কলম্বিয়ার আমাজন জঙ্গলে কাজ করছে এমন কিছু সামাজিক ব্যবসা পরিদর্শন করলেন নোবেল লরিয়েট প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। ইকুয়াডর সীমান্তের নিকটবর্তী এই এলাকাটি কলম্বিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত।
প্রফেসর ইউনূস প্রতিষ্ঠিত “ইউনূস এনভায়ার্নমেন্টাল হাব” কলম্বিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ৩০টি সামাজিক ব্যবসা গড়ে তুলেছে ও এই ব্যবসাগুলিকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এদের মধ্যে ১০টি সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আমাজনিয়ার জঙ্গলে। আমাজনিয়ার ক্রমাগতভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বনাঞ্চলের বনায়ন সহ এলাকায় চক্রাকার অর্থনীতি গড়ে তোলা এই ব্যবসাগুলির উদ্দেশ্য।
আমাজনিয়া রেইনফরেস্ট কলম্বিয়ার মোট ভূমির প্রায় অর্ধেক জুড়ে বিস্তৃত। শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর এই এলাকায় বিরোধের অবসান হলে ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক উদ্যোগে এই রেইনফরেস্টে বৃক্ষ নিধন পুরোদমে শুরু হয়ে যায়। কলম্বিয়ার নতুন সরকার এই বনভূমির আরো বিনাশ রোধ করতে এবং একে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তবে এই সরকার সবেমাত্র তার কাজ শুরু করেছে। দেশটির নতুন ও প্রথম নারী ভাইস-প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সিয়া মারকুয়েজ একজন নিবেদিতপ্রাণ পরিবেশবাদী যিনি অবৈধ খনিখননের বিরুদ্ধে বহু বছর ধরে সরাসরি সংগ্রাম করে আসছেন।
প্রফেসর ইউনূস যে এলাকাটি পরিদর্শন করলেন তার নাম কেকোয়াতা (Cequeta)। এলাকাটি FARC (Revolutionary Armed Forces of Colombia) এর সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। শান্তি চুক্তির পর এলাকায় কোন সুস্পষ্ট শাসন ব্যবস্থা না থাকায় বন ধ্বংসের প্রক্রিয়া চুক্তি-পূর্ব সময়ের চেয়ে বরং আরো খারাপ হয়েছে। এলাকার গরীব মানুষ বেঁচে থাকার প্রয়োজনে নির্বিচারে গাছ কাটছেন বা অটেকসই উপায়ে জমি চাষ করছেন। আর কোম্পানীগুলি বনের গভীরে গিয়ে পরিবেশ ও দীর্ঘমেয়াদী পরিস্থিতির কথা বিবেচনা না করে বন উজাড় করছে এবং বনাঞ্চল ও মাটির যথেচ্ছাচার ব্যবহার করছে।
সামাজিক ব্যবসাগুলির একটি “আমাজনিয়া এমপ্রেনদ্রে” (Amazonia Emprendre) বা AE ফ্লোরেন্সিয়া থেকে এক ঘন্টার দূরত্বে রেইনফরেস্টের পাহাড়ি এলাকায় গভীর জঙ্গলে অবস্থিত। প্রফেসর ইউনূস দুজন সামাজিক ব্যবসা উদ্যোক্তা জুলিও আন্দ্রে ও জুলিয়া হেরনেন্দেজের অতিথি হয়ে তাদের কাজ দেখতে গিয়েছিলেন । এঁরা দুজনেই সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে ফ্রাংফুর্টের কাছে ওয়েজবাডেনে অবস্থিত ইউনূস এনভায়ার্নমেন্টাল হাব এর সহযোগিতায় সামাজিক ব্যবসা সৃষ্টি ও পরিচালনায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
তাঁদের এই সামাজিক ব্যবসাগুলিতে তাঁরা ১৮,০০০ গাছ ও চারা রোপন করেছেন। এগুলি স্থানীয় ১,২৮৫টির মধ্যে ৪৭ প্রজাতির। এই সামাজিক ব্যবসাটি সরকারের নিকট থেকে ৩০ হেক্টর জমির লাইসেন্স নিয়ে তা পুররুদ্ধারের কাজ শুরু করে এবং ব্যবসাটির কর্মকান্ড ১ লক্ষ হেক্টর জমিতে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে। FARC এর অধীনে থাকাকালে এই এলাকায় কেউ প্রবেশ করতে পারতো না এবং কোনো পুনরুদ্ধার কাজও তখন সম্ভবপর ছিলনা। সামাজিক ব্যবসাটি একই সাথে হুলবিহীন মৌ-চাষ (Melliponic culture of stingless bees) নিয়েও কাজ করছে যা আমাজনিয়ার অন্যতম প্রাচীন এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বিবর্তিত চাষগুলির একটি যা এই এলাকায় ব্যাপকহারে বৃক্ষ নিধনের কারণে এখন প্রায় হারিয়ে গেছে।
AE সামাজিক ব্যবসা হিসেবে বন পুনরুদ্ধারে প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান দিতে ব্যক্তি ও উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে একটি অরণ্য-বিদ্যালয় ও প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনা করছে। প্রশিক্ষণ কয়েকদিন ধরে চলে এবং প্রশিক্ষণার্থীদেরকে হোস্টেল হিসেবে তৈরী করা ব্যক্তিগত মিনিতাঁবুতে রাত্রি যাপন করতে হয়। অংশগ্রহণকারীদেরকে একাকী রাত কাটাতে হয় যাতে তাঁরা অরণ্যের রাত ও ভোরের শব্দের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন।
প্রফেসর ইউনূস ও তাঁর সফরসঙ্গীদেরকে AE তাদের প্রক্রিয়াগুলির মধ্য দিয়ে নিয়ে যায় এবং তাদের কিছু প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান প্রদর্শন করে। প্রফেসর ইউনূস তাদের সাথে দীর্ঘ সময় কাটান এবং তাদের ভবিষ্যত সম্প্রসারণ পরিকল্পনা, কর্মসূচিগুলির বহুমুখীকরণ এবং সামাজিক ব্যবসা হিসেবে বনায়নের মাধ্যমে এলাকার মানুষের আয়ের সুযোগ সৃষ্টি, মধু, ফল ও অন্যান্য বনজ দ্রব্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং স্থানীয় মানুষদেরকে বাজারজাতকরণ ও আর্থিক সেবাসমূহ প্রদান বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান।
তাঁর পরিদর্শন শেষে প্রফেসর ইউনূস এলাকার তিনটি স্থানে আমাজনিয়া পুনরুদ্ধারে – যার উপর শুধু কলম্বিয়া বা ল্যাটিন আমেরিকা নয়, বরং সমগ্র পৃথিবী নির্ভরশীল – তাঁর সমর্থন ও প্রতিশ্রুতির চিহ্ণ হিসেবে কেকেও চারা রোপন করেন।
এরপর প্রফেসর ইউনূস ও তাঁর সফরসঙ্গীদেরকে এক ঘন্টার দূরত্বে অবস্থিত বেলিন ডে লস অ্যান্ডাকিস-এ ইসাবেলা গনজালেজ ও তাঁর ২৩ জন নারী সহ-সদস্য পরিচালিত দ্বিতীয় সামাজিক ব্যবসা “আয়াকুনা” পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হয়। এই সামাজিক ব্যবসাটি প্রেসিডেন্ট সান্তোসের “কামপাজ ফাউন্ডেশন” এর সাথে যৌথভাবে আমাজন রেইনফরেস্টের বিভিন্ন ফল ও দ্রব্য প্রক্রিয়াজাত ও বিক্রি করে থাকে, যেমন Ñ কানানগুচা, আসাই, মারাকুয়া, ও অন্যান্য জিনিষ থেকে তৈরী কুকিজ, আরেকিপে ও আইসক্রীম যা বনাঞ্চলের কোনরূপ ক্ষতি না করে উৎপাদন করা হয়। সামাজিক ব্যবসাটি বেলিন ডে লস অ্যান্ডাকিসের প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনায় নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরছে।
আয়াকুনা’র উদ্যোক্তা ইসাবেলা গনজালেজ ও তাঁর পরিবার প্রফেসর ইউনূসকে রেইনফরেস্টের প্রান্তে নিয়ে যান যেখান থেকে তাঁরা প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য পাম ফল আহরণ করে থাকেন।
এরপর তাঁরা সকলে নিকটবর্তী একটি গ্রাম্য কফি শপে আলোচনা করতে বসেন এবং আয়াকুনা’র দলীয় সদস্যদের সাথে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ব্যবসার সীমাহীন সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেন। গ্রামবাসীরা বহু প্রজন্ম ধরে এই বনে তাঁদের জীবনের কাহিনী বর্ণনা করেন, বিশেষ করে FARC সংঘাতের সময়কার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথা এবং কীভাবে শান্তি চুক্তি নাটকীয়ভাবে পরিস্থিতি পরিবর্তিত করে দিয়েছে সেকথা। দুজন দাদী প্রফেসর ইউনূসের কাছে তাঁদের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন যে, পরিস্থিতি এখন নাটকীয়ভাবে ভাল এবং তাঁরা আশা করেন যে, নয় মাস বয়সী শিশু লুইস সহ তাঁদের পরিবারের ছোট ছোট শিশুদেরকে ভবিষ্যতে আর কোন সংঘাত দেখতে হবে না যা হাজার হাজার মানুষের জীবনসহ অসংখ্য কমিউনিটি ধ্বংস করে দিয়েছে।
ইউনূস এনভায়ার্নমেন্টাল হাব আমাজনিয়া রেইনফরেস্টে বিভিন্ন সামাজিক ব্যবসা গড়ে তোলা ও এসব ব্যবসাকে সহায়তাদানে নিযুক্ত এবং হাব এসব ব্যবসাকে বন ও সেখানে বসবাসরত মানুষদের কল্যাণে নিবেদিত বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সাথে যুক্ত করে থাকে যাতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের সুবিধাগুলি গ্রহণ করা যায় এবং সংশ্লিষ্ট সামাজিক ব্যবসাগুলির অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শুধু কলম্বিয়ায় নয় বরং অন্যান্য রেইনফরেস্ট দেশ যেমন ব্রাজিল, বলিভিয়া ও ইকুয়েডরে অনুরূপ সামাজিক ব্যবসা সৃষ্টি ও সম্প্রসারিত করা যায়।
একজন দাদীর কাহিনী
“গেরিলাদের কঠোর আদেশ মোতাবেক মানুষকে চলতে হতো।
আমার স্বামী ছিলেন একজন গেরিলা কমান্ডার। তাঁর বিপুল ক্ষমতা ছিল। এরপর সরকার এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিল। FARC পালাতে থাকলো। দুপক্ষই পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত নির্দয় ছিল। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতি ছিল ভয়াবহ। আমি প্রার্থনা করতে থাকলাম আমার স্বামী বরং মারা যাক, তবু ধরা যেন না পড়ে।
মানুষ একে অপরের বিরুদ্ধে গোপন তথ্য দিচ্ছিলো। এসব তথ্যের ভিত্তিতে কেউ মারা যেতে, কেউ ধরা পড়তে লাগল। দেওয়া তথ্য নির্ভরযোগ্য কি-না তা যাচাই করা হতো না।
বাইরে থেকে জীবন ‘স্বাভাবিক’ মনে হলেও ভেতরে ভেতরে ভয়াবহ সব ঘটনা ঘটতে লাগল। আমরা সবাই শান্তি চাইছিলাম। সরকারও সবসময় শান্তির আশ্বাস দিচ্ছিলো। কিন্তু শান্তি কিছুতেই আসছিল না। নিষ্ঠুরতা ক্রমেই বাড়তে লাগল। আমাদেরকে বলা হলো সরকারের সেনাবাহিনী শান্তি চায় না। কখনো কখনো কিছু সময়ের জন্য শান্তি আসতো। কিন্তু সেটা দীর্ঘস্থায়ী হতো না। অনেকেই পক্ষ পরিবর্তন করতো। কে আসলে কোন পক্ষের কেউ বলতে পারতো না। একই পরিবারের মধ্যেই দুপক্ষের লোক ছিল। কখনো তারা একজন অপরজনকে সেটা বলতো না। সরকারী কর্মকর্তারা যে-শক্তি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতো তার মাধ্যমে তাদের কাজ করতে বাধ্য হতো। কেকোয়াতা ছিল FARC এর সদর দপ্তর। FARC যখন এলাকা ছেড়ে গেল তখন কেউ উল্লাস প্রকাশ করলো না কারণ সবাই জানতো তারা আবার ফিরে আসবে।
কিন্তু তারা ফিরে এলো না বরং শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করলো। এবার কাজ হলো। আমরা সবাই প্রেসিডেন্ট সান্তোসের কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা সারা জীবন তাঁর জন্য প্রার্থনা করবো। তিনি আমার স্বামী ও আমাদের দেশকে নরকের অত্যাচার থেকে বাঁচিয়েছেন। আমার নাতির মতো এই ছোট বাচ্চারা কখনো জানবে না গেরিলা যুদ্ধ কী জিনিষ। প্রার্থনা করি যেন কোন যুদ্ধের সাথেই তাদের পরিচয় না হোক।
আমরা এখন শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে ও ঘুমাতে পারি। প্রার্থনা করি আমাদেরকে আর কখনো যেন যুদ্ধের পথে ফিরে যেতে না হয়। আমার স্বামী এখন একটা ব্যবসা চালাচ্ছে। সবার সাথে তার সম্পর্ক ভাল। সে অতীতে কী করেছে তা কেউ আর স্মরণ করতে চায় না।” সুত্র, ইউনুস সেন্টার ।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.