
নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠী, কাঠামো-প্রতিষ্ঠান, বিধি-বিধান ও কর্তৃপক্ষসমূহের সমন্বয়ে হলো রাষ্ট্র এবং এলাকা ও জনগোষ্ঠী বাদে কাঠামো-প্রতিষ্ঠান, বিধি-বিধান ও কর্তৃপক্ষসমূহের সমন্বয়ে হলো রাষ্ট্রব্যবস্থা। আর এলাকা বাদে জনগোষ্ঠী, কাঠামো-প্রতিষ্ঠান, বিধি-বিধান ও কর্তৃপক্ষসমূহের সমন্বয়ে হলো সমাজ এবং জনগোষ্ঠী বাদে কাঠামো-প্রতিষ্ঠান, বিধি-বিধান ও কর্তৃপক্ষসমূহ হলো সমাজব্যবস্থা। একই এলাকায় বসবাসকারী বর্ণ, ধর্ম বা অঞ্চল ভিত্তিক জনগোষ্ঠী, বিধি-বিধান ও কর্তৃপক্ষসমূহের ভিত্তিতে উপ-সমাজ হতে পারে। যেমন, লন্ডন, নিউ-ইয়র্ক, দিল্লী, ইত্যাদি বৃহত্তর শহরে বিভিন্ন উপ-সমাজ রয়েছে। কাঠামো-প্রতিষ্ঠান ও বিধি-বিধানের ভিত্তিতে সমাজ ও সমাজব্যবস্থা রূপও ভিন্নতর হতে পারে।
আদিতে স্বার্থ-দ্বন্দে-প্রাকৃতিক কারণে বৃহত্তর গোত্র-সমাজ বিভক্ত হয়ে আসেপাশে এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বহুমুখী স্বার্থে কতিপয় পাাশাপাশি সংলগ্ন বর্ণভিত্তিক জ্ঞাতি-সমাজ নিয়ে বিশ্বে ছোট ছোট জ্ঞাতি-রাষ্ট্র গড়ে উঠে। অতঃপর রাষ্ট্রশক্তিতেও একই বা পৃথক বর্ণ ও ধর্ম ভিত্তিক ছোট ছোট রাজ্য/রাষ্ট্রের সমন্বয়ে মধ্যম বা বৃহৎ সম্রাজ্য/রাষ্ট্রসমূহ্ গড়ে উঠে। জনসংখ্যা বাড়ায় অঞ্চলিক স্বকীয়তাও প্রভাবশীল হয়ে উঠে। তাই ছোটরাষ্ট্র একই বর্ণ, ধর্ম বা অঞ্চলিক বিধান ভিত্তিক হলেও মধ্যম বা বৃহৎ সম্রাজ্য/রাষ্ট্রসমূহ্ বহু বর্ণ, ধর্ম বা অঞ্চলির বিধান ভিত্তিক এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার আঙ্গীক ও রূপ ভিন্নতর। বিশ্বে সকল রাজতান্ত্রিক বা জনতান্ত্রিক রাষ্ট্র একইধারায়, স্বার্থে বা রূপে গড়ে উঠেনি।
ধর্মবাদীরা কল্যাণমুখী ও মতবাদী হেগেল স্বাভাবিক ধারা হিসেবে দেখলেও মার্ক্স ক্রমে বৃহত্তর রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠার লক্ষ্য, প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাকে শোষণ-শাসন-নিপীড়ণের হাতিয়ার হিসেবে দেখেছেন; এবং রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিলোপেই শোষণ-শাসন-নিপিড়ণ থেকে মুক্তির তত্ত্ব দিয়েছেন। হেগেলের সমন্বয়মুখী দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার বিপরীতে মার্ক্স অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা ও অসমন্বয়মুখী দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় মানবসমাজের বিবর্তনকে আদি কমিউনসমাজ, দাসতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, ধনতন্ত্র ও আধুনিক কমিউনতন্ত্রে বিভক্ত করেছেন। রাষ্ট্র বিলোপ ও আধুনিক কমিউনতন্ত্রকে শোষণ-শাসন-নিপিড়ণমুক্ত সমাজব্যবস্থা বলেছেন। কিন্তু আধুনিক কমিউনও নির্দিষ্ট এলাকাভুক্ত সমাজ, বিধান ও কর্তৃপক্ষসহ ক্ষুদ্রতর রাষ্ট্রের বাইরে নয়।
বিংশ-শতাব্দীর তুলনা কয়েকগুণ হ্রাস পেলেও একবিংশ-শতাব্দীতেও বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহুদেশে মার্ক্সবাদের অনুসারী রয়েছে। এ নিবন্ধে লেখা, ‘উত্তরাধিকার বিধানাবলী ও সমাজব্যবস্থার স্বরূপ’ অংশটুকু পাঠের পরে তারা মার্ক্সবাদী বিবর্তন মতবাদের মূল সীমাাবদ্ধতা জানবেন। সমাজ/রাষ্ট্রের জনসংখ্যা ও এলাকা বাড়ার সাথে সাথে সমকালে চিন্তা-চেতনা-প্রজ্ঞায় বিধি-বিধান ও কর্তৃপক্ষ ছাড়া সহাবস্থানকারী ও পরষ্পর নির্ভরশীল সবল-দূর্বলের আচরণ ও স্বার্থরক্ষণ ন্যায়মুখী, সুষমকরণ ও নিয়মিক হয় না। আর বিধি-বিধান ছাড়াও এ লক্ষ্যে রাষ্ট্রের নৈব্যক্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থাও রয়েছে, তা ‘রাষ্ট্র-অবকাঠামো ও রাষ্ট্রব্যবস্থা’ অংশটুকু পাঠের পরে সহজবোধ্য হবে।
রাষ্ট্র চলে রাষ্ট্রব্যবস্থায়। রাষ্ট্রের জনসংখ্যা বা/ও এলাকা বাড়লে বিধি-বিধানের সংখ্যা-পরিমান বাড়ে। একাধিক বর্ণ, ধর্ম বা/ও অঞ্চল ভিত্তিক রাষ্ট্র হলে বিধি-বিধানের সংখ্যার পরিমানও সে অনুসারে বাড়ে। সংবিধান থাকায় রাজতন্ত্রের তুলনায় জনতন্ত্রের বিধি-বিধানের সংখ্যা-পরিমান আরও বেশী হয়। তেমনি এককরাষ্ট্রের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের বিধি-বিধানের সংখ্যা-পরিমানও বেশী হয়। `রাষ্ট্রের কর্তৃ্ত্ব বাড়লে নির্বাহী-পুলিশ-আদালতসহ বিধিকরণের বিধিমালা ও কর্তৃপক্ষও বাড়ে। এতে বিধিমালা ও কর্তৃপক্ষের অনাচারের সীমাবদ্ধাতা এবং কাংখিত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতির সম্ভাবনাও বাড়ে। তাই রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিধি-বিধান ও নির্বাহী-পুলিশ-আদালতসহ বিধিকরণের কর্তৃপক্ষ যথাসম্ভব হ্রাস করা কলল্যাণমুখী।
সংবিধান না থাকলেও রাষ্ট্র চলে, যেমন গ্রেটবৃটেন। একই বিধি-বিধানেও রাষ্ট্র প্রকৃতি ভিন্নতর হয়। ভিন্ন মতবাদ ও বিধি-বিধানের একইরাষ্ট্রও চলে।, তাহলে মতবাদ, সংবিধান বা বিধি-বিধান রাষ্ট্রের জন্যে উপযোগী হলেও অপরিহার্য নয়। তাহলে এর বাইরেও বিষয়াদি রয়েছে যা রাষ্ট্রব্যবস্থাসহ রাষ্ট্র চলার জন্যে অধিকতর গুরুত্বপুর্ণ। কাঠামো-প্রতিষ্ঠান ও বিধি-বিধান প্রায় একই থাকলেও ১৯৪৭ ও ১৯৭১ উত্তর বাংলদেশাঞ্চলের পরিস্থিতি অবনতিশীলসহ দারিদ্র ও স্বৈররাষ্ট্রে পরিনত হয়। এ অবস্থা থেকে মুক্তি এবং উচ্চতর সমৃদ্ধিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠণের জন্যে রাষ্ট্র-এলাকা, কাঠামো/প্রতিষ্ঠান, বিধি-বিধান ও কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে নিবন্ধকারের প্রচলিত রাষ্ট্রচিন্তার বাইরে অনুসন্ধান ও ভাবনা।
ধর্ম/মতবাদ ও সমাজব্যবস্থার স্বরূপঃ একটি নুতন তত্ত্ব
ধর্ম/মতবাদগুলোর স্বকীয় দর্শন ও বিধানগুলো ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে স্বকীয় সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিধান-প্রতিষ্ঠান ও চেতনা দেয়। এর উপর সমাজের স্বরূপ ও বিবর্তনের ধারা অনেকাংশে নির্ভর করে। ধর্মগুলোর পারিবারিক বিধানাবলীর উত্তরাধিকার বিধানের সাথে সমাজব্যবস্থার সম্পর্ক পর্যালোচনা করলেই তা অনুধাবণ করার জন্যে যথেষ্ট। বৈবাহিক (সমকালীণ) ও উত্তরাধিকার (উত্তরকালীণ) বিধানাবলীর সমন্বয়ে পারিবারিক বিধানাবলী। পারিবারিক ও সামাজিক বিধানাবলী গহবরে নারী-পুরুষের ব্যক্তির-অধিকার ও স্বাধীনতার বিধানাবলী র্নিহিত রয়েছে।
এ্যাডাম স্মিথের ‘ওয়েল্থ অফ নেচার’ (১৭৭৬) থেকে বর্তমানাবদি আধুনিক অর্থনীতিতে আয়বন্টনের অনেক তত্ত্ব আছে। কিন্তু সম্পদ/পুঁজি বন্টনের কোন তত্ত্ব নেই। অথচ সম্পদ/পুঁজির মালিকানা ও বন্টনের ধারা হলো সমাজের স্বরূপ ও বিবর্তনের ধারার জন্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও প্রতিষ্ঠান। বেসরকারী বা ব্যক্তিগত সম্পদ/পুঁজির বন্টনের সাথে বাজার অর্থনীতির প্রতিষ্ঠান ও আয়-বন্টনসহ সমাজ/রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বরূপের সম্পর্ক নিগুঢ়। কোম্পানী/যৌথ মালিকানা ও আয়কর বিধানাবলী এর স্বরূপের পরিবর্তন এনেছে, তবে এগুলো সম্পদ/পুঁজির বন্টনের মূল বিধান-প্রতিষ্ঠানে বিকল্প নয়।
বিশ্বে প্রায় সকল রাষ্ট্রের বেসরকারী সম্পদ/পুঁজি এখনও স্বনামে-বিনামে ধর্মীয় উত্তরাধিকার বিধানাবলী দিয়ে বন্টন হয়। ভিন্ন নামে হলেও ফরাসী রাষ্ট্রীয় ও বৃটেনর খৃষ্টধর্মীয় উত্তরাধিকার আইন একই বিধানাবলী। এজন্যে ধর্ম থেকে সমাজব্যবস্থা বিশেষতঃ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এখনও পৃথক নয়। বিভিন্ন ধর্মের সম্পদ/পুঁজির উত্তরাধিকার বিধানগুলোর স্বরূপ এবং রাজনৈতিক-অর্থনীতির প্রভাব ভিন্নতর। বিশ্বের বহুল প্রচলিত হিন্দু-বৌদ্ধ, রোমান-ক্যাথলিক, খৃষ্ট ও মুসলিম ধর্মগুলোর ভিন্ন ও মৌলিক উত্তরাধিকার বিধানগুলোর স্বরূপ ও প্রভাব থেকে তা বুঝা যাবে।
ধর্মের উত্তরাধিকার বিধানাবলী ও সমাজব্যবস্থার স্বরূপঃ
রোমান-ক্যাথলিক মূল উত্তরাধিকার বিধানঃ সম্পদ/পুঁজির একমাত্র উত্তরাধিকারী জ্যেষ্ঠতর পুরুষ সন্তান হওয়ায় রোমান-ক্যাথলিক ধর্মের উত্তরাধিকার বিধান হলো একচেটিয়ামুলক ও অগণতান্ত্রিক। এটা রাজতন্ত্রেরও উত্তরাধিকার বিধান। এ বিধান পরিবারে সম্পদ/পুঁজির একচেটিয়া এবং তা থেকে সমাজ-রাষ্ট্রে প্রজন্মোত্তর সম্পদ/পুঁজির একচেটিয়ামুখী মালিকানা ও বাজার অর্থনীতির ধারা দেয়। এ একচেটিয়ামুলক বিধান পুঁজির স্বপক্ষে আয়বন্টন এবং ক্রমবর্ধমান সম্পদ/পুঁজিহীন জনগোষ্ঠীসহ ‘অর্থনৈতিক শ্রেণী’ ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার ধারা দেয়। প্রোটেষ্ট্যান্টবাদীরাও ক্যাথলিক ধর্মের এ উত্তরাধিকার বিধানের মৌলিক পরিবর্তন আনেনি। এ বিধানের ধারাবাহিকতার জন্যে ইউরোপে সভ্যতা-জ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথে সাথে আদিমসমাজ পর্যায়ক্রমে দাসতন্ত্রী, সামন্ততন্ত্রী ও ধনতন্ত্রী রাষ্ট্রব্যবস্থায় উত্তরণ হয় (প্রগতিশীল গণতন্ত্র, ১৯৯১)।
হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মের মূল উত্তরাধিকার বিধানঃ পুরুষ সন্তানেরা সম্পদ/পুঁজির সম-উত্তরাধিকারী এবং নারী সন্তানেরা বঞ্চিত হওয়ায় হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মের মূল উত্তরাধিকার বিধান আধা-গণতান্ত্রিক। এ বিধানে প্রজন্মোত্তর পুরুষ-সন্তান বংশেই সম্পদ-পুঁজির মালিকানার ধারাবাহিকতা থাকে এবং জ্ঞাতিভিত্তিক পেশার ধারা দেয়। এ উত্তরাধিকার বিধানের জন্যে হিন্দু-বৌদ্ধ সমাজে ‘সামাজিক/বর্ণ শ্রেণী’ ভিত্তিক আধা-গণতন্ত্রমুখী সমাজব্যবস্থার উৎপত্তি ও ধারা। ভারতসহ দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় সুদীর্ঘকাল এ উত্তরাধিকার বিধান প্রচলিত থাকায় কম-বেশী একইধরণের সামাজিক/বর্ণ শ্রেণীভিত্তিক সমাজব্যবস্থার ধারা (প্রগতিশীল গণতন্ত্র,’৯১)। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর গণতান্ত্রিক বিবেচনায় ও ইসলাম বিদ্বেশীমনায় ভারতসহ দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দেশে খৃষ্টীয় সম-গণতন্ত্রী উত্তরাধিকার বিধান চালু হয়।
খৃষ্ট ধর্মের মূল উত্তরাধিকার বিধানঃ পুরুষ ও নারী সন্তানেরা সম-উত্তরাধিকারী হওয়ায় খৃষ্টীয় উত্তরাধিকার বিধান হলো সম-গণতন্ত্রী। কনষ্টিনেপল্স চার্চের খৃষ্টদশর্নের ভিত্তিতে প্রণীত এ বিধান পূর্বরোমান সাম্রাজ্যে ৫৩৪ সালে প্রথম চালু হয়। এ বিধানে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রজন্মোত্তর সম্পদ/পুঁজির মালিকানার সম-গণতন্ত্রী বিভাজন, প্রতিযোগীমুখী বাজার অর্থনীতি এবং পুঁজি-শ্রমের সমানুপাতিক আয়বন্টনের ধারাসহ সম-গণতন্ত্রী সমাজব্যবস্থার ধারা দেয়। এ বিধান সমাজে ‘অর্থনৈতিক শ্রেণী’ বা ‘সামাজিক শ্রেণী’র ধারা দেয় না। তবে উচ্চমাত্রায় বিবাহ বিচ্ছেদ ও সন্তান লালনসহ সামাজিক সংকটের ধারা দেয়। এ বিধানের জন্যে পূর্বরোমান সাম্রাজ্যে সামাজিক সংকটের ধারা ক্রমবর্দ্ধমান হয়। এ বিধানের জন্যে এখন পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ও ভারতে একই সামাজিক সংকট ক্রমবর্ধমান (প্রগতিশীল গণতন্ত্র, ১৯৯১)।
ইসলাম ধর্মের মূল পারিবারিক বিধানঃ ইসলামী/মুসলিম বৈবাহিক বিধানে পুরুষের থেকে নারীর অধিকার বেশী। আর উত্তরাধিকার বিধানে পুরুষ থেকে নারীর অধিকার কম ও অর্ধ-আনুপাতিক। উভয় বিধানের সমন্বয়ে মুসলিম পারিবারিক বিধান সুষম-গণতান্ত্রিক। এ বিধানে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রজন্মত্তর সম্পদ/পুঁজির মালিকানার সুষম-গণতন্ত্রমুখী বিভাজন, সুষম-প্রতিযোগীমুখী বাজার অর্থনীতি এবং সুষম-আয়বন্টনমুখী ধারা থাকে। এ বিধান সুষম-গণতন্ত্রমুখী সমাজব্যবস্থার ধারাও দেয়। এ বিধান সমাজ-রাষ্ট্রে ‘অর্থনৈতিক শ্রেণী’ বা ‘সামাজিক শ্রেণী’ অথবা উচ্চমাত্রায় বিবাহ বিচ্ছেদ ও সন্তান লালনসহ সামাজিক সংকটের ধারা দেয় না। (প্রগতিশীল গণতন্ত্র, ১৯৯১)।
মার্ক্সীয় মতবাদ/বিধানঃ আদিমসমাজ থেকে পর্যায়ক্রমে বেড়ে ওঠা ইউরোপের দেশগুলোতে ‘অর্থনৈতিক শ্রেণী’ ও দ্বান্দিক সমাজব্যবস্থা ভিত্তিক দাসতন্ত্রী, সামন্ততন্ত্রী ও ধনতন্ত্রী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ ও প্রতিকারের লক্ষ্যে মার্ক্সীবাদসহ সমাজতন্ত্র/কমিউনতন্ত্র মতবাদসমূহের উদ্ভব। মার্ক্সবাদের সমাজতন্ত্র-কমিউনতন্ত্রে সরকারী/গণমালিকানায় অর্থনৈতিক সম্পদ/পুঁজি অবিভাজ্য এবং ধর্ম/মতবাদের উত্তরাধিকার বিধান বিলুপ্ত। সামাজিক (সন্তান) সম্পদসহ ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের বিধানাবলী মার্ক্সবাদে নেই। কেবল সরকারী/গণমালিকানায় উৎপাদন ও আয়-বন্টনের কিছু বিধান রয়েছে। বহুমাত্রিক মানবজীবনের ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে জন্যে অপরিহার্ষ বিধানগুলো “মার্ক্সবাদের সমাজদর্শন-বিধানে” নেই। দীর্ঘ প্রচলিত মৌলিক ও স্বকীয় উত্তরাধিকার বিধানগুলো সাথে রাষ্ট্রব্যবস্থার দীর্ঘ স্বকীয় ধারাই প্রমান করে যে, মার্ক্সীয় ‘সমাজ বিবর্তন মতবাদ’ অভ্রান্ত নয় (প্রগতিশীল গণতন্ত্র, ১৯৯১)।
মানবজীবন কেবল অর্থনৈতিক নয়। একইসাথে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বহু উপধারার। সুষম বা সার্বজনিন কল্যাণমুখী না হলেও বহুল অনুসারিত ধর্মগুলোতে বহুমাত্রিক মানবজীবনের ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে জন্যে অপরিহার্য বিধান-নীতিমালা রয়েছে। ব্যক্তিভিত্তিক ‘প্রকৃতিদর্শন’ ও ‘সমাজদর্শন’ হওয়ায় ধর্মগুলোর জীবনদর্শন ও বিধানাবলী সমষ্টিকভিত্তিক মার্ক্সবাদ থেকে বহুগুন প্রভাবশীল এবং প্রজন্মোত্তর ধারাবাহিক। স্বকীয় ধর্ম/মতবাদের ‘সমাজ দর্শন-বিধানগুলো স্বকীয় সম্প্রদায়েরও ধারা দেয়। অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন কারণে নৈকট্য থাকলেও সামাজিক (বৈবাহিক) ও সাংস্কৃতিক কারণে রাষ্ট্রে একই সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশী নৈকট্য এবং পৃথক সম্প্রদায়ের মধ্যে কম নৈকট্যেও ধারা থাকে।
রাষ্ট্রদর্শণে ব্যক্তি-অধিকারের দর্শন-বিধানঃ
ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক ও নাগরিক-রাষ্ট্রিক জীবনের সমন্বয়ে মানবজীবন। ধর্মগুলো মূলতঃ ব্যক্তিক, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের দর্শন-বিধানের ভিত্তিতে সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠে। সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা এক বিষয় নয়। রাষ্ট্রব্যবস্থা হলো আরও ব্যাপক আঙ্গীকের। নিদিষ্ট রাষ্ট্র-এলাকার বিভাজিত উপ-এলাকা ভিত্তিক রাষ্ট্র-অবকাঠামো এবং প্রচলিত ধর্ম-মতবাদ ও দর্শণ-বিজ্ঞান ভিত্তিক বিধানাবলী-প্রতিষ্ঠানসহ বহুমাত্রিক সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা। তবে সামাজিক জীবনের মতো রাষ্ট্রব্যবস্থায় বৃহত্তর নাগরিক জীবনও রয়েছে। সমাজব্যবস্থায় পরিচালনা ব্যবস্থা থাকলেও রাষ্ট্রব্যবস্থার আরেকটি মৌলিক বিষয় হলো রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার-ব্যবস্থা।
মানবজীবনে ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন মূখ্য হওয়ায় প্রাচীন ও মধ্যযুগে একই ধর্মসমাজ ভিত্তিক ছোট-মধ্যম একক/যুক্ত রাষ্ট্র গড়ে উঠে। একক ধর্ম সমাজ/রাষ্ট্রে ধর্মীয় বিধানের কর্তৃত্বও বেশী প্রভাবশীল ছিল। ইশ্বর-ধর্মের মৌলিক দর্শন-বিধান অপরিবর্তনীয়। রাষ্ট্রের উপ-এলাকার হ্রাস-বৃদ্ধি বা পুনর্গঠণের সাথে সাথে রাষ্ট্রব্যবস্থার অবকাঠামোগত প্রতিষ্ঠানের প্রভাব পরিবর্তিত হয়। রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বরূপ পরিবর্তনের সাথে সাথে অপরিবর্তিত ধর্মীয় দর্শন-বিধানের প্রভাবও পরিবর্তিত হয়। রাষ্ট্রে অবিছিন্ন ও মিশ্রিত হওয়ায় সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অনেকে একই মনে করেন।
প্রাচীনকাল থেকে বিশ্বের রাজ্যগুলোতেও নিজস্ব প্যাগান রাষ্ট্রধর্মের বিধি-বিধান প্রচলিত ছিল। স্বকীয় ধর্মগুলোর দর্শন-বিধানগুলো সমাজ/রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বকীয় স্বরূপ ও বিবর্তনের ধারা দিয়েছে। অতঃপর ভারতকেন্দ্রিক উন্নতর একেশ্বরবাদী রাম-কৃঞ্চীয় হিন্দুধর্ম এবং হিন্দুধর্মের মৌলিক দর্শণ-বিধান আশ্রিত ধর্মগুলোর পারিারিক-সামাজিক বিধানাবলী সমগ্র এশিয়ায় ও পৃর্ব-দক্ষিণ ইউরোপে সম্প্রসাররিত হয়। এজন্যে এসকল দেশে রাষ্ট্রব্যবস্থায় সামাজিক-শ্রেণীতে বিভাজিত পুরুষ-জনগণের স্বাধীনতা ও সমাধিকারের ধারা ছিল। মধ্যযুগ থেকে পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ায় দেশগুলোতে কম-বেশী সুষম-গণতন্ত্রী মুসলিম পারিারিক-সামাজিক বিধান-প্রতিষ্ঠান প্রচলিত হওয়ায় রাষ্ট্রব্যবস্থায় নারী-পুরুষের স্বাধীনতা ও অধিকার বাড়ে। এজন্যে ইউরোপের তুলনায় এশিয়ায় ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সমাধিকারের মতবাদ/বিধানের প্রয়োজনীয়তা কম ছিল।
অন্যদিকে প্রাচীনকালে ইউরোপের ছোট রাজ্যগুলোতেও নিজস্ব প্যাগান রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মীয় বিধি-বিধান চালু ছিল। রোমান সম্রাজ্যভুক্ত হওয়ার পরে প্রথমে রোমান ও পরে ক্যাথলিক রাষ্ট্রধর্ম হয়। খৃষ্ট ধর্মীয় আরোধনা ও রোমান ধর্মীয় সামাজিক বিধানের সমন্বয়ে গড়ে উঠা ক্যাথলিক রাষ্ট্রধর্মের সামাজিক-অর্থনৈতিক বিধানাবলী ইউরোপে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়। অন্যান্য কারণেও গড়ে উঠলেও রোমান-ক্যাথলিক উত্তারাধিকার বিধানের ধারাবাহিকতা এবং জ্ঞান-প্রযুক্তি-সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে ইউরোপে পর্যায়ক্রমে একচেটিয়ামুখী সম্পদ/পুঁজিসহ অসাম্য, শোষন ও স্বৈরমুখী দাসতন্ত্রী, সামন্ততন্ত্রী ও ধনতন্ত্রী সমাজ/রাষ্ট্র ব্যবস্থার ধারা দেয়। রাষ্ট্র প্রচলিত ধর্মীয় বিধানাবলীর ধারক ও সংরক্ষক হওয়ায় এ থেকে মুক্তির জন্যে রেনেসোঁত্তর ইউরোপে ধর্ম ও রাষ্ট্রকে পৃথক করার জন্যে ‘ইহজাগতিক (Secularism)’ মতবাদগুলোর উৎপত্তি হয়।
প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইউরোপীদের বিশ্বাস ছিল ধর্মসহ রাজা ইশ্বরের প্রতিনিধি এবং রাজকর্তৃত্ব ইশ্বর প্রদত্ত। ‘ইহজাগতিক’ মতবাদগুলোর জন্যে ইউরোপে ধর্মচেতনা ও রাজভক্তি হ্রাস পায়। অতঃপর অসাম্য, শোষন ও একচেটিয়ামুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে মুক্তির জন্যে বিভিন্ন সমাজ ও রাষ্ট্র মতবাদ/দর্শনের উৎপত্তি হয়। হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মে নারীরা বঞ্চিত হলেও এশিয়ায় রাষ্ট্রব্যবস্থাগুলোতে পুরুষ-জনগণের সমাধিকার ও স্বাধীনতার ধারা ছিল। মুসলিম শাসকরা ভারতসহ বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রধর্মের বদলে সমাধিকারসহ ও ধর্মীয় স্বাধীনতাসহ সম্প্রদায়-ধর্ম চালু করে। হিন্দু-বৌদ্ধ-ইসলাম ধর্মমতে রাজা-সম্রাটগণ ইশ্বরের প্রতিনিধি নন। সেজন্যে এশিয়ায় ব্যক্তির সমাধিকার ও স্বাধীনতার জন্যে ধর্ম ও রাষ্ট্রকে পৃথক করার মতবাদ/বিধানের উপযোগীতা ছিল না।
রুশোর স্বাধীনতা ও সমাধিকারের মতবাদঃ
অসাম্য, শোষন ও একচেটিয়ামুখী হলেও হর্বস, লর্ক, রুশো, প্রমুখণ রাষ্ট্র দার্শণিকগণ সম্পদ/পুঁজির ব্যক্তিমালিকানা ও রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে মানবসভ্যতা বিকাশে সহায়ক হিসেবে দেখেছেন। এ জন্যে বৃটেনের হর্বস, লর্কসহ গণতন্ত্রী বিপ্লবদ্বয়ের প্রভাবশীল রাষ্ট্র-দার্শনিকগণ রাজ-সার্বভৌমত্ব রেখে গ্রীক-রোমান গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার আলোকে আইন প্রনয়ন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অধিকার ও অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার মতবাদ দিয়েছেন। অন্যদিকে অসাম্য, শোষন ও স্বৈরচারিতা থেকে মুক্তির জন্যে ফরাসী রাষ্ট্র-দার্শনিক রুশো সম্পদ/পুঁজির ব্যক্তিমালিকানা রেখে রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের স্বাধীনতা (Liberty) ও সমাধিকারের (Equal Rights) মতবাদ দিয়েছেন।
রুশোর মতবাদে প্রভাবিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে জনগণের স্বাধীনতা (Liberty) মুখ্য্ ও অলঙ্ঘনীয় বিষয় হিসেবে স্থান পায়। ক্রমে নাগরিক মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে সমাধিকারের গড়ে উঠে। অন্যদিকে গণতন্ত্রী বিপ্লবের পরে ফ্রান্সে ১৭৯০ সালে একদা ৫৩৪ সালে পূর্ব-রোমান সাম্রাজ্যে প্রচলিত ও পরবর্তীতে পরিত্যক্ত সম-গণতন্ত্রী খৃষ্ট্রীয় উত্তরাধিকার বিধান প্রচলন করা হয়। ১৭৯১ সালে সংবিধানে সার্বজনিন সম-গণতন্ত্রী ‘নাগরিক মৌলিক অধিকার’-এর বিধান করা হয়। অতঃপর ক্রমান্বয়ে সম-উত্তরাধিকারসহ সম-বৈবাহিক চালু হয়। সরকার-আদালত ছাড়া রুশোর সমাধিকার ও স্বাধীনতার মতবাদ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আর নিরুষ্কুশ মুসলমান ভিত্তিক অঞ্চল-দেশগুলোতে সুষম-গণতান্ত্রিক পারিবারিক এবং সম-গণতান্ত্রিক সামাজিক বিধানাবলী প্রচলিত থাকায় নাগরিক মৌলিক অধিকারের বিধান/প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত।
প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর ক্রমান্বয়ে ইউরোপের প্রায় সকল রাষ্ট্রে সম-গনতন্ত্রী খৃষ্ট্রীয় উত্তরাধিকার বিধান প্রচলিত হয়। গ্রেটবৃটেনসহ বৃটিশ-সম্রাজ্যে ১৯২৫ সালে সম-গনতন্ত্রী খৃষ্ট্রীয় উত্তরাধিকার প্রচলিত হয়। এ বিধান প্রচলনের জন্যে ইউরোপের সুদীর্ঘকালের সামন্ত-ধনতন্ত্রী রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারা ক্রমাবসান হয়ে সম-গনতন্ত্রী রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারা শুরু হয়। তিন-প্রজন্মকাল পরে গ্রেট-বৃটেনে ২০০৫ সালে সুদীর্ঘকালের উত্তরাধিকার বিধানের ভিত্তিতে গঠিত লর্ডহাউজ ও সুপ্রীমকোর্ট বিলুপ্ত হয়ে নয়া-আঙ্গীকে পুনর্গঠিত হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার নিরুষ্কুশ হিন্দু-বৌদ্ধ ভিত্তিক দেশগুলোতেও সম-গণতন্ত্রী ‘নাগরিক মৌলিক অধিকারের বিধানসহ পারিবারিক জীবনে সম-গনতন্ত্রী খৃষ্ট্রীয় উত্তরাধিকার বিধান ক্রমান্বয়ে প্রচলিত হয়।
‘অর্থনৈতিক শ্রেণী’ ভিত্তিক অসাম্য, শোষন ও একচেটিয়ামুখী ভূমি-পুঁজিসহ রাষ্ট্রব্যবস্থার থেকে মুক্তির জন্যে কার্ল মার্ক্স সম্পদ/পুঁজির ব্যক্তিমালিকানার বদলে সরকারী/রাষ্ট্র মালিকানায় প্রথমে সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা বিলুপ্তির পরে সম্পদ/পুঁজির গণমালিকানায় ছোট এলাকা/কমিউন ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার মতবাদ দেন। [কমিউনতন্ত্রের সঠিক বঙ্গানুবাদ সাম্যবাদ নয়, ছোট কমিউন-এলাকা ভিত্তিক সমাজ। গণতন্ত্রের মর্মার্থ হলো সাম্যবাদ]। এজন্যে আদিম সমাজ থেকে একই উত্তরাধিকার বিধানে পর্যাক্রমে গড়ে উঠা ইউরোপের দাসতন্ত্রী, সামন্ততন্ত্রী ও ধনতন্ত্রী সমাজব্যবস্থার সাথে কমিউনতন্ত্রী সঙ্গতিহীন সমাজব্যবস্থা। সঙ্গতিহীন হলেও ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ (Dialectic Materialism)’ প্রকৃতিদর্শনের সমান্তরাল ও অনুসিদ্ধান্তমূলক হিসেবে ‘সমাজ বিবর্তন মতবাদ (Historical Materialism)’ যুক্ত উপস্থাপন করায় অনুসারীদের কাছে মার্ক্সবাদ ধর্মবিশ্বাসের (Faith) মতো পরিনত হয়।
স্বৈর-রাষ্ট্রশক্তিতে একদলীয় রাজনৈতিকব্যবস্থা পরিচালিত হওয়ায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রে শাসকশ্রেণী ও শাসিতশ্রেণীর ধারা সৃষ্টি করে। ব্যক্তিস্বার্থকে ধারণ না করে কেবল স্বৈরমুখী পরিচালনায় রাষ্ট্র-মালিকানার সম্পদ/পুঁজিও স্বল্প উৎপাদনশীল থাকে। স্বল্প সম্মৃদ্ধিশীল ও রাজনৈতিক শ্রেণীর স্বৈরমুখী পরিচালনা হওয়ায় সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র ক্রবর্দ্ধমান সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক (চতুর্মুখী) শাসন-শোষণ-নির্যাতনমুখী গণজীবনের ধারা দেয়। ক্রমবর্দ্ধমান অসাম্য, সম্মৃদ্ধি, শোষন ও স্বৈরচারিতার বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহে পূর্ব ইউরোপের সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলোর পতন হয়। অতঃপর পূর্ব ইউরোপের সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলোতে সার্বজনিন সম-গণতন্ত্রী ‘নাগরিক মৌলিক অধিকারের’ সংবিধানে বিধান ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রচলিত হয়। ধর্মপালনের স্বাধীনতা পুনঃপ্রচলিত হওয়ায় ‘নাগরিক অধিকারে’ পারিবারিক বিধানবলী প্রভাব বাড়ছে।
সরকারব্যবস্থার মতবাদ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাঃ
জ্ঞাতিসমাজ, কমিউনসমাজ ও ছোট রাষ্ট্র গড়ে উঠা সাথে সাথে জ্ঞাতি-প্রধান, কমিউন-প্রধান, রাষ্ট্র-প্রধান ব্যবস্থাও গড়ে উঠে। রাষ্ট্র/রাজ্য-প্রধানসহ বৃ্হত্তর রাজ্য, ধর্ম ও উত্তরাধিকার বিধানে সুত্রে রাজতন্ত্রের স্থিতিশীল ধারা দেয়। আবার রাজ্য ও রাজার সমন্বয়ে সম্রাজ্য ও মহারাজ্য/সম্রাট ব্যবস্থা গড়ে উঠে। রাষ্ট্রব্যবস্থার স্থিতিশীল ধারা গড়ে উঠার নৈপথ্যের বিষয়গুলো নয়, এখানে আলোচ্য হলো বৃ্হত্তর রাষ্ট্রের “স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা’ মৌলিক প্রতিষ্ঠাণগুলো। অসাম্য, শোষন ও একচেটিয়ামুখী সম্পদ/পুঁজির বৈষম্য থাকলে রাষ্ট্রে সংঘর্ষিক সম্পর্কও কম-বেশী বিরাজমান থাকে। তারসাথে প্রকৃতিক বা সামাজিক দূর্যোগ অথবা দূর্ভিক্ষ যুক্ত হলে গণবিদ্রোহও হয়। প্রকৃতিক দূর্যোগ ও দূর্ভিক্ষে খৃঃপূঃ ৫৯৬-এ “গ্রীক গণতন্ত্র” এবং সামাজিক দূর্যোগে খৃঃপূঃ ৫০৯-এ “রোমান গণতন্ত্র’ গড়ে উঠে। “গ্রীক গণতন্ত্রের” ও “রোমান গণতন্ত্রের’ উত্তারধিকার হলো, ডাচ-বৃটিশ “রাজকেন্দ্রিক সংসদীয় সরকার” ও যুক্তবাষ্ট্রের “রাষ্ট্রপতিকেন্দ্রিক সরকার” ব্যবস্থা।
গ্রীক ও রোমান উভয় গণতন্ত্রের মুখ্য-ধারণা হলো ‘গণ-প্রতিনিধিত্বশীল বা গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা’। ‘আধুনিক গণতন্ত্র’-এর ধারণা আরও ব্যাপক যা ‘‘গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা’র সাথে ‘নাগরিকদের গণতান্ত্রিক মৌলিক মানবাধিকারের’ সমন্বয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা (State-Democracy)’। প্রত্যেক ব্যক্তিই কম-বেশী স্বার্থমুখী। সংসদ ও সরকারে প্রতিনিধিরা নিজেদের স্বার্থমুখী এবং একটানা ক্ষমতাসীন থাকার চেষ্ঠা করে। এতে সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থা স্বৈরমুখী হতে থাকে এবং সাথে সাথে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা, রাজনীতি ও রাষ্ট্র অস্থিতিশীল হয়ে উঠে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্যে “গ্রীক গণতন্ত্রে” একবছর মেয়াদী প্রতিনিধিত্ব চালুসহ এক্যক্তির একাদিক্রমে একাধিক বছর পুনঃনির্বাচন ব্যবস্থা রহিত করা হয়। “গ্রীক গণতন্ত্র” হলো, নির্দলীয় সংসদীয় সরকারব্যবস্থা।
একবছর মেয়াদ” কম হওয়ায় “গ্রীক গণতন্ত্র” থেকে শিক্ষা নিয়ে রোমান গণতন্ত্রে শুরু থেকে “দুইবছর মেয়াদী” প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থা’ চালু করা হয়। দু’জন রাষ্ট্রপতিও একত্রে নির্বাচিত হয়। ১ম-পর্বে একজন নির্বাহী রাষ্ট্রপতি ও ২য়জন অভিমত প্রদানকারী রাষ্ট্রপতি থাকেন। ২য়-পর্বে ২য়জন নির্বাহী রাষ্ট্রপতি ও ১ম-জন অভিমত প্রদানকারী রাষ্ট্রপতি হন। এটা একধরণের স্বনিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য ব্যবস্থা। রোমান এককরাষ্ট্র শুরুতেই গ্রীক-রাষ্ট্রের ছয়গুণ ছিল। এলাকা ও জনতা বাড়ার সাথে সাথে সংসদ ও সরকারের সকল কমিউনিটির প্রতি ও দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতা কমতে থাকে। তাই বৃহত্তর জনগণের দাবী মিটানো জন্য কয়েকটি প্রতিনিধিত্বশীল ফোরাম/কক্ষ এবং চুড়ান্ত বিবেচনার জন্যে অভিজ্ঞদের নিয়ে উচ্চকক্ষ সিনেট গঠণ করা হয়। এতে সংসদ ও সরকার নিরপেক্ষমুখী, স্বদায়িত্বশীল ও স্বজবাবদিহিমূলক হয়ে উঠে।
প্রাচীন রোমান এককরাষ্ট্রের এই অভিজ্ঞতায় পরবর্তীতে রোমান যুক্তরাষ্ট্র/সাম্রাজ্যব্যবস্থায় সরকার ও বৃহত্তর রাষ্ট্র/রাজ্যগুলোতে দুইকক্ষ সংসদ ব্যবস্থা চালু হয়। সেই অভিজ্ঞতায় আধুনিককালে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউনিয়ণ রাষ্ট্রের যুক্ত/ইউনিয়ণ সরকারব্যবস্থায় দুইকক্ষ সংসদ সার্বজনিন প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়েছে। এমনকি এককরাষ্ট্র গ্রেটবৃটেন, ফ্রান্স, ইতালী, জাপান, ইত্যাদি বৃহত্তর রাষ্ট্রগুলিতে এবং আমেরিকার অঙ্গরাষ্ট্রগুলোতে ও ভারতের উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক, বিহার, ইত্যাদি বৃহত্তর প্রদেশে দুইকক্ষ সংসদ ব্যবস্থা প্রচলিত। কাঠামো-প্রতিষ্ঠানগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে একক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কম স্বনিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য থাকে। তাই এককক্ষ সংসদ ব্যবস্থায় বৃহত্তর এককরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক সরকারের ধারাবাহিকতা থাকে না। একক গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বৃহত্তর এককরাষ্ট্রে দুইকক্ষ সংসদব্যবস্থা বেশী অপরিহার্ষ।
প্রথম ও দ্বিতীয় গণতন্ত্রের ঢেউয়ের সময়ে বিশ্বে ৪৭টি গণজনতান্ত্রিক এককরাষ্ট্রে এককক্ষ সংসদভিত্তিক হওয়ায় ৩৬টা রাষ্ট্রেই গণতান্ত্রিক সরকার টেকসই হয়নি। তবে দুইকক্ষ সংসদব্যবস্থার জন্যে ১১টি মধ্যে ৮টি রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা টেকসই হয়। হিটলামলে প্রাদেশিক সরকারগুলো বিলুপ্তিতে জার্মানী এককরাষ্ট্র, দলীয় নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে এককক্ষ সংসদ ও নির্বাহী প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় পরিনত। এতে জাতীয়সহ বিশ্বে মহাবিপর্যয় আনে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর আবার যুক্তরাষ্ট্রীয় দুইকক্ষ সংসদ এবং প্রাদেশিক সংসদ প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক সংকটের অবসান হয়। ইন্দোনেশিয়ায় দুইকক্ষ সংসদব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হলে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক সংকটের অবসান হয়। দলীয় নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে এককক্ষ সংসদ ও নির্বাহী প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক সংসদীয় সরকারব্যবস্থা বাংলাদেশেও ১৯৭৫-এ জাতীয় মহাবিপর্যয় আনে।
রাষ্ট্র-অবকাঠামো ও রাষ্ট্রব্যবস্থাঃ আরেকটি নুতন তত্ত্ব
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রচলিত “আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার” ধারণা হলো, ‘ব্যক্তির সম/সুষম মৌলিক অধিকারসহ গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা’। এদুটোই সংবিধানের বিধান ভিত্তিক এবং নির্বাহী ও আদালতের আদেশ নির্ধারিত বা ফয়সালা হয়। দুইকক্ষ সংসদসহ অন্যান্য কাঠামো-প্রতিষ্ঠানগতভাবে স্বনিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য না থাকলে ব্যক্তি/দলীয় স্বার্থে নির্বাহী সরকারও নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণ করে বা রক্ষা করে না। চলমান বিশ্বেও বৃহত্তর একক রাষ্ট্রগুলো দুইকক্ষ সংসদেও ‘ব্যক্তির মৌলিক অধিকারসহ গণতন্ত্রমুখী সরকারের ধারাবাহিকতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। এর মূলে বৃহত্তর একক রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্র-অবকাঠামো প্রতিষ্ঠান ও প্রতিরক্ষা কাঠামোর সীমাবদ্ধতা। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা হলো ছোট রাষ্ট্রের। বৃহত্তর রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে “গণতন্ত্রমুখী রাষ্ট্র-অবকাঠামো প্রতিষ্ঠান” ও “গণতন্ত্রমুখী প্রতিরক্ষা কাঠামো-প্রতিষ্ঠান”-এ দুটো প্রতিষ্ঠান যুক্ত করা অপরিহার্য।
প্রাচীনকালের রাজ্য/রাষ্ট্রগুলো ছোট এলাকা ও স্বল্প জনসংখ্যার ছিল। আধুনিক রাষ্ট্রগুলো বৃহত্তর এলাকা ও বিপুল জনসংখ্যা ভিত্তিক। বৃহত্তর রাষ্ট্রগুলো ক্রমান্বয়ে প্রদেশ/অঞ্চল/বিভাগ, জেলা, উপজেলা, নগর/ইউনিয়ন, ইত্যাদি উপ-এলাকা ও জনগোষ্ঠিতে বিভক্ত। উল্টোভাবে বলা যায়, বৃহত্তর রাষ্ট্রগুলোর জনতাসহ পল্লী/প্রামগুলো বা নগরগুলো ক্রমান্বয়ে উপজেলা, জেলা ও প্রদেশ/অঞ্চল/বিভাগ অধি-এলাকার ভিত্তিতে সমন্বিত। রাষ্ট্র-এলাকার এ ক্রমঃবিভক্তি/সমন্বয়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের জনগণ ও জনগণের সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও কর্তৃপক্ষসমূহ ক্রমবিভক্ত/সমন্বিত। তাই রাষ্ট্র-এলাকার ক্রমঃবিভক্তি/সমন্বয়ের ভিত্তিতে গড়ে উঠা রাষ্ট্র-অবকাঠামো প্রতিষ্ঠানের স্বরূপের উপর রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বরূপ অনেকাংশে নির্ভর করে। বৃহত্তর রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্র-অবকাঠামো প্রতিষ্ঠানের স্বরূপ স্বৈরমুখী (Autocratic), গণতন্ত্রমুখী (Democratic) বা সন্ত্রাসমুখী (Anarchic) হলে, রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বরূপ ও বিবর্তনের ধারাও যথাক্রমে স্বৈরমুখী, গণতন্ত্রমুখী বা সন্ত্রাসমুখী হয়।
বিশ্বের অভিজ্ঞতায় এককরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কেন্দ্র-বিভাগ, বিভাগ-জেলা, জেলা-উপজেলা বা উপজেলা-ইউনিয়ন এর বিভক্তি/সমন্বয়ের ভারসাম্য ১ঃ ৯ অনুপাত উচ্চতর-গণতন্ত্রমুখী। এর থেকে হ্রাস-বৃদ্ধি হলে গণতন্ত্রমুখী বৈশিষ্ট্য হ্রাস পায় এবং এক পর্যায়ের পরে ক্রমশঃ যথাক্রমে অধিকতর স্বৈরমুখী বা সন্ত্রাসমুখী হয়। গণতন্ত্রমুখী ক্রমবিভক্তি/সমন্বয়ের জন্যে সবস্তরে ন্যুনত ১ঃ ৫ ভারসাম্যের অনুপাত অপরিহার্য। সমীক্ষামতে চার-স্তরে ক্রমবিভক্তি/সমন্বয়ের ভারসাম্য ১ঃ ১০ ১ঃ ৯ ও ১ঃ ৮ হলে রাষ্ট্র-অবকাঠামোর সবচেয়ে সুষম-গণতন্ত্রী। ক্রমবিভক্তি/সমন্বয়ের স্তর কম ব বেশী হলে এ ভারসাম্যের ব্যস্ত অনুপাত বিভিন্নস্তরে কম ব বেশী হবে। রাষ্ট্র এলাকা ও জনগণের প্রথম বিভক্তি হওয়ায় রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বরূপের জন্যে ‘কেন্দ্র-বিভাগ’-এ বিভক্তির ভারসাম্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ (প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ)। ক্রমান্বয়ে বিভাগ-জেলা, জেলা-উপজেলা ও উপজেলা-ইউনিয়ন একইহারে ক্রমান্বয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ।
অতীতে প্রশাসনিক কারণে গঠিত হওয়ায় বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন এলাকাকে সরকারী প্রশাসনিক একক ও বিষয়ক হিসাবে ভাবা হয়। বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন এলাকার ভিত্তিতেই রাষ্ট্রের জনগণ ও জনগণের বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও কর্তৃপক্ষসমূহও বিভক্ত/সমন্বিত হয়। এজন্যে সরকারী প্রশাসনিক থেকে বিভাগ কয়েকগুণ বেশী বেসরকারী এবং রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংকৃতিক ও সামাজিক রাষ্ট্র-অবকাঠামো প্রতিষ্ঠান। বিষয়টি প্রাচীনরোম, বৃটেন. জাপান ও দঃকোরিয়া এবং ডাচ, যুক্তরাষ্ট্র পঃজার্মানী, মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংকৃতিক ও সামাজিক আঙ্গীকের সম্মৃদ্ধিশীল ধারা থেকেও উপলব্দি করা যাবে। এ সকল একক ও যুক্ত রাষ্ট্রগুলোর উচ্চতর সমৃদ্ধিশীল ধারার মূলে গণতন্ত্রমুখী রাষ্ট্র-অবকাঠামো।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা
বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মতো দক্ষিণ এশিয়ার গঙ্গা-পদ্মা-বহ্মপুত্র-যমুনা-মেঘনা অববাহিকাতে একই ধারায় রাজ্য/বাষ্ট্র গড়ে উঠে। শুরুতে জ্ঞাতি সমাজ থেকে জ্ঞাতি রাজ্য/বাষ্ট্র। অতঃপর সংলগ্ন কতিপয় জ্ঞাতি রাজ্য/বাষ্ট্রের সমন্বয়ে বৃহত্তর জ্ঞাতি বা উপজাতীয় রাজ্য/বাষ্ট্র গড়ে উঠে। প্রান্তিক ও নিরাপদ এলাকা হওয়ায় বহিরাগত অধিবাসীদের ক্রমাগত বঙ্গাঞ্চলে সমাগম হয়। ক্রমান্বয়ে শংকর জাতিতে রূপান্তরিত হওয়ায় বর্ণ স্বকীয়তা বৈশিষ্ট্য হ্রাস পায় এবং ধর্ম বা/ও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য প্রাধান্যসহ কতিপয় আঞ্চলিক রাজ্য/বাষ্ট্রে পরিনত হয়। একাধিক বার রাজশক্তিতে মোগধ, মৌর্ষ, গুপ্ত, পাল, সামাজ্যভুক্ত এবং সাম্রাজ্যের অবসানে আবার ধর্ম বা অঞ্চল ভিত্তিক ছোট ছোট রাজ্য/বাষ্ট্রে পরিনত হয়।
বিশ্বের বহুদেশের মতো বঙ্গাঞ্চলও বিগত হাজার বছর একইরূপে থাকেনি। সুলতানী আমলে “বঙ্গদেশ” স্বাধীন রাজ্য হিসেব গড়ে উঠে এবং পলিল সাংস্কৃতিক ও ভাষা ভিত্তিক সমৃদ্ধিশীল জাতীয়রাষ্ট্রে রূপ পায়। অতঃপর মোঘল-বৃটিশ সম্রাজ্যভুক্ত হলেও ১মপর্বে সমৃদ্ধিশীল প্রদেশ থাকে। ২য়পর্বে সংলগ্ন অঞ্চল/প্রদেশ যুক্ত করে নুতন বৃহত্তর সুবেবঙ্গ গঠণ করা হলে বঙ্গাঞ্চল ‘অবনতিশীল রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়। অর্ধ-শতাব্দীর মধ্যেই বৃটিশের বাণিজ্য উপনিবেশে পরিনত হয় এবং বাণিজ্যস্বার্থে বৃটিশ-শাসকরা সমৃদ্ধিশীল প্রদেশ হিসেবে গড়ে তুলে। তবে বৃটিশামলের সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রনীতি ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিক্রমায় ১৯৪৭-এ বঙ্গপ্রদেশ বিভক্ত এব পূর্বাঞ্চল পাকিস্তানভুক্ত বাঙালী মুসলমানদের প্রদেশে পরিনত হয়। ৬ দফার গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এবং গণম্যান্ডেট ও গণবিদ্রোহে ১৯৭১-এ বাংলদেশ নামে বাঙালী মুসলমানের জাতীয় বাষ্ট্র/দেশে পরিনত হয়।
১৩৫২, ১৬০৯, ১৭১৭, ১৭৮৪, ১৯১২, ১৯৪৭ ও ১৯৭১-এ সংলগ্ন অঞ্চল/রাজ্যগুলো সমন্বয়, বিভাজন বা পুনর্গঠণের জন্যে বাংলাদেশাঞ্চলের রাষ্ট্রব্যবস্থার রাষ্ট্র-অবকাঠামোর স্বরূপও পরিবর্তন হয়। এতে বাংলাদেশাঞ্চল কখনও সমৃদ্ধিশীল, কখনও বা অবনতিশীল রাষ্ট্রে পরিনত হয়। এটা প্রকৃতি প্রদত্ত/প্রাপ্ত নয়, প্রধানতঃ রাষ্ট্র-অবকাঠামোগত স্বরূপের কারণে উদ্ভুত। ১৯৪৭ উত্তর বিশেষতঃ ১৯৭১ উত্তর রাষ্ট্র-অবকাঠামোগত কারণে বাংলাদেশ ‘অবনতিশীল রাষ্ট্র’-এ পরিনত হয়। ১৯৭১ উত্তর ব্যক্তিস্বার্থে সরকার-প্রধানের গণম্যান্ডেট ও মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার বিরোধী ও প্রজ্ঞাহীন কর্মে পরিস্থিতি চরমে উঠে। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্যে নিবন্ধকারের রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বরূপের নৈপথ্যের কাঠামো-প্রতিষ্ঠানের অনুসন্ধান।
চারিদিকের রাষ্ট্রগুলো থেকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ভিত্তিক জনতান্ত্রিক, জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় বিভাজনোত্তর বাংলাদেশ দীর্ঘতর স্থায়ী হবে। একইসাথে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় একক থেকে প্রদেশ ভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠার অপরিহার্যতাও বাড়বে। ১৯৭১ উত্তর উত্তরাধিকারসুত্রে প্রাপ্ত ও ব্যক্তিস্বার্থে সৃষ্ট পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্যে ১৯৮২ সাল থেকে নিবন্ধকার বাংলাদেশকে ১মপর্বে একটি ‘উচ্চতর সমৃদ্ধিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’-এ রূপান্তর করার জন্যে গণতন্ত্রমুখী পুনঃর্গঠন/সংস্কারগুলোর উদ্যোগ নিয়ে আসছে। ২য়পর্বে গণবিপ্লব ছাড়াই গণভভোটে বাংলাদেশকে একই রাষ্ট্র-অবকাঠামোতে প্রদেশভিত্তিক একটি ‘উচ্চতর সমৃদ্ধিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’-এ রূপান্তর করা যাবে যা কয়েক শতাব্দী ধারাবাহিক হবে। এ নিবন্ধে সেই মূল দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের মৌল-অধিকারসমূহ
সংবিধানের “নাগরিক মৌলিক অধিকার” আইনী ব্যাখ্যার বিষয়। নির্বাহী আদেশ বা আদালতের বিধি/রায় দ্বারা নির্ধারিত হয়। আর্থিক ব্যয়যুক্ত ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায় দৈনিন্দিন গণজীবনে মৌলিক অধিকার ও আচরণের সীমারেখা নির্ধারণের জন্যে নির্বাহী/আদালতের আদেশ/বিধি/রায় নেওয়া সম্ভব নয়। গণজনতার দৈনিন্দিন সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংকৃতিক ও রাজনৈতিক মৌলিক অধিকার ও আচরণ চলে চেতনা, মুল্যবোধ ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে। এগুলো প্রধানতঃ পারিবারিক ও রাষ্ট্র-অবকাঠামো প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রভাবে গড়ে উঠে। এ জন্যে বাস্তবে ‘পারিবারিক প্রতিষ্ঠান’, ‘রাষ্ট্র-অবকাঠামো প্রতিষ্ঠান’ ও ‘সরকারব্যবস্থার প্রতিষ্ঠান’ স্বরূপের সমন্বয়ের উপরই ‘রাষ্ট্রব্যবস্থা’ স্বরূপ মুলতঃ নির্ভর করে।
‘পারিবারিক প্রতিষ্ঠান’, ‘রাষ্ট্র-অবকাঠামো প্রতিষ্ঠান’ ও ‘ সরকারব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানের’ সমন্বয়ের স্বরূপ গণতান্ত্রিক হলে ‘রাষ্ট্রব্যবস্থা গণতান্ত্রিক’ হয়। এ তিনটি প্রতিষ্ঠানই আলাদাভাবে গণতান্ত্রিক হলে রাষ্ট্রব্যবস্থা “উচ্চতর সমৃদ্ধিশীল গণতান্ত্রিক” হয়। স্থিতিশীল গণচেতনার ভিত্তিতে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠা রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রব্যবস্থা সাধাারণতঃ স্থিতিশীল ধারাবাহিক হয়। কিন্তু সকল রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রব্যবস্থা বিবর্তন প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠে না। শাসন-শোষন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ/বিদ্রোহ থেকে বিপ্লবী প্রক্রিয়াতেও অনেক রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রব্যবস্থাও গড়ে উঠে। বিপ্লবোত্তর অস্থিতিশীল চেতনা হ্রাস পায়। তাই ইতিহাসের ধারার স্থিতিশীল চেতনার বদলে অস্থিতিশীল চেতনার ভিত্তিতে প্রণীত সংবিধান বা রাষ্ট্রব্যবস্থার স্থিতিশীল ধারাবাহিকতা দেয় না।
মাধ্যমিকস্তর পর্যন্ত শিক্ষিত বাংলাদেশের ৯০% জনগণ পশ্চিমা মতবাদগুলোর সংস্পর্শে আসে না। তাদের জীবন চলে চলমান বিধান-সংস্কৃতিতে। নয়াবিধান চলমান জীবনের জন্যে বাধা হলে ক্ষোভ/বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং সমৃদ্ধিশীল হলেই অনুসরণ করে। বাংলাদেশের মানুষ হাজার বছর ইসলাম ধর্মের অনুসারী। ‘অবরোহমুখী’ হলেও জীবনদর্শন-বিধান সুষম-গণতন্ত্রমুখী হওয়ায় ইসলাম ধমের্র কোরানিক পারিবারিক-সামাজিক বিধানগুলোর বিরুদ্ধে শত শত বছরে বি্শ্বের কোথাও জনগণের ক্ষোভ/বিক্ষোভ হয়নি। জীবনদর্শনসহ সুষম-গণতন্ত্রমুখী মুসলিম ব্যক্তিক-পারিবারিক-সামাজিক বিধানাবলী বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতির অংশ। এরসাথে অসামঞ্জস্য অথবা পরিপন্থী কিম্বা উন্নতর না হলে নুতন কোন জীবনদর্শন-বিধান বৃহত্তর জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভ সঞ্চার করবেই। রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ধারা থাকবে না।
স্বকীয় বর্ণ-অঞ্চলিক-ধর্ম/মতবাদে গড়ে উঠা স্বকীয় চেতনায় বিভক্ত জনতার সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আচরণগুলোকে নিয়মিক ধারায় আবদ্ধ থাকার জন্যেই সংবিধান। সার্বজনিন সম্-অধিকার সংরক্ষণ এবং নিরুষ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর জীবনাদর্শের পরিপন্থীতে কোন বিধান/আইন প্রণীত নাহলে রাষ্ট্রে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা হবে না। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্যে অপরিহার্য মৌলিক অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠানগুলো হলোঃ ব্যক্তিক-পারিবারিক-সামাজিক বিধানসহ ধর্মপালনের স্বাধীনতার বিধান, ব্যক্তির সম-গণতান্ত্রিক নাগরিক অধিকারের বিধান এবং সুষম-গণতন্ত্রমুখী রাষ্ট্র-অবকাঠামো। ৯০% জনগণ হাজার বছরের মুসলমান হওয়ায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্যে ভিত্তি ও মৌলিক ব্যক্তিক-পারিবারিক-সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বের সেরা গণতান্ত্রিক।
বাংলাদেশের সংবিধানিক সরকারব্যবস্থা
বৃহত্তর রাজ্য্/রাষ্ট্র গড়ে উঠার সাথে সাথে সরকারব্যবস্থা সংসদ (আইন), নির্বাহী ও বিচার প্রক্রিয়া–এ ত্রিধারার স্বকীয় ও সম্পুরক কর্তৃত্বে বিভাজিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার মর্মার্থই হলো, জনগণমুখী সরকারব্যবস্থা যা জনগণ কর্তৃক গঠিত হবে এবং জনগণমুখী থাকবে। বিশ্বে এটা পরীক্ষিত যে, গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা জন্যে অপরিহার্য শর্তগুলো হলো- এক, সংসদ, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের প্রয়োজনীয় পৃথকীকরণ ও সমন্বয়; দুই, নিরপেক্ষমুখী আইন প্রণয়নের জন্যে স্বনিয়ন্ত্রিত দু’স্তরের সংসদব্যবস্থা; তিন, নিরপেক্ষমুখী বিচারব্যবস্থার জন্যে স্বনিয়ন্ত্রিত দু’স্তরের উচ্চতর আদালতব্যবস্থা; চার, গণমুখী রাষ্ট্রপরিচালনার জন্যে সংসদ ও বিচার বিভাগের কাছে নির্বাহী সরকারের জবাবদিহিতা; এবং পাঁচ, স্বল্পমেয়াদী ও কার্যকরী প্রতিনিধ্বিশীল সংসদ ও নির্বাহী সরকার।
গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার ভিত্তিমূলক প্রতিষ্ঠান হলো গণতান্ত্রিক সংসদ। গণতান্ত্রিক সংসদব্যবস্থা ছাড়া নির্বাহী প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক বা রাষ্ট্রপতিকেন্দ্রিক সংসদীয় সরকারের চলনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক হয় না। দু’স্তরের উচ্চতর আদালতব্যবস্থার (সুপ্রীমকোর্ট ও হাইকোর্ট) ও আপীলব্যবস্থার মতো ‘দুইকক্ষ সংসদব্যবস্থা’ ছাড়া আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়াও স্বনিয়ন্ত্রিত ও নিরপেক্ষমুখী হয় না। দলীয় নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে এককক্ষ সংসদ হলে নির্বাহী প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় সংসদ ও নির্বাহী বিভাগ আর পৃথক থাকে না। নির্বাহী রাষ্ট্রপতিকেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির কর্তৃত্বও হ্রাস করে ভারতের মত সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় রূপান্তরিত করা যায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব হ্রাস করা যায় না। তাই যে দল সংসদে যত বেশী আসনে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করবে, সরকারব্যবস্থা তত স্বৈরমুখী হয় এবং উত্তরাত্তর তত ‘স্বৈরমুখীতা’ বাড়তে থাকে শেষে রাষ্ট্রে রাজনৈতিক বিপর্যয় আনে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের অঙ্গীকার হলো, ৬ দফার রাষ্ট্রদর্শন ও গণম্যান্ডেটের আলোকে “সাম্য. মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারসহ গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা”। ‘গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা’র বিষয়ে প্রজ্ঞা কম থাকায় হক-সোরওয়ার্দী ১৯৫৬ সালে এককক্ষ সংসদ ভিত্তিক সংসদীয় সরকারব্যবস্থার সংবিধান করেছিলেন। সোরওয়ার্দীর সতীর্থ ও নিম্নমেধার হওয়ায় স্বৈরমুজিবেরও “গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা’র বিষয়ে প্রজ্ঞা কম ছিল। আইনে বিশেষজ্ঞ হলেও রাষ্ট্রবিশেষজ্ঞ না হওয়ায় মার্ক্সমনা ডঃ কামালেরও ‘গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা’র বিষয়ে প্রজ্ঞা ছিল না। বৃহত্তর বাংলাদেশের আদি সংবিধান দুইকক্ষ সংসদের স্থলে এককক্ষ সংসদ ও নির্বাহী প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক সংসদীয় সরকারব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়। সরকারের স্থিতিশীলতার জন্যে ‘দলীয় নিয়ন্ত্রণ বিধান’ যুক্ত করা হয়। তাই বাংলাদেশের “দলীয় নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে এককক্ষ সংসদ ও প্রধানমন্ত্রী-শাসিত সংসদীয় সরকারব্যবস্থা” হয়ে উঠে জার্মানীর “মহাস্বৈরমুখী হিটলারী সরকারব্যবস্থা”।
দলীয় নিয়ন্ত্রন পদ্ধতিতে এককক্ষ সংসদ ও নির্বাহী প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় ৯৭.৫% আসনে নির্বাচিত হওয়ায় মুজিব-সরকার উত্তরাত্তর ‘স্বৈরমুখী’ হয়। অবশেষে সমাজতন্ত্রের নামে বিনা-নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি, জনতার মৌলিক অধিকার হরণ, একদলীয় স্বৈরতন্ত্র চালু করে স্বৈমুজিব জাতিকে সংঘর্ষিক রাজনীতির গর্তে নিক্ষেপ করে জাতির মহাবিপর্যয় ঘটান। বিনা-নির্বাচনে দখলদার রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ জাতির দায়িত্ব। একদলীয় রাজনৈতিকব্যবস্থা, সমাজতন্ত্র ও বেসরকারী ব্যক্তি বিনা-নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি হলে স্বৈরসরকারের অপসারণে সামরিক অভ্যুত্থান বিশ্বে নুতন কিছু না। অতঃপর ১৫ই আগষ্ঠে ৬ দফার গণতন্ত্রের অনুসারী মুক্তিযোদ্ধা সেনাদের হাতে স্বৈরমুজিব দুঃখজনকভাবে নিহত হন।
একদলীয় রাজনৈতিকব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ার পরে সরকারব্যবস্থার স্বরূপ দাঁড়ায় ‘দলীয় নিয়ন্ত্রন পদ্ধতিতে এককক্ষ সংসদ ও নির্বাহী রাষ্ট্রপতি-শাসিত সংসদীয় সরকারব্যবস্থা’। পৃথকভোটে নির্বাহী রাষ্ট্রপতি হওয়ায় সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের স্বকীয়তা হয়। হ্রাস পেলেও রাষ্ট্রপতির অবাধ কর্তৃত্ব ও দলীয় নিয়ন্ত্রিত এককক্ষ সংসদের জন্যে সরকারব্যবস্থার স্বরূপ ‘স্বৈরমুখীই’ থাকে। “দলীয় নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে এককক্ষ সংসদ ও নির্বাহী প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক সংসদীয় সরকারব্যবস্থা” ১৯৯১ সালে পুনঃপ্রচলিত হলে বাংলাদেশের সরকারব্যবস্থা আবার “হিটলারী স্বৈরমুখী” হয়ে উঠে। ৮ম থেকে ১১শ সংসদে জোটসরকার ৭৫%-এর বেশী আসনে নির্বাচিত হওয়ায় সরকারগুলো উত্তরাত্তর ‘স্বৈরমুখী’ হয়। ১০ম ও ১১শ সংসদ সুষ্ঠ নির্বাচিত না হওয়া এবং সরকারী দল/জোট আরও বেশী আসনে নির্বাচিত হওয়ায় সরকার আরও ‘স্বৈরমুখী’ হয়।
নিবন্ধকারের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় ১৯৭১ উত্তর উত্তরাধিকারসুত্রে প্রাপ্ত স্বৈরমুখী রাষ্ট্র-অবকাঠামো ও প্রতিরক্ষা-কাঠামো গণতন্ত্রমুখী রূপ নেওয়ায় (পরবর্তীতে আলোচিত) এবং উচ্চতর সমৃদ্ধিশীল অর্থনীতি হওয়ায় সংঘর্ষিক রাজনীতিতে নিপাতিত হলেও জাতির এখনও মহাবিপর্যয় ঘটেনি। বিশ্বের অভিজজ্ঞতা নিয়ে চক্রাকারে পরোক্ষভোটে জেলাভিত্তিক দু’জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ভিত্তিক ২য়কক্ষসহ দুইকক্ষ সংসদ ও সংসদীয় সরকারব্যবস্থা, জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের প্রধান নির্বাহী পদে একইব্যক্তির দুই-মেয়াদ বা ৮ বছরের বেশী না থাকার বিধান (স্বৈরব্যক্তি ও সরকারের শিরঃচ্ছেদ) এবং ভারতের মতো রাষ্ট্র নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্তসহ হলে বাংলাদেশের সংসদীয় সরকারব্যবস্থা উচ্চতর গণতান্ত্রিক হবে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র-অবকাঠামোর স্বরূপ
সোনারগাঁকেন্দ্রিক দেশ ও জেলার কেন্দ্রগুলো মোঘলামলে ঢাকাকেন্দ্রিক প্রদেশ ও জেলার কেন্দ্রগুলো স্থান পরি্বর্তন করা হলেও রাষ্ট্র-অবকাঠামো একই থাকে। এজন্যে সুলতানামলে শেষার্দ্ধে ও মুঘোলামলে প্রথমার্দ্ধে ১৭০৩ পর্যন্ত বঙ্গ দেশ/প্রদেশ উচ্চতর সমৃদ্ধিশীল ছিল। ১৭০৩ উত্তর অঞ্চল-জেলা-থানা পূনর্গঠণের জন্য রাষ্ট্র-অবকাঠামো শীথিল হয় এবং সুবেবঙ্গ দ্রুত দরিদ্র প্রদেশে পরিণত হয়। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে গ্রেটবৃটেনের আলোকে বেঙ্গল-প্রেসিডেন্সী/প্রদেশও নুতন জেলা-মহকুমাসহ ৯টি বিভাগ ভিত্তিক পূনর্গঠণের জন্যে রাষ্ট্র-অবকাঠামো উচ্চতর গণতন্ত্রমুখী হয়। এতে উদার, নৈতিক ও সৃজনশীল চেতনার বিকাশের ধারাসহ জনজীবন উচ্চতর সম্মৃদ্ধিশীল এবং সাহিত্যে বিশ্বয়কর উত্তরণে ধারা ছিল। ১৯১২-এ বিভক্তির পরে বঙ্গপ্রদেশ ৫টি বিভাগ ভিত্তিক হওয়ায় প্রাদেশিক রাষ্ট্র-অবকাঠামো নিম্নমাত্রায় গণতন্ত্রমুখী হয়। উদার, নৈতিক ও সৃজনশীল চেতনাসহ জনজীবনের সমৃদ্ধিশীলের ধারাও হ্রাস পায়।
১৯৪৭-এ বঙ্গবিভক্তির পরে ৪টি বিভাগ, ১৮টি জেলা ও গড়ে ৬৮টি মহকুমা ভিত্তিক তথা সকল স্তরে স্বৈরমুখী ভারসাম্য হওয়ায় বাংলাদেশাঞ্চলের রাষ্ট্র-অবকাঠামোর স্বরূপ স্বৈরমুখী রূপ নেয়। ১৯৭১-এর পরে সাবেক পাকিস্তানের কেন্দ্রীয ও প্রাদেশিক-এ দু’স্তরের সরকারব্যবস্থার অবসানের হওয়ার পরে রাষ্ট্র-অবকাঠামোর স্বৈরমুখী প্রভাব বৃদ্ধি পায়। বিকশিত উদার-চেতনা ১৯৪৭ উত্তর স্বল্পমাত্রায় এবং ১৯৭১ উত্তর উচ্চতর মাত্রায় হ্রাসমুখী হয়। এতে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংকট বাড়তে থাকে। এজন্যে স্বাধীনতার পূর্বদশকে অর্থনীতির সমৃদ্ধির গড়হার প্রায় ৪.৪% ছিল। পশ্চিমাদের শোষণ মুক্ত হলেও রাষ্ট্র-অবকাঠামো অপেক্ষাকৃত স্বৈরমুখী ও কম-প্রতিযোগী হওয়ায় স্বাধীনতার উত্তরদশকে অর্থনীতির সমৃদ্ধির হার ১.০% কমে ৩.৪%-এ দাঁড়ায় এবং জনপ্রতি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হার দাড়াঁয় ০.৯%। ১৯৭১ উত্তর আয়গোষ্ঠীর পূনর্গঠণের ব্যয় ২.২%-এর বেশী থাকায় স্বাধীনতোত্তর দারিদ্রতার হার বেশীহারে বাড়তে থাকে।
অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কেবল আর্থিক সম্পদ/পুঁজির উপর নির্ভর করে না। একইসাথে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সম্পদ, পরিস্থিতি ও দক্ষতার প্রবৃদ্ধির উপরও নির্ভর করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা উদার, নৈতিক ও সৃজনশীল আরোহমুখী চেতনাসহ সুষম প্রতিযোগিতার ধারা দেয় যা সর্বক্ষেত্রে সমৃদ্ধির ধারা দেয়। মুসলিম পারিবারিক বিধান-প্রতিষ্ঠান সুষম-গণতান্ত্রিক হওয়ায় ব্যক্তি ও সামাজিক চেতনা এবং জাতীয় সমন্বয়ের ধারা উদারমুখী হয়। এর সাথে বর্ণিক-আঞ্চলিক চেতনা উদারমুখী এবং রাষ্ট্রপরিচালনা গণতান্ত্রিক হলেই ‘রাষ্ট্রিক/নাগরিক চেতনা’ আরও উদার, নৈতিক, সৃজনশীল ও আরোহমুখী হবে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র-অবকাঠামোকে সুষম-গণতন্ত্রমুখী পুনর্গঠণের জন্যে প্রাচীনরোম, গ্রেটবৃটেন, জাপান, দঃকোরিয়াসহ বিশ্বের অভিজ্ঞতায় ১৯৮২ সালে সরকারের কাছে থানাগুলোকে (৪৮৭) মহকুমায় ও মহকুমাগুলোকে (৭১) জেলায় উন্নীত এবং বাংলাদেশকে ৯/১০টি বিভাগে বিভক্ত করার জন্যে নিবন্ধকার প্রস্তাব রাখে। পরবর্তীতে পল্লী/গ্রাম ইউনিয়ন এলাকাকে ৯টি ওয়ার্ডে পুনর্গঠণের প্রস্তাব রাখে (১৯৮৫)। এর উদ্দেশ্য ছিল, রাষ্ট্র-অবকাঠামোকে সুষম-গণতন্ত্রমুখী রূপান্তরিত করে জাতির উদার, নৈতিক ও সৃজনশীল আরোহমুখী চেতনা বিকাশের স্থায়ী ধারা সৃষ্টি করা। এতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাসহ সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আঙ্গীকের সর্বক্ষেত্রে উচ্চমাত্রায় স্থিতিশীল টেকসই সমৃদ্ধির ধারা সৃষ্টি হয়।
প্রস্তাবনামত ৯/১০টি বিভাগে বিভক্ত করা না হলেও ১৯৮২-৮৪ সালে বাংলাদেশকে ৪৬০টি উপজেলা ও ৬৪টি জেলায় পুনর্গঠণের জন্যে অর্থনীতির সমৃদ্ধির গড়হার ৩.৪% থেকে প্রায় ৪.১%-এ উন্নীত হয়। জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি হার ২.৪% থেকে ২.২% এবং আয়গোষ্ঠীর পূনর্গঠণের ব্যয় এর থেকে নীচে হওয়ায় ১৯৮৯ উত্তর দারিদ্রতার হার কমতে শুরু হয়। রাষ্ট্র এলাকার প্রথম বিভক্তি হওয়ায় রাষ্ট্র-আবকাঠামোর ক্ষেত্রে কেন্দ্র-বিভাগের গণতন্ত্রমুখী ভারসাম্যই সবচেয়ে প্রভাবশীল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত ৪৫ বছর বাংলাদেশের রাষ্ট্র-অবকাঠামো ৪টি বিভাগ ভিত্তিক স্বৈরমুখী থাকায় অর্থনীতির সম্মৃদ্ধির গড়হার প্রায় ৪.২% আবদ্ধ ছিল। ৬৪টি জেলা পুনর্গঠণের প্রেক্ষাপটে ৪টি বিভাগ অব্যহত থাকায় রাষ্ট্র-আবকাঠামোর শীথিল বা সন্ত্রাসমুখী হয়ে। এতে বহুমাত্রিক সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সন্ত্রাস ক্রমবর্দ্ধমান হয়।
৬টি বিভাগে বিভক্তি হওয়ায় (১৯৯৫) রাষ্ট্র-অবকাঠামো স্বল্পমাত্রায় গণতন্ত্রমুখী হয় এবং অর্থনীতির সমৃদ্ধির ঠেকসই গড়হার ক্রমশঃ বেড়ে ২০০৪/০৫-এ প্রায় ৬.৩%-এ উন্নীত হয়। রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগ গঠণের (২০১৫) বাংলাদেশ ৮টি বিভাগে বিভক্ত হলে রাষ্ট্র-অবকাঠামো আরও গণতন্ত্রমুখী হয় এবং অর্থনীতির সমৃদ্ধির স্থিতিশীল ক্ষমতার গড়হার ক্রমে প্রায় ৮.৩%-এ উন্নীত হয় (করোনার জন্যে ৮.১%-এ সীমিত হয়)। ১০টি বিভাগে বিভক্তির পরে রাষ্ট্র-অবকাঠামো সর্বোচ্চ সুষম-গণতন্ত্রমুখী হবে। এতে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আঙ্গীকে আরও উদার, নৈতিক ও সৃজনশীল আরোহমুখী চেতনা বিকাশের ধারা সৃষ্টি হবে এবং সকলক্ষেত্রে আরও উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধির ধারাসহ দেবে। অর্থনীতির সমৃদ্ধির ধারা ক্রমশঃ ১.৩% বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৯.৬%-এর উন্নীত হবে। সকল আঙ্গীকের বহুমাত্রিক সন্ত্রাসও অবসান হবে।
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা-কাঠামোর স্বরূপঃ আরেকটি নুতন তত্ত্ব
১৯৭৫ সালে বিনা-নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি সামরিক বিদ্রোহ স্বৈরমুজিবকে অপসারণ এবং একদল ও স্বৈরতন্ত্রের অবসানসহ জনতার মৌলিক অধিকার পুনপ্রতিষ্ঠা করে। অন্যদিকে ১৯৮২ সালের সামরিক অভ্যূত্থান বাংলাদেশকে ৪৬০টি উপজেলা ও ৬৪টি জেলায় পুনর্গঠণের মাধ্যমে রাষ্ট্র-অবকাঠামোসহ রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক বিনির্মানকে ভিত্তি দেয়। তবে স্বৈরমুখী প্রতিরক্ষা-কাঠামো চক্রাবৃত্ত সামরিক অভ্যুত্থানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সংরক্ষণের বদলে আরও ধংশ করে। ১৯৪৭ উত্তর উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া ৪টি বিভাগ ভিত্তিক রাষ্ট্র-অবকাঠামোর স্বরূপ যেমন স্বৈরমুখী ছিল, তেমনি ৪টি আঞ্চলিক ক্যান্টঃভিত্তিক প্রতিরক্ষা-কাঠামোর স্বরূপও স্বৈরমুখী ছিল। ১৯৭৫ উত্তর ৫টি আঞ্চলিক ক্যান্টনমেন্ট ভিত্তিক থাকায় প্রতিরক্ষা-কাঠামো স্বৈরমুখী ছিল এবং ১৯৮১-৮২ সালের সংকটকালে সামরিক অভ্যূত্থানের সহায়ক ছিল। ৯টি আঞ্চলিক ক্যান্টমেন্ট ভিত্তিক হলে প্রতিরক্ষা কাঠামো সুষম-গণতন্ত্রমুখী হয়।
প্রতিরক্ষা-কাঠামোকে গণতান্ত্রিক রূপ দেয়া সহজ বিষয় নয়, তাছাড়া, নিবন্ধকার সরকারও নয়। স্বার্থরক্ষা না হলে, ক্ষমতাসীন সরকার কোন প্রস্তাব বাস্তবায়ন করে না। প্রতিরক্ষা-কাঠামোকে পুনর্গঠণ করা আরও ঝুকির বিষয়। পুনরায় সামরিক আইন হলে ক্ষমতাসীন এরশাদ-সরকার অপসারিত হবে, এটা সবাই জ্ঞাত বিষয়। ১৯৮৮ উত্তর সংকটকালে পুনরায় সামরিক অভ্যূত্থান না হয়, সেজন্যে এরশাদ সরকারকে রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট ক্যান্টমেন্টকে বগুড়া, ঢাকা ও কুমিল্লা থেকে পৃথক ও আঞ্চলিকে রূপান্তরিত করার জন্যে তাগিদ রাখি। নিবন্ধকারের মডেলটি ১৯৮৫ থেকে এরশাদ-সরকার, প্রভাবশীল, খালেদা-হাসিনা নেত্রী, সিরাজ-রবসহ অনেক দলের নেতাদের রয়েছে। এরশাদ-সরকারের স্বার্থরক্ষা হওয়ায় ও আমার প্রচেষ্টায় ৮টি আঞ্চলিক ক্যান্টঃভিত্তিক হওয়ায় প্রতিরক্ষা-কাঠামো গণতন্ত্রমুখী হয় (১৯৯০)। বাংলাাদেশে গণবিক্ষোভ ছাড়া সামরিক অভ্যূত্থান ও শাসন সীমিত হয়।
৯ম সংসদ নির্বাচনকালে (২০০৮) প্রধানমন্ত্রী স্বৈর-হাসিনার ১নং অঙ্গীকার ছিল, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংস্কার, গণতন্ত্র ও কার্যকর সংসদ” প্রতিষ্ঠা করা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা শক্তিশালী ও সমৃদ্ধির আরও উচ্চতর হবে জন্যে গণম্যান্ডেটকৃত অঙ্গীকার ও নির্বাচনোত্তর অঙ্গীকারকৃত কুমিল্লা-ফরিদপুর বিভাগ, সুষমমুখী জাতীয় বেতন স্কেল ও দুইকক্ষ সংসদ তিনি চালু করছেন না। তবে স্বৈরস্বার্থ রক্ষা হওয়ায় স্বৈর-হাসিনা রামুকে অস্থায়ী ৯ম আঞ্চলিক ক্যান্টেঃ উন্নীতসহ বরিশালে স্থায়ী আঞ্চলিক ক্যান্টনমেন্টের ভিত্তি দিয়েছেন। সামরিক অভ্যূত্থান হওয়ার সুযোগ সঙ্কুচিত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী স্বৈর-হাসিনা দেশে লুট-দূর্নীতি-সন্ত্রাস-ধর্ষণ-হত্যা ও বহুমুখী অনৈতিকতা বাড়ানোসহ কুকৌশলে বাবামতো অপ/বিনা-ভোটের ক্ষমতাসীন রয়েছেন। ১৯৮২ থেকে নিবন্ধকারে রূপকল্পে গড়ে উঠা “উচ্চতর সম্মৃদ্ধিশীল বাংলাদেশ”কে বাবা স্বৈরমুজিবের রূপরেখায় তাঁর গড়া বলে মিথ্যাচার ও অপপ্রচার করে জাতিকে বিভ্রান্ত করছেন। অনাচার ও মিথ্যাচার ক্ষণস্থায়ী।
শেষের কথাঃ
সংবিধানে ব্যক্তির গণতান্ত্রিক নাগরিক মৌলিক অধিকারের বিধানগুলো রয়েছে। তবে নিবর্তনমূলক বিধানসহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সংস্কার করতে হবে। বাংলাদেশাঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রসারের সাথে সাথে সুষম-গণতান্ত্রিক পারিবারিক বিধানও আনুপাতিকহারে অনুসারিত। বর্তমানে বাংলাদেশে ৯০% জনগোষ্ঠী মুসলমান হওয়ায় পারিবারিক প্রতিষ্ঠান মূলতঃ সুষম-গণতান্ত্রিক। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম তা সংরক্ষণ করবে। ভৌগলিক গঠণ ও ৬৪টি জেলা পুনর্গঠণের প্রেক্ষাপটে ১০টি বিভাগে বিভক্তি করা হলেই বাংলাদেশের রাষ্ট্র-অবকাঠামোও সুষম-গণতন্ত্রমুখী হবে। এ জন্যে বাকী কুমিলা ও ফরিদপুর গঠন করা জরুরী। বাকী কুমিল্লা ও ফরিদপুর বিভাগ, সুষমমখী জাতীয় বেতন স্কেল, দুইকক্ষ সংসদ, এবং সরকার প্রধানপদে কারও দুইবারের বেশী না হওয়ার ব্যবস্থা চালু হলে ১ম-পর্ব গড়া শেষ হবে। ২য়-পর্বে ১০টি প্রদেশভিত্তিক হলে বাংলাদেশ “কয়েক শতাব্দী” উচ্চতর সমৃদ্ধিশীল গণতান্ত্রিক থাকবে।
বাংলাদেশের মূল-সমস্যা হলো, সাংবিধানিক সরকারব্যবস্থা। প্রতিনিধিত্বশীল হলেও গণতান্ত্রিক নয়, ‘স্বৈরমুখী’ (প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেথা, ১৯৮৫, প্রগতিশীল গণতন্ত্র, ১৯৯১, সংবিধান সংশোধনের দিকগুলো, ২০১০ ও সুপ্রীমকোর্টে পেশকৃত প্রতিবেদন, ২০১১)। তাই যিনি সরকারে ক্ষমতাসীন হন, তিনি দুইকক্ষ সংসদ চালু করে স্বদায়িত্বশীল-জবাবদিহিমুলক গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা চালুর বদলে চলমান সরকারব্যবস্থাটিকে আরও ‘স্বৈরমুখী’ করে তোলেন। ৯ম সংসদ নির্বাচনে গণম্যান্ডেটকৃত ১নং অঙ্গীকার (তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংস্কার, গণতন্ত্র ও কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠা) প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ১২ বছরেও রক্ষা করেননি। বছরে মাত্র ১৯/২০ কোটি টাকা ব্যয়ের অঙ্গীকারকৃত কুমিল্লা ও ফরিদপুর বিভাগ ৭ বছরেও করছেন না। বরং বাবার মতো রাজনীতিকে মিথ্যাচার ও স্বৈরাচারের বিষয়ে পরিণত করছেন।
====================================================
মোহাম্মদ আহ্সানুল করিমঃ
রাষ্ট্র-বিশেষজ্ঞ, মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক বিসিএস কর্মকর্তা। ১৯৮২ থেকে “সম্মৃদ্ধিশীল গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ” গঠনে ভিত্তিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর গণতন্ত্রমুখী পুনর্গঠনের উদ্যোগী এবং প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা (১৯৮৫), প্রগতিশীল গণতন্ত্র (১৯৯১), ও সংবিধান সংশোধনের দিকগুলো (২০১০) নিবন্ধ/বইযের লেখক।