
অ্যাডভোকেট আনসার খান :নিকট প্রতিবেশী সামরিক শক্তির দিক থেকে দূর্বল রাষ্ট্র ইউক্রেনের ওপর সর্বাত্মক সামরিক হামলা শুরু করেছে রাশিয়া।২০১৪-সালে অনুরূপ এক হামলা চালিয়ে দেশটির একটি অংশ ক্রিমিয়া দখল করে রাশিয়া তার নিজেদের ভূখণ্ডের সঙ্গে একীভূত করেছিলো।তখন থেকেই একটি আশংকা ছিলো যে রাশিয়া হয়তো একসময় পুরো ইউক্রেনকে গ্রাস করে নিতে পারে।আশংকা বাস্তব হতে চলেছে রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেনে সামরিক অভিযান পরিচালনার প্রেক্ষিতে।কারণ রাশিয়া পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন বিশ্বের দ্বিতীয় সামরিক শক্তির অধিকারী একটি দেশ এবং সঙ্গতকারণেই ইউক্রেন রাশিয়াকে মোকাবেলা করে টিকে থাকতে পারবে না।
ইউক্রেনে রাশিয়ান সামরিক হামলা পরিচালনার অজুহাত হিসেবে যত যুক্তিই প্রদর্শন করা হোক না কেন,একটি মৌলিক বিষয় সামনে এসেছে-তাহলো বিশ্বব্যবস্হায় দূর্বল,সামরিক শক্তিহীন জাতি ও রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় নিরাপত্তা ও টিকে থাকার ঝুঁকি রয়েছে।
একটি বৃহৎ সামরিক শক্তি রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক হামলার পেছনে যত কারণই দেখাক না কেন,এটি বলতেই হয় যে শুধুমাত্র শক্তির বলেই গায়েরজুড়ে দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে পর্যায়ক্রমে দখলে নিয়ে নিজেদের সীমানা প্রসারিত করতে চাইছে রাশিয়া-যা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
রাশিয়ার সামরিক অভিযান-ইউক্রেনকে দখলে নিয়ে নিজেদের ভূখণ্ডের সঙ্গে একীভূত করা বা রাশিয়ার আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা থেকে একটি বিষয় বেশ স্পষ্ট হয়েছে যে,শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর কারণে দূর্বল ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো এই একবিংশ শতাব্দীতেও তাদের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে বড়ধরণের হুমকিতেই আছে।আন্তর্জাতিক ব্যবস্হা এবং আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতিগুলো দূর্বল এবং ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে বা তাদের জাতীয় নিরাপত্তা সমুন্নত রেখে টিকে থাকার গ্যারান্টি দিতে অক্ষম এটি আবারও প্রমাণ করেছে।
ইউক্রেন দখলে নেওয়ার যুক্তি হিসেবে রাশিয়া তার নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে।কিন্তু ইউক্রেনেরও যে নিজস্ব জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি জড়িত আছে,সেটি একবারও ভাবেনি রাশিয়া-কারণ ইউক্রেন দূর্বল রাষ্ট্র,পক্ষান্তরে রাশিয়া বৃহৎ শক্তি যে।তাই রাশিয়ার শক্তির জবাব দেওয়া ইউক্রেনের পক্ষে সম্ভব হবে না ভেবেই গিলে ফেলতে আক্রমণ করেছে রাশিয়া।তবে জাতীয় স্বার্থের দোহাই দিয়ে দূর্বল রাষ্ট্রকে জোরপূর্বক দখলে নেওয়ার যে প্রবণতা তা বিশ্বব্যবস্হায় মাৎস্যন্যায় অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে,-যেমনটি সপ্তদশ, অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতাব্দীতে ঘটতে দেখা গেছে।ওই সময়কালে বৃহৎ শক্তিগুলো তাদের শক্তিরজুড়ে দূর্বল জাতি ও রাষ্ট্রগুলোকে দখল করে নিয়ে আধিপত্যবাদী এবং ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম করতো,এগুলো হতো বৃহশক্তিগুলোর অর্থনৈতিক বাজার,শোষণ-শাসনের পশ্চাৎপদভূমি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে জোরপূর্বক কোনো জাতিকে দখল করে নেওয়ার সূযোগ বন্ধ হয়েছিলো এবং জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন ও প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে একটি সুশৃঙ্খল বিশ্বব্যবস্হা গড়ে তোলা হয়েছিলো।মোটামুটি বলা যায়-বৃহৎ শক্তির রাষ্ট্রগুলো দ্বারা ক্ষুদ্র এবং দূর্বল জাতিগুলোকে জোরপূর্বক দখলে নেওয়ার আধিপত্যবাদী প্রবণতা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।তবে দুটি বৃহৎ শক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেকার শীতলযুদ্ধের সময়টাতে দূর্বল রাষ্ট্রগুলোকে বৃহৎ দুটি রাষ্ট্রের যেকোনো একটির ছায়াতলে থাকতে দেখা গেছে,যদিও ওই দুটি রাষ্ট্রের বাইরে থাকার জন্য জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নামে উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র ও দূর্বল রাষ্ট্রগুলো একটি আলাদা প্লাটফর্ম গড়ে তোলেছিলো।
বিগত শতকের নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে পড়ার মধ্যদিয়ে দ্বিমেরু বিশ্বব্যবস্হারও পতন ঘটে এবং উদ্ভব হয় একমেরু বিশ্বব্যবস্হার-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বব্যবস্হায়।আবারও ক্ষুদ্র জাতিগুলো জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে যায়। নানান অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র গ্রানাডা,ইরাক,আফগানিস্তান,লিবিয়া,মেক্সিকো ইত্যাদি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছিলো-মার্কিনীদের দ্বারা ওইগুলোর জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা হুমকির মধ্যে পড়েছিলো।
দূর্বল এবং ক্ষুদ্র জাতিগুলো মূলত অরক্ষিত ছিলো সর্বকালেই এবং সেকারণে ওই জাতিসমূহের জাতীয় নিরাপত্তা,জাতীয় অস্তিত্ব বৃহৎ শক্তির অনুকম্পা বা দয়ার ওপর নির্ভরশীল ছিলো এবং আছে সবসময়ই।
জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি বহুমাত্রিক এবং এর পরিধিও অত্যন্ত ব্যাপক।একটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত হলো তার সামরিক তথা প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত নিরাপত্তা-বহি:রাষ্ট্রের আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাওয়ার নিশ্চয়তা,সীমান্ত রক্ষা করার নিরাপত্তা,অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক সম্পদের নিরাপত্তা,এনার্জি ও ভূ-কৌশলগত এবং ভূ-রাজনৈতিক নিরাপত্তা,ডেমোগ্রাফি,খাদ্য,স্বাস্থ্য,পরিবেশ-প্রতিবেশ,প্রযুক্তির নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি অন্যরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপমুক্ত অবস্থায় ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর জনগণের পছন্দসই শাসনের নিরাপত্তা থাকা।এই দৃষ্টিকোণ থেকে একটি জাতির জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিকে সাধারণত দুটি দিক থেকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।১.রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং অন্যটি হলো-২.বহি:শক্তির পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ হুমকি ও হস্তক্ষেপ থেকে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত ও সুরক্ষা করা।
অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা অর্জন করার ওপর একটি রাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষা নিশ্চিত করা নির্ভর করে।কিন্তু বর্তমান বিশ্বব্যবস্হার প্রেক্ষাপটে এইসব বিষয়ে ক্ষুদ্র ও দূর্বল রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে আত্মনির্ভরশীলতা এবং সক্ষমতা অর্জন করা অসম্ভব বিধায় এইসব রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় নিরাপত্তা অনেকাংশেই বৃহৎ শক্তিগুলোর সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল বলা যায়।ফলে এসকল রাষ্ট্রকে কোনো না কোনো বৃহৎ রাষ্ট্রের ছায়াতলে থাকতে হচ্ছে।তার একটু ব্যত্যয় হলে স্বাধীনতা ও জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।এমনকি সামরিক হামলার শিকার হতে হয়।এমনকি,বৃহৎ রাষ্ট্র কর্তৃক দখল হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। এর হালনাগাদ উদাহরণ হলো ইউক্রেন।২০১৪-সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া নিয়ে গেছে এবং এখন পুরো ইউক্রেন নিয়ে যাবে এমন অবস্থা বিদ্যমান।আন্তর্জাতিক মহল,জাতিসংঘ, ন্যাটো-সবাই রাশিয়াকে হম্বিতম্বি করে ভয় দেখাচ্ছে, কোনো ভয়ভীতি আমলে না নিয়ে সশস্ত্র হামলা করে পুরো ইউক্রেন দখল করে নিচ্ছে রাশিয়া।তাহলে দূর্বল ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার গ্যারান্টি কোথায় বর্তমান বিশ্বব্যবস্হায়?
জাতিগুলো তার সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তার গ্যারান্টি কেবল নিজেদের সামরিক সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে পেতে পারে।এছাড়া জাতীয় নিরাপত্তাসহ সার্বভৌমত্ব নিয়ে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব।যেমন-ইউক্রেন টিকে থাকতে পারবে কেবল রাশিয়ার আশ্রিত হয়ে।ইউক্রেন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে চাইছে,রাশিয়া বলছে ইউক্রেন এটি করতে পারবে না।বিরোধ এখানেই।ভয়-ভীতি দেখিয়ে ইউক্রেনকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়ে এখন তার ক্ষমতাবলে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে গোটা দেশই দখল করে নিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া।কারণ রাশিয়ার আছে সামরিক সক্ষমতা,ইউক্রেনের সেটি নেই।
সামরিক শক্তি হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সর্বোচ্চ গ্যারান্টি।কিন্তু বাস্তবতা হলো,ইউক্রেন সহ দূর্বল ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে সর্বোচ্চ সামরিক শক্তি অর্জন করা অসম্ভব।কারণ ওই রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিকভাবেও দূর্বল।এইসকল দূর্বলতার কারণে ক্ষুদ্র ও দূর্বল রাষ্ট্রগুলো তাদের সার্বভৌমত্ব,ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা রক্ষা করা সহ নিজেদের জাতীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।এসব রাষ্ট্র তাই বহি:শক্তির আগ্রাসন থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হয় না।
আসলে দূর্বল রাষ্ট্রগুলো সর্বদাই বৃহৎ এবং উন্নত রাষ্ট্রগুলোর আর্থিক, সামরিক,প্রযুক্তি সহ প্রায় সকল বিষয়ে সাহায্য-সহযোগিতা,ঋণ ও অনুদানের অর্থের ওপর নির্ভরশীল থাকে এবং এজন্য নানান শর্তের বেড়াজালে আটকা পড়ে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো।আর তাই গ্রহীতা রাষ্ট্রগুলো দাতারাষ্ট্রগুলোর ইচ্ছাধীন হয়ে পড়ে-সকল ক্ষেত্রে গ্রহীতা রাষ্ট্রগুলো স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না,পাছে সাহায্য বন্ধ হয়ে যায় এই ভয়ে।অথচ জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের অর্থ হলো আন্তর্জাতিক শক্তির প্রভাবমুক্ত বা নির্দেশনামুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া বা কাজ করে যাওয়ার সক্ষমতা।এই সক্ষমতা দূর্বল ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর নেই বলে তাদের জাতীয় নিরাপত্তা সর্বদাই হুমকির মূখে থাকে।সবলের আঘাত প্রতিহত করা দূর্বলের পক্ষে সম্ভব হয় না।যেমন-ইউক্রেন পারছে না।
ক্ষুদ্র ও দূর্বল এবং সবল প্রতিটি রাষ্ট্র পরস্পরের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান জানাবে,রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেউ-ই কাউকে প্রভাবিত করবে না,শক্তি প্রদর্শন করবে না-এটিই দূর্বল ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারে।কিন্তু বর্তমান বিশ্বব্যবস্হায় এটি আদৌও সম্ভব নয়।বৃহৎ শক্তিকে সমীহ করে চলতে হয় দূর্বল রাষ্ট্রগুলোকে।ক্ষুদ্র ও দূর্বল রাষ্ট্রগুলোর জন্য এটিই যেন নিয়তি।
লেখক: আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।