ময়মনসিংহের ত্রিশালে সড়ক দুর্ঘটনায় মায়ের পেট ফেটে জন্ম নেওয়া শিশুটি ভালো আছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নবজাতক অন্য মায়ের দুধ পান করছে। নবজাতকের বড় বোন তার নাম রেখেছে ‘ফাতেমা’। সোমবার ইউএনও নিহতদের বাড়িতে গিয়ে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন।

জন্মেই অনাথ সেই শিশুর আপন বলতে বেঁচে আছে আট বছর বয়সী বোন জান্নাতুল ফেরদৌস ও পাঁচ বছরের ভাই ইবাদত। গতকাল সোমবার দুপুরে জান্নাতুল জানায়, বোন হবে জেনেই নাম ‘ফাতেমা’ ঠিক করে রেখেছিল সে। তবে শিশুর দাদা মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু বলেন, তারা এখনও নাম চূড়ান্ত করেননি। এছাড়া যে ক্লিনিকে তার চিকিৎসা চলছে, তার মালিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি নাম প্রস্তাব করেছেন।

নবজাতককে দত্তক নিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকেই তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। এদিকে নিহত জাহাঙ্গীরের পরিবার চায় দুই ভাইবোনের দায়িত্ব নিলে শিশুটিকে দত্তক দেবেন তারা। কারণ জাহাঙ্গীরের বাবা-মা শারীরিক প্রতিবন্ধী। তাদের দেখার কেউ নেই।

সরেজমিন নিহতদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কবরের পাশে বসে আহাজারি করছেন জাহাঙ্গীরের মা সুফিয়া বেগম। আর মলিন চোখে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বাবা-মা-বোনকে যেন খুঁজছিল জাহাঙ্গীর-রত্না দম্পতির মেয়ে জান্নাত ও ছেলে এবাদত।

নিহত জাহাঙ্গীরের বাবা মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু জানান, আমার ছেলের রেখে যাওয়া স্মৃতিটুকু হাসপাতালে রয়েছে। আমি ও আমার স্ত্রী প্রতিবন্ধী। চলতে পারি না নিজেরা। আরও দুটি নাতি রয়েছে। আমি চিন্তা করেছি সবাইকে যদি কেউ দায়িত্ব নেয় তাহলে নবজাতককে দত্তক দেব। আর আমার ছেলে মারা যাওয়ার পর অনেকেই আশ্বাস দিয়েছে সাহায্যের কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ এগিয়ে আসেনি।

তিনি আরও জানান, থাকার ঘরের জায়গাটুকু ছাড়া আমার নিজের কোনো জমিজমা নেই। থাকার ঘরটিও ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। ঘরের চাল ফুটো। বৃষ্টি আসলেই পানি পড়ে। আরও দুই ছেলে ছিল, তারাও মারা গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়। ২০০৪ সালে ট্রাকচাপায় নিহত হয় আমার ছোট ছেলে শামছুল আলম। তারও আগে ১৯৯৫ সালে আমার ভাই ফজলুল হকও মারা যান সড়ক দুর্ঘটনায়।

নিহত জাহাঙ্গীরের বড় মেয়ে জান্নাত বলেন, গতকাল রাতে আমার ছোট বোনকে হাসপাতালে দেখে এসেছি। আমার বোন অনেক সুন্দর হয়েছে। দত্তকের প্রশ্ন করা হলে সে জানায়, আমার ছোট বোনকে কেউ দত্তক নিলে আমাদের আরও দুই ভাইবোনকে দেখতে হবে। আর আমার ছোট বোনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। আমাদের বাবা, মা নেই। প্রধানমন্ত্রী আমাদের না দেখলে আমরা কোথায় যাব। আমার বাবা আমাকে পড়াশোনা করিয়ে অনেক বড় করতে চেয়েছিল।

নিহত জাহাঙ্গীরের বোন মাহমুদা খাতুন জানান, আমার ভাই জাহাঙ্গীর অনেক পরিশ্রম করত। আমার প্রতিবন্ধী বাবা-মাকে সে দেখত। তাদের দেখার আর কেউ রইল না। নবজাতককে কেউ দত্তক নিলে আমার ভায়ের আরও দুটি সন্তান রয়েছে তাদের দায়িত্বও নিতে হবে।

নিহত জাহাঙ্গীরের চাচাতো ভাই শরিফ উদ্দিন শিপন জানান, আমার ভাই মারা গেলেও স্মৃতি হিসেবে নবজাতককে রেখে গেছে। ভাই নিহতের পর থেকে অনেকেই সাহায্যের কথা বললেও এখনও আমরা কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি। এই পরিবারটিকে যদি স্থায়ী সমাধান না করা হয় তাহলে বেঁচে থাকা কষ্ট হয়ে যাবে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আক্তারুজ্জামান জানান, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে নিহত পরিবারের খোঁজখবর নিয়ে তাদের আজ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা নগদ অর্থ প্রদান করা হয়েছে। আর নিহতের মা সুফিয়া বেগমকে প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। পরিবারটির খোঁজখবর সব সময় অব্যাহত থাকবে। তাছাড়া পরিবারটিকে কেউ সাহায্য করতে চাইলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত শনিবার বাড়ি থেকে জাহাঙ্গীর আলম (৪০) তার আট মাসের অন্তসত্তা স্ত্রী ও ছয় বছরের কন্যাসন্তানকে নিয়ে আল্ট্রাসনোগ্রাম করার জন্য ত্রিশাল রওনা দেন। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক পারাপারের সময় দ্রুতগামী মালবাহী ময়মনসিংহগামী একটি ট্রাক চাপা দেয়। ঘটনাস্থলেই তিনজন নিহত হয়। এ সময় অন্তঃসত্ত্বা রত্না বেগমের পেটে থাকা নবজাতকের রাস্তায় প্রসব হয়। বাচ্চাটিকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে ময়মনসিংহের কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। বর্তমানে ময়মনসিংহ নগরীর লাবীব প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে শিশুটি।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from শুদ্ধস্বর ডটকম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading