
জলের শ্যাওলা- প্রথমেই ছোট্ট একটি পরিসংখ্যান দেই। মাত্র ২৮ লাখ জনবসতির মুসলিমদেশ কাতার এবং বিশ্বের ছোটো দেশগুলোর একটি তবে মাথাপিছু আয় বিশ্বের সর্বোচ্চ। কাতার মূলত মাটির নিচের খনিজ সম্পদের কল্যাণেই বিশ্বের ধনী দেশগুলোর চেয়েও ধনীদেশ।
২০২২ কাতার বিশ্বকাপে মোট খরচ হবে ২২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (যা কিনা বাংলাদেশের মোট জাতীয় বাৎসরিক বাজেটের সাড়েতিন গুণ)। চারিদিক থেকে বর্তমানে খবর বের হচ্ছে এই আসরের আয়োজন নিজেদের দেশের করে নিতে কাতার সরকার প্রকাশ্য ২০০ মিলিয়ন ডলারের ঘুষ বানিজ্য বা অনিয়মে করেছে। যেহেতু এগুলো টেবিলের নিচের কর্ম তাই কাগজে- কলমে প্রমাণ এখনও দৃশ্যমান নয়। তবে বাজারে গুঞ্জন চলছে।
২০২২ ফিফা বিশ্বকাপ আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতা ফিফা বিশ্বকাপের এটি ২২তম আসর।যেখানে আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা ফিফার অন্তর্ভুক্ত ৩২টি জাতীয় ফুটবল দল (পুরুষ) প্রতিযোগিতা করবে। এই আসরের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ফিফা বিশ্বকাপ আরব বিশ্বের কোন দেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানে ২০০২ ফিফা বিশ্বকাপের পর এটি এশিয়ায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ফিফা বিশ্বকাপ এবং এটি ৩২ দলের অংশগ্রহণে আয়োজিত ফিফা বিশ্বকাপের সর্বশেষ আসর। কেননা ২০২৬ সালে হতে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো এবং কানাডায় আসর। যেখানে থাকবে ৪৮ দলের সমন্বয়ে ফিফা বিশ্বকাপ।
কাতার তীব্র উত্তাপের দেশ। এই কারণেই এই আসরটি ২০২২ সালের ২০শে নভেম্বর হতে ১৮ ই ডিসেম্বর পর্যন্ত কাতারের ৫টি শহরের মোট ৮টি মাঠে বা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে। সময়সীমা ২৯ দিন সর্বমোট। এই আসরে অনুষ্ঠিত প্রথম ম্যাচে আল খুরের আল বাইত স্টেডিয়ামে কাতার এবং ইকুয়েডর মুখোমুখি হবে। অন্যদিকে, ২০২২ সালের ১৮ই ডিসেম্বর কাতার জাতীয় দিবসে ফাইনাল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এই হলো কাতারে বিশ্বকাপের মোটাদাগে বিবরণ।
২০২২ ফিফা বিশ্বকাপ নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক অনেক কেলেঙ্কারির কথা বাজারে এসেছিলো। সময় যত গড়াচ্ছে, ধীরে ধীরে আরও বের হয়ে আসছে নতুন নতুন কেলেঙ্কারির কথা।। ভয়ানক যে বিষয়টি সামনে চলে এসেছে সেটা মানবিক কেলেঙ্কারির কথা।
শুরুর দিকে, ২০১১ সালের মে মাসে, কাতারের এই আসরটি আয়োজনের জন্য নির্বাচিত হওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে ফিফার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। দুর্নীতির বিষয়ে ফিফার তদন্ত প্রতিবেদনে কাতারকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়েছিলো।
সেই তদন্ত কমিটির প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা “জে গার্সিয়া” তদন্তের বিষয়ে প্রথম থেকেই ফিফার প্রতিবেদনে “অসংখ্য বস্তুগতভাবে অসম্পূর্ণ এবং ভুল উপস্থাপনা” রয়েছে বলে বর্ণনা করেছিলেন।
২০১৫ সালের ২৭ শে মে, সুইস ফেডারেল অভিশংসকরা ২০১৮ ও ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপ নিলাম প্রক্রিয়া বিষয়ে দুর্নীতি এবং অর্থপাচারের তদন্ত শুরু করেছিলেন। ২০১৮ সালের ৬ ই আগস্ট, স্বয়ং ফিফার সাবেক সভাপতি “সেপ ব্লাটার” দাবি করেছিলেন যে কাতার “ব্ল্যাক অপস” ব্যবহার করেছিলো। ব্ল্যাক আপস দ্বারা যা ইঙ্গিত করা হয়েছিলো তা, নিলাম প্রক্রিয়া কমিটি আয়োজন অধিকার অর্জনের জন্য প্রতারণা করেছে। সহজ বাংলায় হবে জোচ্চুরি।
ইতিমধ্যেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল “জোরপূর্বক শ্রম”-এর কথা উল্লেখ করে বলেছে যে কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তুতিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন, অসতর্ক ও অমানবিক কাজের কারণে শত শত অথবা হাজার হাজার অভিবাসী শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেছে। এছাড়াও অনেক অভিবাসী শ্রমিককে চাকরি পাওয়ার জন্য অধিক পরিমাণ “নিয়োগ ফি” দিতে হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এখানে ইউরোপের অষ্ট্রিয়ার জাতীয় টেলিভিশনে গতকালের “ওআরএফ- ২ “- এর একটি রিপোর্টের কথা উল্লেখ করি : গত দশ বছরে স্টেডিয়ামগুলো ও বিভিন্ন প্রকল্প নির্মাণে দক্ষিণ এশিয়ার ৬৫০০ এবং আমাদের দেশ বাংলাদেশ থেকে ১০০০ এর উপরে শ্রমিক নিহত হয়েছে। এটি এখন অফিসিয়াল ডিক্লারেইশন। তবে ইউরোপের বিভিন্ন টিভি আর পত্রিকায় ইদানিং কথা হচ্ছে ইন অফিসিয়াল এই সংখ্যা অনেক অনেক বেশি।
ইউরোপের অনেক পত্রিকায় খবর বের হচ্ছে, বিশ্বকাপের প্রস্তুতির সাথে জড়িত বিদেশি কর্মীরা তাদের আচরণের কারণে কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে।
দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার একটি তদন্তে দাবি করা হয়েছে, অভিবাসী শ্রমিকদের পরিচয়পত্র তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, তাদের সময়মতো অথবা একেবারেই বেতন দেওয়া হয়নি। এমনকি অভিযোগ উঠেছে অনেক অভিবাসী শ্রমিককে খাদ্য ও জল থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে কার্যত ক্রীতদাস করা হয়েছিল- দ্য গার্ডিয়ান
দ্য গার্ডিয়ানের হিসাব অনুযায়ী ( পুরনো রিপোর্), এই আসরটি অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় পর্যন্ত নিরাপত্তা ও অন্যান্য কারণে ৪,০০০ কর্মী মৃত্যুবরণ করেছে, যারা সবাই অভিবাসী শ্রমিক। ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে, কাতারি সরকার এই আসরের কাজের অবস্থার উন্নতির জন্য নতুন শ্রম সংস্কার গ্রহণ করেছিল, যার মধ্যে সকল শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি এবং কাফালা ব্যবস্থা অপসারণ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, গত কয়েক বছরে বিদেশি শ্রমিকদের বসবাস ও কাজের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। এখানে উল্লেখ্য যে, অষ্ট্রিয়া সহ ইউরোপের অনেক টেলিভিশনের খবর অনুযায়ী অভিবাসী নিম্ন শ্রমিকদের মাসিক বেতন ৪০০ মার্কিন ডলারের সম ছিলো। তবে এমন ঘটনা কেবলমাত্র এশিয়ার শ্রমিকদের ক্ষেত্রেই ঘটেছে। যা নতুন শ্রম সংস্কারের সাথে সম্পূর্ণ বেমানান।
কাতার বিশ্বকাপে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের খরচ হচ্ছে। সেটা নিয়ে ইউরোপের দেশগুলোর মূলত মাথা ব্যথা নেই। যদিও ইউরোপের বেশিরভাগ দেশই এই আসরে অংশগ্রহণ করবে। এত এত ডলার খরচ হচ্ছে অথচ শ্রমিকদের নিয়ে কাতার সরকার যে আচরণ করছে বা করছে, সেখানেই ইউরোপে বেশ আলোচনা হচ্ছে। আবারও উল্লেখ্য যে ইউরোপের দেশগুলোই মূলত বেশি দল।
ইতিমধ্যেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শ্রমিক ফেডারেশনগুলো কাতার সরকারের অমানবিক আচরণ নিয়ে বেশ সোচ্চার হচ্ছে। পত্রিকার খবর, ফ্রান্সের বাম শ্রমিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন শহরে বড় পর্দায় খেলা দেখা বয়কট করার কথা বলছে। এমন কি শ্রমিকদের প্রতি কাতার সরকারের এমন মানবধিকার লংঘন ও ক্ষতিপূরনের দাবীতে শ্রমিক সংগঠনগুলো ইতিমধ্যেই চাপ প্রয়োগে প্রচেষ্টায় সংগঠিত হবার কথা বলছে।
কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে বিশ্ববাসীর জনমনে এতদিন পর্যন্ত তেমন কোনো নগেটিভ ভাবনা তৈরি হয়নি। এমনকি শুরুর দিকে কাতার সরকার বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য যে অর্থের বিনিয়োগ লুকিয়ে লুকিয়ে করেছিলো, সেটার সূত্র যেহেতু কাগজে- কলমে নেই এবং প্রমাণের অভাবে তেমনটা সোরগোল হয়নি।
আফ্রিকার ফুটবল কনফেডারেশন যখন কাতারের পক্ষে ভোট দিয়েছিলো সেই সময়ে পত্রিকায় টুকিটাকি লেখা হলেও, তেমনটা আওয়াজ উঠেনি। কেননা আফ্রিকার ফুটবল কনফেডারেশন যে সেদিন কাতারের টাকার কাছে বিক্রি হয়েছিলো, সেটা বেশ পরিষ্কার ছিলো।
কাতারের মোহাম্মদ বিন হান্নানের ফিফা থেকে আজীবন সদস্য পদ হারিয়েছিলেন দূর্ণীতির কারণেই। এমনকি ফিফার সাবেক বস ” সেফ বলাটার” ২০১৫ সালে দূর্ণীতির অভিযোগেই আজীবন সদস্য পথ হারিয়েছেন। এইসব দূর্ণীতিগুলো মূলত কাতার বিশ্বকাপ জুড়েই ঘটেছে।
কাতার তাদের টাকার খুঁটির জোরে ইউরোপের শ্রেষ্ঠ ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনাকে ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহ ইউরোপের ফ্রান্স এবং অন্যান্য দেশের ফুটবল ক্লাবগুলোকেও বড় অংকের টাকার বিনিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করতে পেরেছিলো। সেগুলো নিয়ে বাজারে কথা থাকলেও, ডোনেশন যেহেতু বিশ্ব জুড়েই স্বাগত সেই সূত্রেই আলোচনা তুঙ্গে থাকলও করোরই তেমন করণীয় কিছুই ছিলো না।
তবে এবার কথা উঠেছে মানুষ এবং শ্রমিকদের মর্যদা নিয়ে। শ্রমিকদের প্রকারন্তে হত্যা নিয়ে। জোর জবরদস্তি নিয়ে। অমানবিকতা নিয়ে। আরাবা জাতির মানসিকতা নিয়ে। তবে প্রশ্ন একটি থেকেই যায়, কাতারিদের টাকার কাছেই আবার সব নিস্তব্ধ হয়ে যায় কিনা ? বিশ্বে টাকার শক্তি সত্যিই প্রকট। দিনে দিনে মানুষের মূল্য সত্যিই কমে আসছে। এটা ভয়ানক।
বুলবুল তালুকদার
শুদ্ধস্বর ডটকম