
স্বপ্নের স্বপ্ন! স্বপ্ন! স্বপ্নকে দেখে শ্যামনাথ ভোরে স্বপ্নে , খুব ভোরের স্বপ্নে। ভোরের প্রার্থনার অনেক আগে অনেক ক্ষনধরে। মনে পড়ে তিন দশক আগে স্বপ্নশ্বেতা স্বপ্ন দেখে শ্যামকে লিখতো, আমি ভোরের স্বপ্নে দেখেছি তোমারে, বধূয়ার বেশে এসেছ! বেদনা জারিত নীলকন্ঠ নজরুলের গান, জগন্ময় মিত্রের গাওয়া। শ্যামনাথ শোনে! গেল বসন্তের শুরুতেই বা মাঘের শেষে স্বপ্ন সঙযোগ, চৌত্রিশ বছর পর নির্বাক আলাপনে অনেক কথা হয়! তিন বার কথা হয় বেশ কিছু দিন ধরে, আবার তিন বারই বন্ধ হয়ে যায়। কিছু দিন আগে স্বপ্নের মায়ের মৃত্যুতে ক্রন্দনরতা স্বপ্নকে দেখা।
শ্যামনাথ স্ত্রী শ্যামার দাদার মেয়ের বিয়েতে রাজধানীতে ছিল অনেক দিনই, ছাব্বিশে ডিসেম্বর হতে ছাব্বিশে জানুয়ারী। আপতিত কিছু অসুখে আর প্রচণ্ড ব্যাকপেইন, শেষে আকুপাংচার আর সিআরপির ফিজিওথেরাপি। অনেকটাই লাঘব হয় ব্যথা। এইতো আর কদিন বাদেই বিদায় দেবে ঊনষাট কে। প্রায় সম্পূর্ণ অকপট আর অসঙবহ ব্যাধ শ্যাম প্রায় সারাটি জীবনই নিজের স্বাধীন স্বত্ত্বার সাহসী নির্দেশই মেনে চলেছে। আর মনে হয় না ঐভাবে এগুতে পারবে! সঙশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের ঐ একই উপদেশ, ইউ হ্যাভ টু চেঞ্জ লাইফস্টাইল।
স্ত্রীর প্রাণান্ত প্রয়াস আর তার দিদি সরলা, জামাইবাবু শৈলেনের মনোনিবিষ্ট সহযোগিতা, সহমর্মিতায় মাসাধিক কালের পরিচর্যা। এ এক অপরিশোধযোগ্য দায়! স্বপ্নে দেখা স্বপ্ন যেন পঁয়ত্রিশ বছর আগের স্বপ্ন হয়েই আসে স্বপ্নে, স্বপ্নের তো অস্পস্টতা থাকেই, কিন্তু এ যেন ঠিক সত্যের কাছাকাছি! এমনও কি হয়? এক ঝোড়ো স্বপ্ন হাওয়ায় শ্যামনাথের জীবনের গতি , বাঁক পাল্টে ফেলা অনিন্দ্য সুন্দরী স্বপ্নের হঠাৎ আপতিত অন্ধকারে, ভ্রান্ত অবিশ্বাসে নিজেকে একশত আশি ডিগ্রী কোনে পরিভ্রমণ। দিক বাঁক প্রায় সব হারিয়ে যায়, অবশিষ্ট ছিল শুধু মাত্র বাবা মায়ের নিবিড়, নিবিষ্ট মরমীয়া আশীর্বান। একা এবং একা একাই শ্যামনাথ মরণপন প্রয়াস সবই ব্যর্থ, বিশ্লিষ্ট। পারিবারিক কিছু কারিগরী জটিলতায় পরিবারকে সঙশ্লিষ্ট করতে পারে না চুড়ান্ত বর্ষের প্রকৌশল ছাত্র! ভিসুভিয়াসের অনির্বাণ অনলে নিয়ত জারিত হয় শ্যামনাথের সার্বিক সত্ত্বার সমস্ত আধার। স্বপ্নে দেখা স্বপ্ন— শ্যামনাথ ,শ্যামা আর গ্রহন যেন ভারতের বেশ কয়েকটা জায়গায় বেড়াতে যাচ্ছে ( যদিও শ্যামনাথ পুর্ব ও পশ্চিম এশিয়া এবং ইউরোপের বেশ কয়েকটা দেশে গেছে) এই প্রথম বারের মত, বাড়ীর পাশে। কোন এক এয়ার পোর্টের ট্রানজিট বা কোন ট্রানজিট সেন্টারে নির্দিষ্টকালীন অবসর। শ্যাম উপরতলার স্মোকিঙ জোন থেকে বেরিয়ে ঘুরছে আনমনে।
হঠাৎ শাড়ী পরিহিতা এক সুন্দরীতমা বাঙালি নারী! চিনে যায় শ্যাম আর স্বপ্ন মুখোমুখি! নির্বাক, নিস্তব্ধ দুই জনেই! ঠিক যেন পঁয়ত্রিশ বছর আগের স্বপ্ন! শ্যাম ভাবে স্বপ্ন না সত্যি? না, এতো সেই স্বপ্ন যে দেখা করা বা দুজন বেড়াতে যাওয়ার জন্য গেলে কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটি ছন্দবদ্ধ পায়ে পায়ে মাধুকরী হাসির চ্ছটায় মনোদৈহিক মুগ্ধতায় মৃম্ময়ী সুরের মূর্ছনায় আলী আকবর খাঁ’র সরোদের মত, বিসমিল্লাহ খাঁ’র সানাইয়ের মত আর আল্লারাখা খা’র তবলার মত ত্রিতরঙ্গের অনিন্দ্য সুর তুলে একেবারে ছোট আদরের দুরত্বে চলে আসতো; মোহনীয় দুষ্ট হাসিতে বলতো, “কি?”! প্রেমের পারিজাত কুসুমের কায়িক মন্ত্রমুগ্ধতায় শ্যাম কয়েক মূহুর্ত দুচোখ বন্ধ করে ফেলতো আর স্বপ্ন এদিক ওদিক দেখে শ্যামের দুচোখে চুমু দিয়ে মুগ্ধতার অবসন্নতার অবসান ঘটিয়ে, দুহাতে বাম হাত জড়িয়ে বেড়িয়ে যেতো দুজনে নিরুদ্দিষ্ট কোন খানে মফস্বল শহরের কত কত জায়গায় বা বন্ধুদের বাড়িতে বাড়িতে। স্বপ্নের স্বপ্ন কি সেই একই স্বপ্ন?!!!
শ্যামনাথ দুহাত বাড়িয়ে দেয়, স্বপ্ন অক্লেষে,অশ্লেষে ধরা দেয়। শ্যামনাথ স্বপ্নকে জড়িয়ে সিড়ি বেয়ে নীচে নামতে থাকে, যেখানে শ্যামা আর গ্রহন বসে আছে। আসলে শ্যামা = ( স্বপ্ন+ স্বপ্নশ্বেতা+ নীলঝুরি স্বপ্ন)/তিন !!! শ্যামা হয়তো চিনে যায় কিম্বা না! এই স্বপ্নের কথা শ্যামা বিয়ের পর জানে বা কোন সুত্রে জেনে যায় এবং চির অকপট শ্যামনাথ অবলীলায় অকপটে বলে। শ্যামাও যেন তার চির অকপট ভূবনমোহিনী হাসিতে বরণ করে নেয় স্বপ্নকে, চিরপরিচিত সখীর মতোই। কত কথা দুজনের হাসির প্রাণোচ্ছল প্রদীপ্ততায় উচ্ছসিত যেন দশদিক। নির্বাক নিস্তব্ধ শ্যামনাথ দুই প্রতিলিপ্ত সখার অনেক, অনেক অনেক ছবি তোলায় ব্যস্ত থাকে! এভাবেই দুই সখীর প্রমত্ব হাঁসি আর আনন্দের রশ্মি দিকহীন দিকে আলো ছড়ায়। শেষে শ্যামা স্বপ্নের গন্তব্যে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে দেয় আর শ্যামকে বলে, তুমি এগিয়ে দিয়ে আসো, গ্রহন একা বসে আছে যে। শ্যাম জানে না স্বপ্নের গন্তব্য, কিছু দুর এগিয়ে দিতেই স্বপ্ন সাড়েতিন দশক আগের মধুময় হাসিতে শ্যামের সর্বায়বে প্রণয়ের পারিজাত কুসুম রেণু ছড়িয়ে হারিয়ে যায় স্বপ্নেই!
মাহবুবুল হক গামা , কথা সাহিত্যিক এবং কবি ।