
তিনি অল্প বয়স থেকেই কবিতা রচনা করেছেন এবং ছেলে জুটিয়ে নাটকের দল তৈরি করেছেন। প্রগতি ও কল্লোল নামে দুটি পত্রিকায় লেখার অভিজ্ঞতা সম্বল করে যে কয়েকজন তরুণ বাঙালি লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশাতেই রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের বাইরে সরে দাঁড়াবার দুঃসাহস করেছিলেন তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ইংরেজি ভাষায় কবিতা,গল্প, প্রবন্ধাদি রচনা করে তিনি ইংল্যান্ড ও আমেরিকায়ও প্রশংসা অর্জন করেছিলেন।
বুদ্ধদেব বসুর জন্ম হয় কুমিল্লায়। তাঁর পিতা ভূদেব বসু পেশায় ঢাকা বারের উকিল ছিলেন। তাঁর মাতার নাম বিনয়কুমারী। বুদ্ধদেব বসুর মাতামহ চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন পুলিশ অফিসার। তাঁর পৈতৃক আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রামে। জন্মের চব্বিশ ঘণ্টা পরেই তাঁর মাতা বিনয়ক কুমারীর ১৬ বছর বয়সে ধনুষ্টঙ্কার
রােগে মৃত্যু ঘটে। এতে শােকাভিভূত হয়ে তাঁর পিতা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। মাতামহ চিন্তাহরণ ও মাতামহী স্বর্ণলতা সিংহ’র কাছে প্রতিপালিত হন বুদ্ধদেব। বুদ্ধদেবের শৈশব, কৈশাের ও যৌবনের প্রথমভাগ কেটেছে কুমিল্লা, নােয়াখালী আর ঢাকায়। বুদ্ধদেব বসুর দাম্পত্যসঙ্গী ছিলেন প্রতিভা সােম (বিবাহ-পরবর্তীতে প্রতিভা বসু)
১৯২১ সালে ১৩ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় আসেন এবং প্রায় দশ বৎসর ঢাকায় শিক্ষালাভ করেন। তিনি ১৯২৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৫ সালে ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ১৯২৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আই.এ পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে থেকে ইংরেজিতে ১৯৩০-এ প্রথম শ্রেণীতে বি.এ অনার্স এবং ১৯৩১-এ প্রথম শ্রেণীতে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন মেধাবী এক ছাত্র।
অধ্যাপনার মাধ্যমেই তাঁর কর্মময় জীবন শুরু। জীবনের শেষাবধি তিনি নানা কাজে-কর্মে ব্যাপৃত রেখেছেন। শিক্ষকতাই ছিল জীবিকা অর্জনে তার মূল পেশা। জীবনের শুরুতে স্থানীয় কলেজের লেকচারের পদের জন্য আবেদন করে দু’বার প্রত্যাখ্যাত হলেও ইংরেজি সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য পরিণত বয়সে তিনি আমেরিকা, ইউরােপ ও এশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে সারগর্ভ বক্তৃতা দিয়েআন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন।
বাঙলা ভাষার তুলনামূলক সাহিত্য সমালােচনার ক্ষীণস্রোতকে তিনি বিস্তৃত ও বেগবান করেন। ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কলকাতা রিপন কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত স্টেটসম্যান পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯৫২ সালে দিল্লি ও মহিশূরে ইউনেস্কোর প্রকল্প উপদেষ্টা হিসেবে নিয়ােগপ্রাপ্ত হন। তিনি ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গের পেনসিলভেনিয়া কলেজ ফর উইমেনে শিক্ষকতা করেন। বুদ্ধদেব বসু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক নিযুক্ত হন।
এছাড়াও,তিনি উচ্চ মানের সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বুদ্ধদেব বসু প্রভু ঠাকুরতা, অজিত দত্ত প্রমুখকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন। এ সময় ঢাকার পুরানা পল্টন থেকে তাঁর ও অজিত দত্তের যৌথ সম্পাদনায় ১৯২৭-১৯২৯ পর্যন্ত সচিত্র মাসিক প্রগতি’ (১৯২৭) পত্রিকার সম্পাদনা করেন এবং কল্লোল’ (১৯২৩) গােষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। কলকাতায় বসবাসকালে তিনি প্রেমেন্দ্র মিত্রের সহযােগিতায় ১৯৩৫ সালে ত্রৈমাসিক কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন।
পঁচিশ বছরেরও অধিককাল তিনি পত্রিকাটির ১০৪টি সংখ্যা সম্পাদনা করে আধুনিক কাব্যান্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তৃতীয় বর্ষ ১ম সংখ্যা থেকে বুদ্ধদেব ও সমর সেন এবং ষষ্ঠ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা থেকে বুদ্ধদেব বসু একাই এর সম্পাদক ছিলেন। তাঁরই অনুপ্রেরণা, সদিচ্ছায়, অনুশাসনে এবং নিয়ন্ত্রণে আধুনিক বাংলা কবিতা তার যথার্থ আধুনিক রূপ লাভ করে। এটি কবি বুদ্ধদেব বসুর জীবনের একটি উল্লেখযােগ্য কীর্তি। বাংলা ভাষা ও কবিতার সমৃদ্ধি, প্রসার ও তা জনপ্রিয় করে তুলতে বুদ্ধদেব বসু তুলনারহিত।
১৯৩৮ সালে হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে ত্রৈমাসিক চতুরঙ্গ সম্পাদনা করেন। ১৯৪২ সালে ফ্যাসীবাদবিরােধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের আন্দোলনে যােগদান করেন। পঞ্চাশের দশক থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির একজন সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ লেখক ছিলেন। বুদ্ধদেব বসু’র গদ্য ও পদ্যের রচনাশৈলী স্বতন্ত্র ও মনােজ্ঞ ।
রবীন্দ্র-উত্তর আধুনিক কাব্য ধারার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান উল্লেখযােগ্য। গদ্যশিল্পী হিসেবে সমধিক সৃজনশীল প্রতিভার পরিচয় প্রদান করেন। পরিমার্জিত সঙ্গীতময়তা ও পরিশীলিত স্বতঃস্ফূর্ততা তাঁর গদ্যের বৈশিষ্ট্য। সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনার পাশাপাশি সমালােচনামূলক সাহিত্য রচনায়ও মৌলিক প্রতিভার পরিচয় প্রদান করেন।
ছাত্রজীবনে ঢাকায় তিনি যে এক্সপেরিমেন্ট শুরু করেন প্রৌঢ় বয়সেও সেই এক্সপেরিমেন্টের শক্তি তাঁর মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যায়। তাঁর প্রথম যৌবনের সাড়া এবং প্রাক-প্রৌঢ় বয়সের তিথিডাের উপন্যাস দু’টি দুই ধরনের এক্সপেরিমেন্ট। তাঁর চল্লিশাের্ধ বয়সের রচনাগুলাের মধ্যে- গ্রিক, ল্যাটিন, সংস্কৃত নানা চিরায়ত সাহিত্যের উপমার প্রাচুর্য্য দেখা যায়। অতি আধুনিক উপন্যাসের গীতিকাব্যধর্মী উপন্যাস রচনা করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। রচনার অজস্রতা এবং অভিনব লিখনভঙ্গীর দিক দিয়ে তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন।
তাঁর উপন্যাসে যে ঘাত-প্রতিঘাত ও মানবিক প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করেছেন, তাতে মনঃস্তত্ত্বের বিশ্লেষণের পরিবর্তে কাব্যোচ্ছাসের প্রাধান্য বিদ্যমান। বুদ্ধদেব বসু যেদিন ফুটল কমল, অকর্মণ্য ও রডােড্রেনড্রন গুচ্ছ প্রভৃতি উপন্যাসে কাব্যপ্রবণতার পরিচয় দিয়েছেন। নতুন জীবন-সমীক্ষা-রীতির পরিচয়বাহী উপন্যাস – তিথিডাের, নির্জন স্বাক্ষর, শেষ পাণ্ডুলিপি ইত্যাদি । বুদ্ধদেব বসু’র পৃথিবীর প্রতি (১৯৩৩) কাব্যগ্রন্থটি ‘বন্দীর বন্দনা’র কাব্যগ্রন্থর পরিপূরক গ্রন্থ। উভয় গ্রন্থেই শরীরী প্রত্যয়ে প্রেমের অভিব্যঞ্জনা প্রকাশ পেয়েছে। কিছুটা স্বাদের ব্যতিক্রম এসেছে ‘কঙ্কাবতী’ (১৯৩৭) কাব্যগ্রন্থে। পদ ও বাক্যাংশের পুনরাবৃত্তির সাহায্যে একটি ধ্বনি আবর্ত নির্মাণ করে বুদ্ধদেব বসু যৌবনের আনন্দগানকে স্বাগত জানিয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু ছিলেন আধুনিক কবিকুলের অন্যতম পৃষ্ঠপােষক।
সৃজনশীল সাহিত্যের সঙ্গে সমালােচনামূলক সাহিত্যে তাঁর সাফল্য সমপর্যায়ের। বুদ্ধদেব বসুর বাংলা গদ্যরীতিতে ইংরেজি বাক্যগঠনের ভঙ্গী সুপ্রসিদ্ধ করেছেন। পরিমার্জিত সঙ্গীতমগ্নতা ও পরিশীলিত স্বতঃস্ফূর্ততা বুদ্ধদেব বসু’র গদ্যের বৈশিষ্ট্য। কবিতা, ছােটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সমালােচনা, নাটক, কাব্যনাটক, অনুবাদ, সম্পাদনা, স্মৃতিকথা, ভ্রমণ, শিশুসাহিত্য সহ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসু ১৫৬টি
গ্রন্থে রচনা করেন ।
বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার পত্তনে যে কয়েক জনের নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয় তিনি তার মধ্যে অন্যতম। তাকে কল্লোল যুগ-এর অন্যতম প্রধান কাণ্ডারি হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলা কবিতায় আধুনিক চিন্তা-চেতনা এবং কাঠামাে প্রবর্তনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে পশ্চিমা সাহিত্যের সঙ্গে তার সম্যক পরিচয় ছিল। ফলে ইউরােপীয় এবং মার্কিন সাহিত্যের কলা-কৌশল বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তনে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। কলকাতায় তার বাড়ির নাম রেখেছিলেন কবিতাভবন যা হয়ে উঠেছিল আধুনিক বাংলা সাহিত্যের তীর্থস্থান। ১৯৩০ -এর দশক থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েকটি দশক সাহিত্য পরিমণ্ডলে তার প্রভাব ছিল অবিসংবাদিত। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় বুদ্ধদেব বসু কাজ করেছেন।