জলের শ্যাওলা
বুয়েটের আবরার হত্যার দু’ বছরের মাথায় বিচারকার্য সম্পন্ন হলো। সরাসরি বলি এটা আমার ধারণার বাহিরের ধারণা ছিলো। কেনো ধারণার বাহিরের ? সেটাই বলি প্রথমে এবং দু’ একটি বিষয় তুলে ধরবো।
প্রথমত : (প্রথমেই বলে নেই আমি সকল ফাঁসির বিরুদ্বে, অনেকবার এ বিষয়ে লিখেছি, আজকে তাই আর কিছু লিখছি না) ধারণা করেছিলাম এই হত্যার পিছনে যেহেতু সব ছাত্র লীগাররা জড়িত। সুতরাং এক্কা- দোক্কা খেল দেখিয়েই সময় পাড় হবে।
দ্বিতীয়ত : এ দেশে বিচার পেণ্ডুলামের মতন বছরের পর বছর ঝুলবে, এতে অবাক হবার কিছুই নাই। এটা আমাদের নিয়তি এবং বিচার ব্যবস্থায় অব্যবস্থাপনা।
তৃতীয়ত : আমি ধারণাই করিনি যে ২০ জনের ফাঁসি এবং ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে (আপনারা করেছেন কী ?)। এর পিছনের কারণটিও রাজনীতির নামে রাজনীতির অপব্যবহার, যা আমাদের দেশে একপ্রকার নিয়ামক শক্তি।
চতুর্থত : এদেশে শত- হাজার বিচারকার্য ফাইলের চাপায় মাটিতে গড়াগড়ি খায় । ওপরের কালোহাত কাজ করে। সেখানে অন্তত নিম্ন আদালতে আরবার হত্যার বিচারটি শেষ হয়েছে। এখন উচ্চ আদালতে গিয়ে শেষ হউক এবং শাস্তি কার্যকর হউক, সেটাই চাইবো।
পঞ্চমত : অনেকেই এই বিচারকার্য্ন য়ে অগ্রীম বলছেন যে, আগামীতে আমাদের রাষ্ট্রপতি দুই হস্তে সবাইকে প্রাণ ভিক্ষা দিয়ে দিবেন । এমন উদহারণ আছে বলেই এমন ধারণা করে মানুষ । পাশাপাশি ওই যে রাজনীতি জড়িয়ে যায়। আবার বলি সবাই ছাত্রলীগের ছিলো, তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই মানুষের মনে এমন ধারণার উৎপত্তি হয়। জনমানুষের এখানে কোনো দোষ নেই।
ষষ্ঠত : এই বুয়েটে এই অব্দি কযটা লাশ পড়েছে ? আমার জানা নাই ( তবে আঙুলে গুণেই হবে সেটা এবং সেটা ঘৃণার )। স্মরণ করা ভালো যে, এই বুয়েটেই সনি হত্যার স্বীকার হয়েছিলেন ছাত্রদলের দুইগ্রুপের গোলাগুলির ক্রসফায়ারে । সেটা রিয়েল ক্রসফায়ার ছিলো ছাত্রদলের ছাত্রদের (ছাত্র নামের কলঙ্ক ), সেটা পুলিশের গল্পের ক্রসফায়ার নয়। সেই সনি হত্যার বিচার কিন্ত হয়নি। দূর্ভাগা সনি। মরেও বিচার পায়নি। কি আর বলবো !
সপ্তমত : মনে রাখা ভালো বুয়েট এমন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে মেধাবীদের মধ্যেও যারা ক্রিম, তারাই পড়াশোনা করে। এই প্রতিষ্ঠানের ওপর দেশের অনেক কিছুই নির্ভর করে ( সেটা বড় আলোচনা, আজ নয় )। এখানকার মেধাবীরা যখন রাজনীতির কারণে হত্যা হয়, বুঝতে হবে এই রাজনীতির গোড়ায় মারাত্মক সমস্যা আছে।
অষ্টম : পিতা- মাতারা তাদের সন্তানদের অনেক কষ্ট করে, জীবন বাজি রেখে , সন্তানদের বুয়েটে পাঠায়। যে মুহূর্তে বুয়েটে ( বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই) দিয়ে এলো, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ওপর শতভাগ দায়িত্ব পড়ে, সেই শিক্ষার্থীদের ভালো- মন্দ দেখার। আশ্চর্যের যে, শিক্ষক, হলপ্রোভস্ট, ভিসি এমন কি সেখানকার নানান কর্মচারীরা কেউ কি জানতো না হলের রুমে এমন অত্যাচার হয়। যেখানে সাপের মতন পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। যা আরবারের ক্ষেত্রেও হয়েছে। সুতরাং সকল দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিচারের আওতায় আনাটা এখন সময়ের দাবী । কেননা এই দায়িত্ব জ্ঞানহীদের কারণে আর যেনো কোনো আরবার হত্যা না হয়।
নবম : এবার আসবো একজন মায়ের আকুতির কথায়। আরবার হত্যার এক ফাঁসিপ্রাপ্ত আসামির মা আদালতের সামনে হাটু মোড়া দিয়ে অভিযোগ করেছেন ( পত্রিকার খবর – প্রথম আলো ) আমার এত মেধামী ছেলে রাজনীতির কারণেই আজকে ফাঁসিরকাষ্ঠে। আমার ছেলে এই প্রথম বুয়েটে এসেই বড় ভাইদের কারণে রাজনীতিতে এবং বিপদগামী এবং আজকে মৃত্যুর অপেক্ষায়। সেই মা আকুতি করে অন্যান্য মায়েদের প্রতি জোর হাত বলেছেন, তোমরা তোমাদের ছেলেদের রাজনীতিতে যেতে দিও না।
দশম : একজন মায়ের আকুতিতেও এই রাষ্ট্রের নোংরা রাজনীতির আভাস স্পষ্ট। ভাবুন তো ভালো ছাত্ররা যদি রাজনীতিতে না আসে, তাহলে ভবিষ্যতে এ দেশ কারা পরিচালনা করবে ? কারা হবে ভবিষ্যতের রাজনীতিক ? রাজনীতি কাদের হাতে চলে যাবে ? ( যা ইতিমধ্যেই চলে গিয়েছে ) । রাজনীতি তখন আরও বেশি কুলোষিত হবে, আরও জঘন্য হবে। কেননা তখন রাজনীতির হর্তাকর্তা হবে সব বরবরেরা। মনে রাখতে হবে, একটি রাষ্ট্র পরিচালিত হয় রাজনীতিকদের দ্বারা। সুতরাং রাজনীতিতে ভালোদের আগমন অনেক বেশি প্রয়োজন।
লেখার শেষে বলি, সেই মায়ের আকুতিটি বুঝি এবং শতভাগ বুঝি। রাজনীতি এখানে দোষী নয়। দোষী সেই রাজনীতির নামে অপরাজনীতির, দোষী সেই অপরাজনীতির রাজনীতিকরা। লক্ষ্যণীয় যে, এই অঞ্চলেই ভালো রাজনীতি ছিলো বলেই আজ আমরা একটি স্বাধীন বাংলাদেশ হতে পেরেছি পশ্চিমাদের জঘন্য রাজনীতির হাত থেকে। যে চেতনায় এই দেশ, সেই চেতনা রাজনীতি দ্বারাই প্রষ্ফুটিত হয়েছিলো। আসুন সেই মায়ের অনুভূতিটি অনুভব করি, কেনো সেই মা সবার সন্তানদের রাজনীতি থেকে নিরাপদে থাকতে বলছেন ?
আমাদের রাজনীতিকরা এটা যত তাড়াতাড়ি অনুভব করবেন, রাষ্ট্রের ততই দ্রুত মঙ্গল হবে। আজকে আমরা আছি, আগামীকাল আমরা থাকবো না। তবে আমাদের আগামীর প্রজন্মের জন্য ভালো রাষ্ট্র রেখে যেতে হলে, ভালো রাজনীতি রেখে যেতে হবে। ভাবুন, সবাই ভাবুন ।
বুলবুল তালুকদার
যুগ্ম সম্পাদক, শুদ্ধস্বর.কম