছাত্রলীগের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের অভিমুখী প্রবণতাকে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখেছেন। ১৯৭০ সালের ১২ অগাস্ট ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশগঠন করার প্রস্তাব পেশ করেন তৎকালীন প্রচার সম্পাদক স্বপন কুমার চৌধুরী (‘৭১ মুক্তিযুদ্ধে নিখোঁজ / শহীদ হন ) কেন্দ্রীয় কমিটিতে তখন সদস্য সংখ্যা ছিল ৪৫ জন অনেক বাকবিতন্ডার পর এই প্রস্তাব পাশ হয়। প্রস্তাবের বিপক্ষে ছাত্রলীগের জন প্রভাবশালী সদস্য ভোট দেয়। আব্দুর রাজ্জাকের মারফত শেখ মুজিব এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে খবর পাঠান। ….. কিন্তু পরবর্তীতে সেই প্রস্তাব শেখ মুজিব আব্দুর রাজ্জাকের অনুরোধে সংশোধন করতে হয়। শেষ পর্যন্তস্বাধীন বাংলাদেশগঠনের প্রস্তাব নেয়া হয়। …………. ছাত্রলীগের ভেতরে অবস্থিত দুটি পরস্পর বিরোধী গ্ৰুপের কারণেই হয়তো তারা [ সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রস্তাবের ] বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। (১২) কাজী আরেফ আহমেদের বর্ণনা থেকে জানা যায় শেখ মুজিবের বিরোধিতার কারণে এই প্রস্তাবনা থেকে সরে আসে সমাজতন্ত্রী পক্ষ। যুদ্ধত্তোর দেশে ছাত্রলীগের ভাঙ্গন ও জাসদ প্রতিষ্ঠা পক্ষে যুক্তি দিতে নিজেদের পরিত্যক্ত স্লোগানকে হাতিয়ার হিসেবে তুলে নেয় ছাত্রলীগের একাংশ। নিজেদেরকে পরিচিত করেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী হিসেবে। জাসদ ইতিহাস বর্ণনায় সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রস্তাবের কথা বিশেষ গুরুত্ব পায়।

জাসদের  সৃষ্টি যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের বঞ্চনা ও সমতা ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আখাঙ্খা থাকে । ” স্বাধীনতা আন্দোলনের পর আমরা ভৌগোলিক স্বাধীনতা লাভ করেছি  এবং উৎখাত করেছি পাকিস্থানী ঔপনিবেশিক শাসক বর্গ এবং তাদের বংশবদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল সমূহকে। কিন্ত স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনের শূন্য স্থান পূরণ করেছে নয়া উপনিবেশবাদী শক্তি সমূহ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশীয় উঠতি পুঁজিপতি শ্রেণী, শিল্প প্রশাসক গোষ্ঠী, জোতদার মহাজন, অসৎ ব্যবসায়ী মহল , সুবিধাবাদী রাজনৈতিক টাউট ও অতি অভিলাষী সামরিক ও আধা – সামরিক চক্র। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়ে এ সকল সাম্রাজ্যবাদী , নয়া উপনিবেশবাদী ও দেশীয় শোষক সম্প্রদায় বাংলাদেশের মেহনতী মানুষকে শোষণ করছে। বাংলাদেশ হয়ে ওঠেছে শোষনের একটি কেন্দ্রবিন্দু।(১৩)  জাসদ একটা ঐতিহাসিক সময়কে প্রতিনিধিত্ব করেছিল।  বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের  আন্দোলন হটাৎ  করে গাছ থেকে পড়েনি। যুদ্ধ পূর্ব কালে সীমাবদ্ধতা নিয়ে ছাত্রলীগের মধ্যে এই ধারার চর্চা ছিল। যুদ্ধকালীন সময়ে এই চর্চা সংকট ও সীমাবদ্ধতায় চলমান ছিল। (১৪) মুক্তিযুদ্ধের পর এই ধারা জাসদে সামিল হয়।  মুক্তিযোদ্ধা বিপ্লবাকাঙ্খীদের ঐকান্তিক চেষ্টা, ধনুর্ভঙ্গ পণ থেকে নিঃশর্ত আত্মত্যাগ জাসদের পাথেয় ছিল। জাসদের জন্ম যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে ইতিহাসের  বিভাজন–রেখা। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ–সংস্কৃতি  জাসদের উত্থান –অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা – ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ার  আগে যেমনটি ছিল পরে আর তেমনটি থাকেনি। দল হিসেবে জাসদ নিঃস্ব হলেও মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র নিয়ে জাসদ রাজনীতি বারবার ফিরে আসে।

যুদ্ধত্তোর কালে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীরা শেখ মুজিবর রহমানের রাজনীতির সাথে সমন্বয়ের চেষ্টা করেছে। এই প্রচেষ্টা সফল হয় নাই। রাজনৈতিক ভাবে সফল হওয়া কোন সম্ভবনা ছিল না। এমন একটি উদ্দ্যোগের হদিস পাওয়া যায় জাসদ আত্ম প্রকাশের পূর্বের গণকণ্ঠে।(১৫)   ১৯৭২ সালে ছাত্রলীগের আনুষ্ঠানিক ভাঙ্গনের পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ – ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ দুইটি পৃথক প্যানেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। (১৬) নির্বাচনে ছাত্রলীগের দুই গ্ৰুপের ভরাডুবি ঘটে। ছাত্রলীগ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী গ্ৰুপ নিবার্চনে যৎসামান্য অর্জন নিয়ে শেখ মুজিবর রহমানের সাথে গণভবনে দেখা করেন। শেখ মুজিবর রহমানের সাথে সাক্ষাৎকারের সময় ছাত্রলীগ ( বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র) বঙ্গভবনের করিডোরে  ‘ সর্বহারার অপর নাম শেখ মুজিবর রহমান / শেখ মুজিবের মন্ত্র – সমাজতন্ত্র / এবারের বিপ্লব সামাজিক বিপ্লব / শ্রেণী শত্রু খতম কর /  প্রভৃতি স্লোগানে মুখরিত করে তোলেন। এই মিটিংয়ে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন – আ স ম রব , শাহজাহান সিরাজ , আ ফ ম মাহবুবুল হক প্রমুখ  (১৭) গণকণ্ঠের একই রিপোর্টে তৎকালীন ছাত্র লীগের বৈ : স ) এর সাথে শেখ মুজিবর রহমানের  সহ সম্পাদক আ ফ ম মাহবুবুল হকের সাথে শেখ মুজিবের আলাপচারিতা অনাগত সংকটের অভ্যাস দেয়।  ” আমরা মুজিববাদের বিরোধী নই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নিবার্চনকে  [ ডাকসু ১৯৭২ ] কেন্দ্র করে একদল লোক মুজিববাদের নামে যে মতবাদ প্রচার করেছে তা পুজিঁবাদেরই নামান্তর। আমরা এই মতবাদের বিরোধিতা করি। আমরা মনে করি মার্ক্সবাদের ভিত্তিতে শ্রেণী সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে সামাজিক বিপ্লব সামনের মাধ্যমে এদেশে শোষণহীন – শ্রেণীহীন সমাজ কায়েম করা সম্ভব। …..বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে বাংলাদেশের পরিবেশ , মানুষের মানসিকতা ও চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে যে তত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে সেটাই মার্ক্সবাদ- মুজিববাদ নামে পরিচিত হবে। (১৮) ১৯৭১/৭২ সালে মুজিববাদের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য গ্রহণযোগ্য যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন জাসদ প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম আ ফ ম মাহবুবুল হক ” তখনকার [ ১৯৭১ ] স্লোগান ছিল ‘ মুজিববাদ, যার ব্যাখ্যা ছিল এ রকম -‘ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে শ্রমিক রাজ্ – কৃষকরাজ প্রতিষ্ঠায় হবে মুজিববাদ। ‘ এই বক্তব্যে কিছু অসুম্পর্ণতা থাকলেও তখনকার বাস্তবতায় এই বক্তব্য যুক্তি যুক্ত ছিল। ” (১৯) জাসদের তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিকে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বর্ণনা করেছেন “রাজনৈতিক ভাবে নিজেদের আকর্ষণীয় করে তোলার জন্যই নিজেদের তারা সমাজতন্ত্রী বলত, কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে তাদের প্রধান নেতাদের সমাজতন্ত্রও মুজিববাদী সমাজতন্ত্রই রয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের মূল দ্বন্দ্বটা মোটেই সমাজতন্ত্রকেন্দ্রিক মতাদর্শগত ছিল না, ছিল বঙ্গবন্ধুকে কাছে পাওয়ার প্রতিযোগিতা কেন্দ্রিক। ” (২০)

১৯৭০ সালের অগাস্ট মাসে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটিতে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাব উত্থাপিত ও সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে প্রাস্তাব পাশ হয়ে ছিল। এই প্রস্তাব পাশের সময় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির  তিন ভাগের এক ভাগ সদস্য বৈঠক বয়কট করেছিল। প্রস্তাব পাশের পর শেখ মুজিবর রহমানের অসন্তুষ্টির কারণে ছাত্রলীগ এই প্রস্তাব থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়।( ২১ ) ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনের সময়  সমাজতান্ত্রিক প্রস্তাবের বিষয়টি মাটি চাপা পড়ে যায়। নির্বাচনী প্রচার কালে  সমাজততন্ত্র ও স্বাধীনতার বিষয়টি পুরোপুরি অনালোচিত থাকে।  যদিও সারাদেশের নির্বাচনী এলাকায়  ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ অংশ নিয়েছিল। (২২) কোন কোন এলাকায় ছাত্রলীগ নেতারা স্বাধীনতার কথা বলায়  তাদেরকে নির্বাচনী প্রচারণা থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছিল। (২৩) ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে  আওয়ামী লীগ ভূমি সংস্কারের মত  কিছু সংস্কারবাদী কর্মসূচী স্থান পেয়েছিল।  ১৯৭০ সালের অগাস্ট  সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাব থেকে থেকে  জাসদের  আত্ম প্রকাশ ১৯৭২ সালের অক্টোবর। ১৯৭০ সালের অগাস্ট   থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের বিজয় পর্যন্ত যুদ্ধ ও রাজনীতিতে সমাজতন্ত্র নিয়ে কোন আলোচনা বা উদ্যোগ চোখে পড়ে  না। যুদ্ধত্তোর কালে ছাত্রলীগের ভাঙ্গন ২১ জুলাই ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এই অংশ মুজিববাদ দ্রবীভূত সমাজতন্ত্কে যুদ্ধ পতাকা হিসেবে উড়িয়েছিল। ২১ জুলাই ১৯৭২ জাসদ পন্থীরা প্রকাশ্য কর্তৃক প্রত্যাখিত হওয়ার পরেই জাসদের জন্মের বিষয়টি সামনে আসে। জাসদের আত্ম প্রকাশ আকস্মিক। শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক দূরে ঠেলে দেওয়াই জাসদের জন্মের কারণ। অবিভক্ত ছাত্রলীগের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র পন্থীদের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন থেকেই জাসদের জন্ম। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সমতার আখাঙ্খার জন্ম নিয়েছিল।  তৎকালীন ছাত্রলীগের  বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র পন্থীরাই সামাজিক সমতার ধারক ছিল। এই ধারার সাথে যুক্তরা জাসদের গোড়াপত্তন করে। জাসদের জন্ম ১৯৭২ সালে তবে এই ধারার  পূর্ব-ইতিহাস আছে। জাসদকে বুঝতে হলে এর পটভূমিকে পাশ কাটানোর দুস্কর। জাসদের আত্ম প্রকাশ ছিল  জাতীয়তাবা‌দি রাজনীতির তরঙ্গকে পাশ কাঁটি‌য়ে  বিপ্লব ও সমাজত‌ন্ত্রের শ্লোগা‌নে  নতুন দল গঠন।

তথ্য সূত্র  

——-

(১) জাসদের ভাঙ্গন –

(ক) ১৯৭২ থেকে ১৯৮০ সময় কালে জাসদের প্রধান ধারার নেতৃত্বে ছিলেন মেজর এম এ জলিল ও আ স ম রব।

(খ )১৯৭৬ সালে এম এ আউয়াল জাসদ গঠন করে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দল বিধির অধীনে নিবন্ধিত হয়। জাসদ (আউয়াল) ছিল জাসদের প্রথম ভাঙ্গন। ১৯৭৬ সালে এম এ আউয়াল রহস্য জনক ভাবে খুন হওয়ার সাথে এই গ্ৰুপের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সমাপ্তি ঘটে।

(গ) ১৯৮০ সালে জাসদ ভেঙে বাসদ গঠিত হয়। উল্লেখ্য যে আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্যকের বিরোধিতা করে বাসদ গঠিত হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে বাসদ   ১৫ দলীয় ঐক্যজোটে যোগ দেয় । ঐক্যজোটের ১৫ শরিক দল গুলির অন্যতম ছিল জাসদ ও আওয়ামী লীগ। পরবর্তীতে বাসদ দুই ভাগে বিভক্ত হয় ১৯৮৩ সালে, বাসদ (নয়া ইশতেহার) ও বাসদ (ভ্যানগার্ড)। পরবর্তীতে বাসদ (ভ্যানগার্ড) তিনটি উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

(ঘ) ১৯৮৩ সালে মেজর জলিল জাসদ ত্যাগ করে ইসলামী আন্দোলন গঠন করেছিলেন। মেজর জলিলের দলত্যাগ জাসদের সাংগঠনিক কাঠামোয় তেমন প্রভাব না ফেললেও দলের ভাব মূর্তির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল । ১৯৮৪ সালে মেজর জলিলের মৃত্যর মধ্য দিয়ে এই দলের বিলুপ্তি ঘটে।

(ঙ )১৯৮৩ সালে জাসদ বিভক্ত হয়ে জাসদ (মীর্জা-সিরাজ-ইনু) ও জাসদ (রব) গঠিত হয়।

(চ ১৯৮৬ সালে জাসদ (সিরাজ-ইনু) আবার বিভক্ত হয়ে জাসদ (আরেফ-ইনু) ও জাসদ (মীর্জা-সিরাজ) গঠিত হয়।

(ছ) ১৯৮৮ সালে জাসদ (মীর্জা-সিরাজ) বিভক্ত হয়ে জাসদ (মীর্জা) এবং জাসদ (সিরাজ) গঠিত হয়েছিল। জাসদ (সিরাজ) বিলুপ্ত হয়ে বিএনপি বিলীন হয়ে যায়।

(জ) ১৯৮৮ সালে জাসদ (মীর্জা), বাসদ (মান্না) মিলে জনতা মুক্তি পার্টি গঠন করে। ১৯৯২ সালে জনতা মুক্তি পার্টি আওয়ামী লীগ বিলীন হয়ে যায়।

(ঝ) ১৯৯৭ সালে জাসদ (আরেফ-  ইনু), জাসদ (রব), বাসদের একাংশ (বাদল) একীভূত হয়ে জাসদ ঐক্যবদ্ধ ও পুনর্গঠিত হয়।

(ঞ) ২০০১ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত জাসদ তিন ভাগে বিভক্ত হয়েছে। বর্তমানে জাসদ নামের দল গুলি হচ্ছে জাসদ (ইনু), জাসদ (আম্বিয়া) ও জাসদ (রব) ।

 (ট) ১৯৮০ সালে জাসদ ভাঙ্গন কালে লক্ষীপুর গ্রুপ নামে আঞ্চলিক উপদলের সৃষ্টি হয়েছিল। এই গ্রুপ জাসদের রাজনৈতিক বক্তব্য থেকে দূরে সরে যায়। এই গ্ৰুপের কেউ গণফোরাম ও অন্য দলের সাথে যুক্ত হয়।

(২) জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রথম ঘোষণা পত্র। ৩১ অক্টোবর ১৯৭২।

 (৩) Socialism: Utopian and Scientific by Friedrich ENGELS ১৮৮০ । সালে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস রচিত গ্রন্থ। বইটি কাল্পনিক সমাজতন্ত্র ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য ব্যাখ্যা করে।

(৪) ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত জাসদের প্রকাশনা ‘সাম্যবাদ ‘ এ মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ, মাওসেতুং এর উদৃতি ও কিউবার বিপ্লবীদের মানকারডা আক্রমণের বিষয় উল্ল্যেখ করা হয়েছে।

(৫) পৃষ্ঠা ১৬৫। আমি সিরাজুল আলম খান -একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য শামসু্দ্দিন পেয়ারা।

(৬) (ক) পৃষ্ঠা ১৬৪। আমি সিরাজুল আলম খান -একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য শামসু্দ্দিন পেয়ারা।

(খ) সাপ্তাহিক, ঈদুল ফিতর সংখ্যা ৩০ মে ২০১৯। জাসদ গঠনের সামান্য পরে মবিনুল হায়দার চৌধুরীর সাথে সিরাজুল আলম খানের আলাপচারিতার কথা উল্ল্যেখ করেছেন মবিনুল হায়দার চৌধুরী আত্মজীবনী মূলক সাক্ষাৎকারে। মবিনুল হায়দার চৌধুরী ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ভারতে SUCI সোশালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অফ ইন্ডিয়া এর নেতা ছিলেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। ১৯৮০ সালে বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পরে বহুধা বিভক্ত বাসদ একাংশের সম্পাদক হয়েছিলেন।

(৭) পৃষ্ঠা ৮৬। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র – লেখক মনিরুল ইসলাম। মনিরুল ইসলাম জাসদ রাজনীতিতে মার্শাল মনি হিসেবে পরিচিত।

(৮) রায়হান ফিরদাউস মধু এর সাথে আলাপচারিতা। ১০ অক্টোবর ২০২২।। রায়হান ফিরদাউস মধু -মুক্তিযোদ্ধা ও জাসদের মুখপত্র গণকণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা অন্যতম সাংবাদিক। ১৯৭০-১৯৮০ সময় কালে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্ব পূর্ন দায়িত্ব পালন করেন।

(৯) ১ নভেম্বর ১৯৭২, গণকণ্ঠ। জাসদ ঘোষণা কালীন ৭ সদস্য: মেজর এম এ জলিল, আ স ম রব, শাহজাহান সিরাজ, বিধান কৃষ্ণ সেন, সুলতান উদ্দিন আহমদ, নূরে আলম জিকু ও রহমত আলী। রহমত আলী কখনই জাসদ রাজনীতিতে যুক্ত হন নাই। জাসদ পক্ষ অভিযোগ করে থাকে রহমত আলীকে অপহরণ করে পদত্যাগে বাধ্য করেছিল।

(১০) জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রথম ঘোষণা পত্র। ৩১ অক্টোবর, ১৯৭২।

(১১) জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রথম কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্মেলনে -আহ্ববায়ক কমিটির বক্তব্য। ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭২ সাল।

(১২) বাঙালি জাতীয় রাষ্ট্র – কাজী আরেফ আহমেদ। পৃষ্টা ৭৫

(১৩) জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রথম কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্মেলনে -আহ্ববায়ক কমিটির বক্তব্য। ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭২ সাল।

(১৪) ৬০ -৬১ পৃষ্ঠায়। “পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি” – লেখক ডা শহীদুল ইসলাম খান। জাসদ- বাসদ রাজনীতি ও আ ফ ম মাহবুবুল হক। বেহুলা বাংলা প্রকাশনী। নভেম্বর ২০২১। যুদ্ধকালে বিএলএফ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে সমাজতন্ত্র, মার্ক্সবাদ নিয়ে আলোচনার কথা উল্ল্যেখ করেছেন দিনাজপুরের ডা শহীদুল ইসলাম খান. যুদ্ধকালে বিএলএফ সদস্য। যুদ্ধত্তোর কালে মুজিববাদী ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত ছিলেন শহীদুল ইসলাম খান । শহীদুল ইসলাম খান বিএলএফ ক্যাম্পে যে আলোচনার কথা বলেছেন এই আলোচনা গুলি বিএলএফ এর নির্ধারিত প্রশিক্ষণের বাইরে ছিল। বিএলএফ ক্যাম্পে মার্ক্সবাদ কেন্দ্রিক আলোচনা ছিল প্রান্তিক।

(১৫) ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী গণকণ্ঠ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। প্রকাশনায় মুখ্য ভূমিকা রাখেন আফতাবউদ্দিন আহমেদ ও ফিরদাউস রায়হান মধু। প্রকাশনার শুরুতে পত্রিকাটি সরকারী দপ্তরে নিবন্ধিত ছিল না। ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ সাল থেকে গণকণ্ঠ দৈনিক হিসেবে আত্ম প্রকাশ করে।  

(১৬) ছাত্রলীগের একাংশের প্যানেল ছিল জিনাত – মজলিশ। ডাকসুর সহ-সভাপতি জিনাত আলী আর সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিস নেতৃত্বে প্যানেল দেয়া হয়েছিল। এই অংশ পরবর্তীতে ছাত্রলীগের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী ধারা হিসেবে পরিচিত লাভ করে। ছাত্রলীগের অপরাংশের প্যানেল ছিল শহীদ -মুনির। ডাকসুর সহ-সভাপতি হিসেবে শেখ শহিদুল ইসলাম আর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনিরুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে প্যানেল দেয়া হয়েছিল। উভয় গ্ৰুপ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিল। এই নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও মাহবুব জামান পরিষদ।

(১৭) দৈনিক গণকণ্ঠ। ছাত্রলীগ কর্মীদের সাথে বঙ্গবন্ধুর একটি অন্তরঙ্গ সন্ধ্যা- ২২শে মে ১৯৭২।

(১৮) পূর্বোক্ত

(১৯) পৃষ্ঠা ২৫৯। বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স: একটি পর্যালোচনা – আ ফ ম মাহবুবুল হক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা। সম্পাদক -ডঃ মেসবাহ-কামাল। প্রকাশ কাল -২০০০। প্রকাশক – সম্পর্ক, কলিকাতা।

(২০) পৃষ্ঠা ২৬। আ ফম মাহবুবুল হক ও তার রাজনীতি লেখক   সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। যে জীবন জনতার -কমরেড আ ফম মাহবুবুল হক স্মারকগ্রন্থ। প্রকাশ কাল ২০২০।

(২১) পৃষ্টা ৭৫ । বাঙালি জাতীয় রাষ্ট্র – কাজী আরেফ আহমেদ।

(২২) পৃষ্ঠা ৪১। মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগ ও বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স – শেখ মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন।

(২৩) পৃষ্ঠা ৭০।জাসদ – বাসদের রাজনীতি ও আ ফ ম মাহবুবুল হক –  সাইফুল ইসলাম।

 

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading