
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দাবী যে, তাদের দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক ভাষণের প্রেরণায় বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে। যদিও ৭ই মার্চের ভাষণের মূলবিষয় ছিল ৪ দফা দাবী এবং দাবী না-মানা পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন। সম্প্রতি ইউনেস্কোর “বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য”-এ ৭ই মার্চের ভাষণটি অন্তর্ভুক্তির জন্যে এটাকে আরও বড় করে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দাবী করে যে, পাক-সেনা সরকার বর্বর আঘাত হানার প্রেক্ষিতে তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা-নেতা জাতীয়বন্ধু জিয়াউর রহমনের ২৬-২৭শের মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণায় বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে।
আর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) দাবী করে যে, ৬ দফা আন্দোলনের নেপথ্যে তাদের নেতা সিরাজুল আলম খানের নের্তৃত্বের গোপন সংগঠন নিউক্লিযার্সের জয়বাংলা স্লোগান, পতাকা, জাতীয়-সংগীত ইত্যাদিসহ স্বাধীনতার রূপকল্প ও উদ্যোগের জন্যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে। বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী দল/জোটভুক্ত সরকারের মন্ত্রী হওয়ায় জনবন্ধু মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর পক্ষে সজোরে দাবী করার মতো সংগঠিত দল ও নেতারা আর নেই। আর “বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা’ (১৯৪১-৪২) এবং ৬ দফা বাষ্ট্রদর্শণের রূপকার পাবনার মোহম্মদ ইসরাইল হোসেন নিজেকে ১৯৪৪ উত্তর রাজনীতিক দলের সাথ থাকেননি এবং নুতনপ্রজন্মের কাছে প্রকাশ করেনি।
ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারত-পাকিস্তান, আলজেরিয়া-ইন্দোনেশিয়য়া বা অন্যান্য দেশের মতো কোন পরিকল্পিত ও দীর্ঘ স্বাধীনতার আন্দোলনে বাংলাদেশ হয়নি। ৬ দফা আন্দোলন, গণম্যান্ডেট, ৭ই মার্চের ভাষণ ও ৪ দফা দাবীতে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে পাক-সেনা সরকার বর্বর আঘাত হানে। অতঃপর গণবিদ্রোহ ও নাগরিক স্বাধীনতার স্লোগান/ঘোষণাসহ প্রতিরোধ এবং জনপ্রতিনিধিগণের জাতীয় স্বাধীনতার ঘোষণা, সরকার গঠণ ও মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭১-এ বাংলাদেশ হয়। তাই যার যার অবস্থান, ভুমিকা ও স্বার্থ থেকে এসব দাবীগুলো করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ, জাসদ ও বিএনপির দাবীগুলো চুড়ান্ত পর্যাযে প্রভাবশীল ঘটনা। তবে নেপথ্যের ইতিহাসে আরও প্রভাবশীল কাহিনী ও ভিত্তি রয়েছে।
১৯৭১-এ উদ্ভুত বাংলাদেশ এক প্রজন্মকাল আগে বাংলাদেশাঞ্চল প্রদেশটি পাকিস্তানভুক্ত পূর্ব বঙ্গ/পাকিস্তান প্রদেশ হিসেবে ১৯৪৭-এ উদ্ভুত হয়। ১৯৪৭-এর আগে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশাঞ্চল কোন প্রদেশ বা দেশ হিসেবে ছিল না। পাকিস্তানভুক্ত বাংলাদেশাঞ্চল একটি প্রদেশ হওয়ায় ১৯৪৭-এ বাংলাদেশের নিজস্ব সীমানা ও জনতা হয়েছে (সংবিধানের ২নং বিধান)। প্রদেশ থেকে দেশ হওয়ায় ১৯৭১-এ বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের নিজস্ব পতাকা ও পৃথক অস্তিত্ব হয়েছে। ১৯৪৭-এ উদ্ভুত পাকিস্তানভুক্ত বাংলাদেশাঞ্চল প্রদেশ হওয়া এবং ১৯৭১-এ বাংলাদেশ হওয়ার মধ্যে কোনটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, তা ভিন্ন বিতর্কের বিষয় এবং এ নিবন্ধের তা আলোচনার বিষয় নয়।
মধ্যযুগে সুলতানী শাসনামলে “বঙ্গদেশ” নামে ১৩৪২ সালে প্রথম স্থিতিশীল বঙ্গীয়-জাতিরাষ্ট্র গড়ে উঠে এবং গঙ্গা-বক্ষপুত্র-মেঘনা নদীবাহিত পালিমাটির সংলগ্ন সাংস্কৃতিক ও সম্প্রসারিত বঙ্গভাষী সমতল অঞ্চলসমূহে নিয়ে সোনারগাঁও রাজধানীকেন্দ্রিক ক্রমে বৃহত্তর বঙ্গদেশ সংযুক্তরাষ্ট্র হিসেবে রূপ নেয়। সুলতানী আমলের (১৩৪২-১৫৩৮) অবসান হলে কিছুকাল ১২/১৩টি অঞ্চলগুলো ছোটরাষ্ট্রে পরিনত হয়। অতঃপর বঙ্গপ্রদেশ হিসেবে দিল্লী রাজধানীকেন্দ্রিক মূঘোল-ভারত সম্রাজ্যে অন্তর্ভক্ত হয় (১৫৭৬)। ১৭০৩ সালে প্রথমে বিহার, উড়িষ্যা ও বঙ্গ প্রদেশগুলোর সমন্বিত মুর্শিদাবাদকেন্দ্রিক রাজস্ব বিভাগ এবং পরে মুর্শিদাবাদ রাজধানীকেন্দ্রিক গঠিত বৃহত্তর প্রদেশ বা সুবে-বাংলার অংশ হয় (১৭১৭-১৯০৫)। ভূমির মালিকানা ও নিজস্ববোধের চেতনা না থাকায় দশ প্রজন্মে (১৭১৭-১৯৪৭) নিজস্ব জাতীয় দেশ/রাষ্ট্রের চেতনাও লোপ পায়।
বাংলাদেশের উ্ভুদয়ের আদি বিষয়সমূহ
নবাব মুর্শিদকুলী খানের উত্তরাধিকারীদের শাসন অবসান হলে মুঘোল সম্রাটের থেকে বৃটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সুবে-বঙ্গ প্রদেশের প্রথমে রাজস্ব আদায়ের ভার এবং পরে শাসনভার কারায়ত্ব করে (১৭৭২)। সুবে-বঙ্গের নুতন নামকরণ করো হয় বেঙ্গল-প্রেসিডেন্সী প্রদেশ। তখন বেঙ্গল-প্রেসিডেন্সী প্রদেশে প্রায় ৭৫% ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের ও ২৫% ভাগ মুসলমান সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর বসবাস। মুসলমান বিদ্বেষী ছাড়াও সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে বাড়তি আনুকূল্যের জন্যে বৃটিশ শাসকরা নিরুষ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ও মুসলমান বিদ্বেষী হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষে রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে। রাজস্ব, শাসন ও বিচার বিভাগ থেকে মুসলমান জনগোষ্ঠী ক্রমশঃ হ্রাস পায়। প্রশাসনিক এলাকা পুনর্গঠণোত্তর (১৭৮৪-৮৮) একই রাষ্ট্রনীতিতে সামন্ত আদলে চিরস্থায়ী ব্যক্তিমালিকানায় ভূমিব্যবস্থা চালু করা হলে (১৭৯৩) বঙ্গাঞ্চলে নিরুষ্কুশ মুসলমান বাঙালী জনগোষ্ঠী ক্রমে নিম্ন-মধ্য ও নিম্ন আয়গোষ্ঠীতে আবদ্ধ হয়। ব্রটিশ শাসনামলের গোড়াতেই এ ঔপনিবেসিক, সাম্প্রদায়িক ও সামন্তবাদী রাষ্ট্রনীতিতে শাসিত-শোষিত-নিষ্পেষিত প্রজা-জীবনের বঞ্চনাই হলো স্বাধীন বাংলাদেশের উ্ভুদয়ের প্রথম ভিত্তি।
বাংলাদেশাঞ্চলের জনগণ বৃটিশামলে প্রায় সাত প্রজন্মকাল ঔপনিবেসিক, সাম্প্রদায়িক ও সামন্তবাদী রাষ্ট্রনীতিতে শাসিত-শোষিত-নিষ্পেষিত প্রজা-জীবন এবং প্রধানতঃ নিন্ম ও নিন্মমধ্যবিত্ত জীবনধারায় আবদ্ধ ছিল। স্বাভাবতঃই সুলতানী-মুঘোল আমলে হিন্দু-সম্প্রদায়ের অবস্থা থেকে বৃটিশামলে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রনীতিতে মুসলমান সম্প্রদায়ের বঞ্চনা অনেক বেশী বাড়ে। এতে স্বভাবতঃই বৃটিশের সহযোগী হিন্দু-সম্প্রদায়ের সাথে মুসলমান-সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বিভাজন বাড়তে থাকে। নিরুষ্কুশ সাংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত কেন্দ্র-বিভাগ-জেলার নগর-শহরগুলোতে সীমিত ভোট ও প্রতিনিধি নিয়ে স্থানীয় সরকার পরিষদগুলো চালু হলে তা সম্প্রদায়িক প্রতিযোীতা ও বিদ্বেষ সৃষ্ঠি করেনি। তবে বঙ্গভুক্ত গ্রামাঞ্চলে প্রায় ৬০% মৃসলমান জনতা হওয়ায় প্রতিনিধিত্বশীল ইউনিয়বোর্ড, লোকালবোর্ড ও জেলাবোর্ড গঠিত হলে, বিশেষতঃ ১৯০৯ সালে দুই-তৃতীয়াংশ প্রতিনিধিত্বশীলের গণতান্ত্রিক বিধান হলে হিন্দু ও মুসলমান সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনা ও বিভাজন বাড়তে থাকে। গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাগুলো হলো স্বাধীন বাংলাদেশের উ্ভুদয়ের দ্বিতীয় ভিত্তি।
বর্ধিত বেঙ্গল-প্রেসিডেন্সী থেকে সীমান্ত, পাঞ্চাব, উত্তর-মধ্য প্রদেশগুলো আলাদা করা হলেও মূল বেঙ্গল-প্রেসিডেন্সী অন্যান্য প্রদেশ থেকে বৃহত্তর থাকে। ১৮৯০ দশকে বেঙ্গল-প্রেসিডেন্সী প্রদেশে যুগান্তর, অনুশীলন, ইত্যাদি একাধিক সন্ত্রাসবাদী স্বদেশী আন্দোলনের দলের উত্থান হয়। নিয়ন্ত্রণের জন্যে বৃটিশ-সরকার ১৯০৫ সালে সাম্প্রদায়িক-নীতিতে বেঙ্গল-প্রেসিডেন্সীকে বিভক্ত করে। বিভক্ত পূর্ববঙ্গাঞ্চলের সাথে আসাম-অঞ্চল যুক্ত করে নুতন “পূর্ববঙ্গ-আসাম” প্রদেশ গঠন করে। বিভক্ত ও সংখ্যগড়িষ্ঠতার কারণে “পূর্ববঙ্গ-আসাম” প্রদেশ গঠন মুসলামান বাঙালীর স্বার্থের অনুকূলে যায়। বিভক্ত পশ্চিম-বঙ্গাঞ্চলের অগ্রসর হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বার্থ ক্ষুন্ন হলে কংগ্রেস, যুগান্তর, অনুশীলনসহ রাজধানী কোলকাতাকেন্দ্রিক অগ্রসর হিন্দু-সম্প্রদায় এ বিভক্তির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে। মুসলামান বাঙালীর স্বার্থরক্ষার জন্যে ঢাকা রাজধানীকেন্দ্রিক ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গড়ে উঠে এবং সারা ভারতে বিস্তৃত হয়। মুসলিম লীগের নের্তৃত্বে ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশাঞ্চল এবং এ দলের বাংলাদেশাঞ্চলের জাতীয়তাবাদী একাংশ আওয়ামী (মুসলিম) লীগের নের্তৃত্বে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ হয়। বেঙ্গল-বিভক্তি ও ঢাকাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগ গড়ে উঠা হলো স্বাধীন বাংলাদেশের উ্ভুদয়ের তৃতীয় ভিত্তি।
বেঙ্গল-প্রেসিডেন্সীকে পূনঃবিভক্তির পরের বিষয়সমূহঃ
কংগ্রেস, যুগান্তর, অনুশীলনসহ বৃটিশ-ভারতের রাজধানী কোলকাতাকেন্দ্রিক অগ্রসর হিন্দু সম্প্রদায়ের আন্দোলনের চাপে বৃটিশ সরকার নতি স্বীকার করে। ১৯০৫ সালের দ্বি-বিভক্ত প্রদেশ ১৯১১ সালে আবার একক বেঙ্গল-প্রেসিডেন্সী প্রদেশ পূনঃগঠণ করা হয়। অতঃপর ১৯১২ সালে কোলকাতা থেকে বৃটিশ-ভারতের রাজধানী দিল্লীতে স্থানান্তর এবং আঞ্চলিক সাংস্কৃতির ভিত্তিতে বেঙ্গল-প্রেসিডেন্সীকে আবার বিহার-উড়িষ্যা, আসাম ও বঙ্গ প্রদেশ নামে ত ত্রি-বিভক্ত করা হয়। বিহার-উড়িষ্যা ও আসাম-অঞ্চলকে আলাদা প্রদেশ গঠণ এবং রাজধানী কোলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তর হওয়ায় এ নয়া প্রদক্ষেপের বিরুদ্ধে কোলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু বাঙালীদের আন্দোলন আর জোরদার হয়নি। অতঃপর বঙ্গপ্রদেশে হিন্দু ও মৃসলমান বাঙালীর জনসংখ্যার অনুপাত দাঁড়ায় প্রায় ৪৪% ও ৫৬%। জনসংখ্যার এ নয়া ভারসাম্য প্রতিনিধিত্বশীল স্থানীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও দ্বন্দ্বকে বাড়ন্তমুখী করে যা স্বাধীন বাংলাদেশের উ্ভুদয়ের চতুর্থ ভিত্তি।
নিরুষ্কুশ অংশীদারীত্ব হওয়ায় বঙ্গাঞ্চলে সামন্ত ভূমিব্যবস্থাসহ প্রাদেশিক প্রশাসনব্যবস্থায় হিন্দু-বাঙালীদের আধিপত্য নিরুষ্কুশ ছিল। ১৯০৯ সালে ইউনিয়বোর্ড, লোকালবোর্ড ও জেলাবোর্ড়ের প্রতিনিধিত্ব দুই-তৃতীয়াংশ বিধান করায় ১৯১২ উত্তর স্থানীয় নির্বাচনগুলোকে কেন্দ্র করে এবং নির্বাচনোত্তর স্থানীয় সরকারে মুসলমান বাঙালী প্রতিনিধিরা নিরুষ্কুশ হওয়ায় সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব আরো বাড়তে থাকে। হিন্দু-মুসলমান ও অন্যান্য কোটাব্যবস্থা করেও বর্ধমান সাম্প্রদায়িক চেতনা ও দ্বন্দ্ব হ্রাস করা যায়নি। ১৯১৯ সলের বিশেষতঃ ১৯৩৫ সালের অধিকতর গণতান্ত্রিক “প্রাদেশিক সরকার” আইন/ব্যবস্থা চালু এবং সরকার গঠনে মুসলমান বাঙালীদের স্থায়ীব্যবস্থা হলে চলমান সাম্প্রদায়িক চেতনা, দ্বন্দ্ব ও বিভাজন দ্রুত বর্ধমান দাঙায় রূপান্তরিত হয়। ১৯৩৫ সালের “গণতান্ত্রিক” প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা হলো স্বাধীন বাংলাদেশের উ্ভুদয়ের পঞ্চম ভিত্তি।
দ্রুত বর্ধমান সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও দাঙায় বৃটিশ-ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিরাপত্তা, অধিকার ও দাঙা হ্রাসে মুসলিম লীগ ১৯২৯ সালের প্রস্তাবনাকে সংশোধনপূর্বক “একটি” বদলে “লাহোর প্রস্তাবণা”র (১৯৪০) মাধ্যমে দুই বা অধিক পৃথক একক/যুক্তারাষ্ট্র গঠণের সংশোধনী প্রস্তাব দেয়। লাহোর প্রস্তাবনা ভিত্তিক আন্দোলন ও গণম্যান্ডেটের ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭-এ পাকিস্তানভুক্ত বাংলাদেশাঞ্চলের ঊদ্ভুদয় হয়। ১৯৪৭-এ বঙ্গপ্রদেশ বিভক্তিতে ক্ষুদ্রতর প্রদেশ হলেও ঐতিহাসিক বিজয়গুলো হলোঃ ১) বৃটিশ ঔপনিবেসিক শাসন ও সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রনীতি-রাজনীতির অবসান; ২) সামন্তব্যবস্থার অবসান ও প্রজাজীবনের মুক্তি; ৩) গণতান্ত্রিক ভূমিসংস্কার ও গণতান্ত্রিক জীবনধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠা; এবং ৪) স্বকীয় জাতিসত্ত্বাসহ বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ের ভিত্তি। ১৯৪৭ সালে বঙ্গ-প্রদেশ বিভাজন হলো স্বাধীন বাংলাদেশের উ্ভুদয়ের যষ্ঠ ভিত্তি।
১৯৪৭ উত্তর স্বাধীন বাংলাদেশাঞ্চলের স্বকীয় বিষয়সুমহঃ
বর্ণ, অঞ্চলিক ও ধর্মিক/মতবাদিক বৈশিষ্ট্য ও চেতনা প্রত্যেক ব্যক্তিরই সমন্বিত ও সহজাত এবং এর ভিত্তিতেই প্রধানতঃ জাতীয় ও আন্তর্জাতীয় ঐক্য-অনৈক্য গড়ে উঠে। বৃটিশ-ভারতের সকল প্রদেশে বর্ণ-অঞ্চলিক স্বকীয়তা ছিল। সিন্ধু প্রদেশ ছাড়া পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের ৩টি প্রদেশে বৃটিশদের ঔপনিবেসিক, সাম্প্রদায়িক ও সামন্তবাদী রাষ্ট্রনীতির শাসন-শোষণ-নির্যাতনের বঞ্চনা ও পশ্চাৎপরাতা ছিল না। বরং সুবিধাপ্রাপ্ত থাকায় অগ্রসর ছিল। বঙ্গপ্রদেশের মতো বৃটিশ-পাঞ্চাব প্রদেশেও গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতিযোগীয় সাম্প্রদায়িক চেতনা-দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ বাড়ে।
সাত প্রজন্মকাল ঔপনিবেসিক, সাম্প্রদায়িক ও সামন্তবাদী রাষ্ট্রনীতির শাসন-শোষণ-নির্যাতনের বঞ্চনা ও পশ্চাৎপরাতায় ভোটের রাজনীতিতে বাড়তি সাম্প্রদায়িক চেতনা-দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষের উন্মেষ হয়। ফলে ধর্মীয় ও বাড়তি সাম্প্রদায়িক রাজনীতিক চেতনায় হাজার বছরের ব্যবধানে বর্ণ-অঞ্চলিকে স্বকীয় অঞ্চলগুলোর সমন্বয়ে লাহোর প্রস্তাবে ১৯৪৭-এ একত্রীভুত পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। হিন্দু ও মুসলমান বাঙালীরা আলাদা রাষ্ট্রভুক্ত হওয়ায় ১৯৪৭ উত্তর বাংলাদেশাঞ্চল প্রদেশে সাম্প্রদায়িক চেতনা দ্রুত হ্রাস পায়। কাশ্মীর সংকটের জন্যে পশ্চিমাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক চেতনা কম হ্রাস পায়। সাম্প্রদায়িক চেতনা হ্রাসে বর্ণ-অঞ্চলিক জাতিগত স্বকীয়তা ও চেতনা বাড়তে থাকে।
পাকিস্তানের ঐক্যের জন্যে তাই জাতিরনেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে “একমাত্র” রাষ্ট্রভাষা করার প্রত্যয় জানান। উভয়াঞ্চলের উচ্চ-উচ্চমধ্য গোষ্ঠীর মধ্যে কম-বেশী উর্দূভাষাও প্রচলিত ছিল। পশ্চিমাঞ্চলের নিজস্ব ভাষার বর্ণমালাসহ শব্দমালার সাথে উর্দূভাষা প্রায় ৯০% মিল ছিল। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রনীতির জন্যে ১৯৪৭ উত্তর বাংলাদেশাঞ্চলে স্বাভাবিক ১২.৫% বিপরীতে মুসলিম বাঙালী জনগোষ্ঠীর উচ্চ-উচ্চমধ্য গোষ্ঠীর জনসংখ্যার মাত্র ২.৫% ছিল। তাছাড়া, উর্দূভাষার সাথে বাংলাভাষার বর্ণমালায় ১০০% অমিলসহ শব্দমালায় ৫০%-এর উপরে। স্বভাবতঃ জাতিরনেতার প্রত্যয়ে সাথে সাথে প্রতিবাদসহ বাংলাভাষাও রাষ্ট্রভাষা দাবী হয়। প্রজ্ঞাবান হওয়ায তিনি আর “উর্দু”কে রাষ্ট্রভাষা করার প্রত্যয় জানাননি। “উর্দু”র সাথে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষাদাবী আন্দোলন হলো স্বাধীন বাংলাদেশের উ্ভুদয়ের সপ্তম ভিত্তি।
বাংলাদেশাঞ্চলের মুসলিম জাতীয়তা বোধের প্রাধান্যের অন্যতম বড় কারণ ছিল বৃটিশের সাম্প্রদায়িক ভুমিনীতি। সুলতানী ও তাঁর পূর্বামলে ভুমি-বন্দোবস্তের নির্ভরযোগ্য চিত্র পাওয়া যায় না এবং প্রাচীন ভারতের মতোই সর্বত্র এরূপ ছিলনা বলে অনুমিত হয়। তবে মুঘোল আমলে ভুমির ব্যক্তি-মালিকানা ছিল না। ভারত-সম্রাটের একমাত্র মালিকানা ও ইজারাব্যবস্থায় প্রজন্মান্তর নিজধর্মের উত্তরাধিকার বিধানের প্রাধান্য থাকায় প্রজাদের রায়তসত্ত্ব আধা-ব্যক্তিমালিকার মতো ছিল। শহর-গ্রামীন আর্থ-সামাজিক প্রশাসনকে অধিকতর কার্যকরী করার জন্যে বিভাগ-জেলা-পরগনা(থানা) পূনগঠনসহ (১৭৮৪-৮৮) বৃটেনে প্রচলিত সামন্ত আদলে ভুমির চিরস্থায়ী ব্যক্তিমালিকনা ১৭৯৩ সালে চালু করা হয়।
ভুমি ব্যবস্থাপনায় চিরস্থায়ী ব্যক্তিমালিকনা চালু হলো বঙ্গাঞ্চলে ঐতিহাসিক সংস্কার। এতে ভূমি-মালিকরা বেঙ্গল-প্রেসিডেন্সীর প্রকৃত মালিক এবং বৃটিশরা বিদেশী-ঔপনিবেসিক শাসকে পরিনত হয়। তবে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রনীতিতে আসামভুক্ত সিলেট জেলা বাদে বঙ্গাঞ্চলের প্রায ৪৪% হিন্দু জনগোষ্ঠীর প্রায় ৯৩% মালিকনা থাকায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে অগ্রসর জাতি/জনগোষ্ঠীতে পরিনত হয়। আর ৫৬% মুসলমান জনগোষ্ঠী মাত্র ৭.০% মালিকনা ছিল। ফলে বাংলাদেশাঞ্চলের মুসলমান জনগোষ্ঠী নিজভূমিতে ‘পরবাসী’ ছিল। এতে বর্ণ-আঞ্চলিক চেতনার তুলনায় ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী চেতনা বেশী শক্তিশালী ছিল। অন্যদিকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ জাতি/জনগোষ্ঠীতে পরিনত হয়।
১৯৪৭-এর বঙ্গ-বিভাজন ও স্বাধীনতা এবং ১৯৫০-এ গণতান্ত্রিক ভুমি-সংস্কারের পরে বাংলাদেশাঞ্চলের ‘প্রজারা’ ভুমির মালিকানাসহ স্বাধীন ‘জনতায়’ রূপান্তরিত হয়। এ ভুমি-সংস্কার হলো মুসলমান বাঙালীদের জন্যে “ঐতিহাসিক গণতান্ত্রিক বিপ্লব”। ভূমির ব্যক্তিমালিকানায় বাংলাদেশাঞ্চলের জনগণের আঞ্চলিক জাতিসত্ত্বা ও অধিকার রক্ষার ভিত মজবুদ হতে থাকে। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৫২ সালে ‘মাতৃভাষা গণ-অভ্যূত্থানে’-এ। ৫ জন শহীদ হবার খবর হলে দ্রুত দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে ভাষা-আন্দোলন গণম্যান্ডেটে পরিনত হয়। গণতান্ত্রিক ভুমি-সংস্কার ও সুষম-গণতান্ত্রিক মুসলিম পারিবারিক বিধানের সমন্বয়ে আঞ্চলিক জাতিসত্ত্বার বিকাশের ধারা বৃদ্ধি পায়।
গণতান্ত্রিক ভুমি-সংস্কার ও পারিবারিক বিধানের জন্যে পশ্চাৎপদ জাতি/জনগোষ্ঠীতে থেকে অগ্রসরতা শুরু হয়। আঞ্চলিক জাতিসত্ত্বার বিকাশমান হলে জনতা ‘মুসলমান বাঙালী’ থেকে নিজেকে ‘বাঙালী মুসলমান’ জাতি হিসেবে সনাক্ত করে। ১৯৪৯-এর ‘আওয়ামী মুসলিম লীগের’ নাম ১৯৫৩-এ ‘আওয়ামী লীগে’ সংশোধন/পরিবর্তন হওয়াও তারই বহিঃপ্রকাশ। ১৯৪৭-এর পরে পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের মধ্যে ‘ধর্মচেতনা সমন্বয়ের” এবং ‘আঞ্চলিক চেতনা অসমন্বয়ের” ভিত্তি হয়। আঞ্চলিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদী চেতনা বাড়ন্ত হওয়ার দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল আলাদা হযে যায়। ১৯৫০-এ গণতান্ত্রিক ভুমি-সংস্কার হলো স্বাধীন বাংলাদেশের উ্ভুদয়ের অষ্টম ভিত্তি।
১৯৪৭ উত্তর পাকিস্তান রাষ্ট্রব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা বিষয়সুমহঃ
বিটিশ-ভারতভুক্ত ১৭টি প্রদেশ ও ৫৭২টি স্থানীয় রাজ্য ছিল। হয়ে পৃথক ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। উত্তরাধিকারসুত্রের ১৯৩৫ সালের ভারত-সরকার আইনে উভয় রাষ্ট্রের জাতীয় ও প্রদেশিক সরকারসমূহ প্রচলিত হতে থাকে। ১৯৪৭-এ অন্তর্বর্তীকালীন স্বাধীনতা আইনে ৩টি প্রদেশ ও ৩টি প্রদেশের আংশিক নিয়ে ৫টি প্রদেশ ও ১০টি স্থানীয় রাজ্য নিয়ে পাকিস্তান-রাষ্ট্র গঠিত হয়। অন্যদিকে বৃটিশ-ভারতের ২টি বিভক্ত প্রদেশসহ ১৬টি প্রদেশ ও ৫৬২টি স্থানীয় রাজ্য নিয়ে ভারত-রাষ্ট্র গঠিত হয়। আর একপ্রজন্মকাল সময়ে পাকিস্তান থেকে অধিবাসী যায় ভারতের জনসংখ্যার ২.০%। ১৮% জনসংখ্যা হ্রাস পেলেও এজন্যে বৃটিশ-ভারত ও স্বাধীন-ভারতের রাষ্ট্র-অবকাঠামোর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ঘটেনি।
পূর্বাঞ্চলে ১টি পৃথক ও পশ্চিমাঞ্চলে ৪টি প্রদেশের সমন্বয়ে রাষ্ট্র-অবকাঠামো হওয়ায় বৃটিশ-ভারত থেকে নব পাকিস্তানের রাষ্ট্র-কাঠামোর মৌলিক পার্থক্য ঘটে। তাছাড়া, একপ্রজন্মকাল সময়ে ভারত থেকে অধিবাসী যায় পাকিস্তানের জনসংখ্যার প্রায় ২০% অধিবাসী আসে যার অধিকাংশ যায় পশ্চিমাঞ্চলে। উত্তরাধিকারসুত্রে প্রচলিত ১৯৩৫ সালে ভারত-সরকার আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনসহ ১৯৫০ সালে ভারত পুনাঙ্গ প্রণীত সংবিধান হয়। কতিপয় বৃহত্তর প্রদেশে প্রচলিত দুইকক্ষ সংসদের সাথে জাতীয় সংসদও দুইকক্ষ ভিত্তিক হওয়ায় চলমান রাজনৈতিক সংকট আরও হ্রাস পায়। অবাধ অধিবাসনের সময়সীমা ১৯৫৩ পর্যন্ত থাকায় পশ্চিমাঞ্চলের স্বার্থে পাকিস্তানের সংবিধান প্রনয়ণ স্থগিত রাখা হয়।
১৯৪১ সালে পশ্চিম-পাকিস্তান ও পূর্ব-পাকিস্তানের জনসংখ্যা যথাক্রমে ২.৯৫ কোটি ও ৪.২ কোটি এবং মোট জনসংখ্যায় ৪১% ও ৫৯% অংশীদারীত্ব ছিল। তবে সামরিক ও বেসামরিক কর্মে ব্যপক অংশীদারীত্বসহ অর্থ-সামাজিক অবস্থার ক্ষেত্রে পশ্চিম-পাকিস্তানাঞ্চল অগ্রসর ছিল। সরকারব্যবস্থায় অনাগ্রসর পূর্ব-পাকিস্তানের প্রাধান্য পশ্চিমাঞ্চল মানতে চায়নি। পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমাঞ্চলে অধিবাসী বেশী হবে বিবেচনায় ১৯৪৭-এ অন্তর্বর্তীকালীন বিধানে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের যথাক্রমে ৪৩ (৫৪.৫%) ও ৩৬ (৪৫.৫%)অংশীদারীত্ব রাখা হয়। ১৯৪৭ উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে অধিবাসী বেশী হলেও ১৯৫৩ সালের জনসংখ্যার অনুপাতেও জাতীয় পরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানের অংশীদারীত্ব বেশী ছিল।
প্রচলিত জনপ্রতিনিধিত্বের অনুপাতেই প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের নের্তৃত্ত্বে মুসলিম লীগ-সরকার “খসডা” সংবিধান প্রনয়ণ করে। জাতীয় পরিষদের উভয়কক্ষে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব এবং সরকার গঠনে পূর্ব-পাকিস্তানের স্থায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় ক্ষমতাসীন পাঞ্চাবী প্রেসিডেন্ট গোলাম মোহম্মদ মুসলিম লীগ-সরকারকে অপসারণ করে। অতঃপর বগুড়ার মোহম্মদ আলীর প্রধানমন্ত্রীত্বে সরকার ও আইনমন্ত্রী সোরওয়ার্দীর সহায়তায় পকিস্তানকে পূর্ব ও পশ্চিম দুটো প্রদেশে পুনর্গঠন (১৯৫৫) করে সংখ্যাসাম্য নীতির ভিত্তি করা হয়। ১৯৫৫ সালে পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান গঠণের মাধ্যমে পকিস্তানকে দুই ইউনিট করা বাংলাদেশের উ্ভুদয়ের নবম ভিত্তি।
১৯৪৭-এ অন্তর্বর্তীকালীন বিধানের পরিবর্তন এনে উভয়ের ক্ষেত্রে সংখ্যাসাম্য ৪০(৫০%)টি ও ৪০(৫০%)টির সমন্বয়ে মোট ৮০ আসন বিধানের অধ্যাদেশ করা হয়। সংবিধান প্রনয়ণের জন্যে সেই মতো পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদকে বিদ্যমান প্রাদেশিক পরিষদের প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে গঠন করা হয। অতঃপর চৌধুরী মোহাম্মদ আলেী প্রধানমন্ত্রীত্বে ১৫ সদস্যের মন্ত্রীপরিষদ গঠন করা হয়। এ মন্ত্রীপরিষদে দুজন বাদে ১৩ জন মন্ত্রীই ছিলেন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে হক-সাহেবের কৃষক-প্রজা দলের। সাবেক আইনমন্ত্রী সোরওয়ার্দীর প্রণীত সংবিধানের রুপরেখার ভিত্তিতে ১৯৫৬ সালে প্রণীত সংবিধানের খসড়া আইনমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক জাতীয় পরিষদের অনুমোদেন জন্যে পেশ করেন।
পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের সমর্থন ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানীদের পক্ষে এ সংবিধান পাশ করা সম্ভব ছিল না। কৃষক-প্রজা দলের ১৩ জন ও সোরওয়ার্দীর ১টির সমন্বয়ে ১৪টি আসনের ভোটের সহায়তায় ১৯৫৬ সালের সংবিধান পাশ হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্যে ২১ দফা ও গণম্যান্ডেটের বিপরীতে দিল্লী-প্রস্তাব ও পূর্ব-পশ্চিমের সংখ্যাসাম্য প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে ১৯৫৬ সালের সংবিধান পাশে বিশ্বাসঘাতক হক-সোরওয়ার্দী সহায়তা করেন। দলীয় সিন্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোটদাতা ও বড় বিশ্বাসঘাতক সোরওয়ার্দীকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হয়। আর ছোট বিশ্বাসঘাতক হক-সাহেবকে পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্ণর করা হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধানের সংখ্যাসাম্যের বিধান হলো ১৯৬২ সালের সংবিধানের সংখ্যাসাম্যের বিধানের ভিত্তি। ১৯৫৬-এর সংবিধানের সংখ্যাসাম্যের বঞ্চনা হলো বাংলাদেশের উ্ভুদয়ের দশম ভিত্তি।
বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরোক্ষ সুত্রপাতঃ
১৯৪৭ উত্তর ৫টি প্রদেশে বিভক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্র-অবকাঠামো ন্যুনতমাত্রায় গণতন্ত্রমুখী ছিল। তাই পুনাঙ্গ সংবিধান ছাড়াই অন্তর্বর্তীকালীন বিধানেও প্রায় ৭ বছর গণতান্ত্রিক সরকারের ধারাবাহিকতা ছিল। ১৯৫৫ সালে পূর্ব ও পশ্চিম ইউনিটে পরিনত করায় পাকিস্তানের রাষ্ট্র-অবকাঠামো ‘চরম স্বৈরমুখী’ হয়ে উঠে। অতঃপর দুই পৃথকাঞ্চলের মধ্যে রাজনৈতিক সমন্বয় হ্রাস পেতে থাকে। সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের উপর প্রধানতঃ দুই পৃথকাঞ্চলের সমন্বয়ের ভিত্তি দাঁড়ায়। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রনীতি ও অনাগ্রসরতার কারণে ১৯৪৭ পূর্বে সামরিক সার্ভিসে মাত্র ১৪% ও সিভিল সার্ভিসসমুহেও মাত্র ১৫.৫০% বাঙালী মুসলমান নিয়োজিত ছিল। অন্যান্য ক্ষেত্র কয়েকগুণ প্রাধান্য থাকায় ১৯৫৬ সালের সংবিধানে জাতীয় পরিষদে ‘সংখ্যাসাম্য নীতি’ হলে পূর্ব-পাকিস্তান ক্রমে পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনস্ত হতে থাকে।
১৯৪৭ সাল বাংলাদেশাঞ্চল উদ্ভুদয় হয় একটি কৃষি ও পল্লীভিত্তিক একটি বর্ধমান দরিদ্র-প্রদেশ হিসেবে। ১৯৫১-তে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পশ্চিম-পাকিস্তানের জনপ্রতি আয় প্রায় ২৬% বেশী ছিল। ১৯৫৫ সালের পরে ১২টি বিভাগ ভিত্তিক রাষ্ট্র-অবকাঠামো আরও উৎপাদনশীল হওয়ায় ১৯৬০দশকে পশ্চিম-পাকিস্তানের জাতীয় ও জনপ্রতি প্রবৃদ্ধির গড়হার ক্রমে ৬.৮% ও ৩.৬%-এ উন্নীত হয়। পক্ষান্তরে, ১৯৬০দশকে ৪টি বিভাগ ভিত্তিক রাষ্ট্র-অবকাঠামো স্বৈরমুখী হওয়ায় আইয়ুব-সরকারের বাড়তি উদ্যোগ সত্ত্বেও পূর্ব-পাকিস্তানের এ গড়হার প্রায় ৪.৪% ও ১.৯%-এ আবদ্ধ থাকে। পশ্চিম-পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধির গড়হার ক্রমে বেশী হওয়ায ১৯৫৫ থেকে পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম-পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়তে থাকে।
বাম/সমাজতন্ত্রবাদীরা অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়াকে পূর্ব-পাকিস্তানকে পশ্চিম-পাকিস্তানের শোষন হিসেবে তুলে ধরে। প্রায় ১১ প্রজন্মকার দারিদ্রতায় আবদ্ধ থাকায় সাধারণ জনগণ তা বিশ্বাস করে। অর্থনৈতিক নয়, প্রধানতঃ রাজনৈতিক বৈষম্য ও বঞ্চনা বাড়তে থাকায় ‘আঞ্চলিক’ বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনাও বাড়তে থাকে। ১৯৭১ উত্তর বাংলাদেশ ৪টি বিভাগ ও পাকিস্তান ৪টি প্রদেশ ভিত্তিক হওয়ায় উভযের রাষ্ট্র-অবকাঠামো স্বৈরমুখী হয়ে উঠে। বাজার অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাওয়ায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তান প্রবৃদ্ধি গড়হার হ্রাস পেয়ে যথাক্রমে প্রায় ৩.৪% ও ৫.৫% হয়। ১৯৭১ উত্তর একদশক বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি গড়হার ১.০% হ্রাস পাওয়া সমাজতন্ত্রবাদীদের অর্থনৈতিক শোষণতত্ত্বকে সমর্থন করে না।
লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৪৯ সালে লাহোর প্রস্তাবনা ভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রগঠণে অঙ্গীকার নিয়ে মৌলানা ভাসানীর নের্তৃত্বে আওয়ামী (মুসলিম) লীগ গঠিত হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্যে যুক্তফন্টের ২১ দফা ও গণম্যান্ডেটের সাথে বৈঈমানী করে ১৯৫৫ সালে পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম-পাকিস্তান-এ দুই ইউনিট এবং দিল্লী-প্রস্তাব (ইউনিয়নরাষ্ট্র) ও সংখ্যাসাম্য প্রতনিধিত্বিরে ভিত্তিতে ১৯৫৬ সালের সংবধিান প্রনয়ণে সহায়তা করায় হক-সোহরওর্য়াদীর উপর তিনি ক্ষুব্ধ হন। অন্যদিকে সোহরওর্য়াদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও লাহোর প্রস্তাব বাদ দিয়ে ক্ষমতার রাজনীতির জন্যে তাঁর সাথে যোগ দেন।
অতঃপর আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ও স্বায়ত্বশাসন আন্দোলনের জন্যে সমমনা বিপ্লবীদের (সন্ত্রাসবাদী-মার্ক্সবাদী) নিয়ে জনবন্ধু মৌলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী র্পাটি (ন্যাপ) গঠন করেন। একাধিকবার পূর্ব-পাকিস্তানের সরকারের গঠন-পতন ঘটিয়ে ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারী ও সংবিধান বাতিল করান। হক-সোহরওর্য়াদীও রাজনীতির নের্তৃত্ব থেকে অপসাবিত হয়। অতঃপর স্বায়ত্বশাসন আন্দোলনের নামে পরোক্ষ স্বাধীনতামখী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও স্বাধীনতা আন্দোলন করায় ভারতের সহায়তার পাওয়া যায় জন্যে আগতলা সরকারের সাথে যোগাযোগে করেন। ভারত-সরকারের সাড়া না পাওয়ায় নিরাশ হন।
ঐতিহাসিক ৬ দফার রাষ্ট্র-দর্শন, আন্দোলন ও গণম্যান্ডেটঃ
১৯১৯ সালের ভারত-সরকার আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বৃদ্ধি পাওয়ায় বৃটিশ-সরকার সকল দলের কাছে দাবী/প্রস্তাবনা আহবান করে। কংগ্রেস “ইউনিয়নরাষ্ট্র” গঠনের প্রস্তাব (১৯২৮) এবং মুসলিম লীগ প্রদেশ পুনর্গঠনসহ “ভারত-যুক্তরাষ্ট্র” গঠনের প্রস্তাব (১৯২৯) দেয়। সে প্রস্তাবসমূহ বিশ্লেষণ করে ১৯৩৩ সালে চৌধুরী রহমত আলীর ভবিষ্যতব্য ছিল যে, ভবিষ্যতে বৃটিশ-ভারত পাকিস্তান, ভারত ও বঙ্গ-এ তিন দেশে বিভক্ত হবে। মুসলিম লীগের প্রস্তাবনা মোতাবেক বৃটিশ-সরকার কতিপয় নুতন প্রদেশ গঠণসহ ১৯৩৫ সালে ভারত-সরকার আইন চালু করে। ১৯৩৭ সালে নির্বাচন ও নির্বাচনোত্তর সাম্প্রদায়িক দাঙা বাড়ন্ত হলে মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাব (১৯৪০) গ্রহণ করে।
মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবোত্তর বাবার বন্ধু মৌলানা ভাসানীসহ পাবনা জেলার মুসলিম লীগের সহকর্মী ছাত্র-যুব নেতাদের উত্তর মুসলিম-ছাত্রলীগ নেতা মোহাম্মদ ইসরাইল হোসেন বোঝাতে সক্ষম হন যে, লাহোর প্রস্তাব ধরে রাখলেই ভবিষ্যতে পৃথক বাংলাদেশ রাষ্ট্র হবে। স্বল্পকালীন প্রেসিডেন্সী কলেজের ছাত্রকালে (১৯৪২) ইসলামিয়া কলেজে সহপাঠী ও ছাত্রনেতা শেখ মুজিবও মোহাম্মদ ইসরাইল হোসেন ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী হন। ১৯৪৭-এ পাকিস্তানভুক্ত বাংলাদেশাঞ্চল হওয়ায় তাঁর বিশ্বাস আরও বেড়ে উঠে। এজন্যে তিনি ১৯৪৭ উত্তর সোহরওয়ার্দীকে ছেড়ে মৌলানা ভাসানীর নের্তৃত্বে ‘লাহোর প্রস্তাবনা’ ভিত্তিক ১৯৪৯ সালে গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ন-সম্পাদক পদাসীন হন।
গণম্যান্ডেটের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা এবং ব্যক্তিস্বার্থের রাজনীতির জন্যে বছরান্তে সোরওয়ার্দী-সরকারের অবসান হয়। দিল্লী-প্রস্তাব ভিত্তিক ইউনিয়ন রাষ্ট্রব্যবস্থা, দুই-প্রদেশ ইউনিট ও সংখ্যাসাম্য প্রতিনিধিত্বের বিধান অব্যহত রাখাসহ রাষ্ট্রপতি ও জাতীয়-প্রাদেশিক পরিষদের পরোক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা চালু করায় রাষ্ট্রপতি আউয়ুব খানের নের্তৃত্বে প্রণীত ১৯৬২ সালের রাষ্ট্রপতিকেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থার সংবিধানও পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাধানে ব্যর্থ হয়। তবে তাঁর সুশাসন ও উন্নয়নের কর্মের কাছে ১৯৬৪ পর্যন্ত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের পেশাদার রাজনৈতিক নেতারা ধরাশায়ী হয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পরে ১৯৬৫ সালে জনবন্ধু মৌলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কিছুটা নিরাশ হয়ে উঠেন।
এ অবস্থায় ‘বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা’ পাবনার মোহম্মদ ইসরাইল হোসেন প্রথমে জনবন্ধু মৌলানা ভাসানীকে এবং পরে একদা ইয়ারমেট ও ছাত্রলীগ সাথী শেখ মুজিবকে লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের আন্দোলনে আবার সম্মত করান। উভয়কে তিনি আরও বোঝাতে সক্ষম হন যে, যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থায় তিন-চর্তুথাংশ এবং ইউনিয়নরাষ্ট্র ব্যবস্থায় এক-তৃতীয়াংশ প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন হয়। ইউনিয়নরাষ্ট্র ব্যবস্থায় যেখানে রাজধানী, সে প্রদেশই র্সাবভৌম। সেনাবাহিনীর জন্যে পশ্চিমাঞ্চল থেকে রাজধানী সড়ানো সম্ভব না। যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা ছাড়া হাজার মাইল ব্যবধানে দুই অঞ্চল নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী স্বার্থের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের সুযোগ কম।
যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু হলে রাজনীতি-অর্থনৈতিক সংকটের অবসান হব। সেনাবাহিনীতে অংশীদারীত্ব বাড়লে প্রয়োজনে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের একধাপ অগ্রগতিও হবে। লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের আন্দোলনে তেমন গণজাগরণ হলে, পশ্চিমারা সম্মত না হলে পৃথক বাংলাদেশ হবে। মৌলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের বিশ্বাস পুনঃজ্জীবিত হয়। উভয়ের সম্মতিতে তিনি ৬ দফার ১ম দফার ১ম লাইন: “লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান হইবে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা” প্রনয়ণ করেন। অন্যদের সাথে আলোচনা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাকী দফাগুলো চুড়ান্ত করেন। এজন্যে ৬ দফার প্রনয়ণের সাথে জনাব রুহুল কুদ্দুস ও ডঃ নুরুল ইসলামহ আরও প্রজ্ঞাজনের নাম শুনা যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের একাডেমিক মেধা-প্রক্ষা কম হলেও সম্মোহনী ভাষনের ক্ষমতা উচ্চতর ছিল। লাহোর প্রস্তাব আন্দোলনে ঐতিহাসিক গণম্যান্ডেটে (৯৭%) ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশাঞ্চলের উদ্ভুদয় হয়। সেই লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রণীত, ৮৫% মুসলমান বাঙালী জনতার পারিবারিক-সামাজিক প্রতিষ্ঠানসহ জীবনদর্শনের সাথে ৬ দফার রাষ্ট্রদর্শণ সামঞ্জস হওয়ায় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সম্মোহনী ভাষণ-ব্যাখ্যায় ৬ দফারদ্রুত জনসমর্থিত হতে থাকে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ৬ দফা আন্দোলনে ফেডারেল পাকিস্তান অথবা স্বাধীন বাংলাদেশ হবে, ‘বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা’ মোহাম্মদ ইসরাইল হোসেনে এ বক্তব্যটা জনবন্ধু ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ‘৬ দফা না মানলে ১ দফা’ কথামালা হিসেবে প্রচালিত ছিল।
লাহোর প্রস্তাবনা ভিত্তিক ৬ দফায় রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা হওয়ার সুযোগ ছিল না। এজন্যে “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়” বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কারাবন্ধি করে ৬ দফা আন্দোলনকে দমনের চেষ্টা হয়। ৬ দফা ও ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের গণ-অভ্যুত্থানে ১৯৬৯ সালে আইয়ুর-সরকারের পতন হয়। অতঃপর নয়া সামরিক সরকারের অধীনে ৫টি প্রদেশ, আনুপাতিক ভোটভিত্তিক জনপ্রতিনিধিত্ব ও কতিপয় শর্তসহ পাকিস্তানের নুতন সংবিধান প্রনয়ণের জন্যে নির্বাচন হয়। নির্বাচনে বাংলাদেশাঞ্চলে ৬ দফা ও আওয়ামী লীগ ৯৯% আসনের গণম্যান্ডেট পায়। ৬ দফার রাষ্ট্রদর্শণ, আন্দোলন ও গণম্যান্ডেট হলো বাংলাদেশের উ্ভুদয়ের একাদশ ভিত্তি।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণঃ
২৮শে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ফেডারেল পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের জন্যে জাতির মানসিক প্রস্তুতি ছিল। ১লা মার্চে জাতীয় সংসদ অধিবেসন স্থগিত হলে ছাত্র-যুব নেতারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্যে আবেদন জানায়। উনি তাদের বলেছেন, ‘পাকিস্তানও হয়েছে জাতির আকাংখা, আন্দোলন, বহুত্যাগ ও গণম্যান্ডেটে। স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট এখনও হয়নি। হঠাৎ স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়া হলে মধ্যবয়সী ও প্রবীনেরা সমর্থন নাও করতে পারে। তখন আমও যাবে, ছালাও যাবে। আগে সর্বস্তরে স্বাধীনতার মন জাগাতে হবে। আন্তর্জাতিক সমর্থনের প্রেক্ষাপটও তৈরী করতে হবে। আমি নবীন-প্রবীন নাগরিকদের ও প্রতিনিধিদের নেতা। আমি ছাত্র-যুবকদের মতো আচরণ ও কথা বলতে পারি না। ৭ই মার্চের ভাষণে আমি আওয়ামী লীগের বক্তব্য রাখবো”।”।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ইশারায় সাবেক ছাত্রলীগ-নেতা সিরাজুল আলম খানের নের্তৃত্বাধীন নিউক্লিয়ার্সে উদ্যোগে থেকে ছাত্রলীগ ২রা মার্চে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ছাত্র-যুব নেতারা পতাকা উত্তোলন করে’ (সিরাজুল আলম খানের বক্তব্য অনুসারে)। পাবনায় বিকাল ৪-০০ টায় ছাত্রলীগ পতাকা উত্তোলন করে (নিবন্ধকার সেখানে যোগদেন)। ২রা মার্চের পতাকা উত্তোলনে সারাদেশে ছাত্র-যুবদের মধ্যে স্বাধীনতার আকাংখা বাড়তে থাকে। এমন সুযোগ ও প্রতিবেশে সমাজতন্ত্রবাদী সিরাজুল আলম খান ৩রা মার্চে ছাত্রলীগের সমাজতন্ত্রবাদী ও নিউক্লিয়ার্সের সদস্যদের দিয়ে ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের ইস্তেহারও’ পাঠ করান।
সমাজতন্ত্রবাদী সিরাজুল আলম খান এ উদ্যোগ গণম্যান্ডেটকৃত ৬ দফার রাষ্ট্রদর্শনের সাথে সঙ্গতি ছিল না এবং জাতির জন্যে চরম হটকারিতা ছিল। জ্ঞাত হয়ে বঙ্গবন্ধু বন্ধ করতেই হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হন। পাঠ হয়ে যাওয়ায় কপি নিয়ে নিরবে চলে আসেন। সিরাজুল আলম খানের এ হটকারিতা এবং সমাজতন্ত্রবাদী যুব-ছাত্রদের কাঠ-বাঁশের কুজকায়াজ পাক-সেনাদের গণহত্যার সুযোগ করে দেয়। সাবেক ছাত্রলীগ-নেতা ও পরবর্তীতে সমাজতন্ত্রবাদী সিরাজুল আলম খান “সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ” কায়েমের জন্যে ১৯৬২ সালে নিউক্লিয়ার্স গঠন করেন এবং তা গোপনে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে পরগাছার মত কর্মী সংগ্রহ করেন। ১৯৭১-এ পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় সাত হাজার ছাত্রলীগ নেতা-কমীরা নিউক্লিয়ার্সের সাথে যুক্ত হয়।
৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতির উদ্দেশ্যে ‘বিশ্বসেরা’ ঐতিহাসিক জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক ভাষণ দেন। সেই ভাষণে সামরিক-সরকারকে জন-প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরসহ ৪ দাবী দেন এবং ৪ দাবী না মানা পর্যন্ত “অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের” ডাক দেন। ভাষণে আরও বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীত্বে বদলে জনগণের অধিকার চান। বাড়তি চাপ সৃষ্টিতে ২৫শে মার্চে বেতন-ভাতা প্রদান এবং ২৫শে মার্চে বেতন-ভাতা প্রদানের বদলে জনতার উপর গুলি করা হলে, তখন সংগ্রাম হবে, মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রামের কথা বলেন। অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক হাইকোর্ট ও সচিবালয়সহ সর্বস্তরে আকুন্ঠ সমর্থিত হয়।
৭ই মার্চে ভাষণের মূলকথা ছিল, জন-প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরসহ ৪ দাবী মেনে নেওয়া। ব্যক্তি-বিশেষ ছাড়া সরকারী-বেসরকারীখাতে ৭ দিন আগে বেতন প্রদান প্রথা নয়। ২৫শে মার্চে বেতন প্রদানের বদলে গুলি করা হলে জনতা মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামের পথ ধরবে বলার উদ্দেশ্য ইয়াহিয়া-সরকারকে বাড়তি চাপ দেওয়া। কিন্ত জনগণ এটাকে ভবিষ্যৎ আন্দোলনের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করে। ৬ দফার রাষ্ট্রদর্শন আন্দোলনে তিন-চতুর্থাংশ (৭৫%) স্বাধীনতার চেতনা বিকশিত হয়। ৭ই মার্চের ভাষণ ও অসহযোগ আন্দোলনে স্বাধীনতার বাকী এক-চতুর্থাংশ মানষিক প্রস্তুতি ক্রমশঃ সম্পন্ন হতে থাকে। ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণ হলো, বাংলাদেশের উ্ভুদয়ের দ্বাদশ ভিত্তি।
নাগরিক ও আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণাসমূহ ও প্রত্যক্ষ স্বাধীনতা সংগ্রাম
৬ দফার রাষ্ট্রদর্শনের আন্দোলন ও গণম্যান্ডেটোত্তর ছাত্র-যুব নেতাদের পতাকা উত্তোলন ও ৭ মার্চের ভাষণের জন্যে জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক চেতনা আরও বিকশিত হতে থাকে। এ বিকশিত চেতনার উপরে ২৫শে মার্চের মধ্যরাত থেকে সারা বাংলাদেশাঞ্চলে পাক-সেনারা বর্বর আঘাত হানলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সম্পর্ক প্রায় বিচ্ছেদ হয়ে যায়। সেনা-বিডিআর-পুলিশ-আনসার-ছাত্র-যুব-জনতা সবাই যার যার অবস্থান থেকে স্ব-উদ্যোগে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও স্বাধীনতার স্লোগান-ঘোষণাসহ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শহীদ হবার আগে ইপিআর-ওয়ারলেচ থেকে কোন কর্মকর্তা ৭ই মার্চের ভাষণের পাথেয় অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর নামে “স্বাধীনতার ওয়ারলেস বার্তা” পাঠান। এজন্যে তার পরিচয় জানা যায়নি। পাক-সেনাদের বর্বর আঘাত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের উ্ভুদয়ের ত্রিরোদশ ভিত্তি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে স্বাধীনতার ওয়ারলেস বার্তার কথায় ২৬শে মার্চের ভোরবেলা থেকেই পাবনা শহরবাসীরাও (নিবন্ধকারসহ) বিক্ষোভ, প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধ শুরু করি। নিবন্ধকারে একইবর্ষে সহপাটি ও পাশে পাড়ার প্রতিবেশী সাদেক আহম্মেদ সাদু পাকসেনার ভ্যান দেখে “জয়বাংলা” স্লোগান দেন। অতঃপর পাকসেনারা তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। পাকসেনার রাইফেলের গুলিতে ২৬শে মার্চের আনুমানিক সকাল ১০-০০টায় শহীদ হন। শহীদ হবার আগে তিনি দাঁড়িয়ে “স্বাধীনতার স্লোগান” দেন। পাবনার শহীদ সাদু, চট্টগ্রামের বেলাল মোহাম্মদ, প্রমুখদের মতো সারাদেশে অনেকেই ২৬-২৮শে মার্চে বিক্ষোভ-বিদ্রোহসহ স্বাধীনতার স্লোগান বা ঘোষণা দেন এবং প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন।
জাতির মহাক্রান্তিকালে ২৬শে মার্চ থেকে “নাগরিক স্বাধীনতা ঘোষনা”গুলোর মধ্যে সেনাকর্মকর্তা হিসেবে মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষণা ছিল সবচেয়ে প্রভাবশীল। এরমূলেও ছিল ৬ দফার আন্দোলন, গণম্যান্ডেট ও ৭ই মার্চের ভাষণ। মেজর জিয়ার ঘোষণা পাক ও বাঙ্গালী বাহিনীদের মধ্যে বিভাজন এনে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে এবং ছাত্র-যুব-জনতাসহ অবসরপ্রাপ্ত সেনাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করে। এ ঘোষণা জাতিকে আশ্বস্থ ও বাড়তি সাহস জোগায় যে, ‘আমাদের সেনারা আমাদের সাথে আছে’। এ ঘোষণা দেশের বিছিন্ন বিদ্রোহ ও প্রতিরোধগুলো জাতীয় স্বাধীনতাযুদ্ধে রূপ দেয়। জাতীয়বন্ধু মেজর জিয়ার “নাগরিক” স্বাধীনতার ঘোষণা হলো স্বাধীন বাংলাদেশের উ্ভুদয়ের চতুর্দশ ভিত্তি।
২৬শে মার্চ ভোর থেকে সারাদেশে গণবিক্ষোভ, গণবিদ্রোহ ও নাগরিক স্বাধীনতা স্লোগান-ঘোষণার প্রেক্ষিতে ৬ দফার গণম্যান্ডেটপ্রাপ্ত জনপ্রতিনিধিগণ জনগণের পক্ষ থেকে ১০ এপ্রিলে আনুষ্ঠানিক “জাতীয়” স্বাধীনতার ঘোষণা দেন (স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র)। ঘোষনাপত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈযদ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাস্ত রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। স্বাধীনবাংলা সরকারের ভারপ্রাস্ত রাষ্ট্রপতি সৈযদ নজরুল ইসলাম ও মন্ত্রীগণ ১৭ এপ্রিলে শপথ গ্রহণ করেন। ১০ এপ্রিলে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা হলো স্বাধীন বাংলাদেশের উ্ভুদয়ের পঞ্চদশ ভিত্তি। প্রতিবেশী ভারতের সামরিক সহায়তায় শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তি-স্বাধীনতার যুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় অর্জন হলো, স্বাধীন বাংলাদেশের উ্ভুদয়ের ষষ্ঠদশ ও চুড়ান্ত ভিত্তি।
শেষের কথাঃ
গণতান্ত্রিক পথে সাতকোটি জনতার জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মূলধারার সাথে বহু উপমত-উপধারা যুক্ত থাকে। নিজের মত-পথ-দল সবার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর মত-পথ-কর্ম নিয়েও বহু প্রশ্ন ও বিতর্ক থাকাও স্বাভাবিক। যেমন, স্বাধীনতার ঘোষনাপত্রে লেখা “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনুয়ায়ী অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ তারিখে ঢাকায় ‘যথাযতভাবে’ স্বাধীনতার ঘোষনা প্রদান করেন”। ‘যথাযতভাবে’ স্বাধীনতার ঘোষনার সংঙা এবং কাদের উপস্থাতিতে তা দেওয়া হয়েছে, কোথাও তার ইঙ্গীদ ও বর্ণনা না দিয়ে, স্বাধীনতার ঘোষনাপত্রে এমন “অসত্যকথা” লেখা দরকার এবং তা আবার অনুমোদন করার প্রয়োজন ছিল না।
উপনেতা-জনগণের উপস্থিতি ছাড়া ‘যথাযতভাবে’ স্বাধীনতার ঘোষনা হয় না। সারাদেশে গণবিক্ষোভ, গণবিদ্রোহ ও নাগরিক স্বাধীনতা স্লোগান-ঘোষণার প্রেক্ষিতে “২৬শে মার্চ তারিখ” কার্যকরিতা দিয়ে ১০ এপ্রিলে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা করাই যথেষ্ঠ ছিল। বঙ্গবন্ধুর নামেই নাগরিকগণ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে। তাঁকে নেতা রেখে ও মেনেই স্বাধীনতাযুদ্ধ হয়েছে। তাঁর অনুপস্থিতি-কারাবন্ধিত্ব জাতীয় ঐক্য দিয়েছে। তাই ৭ই মার্চের ভাষণের পরে নিজমুখে স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতির প্রধাননেতা। বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা, সরকারগঠন বা স্বাধীনতাযুদ্ধ হলেও–এসব তাঁর কর্ম নয়। তাই বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ে মূলপর্বে অন্যান্য নেতাদের অবদানও নক্ষত্রের মতো।
স্বাধীনতোত্তর সংবিধান প্রনয়ণসহ রাষ্ট্রগঠন, রাষ্ট্রের মূলনীতিসমূহ ও সরকারগঠনের বিধানসমুহ প্রনয়ণসহ রাষ্ট্র-পরিচালনায় অনেক ভুল-ত্রুটি হয়েছে। ৬ দফার রাষ্ট্রদর্শনের আন্দোলন, গণম্যান্ডেট ও স্বাধীনতার ঘোষিত অঙ্গীকার বিরোধী সংবিধান প্রনয়ণ করা মুজিব-নের্তৃত্বের সমীচিন হয়নি। তাঁর ভুল ও নৈতিকহীনতায় সংঘর্ষিক রাজনীতি ও দুঃখজনক ঘটনায় জাতি বিভাজিত। বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রধাননেতা—তা যেমন অস্বীকার করার সুয়োগ নেই, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে জাতির ভগবান ভাবা বা বানোনোর সুযোগও নেই। সুদীর্ঘ বঞ্চনা ও ঘটনাবলী, ক্ষোভ-বিক্ষোভ-আন্দোলনসহ জাতির সম্মিলিত আকাংকায় ও প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের উদ্ভুদয় হয়েছে।
নিবন্ধকারের গণতন্ত্রমুখী রাষ্ট্রববস্থা তত্ত্বভিত্তিক পূনর্গঠণের প্রস্তাবনা ও উদ্যোগে ১৯৮২ থেকে “উচ্চতর সমৃদ্ধিশীল বাংলাদেশ” গড়ে উঠেছে (প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেথা, ১৯৮৫, প্রগতিশীল গণতন্ত্র, ১৯৯১, সংবিধান সংশোধনের দিকগুলো, ২০১০ ও সুপ্রীমকোর্টে পেশকৃত প্রতিবেদন, ২০১১)। ৯টি আঞ্চলিক ক্যান্টমেন্টের ভিত্তিক প্রতিরক্ষা-কাঠামো এখন স্বনিয়ন্ত্রিত ও গণতন্ত্রমুখী। অতঃপর জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার (খালেদা-সরকার ও হাসিনা-সরকার) ক্ষমতাসীন হন ও থাকতে পারেন। ৯ম সংসদ নির্বাচনকালে (২০০৮) গণম্যান্ডেটকৃত ১নং অঙ্গীকার হলো, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংস্কার, গণতন্ত্র ও কার্যকর সংসদ” প্রতিষ্ঠা এবং নির্বাচনোত্তর অঙ্গীকার হলো, কুমিল্লা ও ফরিদপুর বিভাগ গঠন করা।
নিবন্ধকারের সুষম/প্রগতিশীল গণতন্ত্রমুখী রাষ্ট্রববস্থার পূনর্গঠণের প্রস্তাবনা ও উদ্যোগমত বাকী কুমিল্লা ও ফরিদপুর বিভাগ হলে রাষ্ট্র-অবকাঠামো সুষম-গণতান্ত্রিক হবে। আর দুইকক্ষ সংসদব্যবস্থা চালু হলে চলমান স্বৈরমুখী সরকারব্যবস্থা গণতান্ত্রিক রূপ পাবে। তাহলে সুষম-বাজার অর্থনীতি ও সুশাসনাবস্থাসহ “সুষম-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা” প্রাতিষ্ঠানি রূপ পাবে। এবং সংঘর্ষিক রাজনীতি, জাতির বিভাজন ও দুঃখজনক ঘটনাপ্রবাহের সমাপ্তি হবে। ২য়-পর্বে ১০টি প্রদেশভিত্তিক হলে বাংলাদেশ “কয়েক শতাব্দী” উচ্চতর সমৃদ্ধিশীল গণতান্ত্রিক থাকবে।(আংশিক ২০০৯ সাথে বিভিন্ন পত্রিকায় ও ফেসবুকে প্রকাশিত)।
*মোহাম্মদ আহ্সানুল করিমঃ রাষ্ট্র-বিশেষজ্ঞ, মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক বিসিএস কর্মকর্তা। ১৯৮২ থেকে “সম্মৃদ্ধিশীল গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ” গঠনে ভিত্তিমূলক কাঠামো-প্রতিষ্ঠানগুলোর গণতন্ত্রমুখী পুনর্গঠনের উদ্যোক্তা; প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা (১৯৮৫), প্রগতিশীল গণতন্ত্র (১৯৯১), ও সংবিধান সংশোধনের দিকগুলো (২০১০) ও সুপ্রীমকোর্টে পেশকৃত প্রতিবেদন, ২০১১- নিবন্ধ/বইযের লেখক এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রবক্তা।