
অ্যাডভোকেট আনসার খান :যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের সাথে যখন চীন ও রাশিয়ার বিভিন্ন ইস্যুতে মতবিরোধ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে-ঠিক তখন বেইজিং এবং মস্কো নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে।উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের এই গভীরতাকে বিশ্বব্যবস্হায় একটি নতুন কৌশলগত অংশীদারত্বমূলক জোটের উদ্ভবের সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।কোনো-কোনো পর্যবেক্ষক অনুরূপ জোটের উদ্ভবকে”চীনের ভূ-রাজনৈতিক উত্থানকে ধারণ করার একটি নতুন হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন এবং এটি বেইজিং ও মস্কোর মধ্যে সহযোগিতার প্রসার সাধন করবে বলে মনে করছেন।
বেইজিং এবং মস্কোর মধ্যে একটি গভীর দীর্ঘস্হায়ী জোটের ধারণা তাদের উভয়ের জন্য বাস্তবতার চেয়েও বেশি কার্যকর বলে মনে করা হয়।নিষেধাজ্ঞা,বানিজ্য যুদ্ধ এবং তাদের রাজনৈতিক ভাবে বিচ্ছিন্ন করার জন্য পশ্চিমা বিশ্বের প্রচেষ্টার মূখে উভয় রাষ্ট্রের জোটবদ্ধভাবে ওই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উদ্যোগী হওয়ার কারণে সেটি বিশ্বব্যবস্হায় ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করতে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ষাট দশক থেকে নব্বই দশকের প্রারম্ভকাল পর্যন্ত বেইজিং ও মস্কোর মধ্যে বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে রাশিয়ান ফেডারেশনের সাথে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি হয় এবং ২০০১ সালে তারা একটি কৌশলগত অংশীদারত্ব সম্প্রসারণের জন্য “বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা” চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।ওই সম্পর্ক ২০১৪ সাল থেকে ক্রমবর্ধমান শক্তিশালী বাস্তব সম্মত কৌশলগত অংশীদারত্বে পরিণত হয়েছে।দেশ দুটি সামরিক,অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক উপভোগ করছে।২৯-ডিসেম্বর ২০২০-সালে চীন-রাশিয়ার প্রেসিডেন্টদ্বয়- যথাক্রমে-শি জিনপিং ও ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ভার্চুয়াল বৈঠক ও আলোচনাকালে- শি জোর দিয়েছিলেন যে উভয়দেশ-“একটি ঘনিষ্ঠ অংশীদারত্ব বিকাশের জন্য কাজ করবে যা চীন-রাশিয়ার মধ্যে কৌশলগত সহযোগিতা কার্যকরভাবে দুইদেশকে-“দমন ও বিভক্ত”করার পশ্চিমাদের যেকোনো প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করতে পারে।” উল্লেখ্য যে চীন এবং রাশিয়া-উভয়দেশই ওয়াশিংটন ও তার অংশীদারদের কাছ থেকে এক বা একাধিক নিষেধাজ্ঞা বা অন্য আকারে বৈরিতার মুখোমুখি হয়ে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের সাথে যখন চীন-রাশিয়ার বিভিন্ন ইস্যুতে মতদ্বৈধতা,বৈরিতা ও উত্তেজনা বিরাজ করছে ঠিক তখন উভয়দেশ নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা আরও বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের চাপ মোকাবেলা করার জন্য নিজেদের রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক এবং সামরিক সহযোগিতা জোরদার করেছে।দেশ দুটি ইতোমধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সংক্রান্ত একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।শুধু প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেই নয়,দেশ দুটির মধ্যে কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কও গভীরতর হয়েছে।বৈদেশিক নীতিতে-বেইজিং ও মস্কো ইরান,সিরিয়া এবং ভেনেজুয়েলার বিভিন্ন ইস্যুতে সহমত পোষণ ও সমর্থন দিয়েছে।উত্তর কোরিয়ার প্রতিও দেশ দুটি একমত পোষণ করে এর উপর থেকে জাতিসংঘের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিবার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছে।দেশ দুটি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের মিত্র দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান সাগর ও এর সীমান্ত এলাকায় যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে-যেখানে যুদ্ধ জাহাজ ও বোমারু বিমান অংশ নিয়েছিলো।
চীন ও রাশিয়ার সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্বিগ্ন করেছে।সম্পর্কের এই গভীরতা যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর জন্য সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা।গতমাসে লন্ডন-ভিত্তিক ফিনান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেছেন-তিনি চীন ও রাশিয়াকে পৃথক হিসেবে দেখেন না।”উভয় দেশ ঘনিষ্ঠভাবে একসাথে কাজ করে”-বলেন তিনি।চীন এবং রাশিয়া এশিয়া প্যাসিফিক বা ইউরোপের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি বলে মনে করেন তিনি।দেশ দুটিকে একটি “আধা জোট” হিসেবে সন্নিবেশিত করে-যাকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করতে হবে বলে মনে করে ন্যাটো।ন্যাটো দাবি করে চীন ও রাশিয়া একটি নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ।
চীন ও রাশিয়ার অংশীদারত্ব শক্তিশালী হলে-“আসছে দশকগুলোতে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত ল্যান্ডস্কেপ গঠনের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে উঠতে পারে”-বলে মনে করেন অস্ট্রেলিয়ার পার্থের কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় নিরাপত্তা ও কৌশলগত অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আলেক্সি মুরাভিভ।তার মতে-চীন ও রাশিয়ার “প্রায় জোট গঠনের মতো”অবস্থা ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত সামরিক স্বার্থে দুইদেশের ঐক্যবদ্ধ হওয়া থেকেই উদ্ভুত হয়েছে।দুই সরকার আসলে ওয়াশিংটনের “দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ” মোকাবেলায় আগ্রহী এবং “মস্কো ও চীন যদি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন “অকুস চুক্তিকে”চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নেয়,তাহলে দক্ষিণ চীন সাগর ভূ-কৌশলগত প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে”-বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক মুরাভিভ।যদি বেইজিং মনে করে যে দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নৌ-উত্তেজনা বাড়ছে,তবে জাপান সাগরে রাশিয়ান নৌবহরের সাথে বৃহত্তর সমন্বয় সর্বদা একটি বিকল্প হিসেবে উম্মুক্ত থাকবে।এইধরনের ব্যবস্হাগুলো পশ্চিমা নেতাদের জন্য একটি দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠবে।
অন্যদিকে বেইজিং এবং মস্কো-উভয়ই মনে করে যে “যুক্তরাষ্ট্র একটি কপট
আগ্রাসী শক্তি-যারা আধিপত্য বজায় রাখার জন্য চীন ও রাশিয়াকে দাবিয়ে রাখতে চায়” বলেন বেইজিং ভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক এনার টাঙ্গেন।উভয় দেশকে তার জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে ওয়াশিংটন ওই দেশগুলোর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন অভিযোগ তোলে সময়ে-সময়ে অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং এমনকি চীনের সাথে বানিজ্যিক লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে।উভয়দেশকে মোকাবেলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ভারত,অস্ট্রেলিয়া ও জাপানকে নিয়ে “কোয়াড” জোট গঠন করেছে।চীন ওই জোটকে “দক্ষিণ এশিয়ান ন্যাটো” হিসেবে অভিহিত করেছে।তের বছর পরে যুক্তরাষ্ট্র চীনের আশপাশ অঞ্চলে অর্থাৎ ফিলিপাইনস সাগর ও বঙ্গোপসাগরে দুই ধাপে পূনরায় নৌমহড়ার আয়োজন করেছিলো।
চীন ও রাশিয়ার মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র তার দুইমিত্র যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে “অকুস” নামক নিরাপত্তা জোট গঠন করেছে।জোটের চুক্তি অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়াকে শক্তিশালী পারমাণবিক সাবমেরিন রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে যা অস্ট্রেলিয়ান নৌবাহিনীকে দক্ষিণ চীন সাগরের বিতর্কিত জলের পাশাপাশি তাইওয়ান প্রণালীতে টহল দেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। চীন ওই জোটকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য “অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন” হুমকি হিসেবে বর্ণনা করেছে।রাশিয়া এটিকে “আন্তর্জাতিক পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ করার ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ” বলে অভিহিত করেছে।
মস্কো-ভিত্তিক রাশিয়ান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিলের একজন বিশ্লেষক ড্যানিল বোচকভ বলেছেন-“এধরণের কাজগুলো অনিবার্যভাবে চীনকে প্রতিকূল কর্মকাণ্ডের পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া জানাতে রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা গড়ে তোলতে উৎসাহিত করে।”ওই প্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে রয়েছে ওয়াশিংটনের মিত্র জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার আশপাশ সাগরে সাম্প্রতিক চীন-রাশিয়ান যৌথ নৌমহড়া।বোচকভ আরও বলেন তীব্র প্রতিদ্বন্ধীতার ফলে স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালের ন্যায় কঠোর ব্লকের পূন:উত্থান ঘটতে পারে-যার একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ব্লক এবং অন্যদিকে চীন-রাশিয়া ও তার মিত্রদের জোট। “এটি ভূ-রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি করবে যা কিছুতেই অতিক্রম করা অসম্ভব বলে মনে হয়” বলেন বোচকভ।
চীন ও রাশিয়ার মধ্যে অংশীদারত্ব ও কৌশলগত জোট গোটা একুশশতক ধরে আরও শক্তিশালী হতে থাকবে এবং এমনকি একটি “সামরিক জোটে” রূপান্তরিত হতে পারে।স্বাধীনতা ও ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থের আকাঙ্ক্ষা উভয়দেশকে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা থেকে উদ্ভুত ঝুঁকি এড়াতে পরিচালিত করবে যা তাদের শক্তিকে নির্বিঘ্নে একত্রিত করতে ও যুক্তরাষ্ট্রকে আরও কার্যকরভাবে চ্যালেঞ্জ করতে শক্তি যোগাবে এবং এভাবেই ভবিষ্যতে
বিশ্বব্যবস্হায় একটি নতুন মেরুকরণের সম্ভাবনা তৈরি হবে যা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানাবে- ফলস্বরূপ বিশ্ববাসী নতুন একটি স্নায়ুযুদ্ধ দেখতে পাবেন বলে বিশ্লেষকগণ মনে করেন।
লেখক:আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।