
জলের শ্যাওলা
বিষয়বস্তু থেকে আমরা সব সময় দূরে সরে গিয়ে সর্বত্রই রাজনীতি খুঁজি। হ্যা এটা সত্য যে সবকিছুতেই রাজনীতি জড়িয়ে। যেহেতু রাজনীতি দ্বারাই দেশ চলে এবং এটা বরাবরই ভালো দিক। সেই হিসেবে সব বিষয়েই রাজনীতি খোঁজা যে অন্যায়, তা আমি অবশ্যই বলছি না। যেহেতু আমাদের রাজনীতি মোটেও ভালো নয়, সেই ক্ষেত্রে রাজনীতি খোঁজাটাই মূখ্য হয়ে উঠে।
তবে আপন ভাবনা, আপন দেখা, আপন মন, আপন চাহিদার যেকোনো মূল্যায়নে সব সময় বা সব বিষয়ে রাজনীতি দ্বারা দহরম মহরম কখনো কখনো সত্যিই বিরক্তের যোগান দেয় এবং সব আবেগ বিনষ্ট হয়, এটা সম্ভবত আমরা খুব বেশি লক্ষ্য করি না। তার চেয়েও বড় বিড়ম্বনার হলো, রাজনীতি খুঁজতে গিয়ে একপাক্ষিকতায় আমরা অনেক সত্যকে নিজেদের অজান্তেই বা জ্ঞাত জ্ঞানেই লুকিয়ে ফেলি। বুঝতেও পারি না অনেক ভালো বিষয়গুলোর পজিটিভ দিকগুলো থেকে কোনো প্রকার পজিটিভ শক্তিকে সঞ্চারে নিতে পারি না।
আমরা ভুলেই যাই, একটি রাষ্ট্রের পরিচালনায় যারা নিয়োজিত থাকেন, তাদের পজিটিভ/নেগেটিভ দুটো দিকই থাকে। শুধুমাত্র নেগেটিভ থাকলে সেই রাষ্ট্র কখনোই পরিচালিত হতে পারে না। হয় রাষ্ট্র নিজেই জনমানুষের সাথে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয় অথবা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে আসে। আমাদের রাষ্ট্রটি কিন্ত মোটেও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নয় এবং কোনো গৃহযুদ্ধেও লিপ্ত নয়। উল্টো কাগজের সূচক বিবেচনায় নিলে, এমনকি সমাজের চোখে দেখলেও রাষ্ট্রটি মোটের উপর মন্দ নয়। মন্দ নয় এটার অবশ্যই পজিটিভ/ নেগেটিভ বিবরণ বা ব্যাখ্যার দাবী রাখে। সমস্যাটি হয় রাজনীতির দর্শণে এবং একপাক্ষিকতায়।
কেনো উপরের কথাগুলো বলা ? দেশে ভয়াবহ বন্যা চলছে। জনমানুষেরা মহাবিপদে আছে। বলা যায় বিশেষ অঞ্চলে ক্রান্তিকাল চলছে। সরকার একপ্রকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকারের মতন করে সমাধানে। সেনাবাহিনীকে সত্যিঅর্থেই অতী দ্রুত মাঠে নামিয়েছে সরকার। এটা একটি ভালো সিদ্ধান্ত বলেই দেখতে পাই। কেননা এতবড় ভয়াবহতায় বিনা সেনাবাহিনীতে সামাল দেওয়া অসম্ভব হতো।
সরকার তার মতন করে ত্রান দিচ্ছে। সাধারণ জনমানুষেরাও বেশ ভালোই ঝাঁপিয়ে পরেছে সাধ্য মতন। সত্যিই প্রশংসনীয় । এমন ভয়াবহ বন্যায় সবার হাত থাকতেই হবে নতুবা মানুষের বিপদ সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। কেননা বর্তমানের বন্যাটি একটি অস্বাভাবিক বন্যা বা ভয়াল বন্যা। এমন ভয়াবহতায় কোনো রাষ্ট্রের সরকারের পক্ষেই এককভাবে সব শতভাগ সামাল দেওয়া সম্ভব হয় না। এমন উদহারণ আমাদের দেশেই অনেক আছে। আমরা রাষ্ট্র এবং জনগণ মিলেই সফল হয়েছি পূর্বে এবং এবারও নিশ্চয়ই সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই সকলে মিলেই সফল হব।
তবে বেশ লক্ষ্যণীয় যে, সরকার এবং সাধারণ জনগণের এমন ভালো কাজগুলোও রাজনৈতিক একপাক্ষিকতার কারণেই সব মলিন হয়ে যায়। প্রশ্ন হলো কোথায় সেই মলিনতা প্রকাশ পায় ? উত্তরটি হচ্ছে, প্রচার- প্রচারণায়।
একপক্ষ সরকারের কোনো উদ্যোগকেই ভালো মনে করে না। আবার সরকার পক্ষের ধারণা এই সরকার বিনা ভিন্ন কোনো সরকারের পক্ষে এমন ভয়াবহ বন্যা থেকে জনগণকে বাঁচানোর কোনো উপায়ই থাকতো না। দুই দিকেই চরম ভাবনা। একপক্ষ সরকারকে যেহেতু পছন্দ করে না সুতরাং সরকারের সকল কাজেই খুঁত খুঁজে পায়। সরকার কতটাকা বানেভাসা মানুষদের জন্য ত্রান প্রদান করলো, সেটাকেও মাথা পিছু গড়পরতায় হিসেব করে বলে দেয়, মাথাপিছু সরকার মাত্র ছয় টাকা বা সাতটাকা প্রদান করেছে। অথচ হিসেব করে না, সেই গড়পরতার হিসেবে শত- হাজার ধনীক শ্রেনীও যোগ হয়ে যাচ্ছে। যাদের অভাব- অনটন বলতে কিছুই নাই। কোনো সরকারই মাথাপিছু হিসেব করে ত্রান দিতে পারবে না এবং এটার প্রয়োজনও নেই। যেখানে যেটা বেশি প্রয়োজন সেখানেই আগে সরকারকে এগিয়ে আসতে হয, এটাই স্বাভাবিক।
সরকার অতীব দ্রুত সেনাবাহিনীকে নামিয়েছে। সেনাবাহিনীর সত্যিকারের ভালো কাজকেও কম কটাক্ষ করা হচ্ছে না। জেনে বুঝে বা সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই তেমনটা করা হচ্ছে। সেনাবাহিনীকে মানবিক হতে হবে। ওমুক সেনাপ্রধান সেনাবাহিনীর বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেছে সুতরাং সেনাবাহিনীকে আগে আগের মতন সেনাবাহিনী হতে হবে। আগের মতন বলতে কোন সেনাবাহিনী ? সেটা অবশ্য পরিষ্কার নয়।
সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারে বন্যার পরিস্থিতি দেখতে গিয়েছেন। রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে নিজ চোখে দেখে আসলে নিশ্চয়ই সরকার থেকে আরও দ্রুত গতিতে কিছু হবার সম্ভাবনা থাকে। সেখানেও কটাক্ষ কম নয়। হেলিকপ্টার ভ্রমণ বা লোক দেখানো ভ্রমণ, ইত্যাদি কত প্রকার বচন।
আবার না গেলেও বচনের অভাব হতো না। সরকার প্রধান হেলিকপ্টারে ঘুরে এসেছেন, এমনটাই হবার কথা। সরকার প্রধানতো নিজে পানিতে নেমে মানুষের কাছে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ে বাতচিত করবেন না। অনেকেই আবার গামবুট পরা এরশাদকে টেনে এনে, হঠাৎই এরশাদ প্রেমে মগ্ন।
সরকারকে অপছন্দ সেটা ঠিক আছে তবে ওই গামবুটটাই এখন বড় হয়ে সামনে হাজির, সেনা শাসনের কীর্তি বেমালুম ভুলে বসে আছে। নয় বছরের ওপরের লড়াইটিও ভুলে গেছে, সরকারকে সমালোচনার কল্যাণে। এমন আলোচনায় অবশ্য বর্তমান সরকাাকে বেশ ভালোই ঠিল মারতে পারে। কেননা বর্তমান সরকারও একপ্রকার স্বৈরশাসক খেতাবে ভূষিত যে। তবে একথা মহাসত্য যে একপাক্ষীকতায় আমরা নিমজ্জিত। যেহেতু সরকারকে পছন্দ নয় সুতরাং রাজনীতির খোঁজ। কিভাবে রাজনীতির ফয়দা নেওয়া যায়। প্রয়োজনে এরশাদ জিন্দাবাদ।
সরকার প্রধান হেলিকপ্টারে গেছে এবং সাধারণ জনগণের ত্রাণ পৌঁছনোতে বাঁধা দেওয়া হয়েছে। প্রচার চলছে, তাতে কোনো অসুবিধে নেই । দু’ তিনটি ঘটনা ঘটেছেও বটে, নিরাপত্তার দোহাইয়ে । তবে কতজনকে এবং কতক্ষন সেই পথে বাঁধা দেওয়া হয়েছে ? তার কোনো উল্লেখ নেই। বাঁধা দেওয়ার কাজটি এসেছে প্রশাসনের কাছ থেকে এবং অবশ্যই বাঁধা না দিয়ে ভিন্নভাবে পুলিশ বা আর্মির সহায়তায় ব্যবস্থা গ্রহণ করাই যেতো। এটা প্রশাসনের ভুল বা প্রশাসনের নির্বুদ্ধিতা। অবশ্য প্রচারে যা দেখি সেই অনুযায়ী বলার উপায় নেই, পুলিশ বা ভিন্ন প্রশাসন থেকে সহযোগিতার কোনো হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো কিনা ? কেননা প্রচার- প্রচারণা এখানেও একপাক্ষিক।
যেহেতু সরকারকে অপছন্দ যে কারণেই হউক সুতরাং দোষ হলো সরকার প্রধানের। প্রশ্ন থেকেই যায়, সরকার প্রধান আদৌও এমন বিষয় জানেন কি ? সরকার প্রধানের কান পর্যন্ত নিশ্চয়ই এমন কথা পৌঁছায় না বলেই ধারনা করি। ধারনা থেকে বলছি, সরকার প্রধান এমন বিষয় জানলে জনমানুষের কথা ভেবে নিশ্চয়ই এর একটি বিহিত করতেন। কেননা সরকার থেকেও জনমানুষদের উৎসাহিত করা হচ্ছে সবাইকে এগিয়ে আসতে। হউক সেটা নিজেদের দলের মধ্য। সেই দলের লোকজনেরাও নিশ্চয়ই সাধারণ জনমানুষের অংশ।
লাইভ- ভিডিও বা পোস্ট এমনভাবে প্রকাশ হচ্ছে, মনে হতেই পারে সরকার প্রধান মনে হয় সাধারণ মানুষের বিতরণ করা ত্রাণের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। সত্যিকারের কি তাই ? কঠিন সত্য হলো, না এবং তা মোটেও নয়। এখানেও সেই একপাক্ষিকতার প্রভাব। তবে এমন একপাক্ষিকতায় যে প্রকারন্তে বানেভাসা মানুষদের নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে নিজেদের অজান্তেই, সেদিকে কারও লক্ষ্যই নেই অথবা জেনে বুঝেই হচ্ছে।
সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এই সরকার কিভাবে ভোটে এসেছে বা কিভাবে ক্ষমতায় আছে, সেই রাজনীতি হচ্ছে বানভাসি মানুষের বিপদে এবং ত্রান নিয়ে। শত শত পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায় ( অনেক সিনিয়র/ জ্ঞানি – গুণীজদের নিকট হতেও) , যেগুলো সরকারকে দুকথা শুনাতে গিয়ে প্রকারন্তে বানভাসিদের নিয়ে চলছে রাজনীতির খেলা।
একযুগের উপরে সরকারকে টেনে হেঁচরে ফেলতে পারলেন না। আন্দোলনের বালাই নাই। তো আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন, যেনো বানভাসিদের করুন হালে তাদেরকে নিয়ে রাজনীতি করতে না হয়। এমন কর্ম বিবেকের চোখে ভালো ঠেকে না। বানের পানি চলে যেতে দিন। মানুষকে ঘরে ফিরতে দিন। তারপর না হয় প্রয়োজনে সরকারের সকল অপকর্মের বিপরীতে আন্দোলন করে সরকার ফেলে দিন। জনগণ বাঁধা দেবে না নিশ্চয়ই। উল্টো জনগণ হয়তোবা আপনাদের সাথেই থাকবে। কেননা এই সরকারের শত- হাজার দূর্বলতা আছে, সেগুলো জনগণ কিন্ত রাজনীতিবিদদের চেয়ে কম জানেন না।
তবে স্মরণে রাখা ভালো যে, বানভাসিদের নিয়ে রাজনীতি করে খুব বেশি সামনের দিকে এগুনোর পথ খোলা থাকবে না। কেননা এই রাষ্ট্রের জনমানুষেরা কিন্ত মোটেও অন্ধ বা বধির নয়। এই রাষ্ট্রের জনমানুষেরা হয়তো রব করছে না ( এর নানাবিধ কারণ নিহিত আছে ) তবে সব জানে, দেখে, উপলব্ধি করে এবং বুঝে। সুতরাং বানভাসিদের নিয়ে রাজনীতি না করাই উত্তম।
বুলবুল তালুকদার
যুগ্ম সম্পাদক, শুদ্ধস্বর.কম