
অ্যাডভোকেট আনসার খান :সংকট সমাধানের কূটনৈতিক উদ্যোগ সত্ত্বেও রাশিয়া এবং ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশংকা এখন অনিবার্য বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।রাশিয়া যুদ্ধের আশংকা বা ইউক্রেনে আক্রমণের সম্ভাবনা নাকচ করে দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যেকোনো সময়ে,যেকোনো মূহুর্তে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করার মতো যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছে এবং ইউক্রেনের চতুর্দিকে অনধিক এক লাখ ত্রিশ হাজার সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে ইউক্রেনকে ঘিরে ফেলেছে।নৌপথে আক্রমণের জন্য সমুদ্রে যুদ্ধজাহাজ এবং আকাশ যুদ্ধের জন্য বিমানবহর তৈরি রেখেছে রাশিয়া। অর্থাৎ স্হল,নৌ এবং আকাশ-এই তিন ফ্রন্ট থেকেই একযোগে ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে দেশটি দখল করে নিতে পারে রাশিয়া।
ইউক্রেনে যেকোনো রাশিয়ান হামলা গুরুতর পরিণতির কারণ হতে পারে।গোটা ইউরোপ অস্থিতিশীল হওয়ার পাশাপাশি ইউরোপজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশংকা করা হচ্ছে-যা থেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছেন।কেননা-যুক্তরাষ্ট্র,ন্যাটো এবং পশ্চিমাশক্তিগুলো রাশিয়াকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে ইউক্রেনে হামলার জন্য রাশিয়াকে চরম পরিণত ভোগ করতে হবে।যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ইউক্রেনে ট্যাঙ্ক এবং বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র পাঠিয়েছে এবং রাশিয়ার সীমান্তবর্তী ন্যাটো দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করেছে-একইসাথে পূর্ব ইউরোপের মিত্রদেশগুলোতে মোতায়েনের জন্য ৮৫০০-সেনাকে সতর্কাবস্হায় রেখেছে।
ন্যাটোর মহাসচিব স্টলটেনবার্গ সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যুদ্ধ-সংঘাতের আশংকা ও ঝুঁকি খুবই বাস্তব-যদিও রাশিয়া তা অস্বীকার করে চলেছে।তবে রাশিয়ার উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী বর্তমান পরিস্থিতিকে ১৯৬২-র কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সাথে তুলনা করেছেন-যখন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক সংঘাতের কিনারে পৌঁছে গিয়েছিলো।সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে রাশিয়াকেই তার উত্তরসূরী হিসেবে গণ্য করা হয় এবং ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার দখলদারিত্ব কায়েমের হুমকি ও আস্ফালনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে বিধায় যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া এখন নতুন একটি সংকটে আবারও বৈরিতার মুখোমুখি অবস্হানে চলে এসেছে।এই সংকট ও বৈরিতা যে আনবিক মারণাস্ত্র সংকট ও যুদ্ধের দিকে মোড় নিবে না-তা হলফ করে কারো পক্ষেই বলা সম্ভব হচ্ছে না এখনই।তবে রাশিয়ান ওই মন্ত্রীর সতর্কতা ইঙ্গিতবাহী।তাহলে কী বিশ্ববাসী একটি আসন্ন পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকিতে রয়েছে?
রুশ-ইউক্রেন সংকট যে বড়ধরণের যুদ্ধের দিকে মোড় নিতে চলেছে তার আলামত হিসেবে বলা যায় যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলো ইউক্রেন থেকে নিজেদের নাগরিকদের প্রত্যাহার করে নিয়ে যাচ্ছে সম্ভাব্য রুশ আক্রমণের আশংকায়।
সত্যিকারঅর্থে যদি রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক হামলা পরিচালনা করে তবে তার পরিণতি হবে ধ্বংসাত্বক এবং বিধ্বংসী-এমন মন্তব্য করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন-কয়েকদশকের মধ্যে ইউরোপের মাটিতে এটি সবচেয়ে বড় সামরিক সংঘাতে পরিণত হতে পারে।এমনকি এই সংঘাত গোটা বিশ্বব্যবস্হাকে তছনছ ও গ্রাস করতে পারে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এক চরম বিপর্যয়কর অবস্থা সৃষ্টি করবে ইউক্রেনে রাশিয়ান সামরিক হামলা।এটি ১৯৬২-র কিউবার পারমাণবিক সংকট থেকেও বড় বিপদ ডেকে আনবে শান্তিতে বিশ্বাসী বিশ্ববাসীর জন্য।
ইউক্রেনে সামরিক হামলা একটি গুরুতর মানবিক,রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিপর্যয় ও সংকটের কারণ হবে-এটি নিশ্চিত করে বলা যায়।আধুনিক সামরিক অস্ত্রের ব্যবহারের শিকারে পরিণত হবেন নিরপরাধ মানুষ,পশু-পাখি।অনেক বিশ্লেষকদের মতে হামলার প্রথমদিনেই প্রায় ৫০-হাজার ইউক্রেনীয় মারা পড়ার শংকা রয়েছে।এছাড়াও হাজার-হাজার মানুষ আহত-পঙ্গু হবে এবং উদ্বাস্তু হবে অসংখ্য মানুষজন।খাদ্যের অভাবে আরও অসংখ্য মানুষের জীবন হবে বিপন্ন।রাষ্ট্রের অবকাঠামো,শিক্ষা,স্বাস্থ্যসেবা,খাদ্য ও অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্হা ভেঙে পড়বে।এতে করে দেশটির সামগ্রিক জীবনযাত্রা বিপর্যয়ের মূখে পড়ে যাবে।
কেন এই সংকট,এর উদ্ভবই বা কীভাবে হলো-এমন প্রশ্ন ওঠেছে নানামহলে।এই সংকটের গোড়ায় রয়েছে নব্বই দশকের সময়কালে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্যে।সোভিয়েতের দুটি প্রধান অঙ্গরাজ্য ছিলো রাশিয়া এবং ইউক্রেন।অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের ন্যায় এই দুটি অঙ্গরাজ্যও স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে নব্বই দশকে।রাশিয়াকে জাতিসংঘসহ বিশ্বপরিমন্ডলে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।রাশিয়ার সীমান্তের ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার গভীর রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক,সামাজিক,ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পারিবারিক বন্ধন রয়েছে বলে দাবি করে রাশিয়ান শাসকগোষ্ঠী।বিশেষকরে-রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন-“রাশিয়ান ও ইউক্রেনীয়ানদের-‘একজাতি’ বলে অভিহিত করে থাকেন এবং একারণে মস্কো এবং প্রেসিডেন্ট পুতিন তার হারানো ভূখণ্ড ইউক্রেন পুনরুদ্ধার করতে এখনো তৎপর।ইতোপূর্বে একই লক্ষ্যে রাশিয়া ২০১৪-খ্রীষ্টাব্দে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত করেছে।তখন থেকেই উভয়দেশের মধ্যে বৈরিতা বেশ উচ্চতায় পৌঁছে গেছে।যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষার অজুহাত তোলে ইউক্রেনের পাশে এসে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় সংকট আরও গভীর হয়েছে।
ইউক্রেনকেন্দ্রীক যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সঙ্গে রাশিয়ার দ্বন্দ্ব-সংঘাত নতুন কোনো বিষয় নয়।মূলত সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্হা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পরবর্তী সময় থেকে পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটোর পূর্বমূখী সম্প্রসারণকে কেন্দ্র করেই রাশিয়ার সাথে পশ্চিমা বিশ্বের বৈরিতা ও সংকটের সূত্রপাত হয়েছিলো এবং রাশিয়ার আপত্তি সত্ত্বেও ১৯৯১-১৯৯৭-সময়কালে ন্যাটো সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের কয়েকটি স্বাধীন অঙ্গরাজ্য ও পূর্ব ইউরোপের সাবেক কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে,অর্থাৎ মোট চৌদ্দটি রাষ্ট্রকে ন্যাটোর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।এভাবে ন্যাটোকে সম্প্রসারিত করে রাশিয়ার দোরগোড়ায় নিয়ে আসা হয় এবং রাশিয়ার বুকের ওপর থাকা ইউক্রেনকেও ন্যাটোর সদস্য পদ প্রদানের উদ্যোগ নেয় ন্যাটো।রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ন্যাটোর এই সম্প্রসারণকে এবং ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের সম্ভাবনাকে তাঁর দেশের অস্তিত্ব ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হিসেবে বর্ণনা করে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী হয়েছেন এবং বলা যায় ন্যাটোর এই সম্প্রসারণ এবং ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদান ঠেকানোর জন্যই রাশিয়া সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার লক্ষ্যে ইউক্রেনের সীমান্তে সেনাসমাবেশ ঘটিয়ে পশ্চিমাদের একটি সতর্কতা দিয়েছে যে ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার চেষ্টা করা হলে রাশিয়া সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার জবাব দিতে প্রস্তুত রয়েছে।ন্যাটোর সদস্য বা পশ্চিমাবিশ্বের মিত্র হিসেবে নয়,ইউক্রেন টিকে থাকবে একমাত্র রাশিয়ার আশ্রিত রাষ্ট্র হিসেবে-এটিই মি:পুতিনের লক্ষ্য।
ইউক্রেনে সামরিক অভিযান পরিচালনার দ্বারপ্রান্তে রাশিয়া।এই অবস্থায় সংকট সমাধানের জন্য কূটনৈতিক দৌড়ঝাঁপ চলছে।তবে রাশিয়া তার সিদ্ধান্তে অটল থেকেই পশ্চিমাদের বেশকিছু শর্ত দিয়েছে- যার মধ্যে রয়েছে ন্যাটোর পূর্বমূখি সম্প্রসারণ বন্ধ করা,ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য না করা এবং রাশিয়া চায় ন্যাটো তার ১৯৯৭-এর পূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরে যাক।রাশিয়ার সীমান্তবর্তী পোল্যান্ড,এস্তোনিয়া,লাটভিয়া,লিথুয়ানিয়া ইত্যাদি বাল্টিক প্রজাতন্ত্র থেকে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের সকল সেনা ও সামরিক সমরাস্ত্র সরিয়ে নেওয়া হোক এবং প্যোলান্ড ও রোমানিয়ায় ন্যাটোর সেনা ও ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা যাবে না।
রাশিয়ার এসব শর্ত ন্যাটো বা পশ্চিমাবিশ্ব মেনে নেবে মর্মে কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না।আবার কোনো সম্মানজনক সমাধানের ফরমুলার নিশ্চয়তা না পেলে প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং রাশিয়া তার অবস্থান থেকে পিছন ফিরে আসবে বলে মনে হয় না।কারণ এটি এখন মি:পুতিনের ব্যক্তিগত এবং রাশিয়ার ভূ-রাজনীতির প্রভাব-প্রতিপত্তির সাথে সম্পর্কিত হয়ে পড়েছে।এটি বেশ স্পষ্ট যে রাশিয়া- ইউরোপ ও গোটা বিশ্বে তার বিশ্বশক্তির মর্যাদা,তার সশস্ত্রবাহিনীর পূণর্গঠন,সামরিক সক্ষমতার ও এর ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব পূণরুদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।রাশিয়ার মধ্যেই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গৌরব ও মর্যাদা পূন:প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট রয়েছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন।
অন্যদিকে মি:পুতিন এতদিনের চেষ্টায় রাশিয়ায় একক, কর্তৃত্ববাদী এবং অবিসংবাদী ক্ষমতার উজ্জ্বল তারকা হয়ে ওঠেছেন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্হায় একজন শক্তিমান নেতা ও ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।এরকম একটি অবস্হানে থাকাবস্হায় কোনো সম্মানজনক সমাধান ব্যতীত মি:পুতিনের পক্ষে ইউক্রেন থেকে পিছু হটার কোনো সূযোগ নেই বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।কারণ,সম্মানজনক সমাধান ছাড়া ইউক্রেন থেকে পিছু হটার সিদ্ধান্ত হবে মি:পুতিনের জন্য আত্মঘাতী এবং অবশ্যই রাশিয়ার রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে চিরবিদায়ের নামান্তর।কাজেই তিনি চুড়ান্ত না দেখা পর্যন্ত তাঁর অবস্থান থেকে নড়বেন না বলেই মনে হয়।তাহলে কী যুদ্ধের মাধ্যমে ফলাফল চুড়ান্ত হবে?
লেখক: আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।